সুস্নাত চৌধুরী
‘বোধশব্দ’ নয়, তখন নাম ছিল ‘বোধ’। চার পাতার ট্যাবলয়েড। দাম এক টাকা কি দু-টাকা। প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে। বছর দুয়েকের মধ্যে নাম বদলে হল ‘বোধশব্দ’ (Bodhshabda)। পরিবর্তন এল মাপে, সঙ্গে জুড়ল আধা প্রচ্ছদ। রঙিন।
আর-পাঁচটা বাংলা লিটল ম্যাগাজিন শুরুতে সচরাচর যেমন হয়, ‘বোধশব্দ’-ও ছিল তেমনই। গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, সাক্ষাৎকারের পাঁচমিশেলি প্যাকেজ। বোধ ও শব্দ—কোনোটাই তেমন গভীরভাবে দাগ কাটতে পারার মতো হয়তো ছিল না। তবে, উত্তেজনা ছিল। প্রেম ছিল, আশা ছিল— জ্যোৎস্নায়। এইভাবে কেটেও ছিল কয়েক বছর।
ছবিটা অনেকটাই বদলে গেল ২০০৮ সালে এসে। ‘প্রবীর দাশগুপ্ত’ সংখ্যা। এগিয়ে এলেন প্রবীরের বন্ধুরা। ‘বোধশব্দ’-ও গতরে কিঞ্চিৎ বেড়ে হল তিন ফর্মা। দাম বাইশ টাকা। হাফ প্রচ্ছদের রং সেবার ছিল লাল। এই সময় থেকে কবিতাকেন্দ্রিক, কিন্তু বিষয়ভিত্তিক কাজই করে এসেছে ‘বোধশব্দ’। কোথাও একটা ফোকাস্ড হওয়া জরুরি মনে হয়েছিল। যে-কাজ কেউ করছে না, আদৌ করা যায় কি না তা নিয়েই হয়তো সংশয় রয়েছে, অথচ করা উচিত— সে-ধরনের কাজই করতে চাওয়া হচ্ছিল।

২০০৯-এ ‘বিপ্লব মুখোপাধ্যায়’, ২০১৩-এ ‘মৃদুল দাশগুপ্ত’ কিংবা ২০১৫ সালে ‘ভেটকি’ ওরফে সিদ্ধার্থ দাস। আবার, ২০১১-র ‘কবির প্রথম বই’ কিংবা ২০১৬-র ‘কবিতা যেমন দেখায়’—কবিতার মিক্সড ব্যাগ না ছেপেও কবিতার কাছেই থাকতে চেয়েছিল ‘বোধশব্দ’। বিষয়গত দিক থেকে একটা নিরীক্ষার রাস্তা বেছে নেওয়া হয়। হয়তো সেই বিষয়টা লোকাল, কিন্তু তাকে ধরার ভঙ্গিটা যদি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে; এইরকম ভাবনা ছিল আর কি! সবই যে বিশেষ উতরেছিল, তা নয়; কিন্তু চেষ্টা ছিল আন্তরিক।
আর ছিল আমাদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট কিছু পাঠক বা ক্রেতার আশকারা। এক-একটা বিষয়ের গভীরে ঢুকতে, যথেচ্ছ কাটা-ছেঁড়া করতে, ভিন্নতর প্রসঙ্গের দিকে ঝুঁকে দেখতে সাহস জুগিয়েছেন তাঁরা। আজও জোগাচ্ছেন। এসব সংখ্যাও তাই ঘরে ডাঁই হয়ে বিশেষ-একটা পড়ে থাকেনি। পাতা ভারী হয়েছে ক্রমে, প্রিন্ট রান বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে দামও। মজা-মশকরায় সেসব সয়ে নিয়েছেন ‘বোধশব্দ’-র পাঠক, ক্রেতারা। ফুরিয়ে যাওয়া সংখ্যা পুনরায় ছাপা হয়নি। একে একে অধিকাংশই তুলে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জালে। আজও আগ্রহী পাঠক অতীতের ভিয়েনে মজানো সেইসব ‘নরমপাক’ বিনামূল্যে চেখে দেখতে পারেন আর্কাইভ ডট ওআরজি থেকে নামিয়ে। দু-এক ক্ষেত্রে অবশ্য সংখ্যাগুলির ভাবনাবীজ ক্রমে আরও ব্যাপ্ত হয়েছে, কালের সার-জল পেয়ে তা প্রকাশিত হয়েছে স্বতন্ত্র গ্রন্থের আকারে। যেমন, ‘প্রবীর’। বই হয়ে বেরিয়েছে গত বইমেলায়। মাঝে কেটে গিয়েছে ‘বোধশব্দ’-র পনেরো বছর!
আবার, ২০১১-র ‘কবির প্রথম বই’ কিংবা ২০১৬-র ‘কবিতা যেমন দেখায়’—কবিতার মিক্সড ব্যাগ না ছেপেও কবিতার কাছেই থাকতে চেয়েছিল ‘বোধশব্দ’। বিষয়গত দিক থেকে একটা নিরীক্ষার রাস্তা বেছে নেওয়া হয়। হয়তো সেই বিষয়টা লোকাল, কিন্তু তাকে ধরার ভঙ্গিটা যদি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে; এইরকম ভাবনা ছিল আর কি! সবই যে বিশেষ উতরেছিল, তা নয়; কিন্তু চেষ্টা ছিল আন্তরিক।
২০১৮ সালে প্রকাশ পায় ‘কবিতার বিপণন’ আর ২০২০ সালে অতিমারির ঠিক আগে ‘কবিতার মেরামতি’। প্রথম সংখ্যাটিতে খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল কবিতার বাজার, তার মার্কেটিং-এর ভূত-ভবিষ্যৎ—স্থানিক পরিস্থিতি থেকে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে। আর দ্বিতীয়টি আলো ফেলতে চেয়েছিল সম্পাদন, পরিমার্জন আর কাটাকুটিতে বিক্ষত কবিতার ভিতরঘরে—চেয়েছিল তার গড়ে ওঠার কথা, চূড়ান্ত রূপায়ণের বৃত্তান্ত সবিস্তার বুঝে নিতে। ‘বোধশব্দ’ প্রকাশনার গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে নয়, কিন্তু ‘বোধশব্দ’ পত্রিকার তরফে কবিতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কযুক্ত কাজ বলতে সর্বশেষ এ-দুটিই। এই সরণ সাময়িক না কি স্থায়ী বলা মুশকিল; কিন্তু বাস্তব হল, বিস্ময়ে ঘেরা বাংলা কবিতার জগৎ থেকে গত দু-তিন বছরে সচেতনভাবে কিছুটা সরেই এসেছে সে।
২০২২ সালে তার বিষয় ছিল ‘যতিচিহ্ন’, ২০২৩-এ ‘মার্জিন’। সরে এসে আজ এইখানে দাঁড়িয়ে ‘বোধশব্দ’। আগামী দিনে হয়তো আরও সরবে সে। স্থৈর্যে আদ্যন্ত অসফল; কিন্তু এই বদলে যাওয়ার বাসনা, এই পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন, এই সজীবতার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই দিনান্তে তার সবচেয়ে বড়ো পুঁজি। আর তারপর একদিন নিশ্চয় থেমেও যাবে ‘বোধশব্দ’-র এই পথ চলা। সেও তো সরে যাওয়াই। সেও তো বদল। এই মহাবিশ্বে যেমন ভর ও স্বপ্ন বদলে যেতে থাকে শক্তিতে। অবিরাম, প্রতিনিয়ত।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।