মৃদুল দাশগুপ্ত

 

Mridul Dasguptaবনগাঁ থেকে বেরোনো একটি লিটল ম্যাগাজিন শিস পত্রিকায় আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়, গত শতাব্দীর আশির দশকে ডাকে সৌজন্য সংখ্যাটি যখন পাই, অবাক এবং খুশি হই, তার ভেতর ছিল কুড়ি টাকার একটি নোট কবিতা লেখার জন্য সাম্মানিক একটি লিটল ম্যাগাজিন লেখকদের সাম্মানিক দিচ্ছে, বেশ অভিনব এবং তারিফযোগ্য ব্যাপার, মনে হয় আমার লেখার জন্য লিটল ম্যাগাজিনগুলির কাছ থেকে সাম্মানিক অর্থ পেয়েছি ওই প্রথম এবং ওই এক বারই

তবে কিনা ওই শিস পত্রিকা তৎসহ সেই সত্তরআশির দশকের লিটল ম্যাগাজিনগুলি আর এখনকার লিটল ম্যাগাজিনএক নয় বিস্তর ফারাক, বাড়বৃদ্ধি এবং চরিত্রগত ভিন্নতা ঘটে গিয়েছে

বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই, রচনা দীর্ঘ করার ইচ্ছেও নেই আমার, তাই বলি, ওই চরিত্রগত ভিন্নতার ভেতরই রয়েছে বিপণনের বিষয়গুলি, এমনকীকবিতার বিপণন’, যা একালের যুগধর্মও সময় কখনো কখনো অধঃপাতের দিকেও যায় একাধিক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের মনোবাসনা এখন প্রমোটরতুল্য, লক্ষ্য প্রকাশক হয়ে ওঠা, হয়েও উঠেছেন কেউ কেউ এঁদের মধ্যে দুএক জন তো সত্তরআশির দশক থেকে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করছেন তখন ছিল জেদি, তেজি, ছিপছিপে দুআড়াই ফর্মার কবিতাপত্র এখন পৃথুলা, বর্ষীয়ান বিশিষ্ট কবিলেখকের সঙ্গে নবীন কিশোর কবিতাপ্রয়াসীদের লেখায় পরিপূর্ণ, শুধু চরিত্রআদর্শ এসবের বদল ঘটে গিয়েছে ঘটেছে একেবারে ব্যাবসার প্রয়াসে মুনাফা অর্জনে

কড়া কড়া কথা বলে ফেললাম বলতেই হল, কারণ, বিনা মূলধনে ব্যবসায় সিদ্ধিলাভের বৃত্তিটিই হল একালে প্রকাশক হওয়া খুব স্থির এবং নিশ্চিতভাবেই বলছি, বঙ্গে কলকাতা কলেজ স্ট্রিট কেন্দ্রিক এবং আশপাশের জেলায় গজিয়ে ওঠা লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশনগুলির অধিকাংশই অসাধু নিয়মে এবং নিয়মিতভাবে তাঁরা কেউই লেখককবিদের প্রাপ্য রয়ালটি দেন না এবং হিসেব দাখিলে নানাবিধ কারচুপি করেন বড়োদের কৌশল ছোটোরা, অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশনগুলি অনুসরণ করছেই, তৎসহ তারা আরও আরও কৌশলের উদ্ভাবন করেছে সাহিত্যের বাজার এবং বাজারি সাহিত্যকে অগ্রাহ্য করে পঞ্চাশষাটসত্তর দশক থেকে লিখছেন এমন কয়েকজন কবিলেখকের নির্দিষ্ট পাঠকবলয় সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের সাহিত্যসাধনা মান্যতা পেয়েছে গত দেড়, দুই দশকে গায়েগতরে বেড়েওঠা নবীন প্রকাশনগুলির টার্গেট ওই মান্যগণ্য কবিলেখকেরা তাঁদের রচনাসমগ্র বের হচ্ছে এইসব প্রকাশনী থেকে এই বর্ষীয়ান লেখককবিরা ভালোর ভালো মানুষ বইএর বিক্রি, রয়ালটির হিসেবএসবের ঢের ঢের ঊর্ধ্বে উদাসীন তাঁরা আজ নয়, সেই ষাটের দশকের শেষভাগের বৈপ্লবিক সময়ে কয়েকজন তরুণ অধ্যাপকের পত্রিকাউদ্ভূত প্রকাশনী তো ব্যাপারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যুগে সংক্রামকের মতো তার বিস্তার ঘটেছে

আরও আছে আরও আছে স্বনামধন্য জনপ্রিয় চিকিৎসক মাঝবয়সে তাঁর বাসনা হল কবি হওয়ার (তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই) পাঁচ বছরেই ঝলমল করে ওঠা প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক তাঁকে ফর্দ ধরিয়ে বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনার বইএর প্রচ্ছদ এঁকে দেবেন অমুক, প্রকাশ

উদ্বোধন করবেন অমুকবাবু, ছাপাতে লাগবে আশি হাজার গোটাটাই প্যাকেজ প্রচ্ছদশিল্পী, উদ্বোধক কবির নামে ডাক্তারবাবু প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন, পরে গভীর তৃপ্তিতে জ্বলজ্বলে চোখে রাজি হলেন হাজার কুড়ি টাকায় বই করে ফেললেন নবীন প্রকাশক, বাকি ষাট হাজার তাঁর পকেটে ঢুকে গেল বাংলাদেশে বিনিয়োগের বাসনা, নামি শিল্পউদ্যোগী ঢাকায় বৈঠক শেষে বিলি করলেন কলকাতার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার বই ঝকঝকে চকচকে মুদ্রণপ্রযুক্তির বিপ্লবে মহিষাদলের মুদ্রণশালা এখন কলকাতার মুদ্রণশালার সঙ্গে একাকার মফস্সলে তৈরিহওয়া বইও এখন আন্তর্জাতিক মানের পেপারব্যাক বা বাঁধাই নবীন কবি, প্রথম কবিতার বই বের হবে তার, সে তো আর আমাদের তরুণ বয়সের মতো খড়কুটো আঁকড়ানো নয়, ঝকঝকে আইটি ছেলেটি প্রকাশকের কাছে গিয়ে শুনল খরচ পঁয়ষট্টি হাজার, উনি উদ্বোধন করে দেবেন, তিনি প্রচ্ছদ আঁকবেন, পাণ্ডুলিপির সঙ্গে চেক লিখে দিয়ে দিল সে

বইমেলার সময় এইসব প্রকাশনী, কেউ পঞ্চাশটি কবিতার বই বের করছে, কেউ একশোটি উদ্বোধন করছেন যে মান্যগণ্য লেখককবিরা, তাঁরা জানতেই পারছেন না, তাঁরা প্যাকেজে ব্যবহৃত হচ্ছেন গত বছর নন্দন চত্বরে নিভৃতচারী অপ্রাতিষ্ঠানিক কবির দেখলাম আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থপ্রকাশ উৎসব পর্দায় অস্ট্রেলিয়া থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশিষ্টজনেরা কবির প্রশংসা করলেন, ভিডিয়ো কনফারেন্সের মতো হল

সম্প্রতি একটি প্রকাশনী তো টাকা দিয়ে বই করে নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিজ্ঞাপনও দিয়েছে যে যেমন পারছে কলকাতায় ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি ফেস্টিভাল, কলকাতা লিটএসব ডেকে দিচ্ছে সম্পর্কের কারণে, যোগাযোগের ঘনিষ্ঠতায় আমরা কেউ কেউ যোগও দিচ্ছি নির্ঘাত ব্যবহৃত হচ্ছি লেখায় আমি স্পষ্টভাবে বলছি, কবিরা ভিক্টিম, কবিতা নিয়ে ব্যাবসা চলছেই

তা, এখন এইরকম সাহিত্যে, বাংলা কবিতাতেও ঘোর নৈরাজ্য তবে কিনা, হয় বিপ্লব নৈরাজ্য থামাবে, নয় নৈরাজ্য বিপ্লব আনবে

 

 

 

বোধশব্দ, কবিতার বিপণন, ২০১৮
(পুনঃপ্রকাশ)

*ছবি সৌজন্য: বোধশব্দ পত্রিকা, সুস্নাত চৌধুরী

banglalive logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *