নাট্যকার, পরিচালক, নির্দেশক তথা মঞ্চ–অভিনেতা অমৃতলাল বসু আমাদের কাছে অপরিচিত নন।
তবে আরও একটা পরিচয় তাঁর রয়েছে। স্বদেশবাসী তাঁকে ‘রসরাজ‘ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এই শিরোভূষণ আজীবন তিনি শিরে ধারণ করেছিলেন। দেশবাসী কিন্তু তাঁদের কৃতী সন্তানকে প্রায়শই এহেন নানা বিভূষণে ভূষিত করে থাকেন। সেই অর্থে অমৃতলাল বসুকে ‘রসরাজ’ উপাধি দেওয়ার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। তবুও এই প্রশ্ন আমাদের ভাবায়, এক নাট্য়ব্যক্তিত্ত্বকে কেন এই উপাধি? শুধুই কি নাটকের কারণে তাঁর এই সম্মাননা?
থিয়েটারি কর্মজগৎ
অমৃতলাল বসু যে সময় জন্মগ্রহণ করেন, তখন সমাজে পেশা হিসেবে থিয়েটারকে বিশেষ সুনজরে দেখা হত না। থিয়েটারি ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এবং তাঁর জীবন ও কর্ম যে এই থিয়েটারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল তাও সুনিশ্চিত। নাটক, প্রহসন, ব্যঙ্গ–কৌতুকময় কাব্য তাঁকে রসরাজের মর্যাদা এনে দিয়েছিল, খুব খাঁটি কথা। কিন্তু নাটকের প্রয়োজন মিটিয়েই তার সার্থকতা ফুরিয়ে যায়নি, তার একটি সামাজিক আঙ্গিক ছিল। সেদিন যা উপলব্ধি করা গিয়েছিল, আজকের সমাজে তা আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে। এখানেই ‘রসরাজ‘-এর সার্থকতা।

রীতিমতো বনেদি পরিবারের সন্তান পেশা হিসেবে ‘থ্যাটার‘কে বেছে নিচ্ছেন, সামাজিক গঞ্জনার নিয়তি তাঁর জন্য অবধারিত ছিল। তার ব্যতিক্রমও হয়নি। জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ় ইনস্টিটিউশনের কৃতি ছাত্র তিনি, এন্ট্রান্স পাশ করে মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু অসমাপ্ত থেকে যায় ডাক্তারি শিক্ষা, তবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় তিনি পারঙ্গম ছিলেন। কাশীর বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক লোকনাথ মৈত্রের কাছে শেখা বিদ্যে ব্যর্থ হতে দেননি। কলকাতায় বেশ পশার জমিয়েছিলেন একটা সময়। তাঁর কর্মজীবনের গ্রাফটিও বেশ আকর্ষণীয়। পোর্টব্লেয়ারে সরকারি চিকিৎসক হিসেবে যান। ডাক্তারির পাশাপাশি কিছুকাল সেখানে পুলিশের চাকরিও করছেন।মাঝে কিছুকাল শিক্ষকতা। সব মিলিয়ে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের আগে তিনি চিকিৎসক, শিক্ষক, পুলিশের চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময়ের নিরিখে পেশা হিসেবে তিনটিই লোভনীয়। কিন্তু নাটকের সামাজিক প্রয়োজনটা বোধহয় তৎকালীন সমাজে কিছু বেশিই ছিল।
শিক্ষার প্রথম সোপান
অমৃতলালের বাবা কৈলাশচন্দ্র বসু ছিলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ছাত্র ও পরে শিক্ষক। তাঁর বাবার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন কলকাতা উচ্চন্যায়ালয়ের স্বনামধন্য বিচারপতি শম্ভুনাথ পণ্ডিত, আবার ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন দেশনেতা উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘হিন্দু–প্যাট্রিয়টে‘র সম্পাদক কৃষ্ণদাস পাল, পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির কালীকৃষ্ণ ঠাকুর প্রমুখ। নবচেতনার উপলব্ধি–লব্ধ এই ছাত্র–আভিজাত্য ও শিক্ষক–আভিজাত্যের যে ঘরানা কৈলাশচন্দ্র বসুকে অর্জন করতে হয়েছিল, পুত্রের মধ্যেও এই বোধ প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। শিক্ষকের চাকরি ছেড়েও তিনি তাই স্বজাতির কালের শিক্ষক হতে পেরেছিলেন। আর তাঁর শিক্ষা স্বজাতির ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছিল।
বাবার কণ্ঠে ছোট থেকেই অমৃতলাল শেক্সপিয়ার শুনতেন। নাটকের আগ্রহ তাই তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। এই অনুকূল পরিবেশে তিনি বাবাকে ছাড়াও আরো কিছু মানুষকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন, যেমন ওরিয়েন্টাল সেমিনারির প্রধান শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী, ইতিহাসে চন্দ্রনাথ বসু, অঙ্কে বেণীমাধব দে, ইংরেজিতে ফেড্রিক পেনি। শ্যামবাজার এ ভি স্কুলের শিক্ষক ব্রহ্মানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে কাব্য–চর্চার হাতেখড়ি হয় তাঁর। ব্রহ্মানন্দের এই শিক্ষার পরিচয় তাঁর নাটকের জীবনেও আমরা পাব। কিন্তু তার থেকেও আমাদের বড়ো প্রাপ্তি, এই শিক্ষাই রসরাজত্বে তাঁকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেয়।
তবে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে অমৃতলালের সার্থক উপস্থিতির পেছনে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন সুবিখ্যাত নট–নাট্যকার অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। তাঁকে থিয়েটারি জীবনের গুরু বলে স্বীকার করেছেন অমৃতলাল।
পেশা–প্রবেশ: ভিত্তি জাতীয়তা
১৮৭২ সালে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ‘ নাটকে সৈরিন্ধ্রীর ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে থিয়েটারি মঞ্চে তাঁর আত্মপ্রকাশ। এই আত্মপ্রকাশের লগ্নে তাঁর মধ্যে স্বদেশপ্রেমের যে হোমানল জ্বলেছিল, আজীবন সেই আগুন আর নেভেনি। এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেল অবশ্য আরও কয়েক বছর পর। দেশপ্রেমের বহ্নিশিখার মূর্ত প্রকাশ দেখা গেল ১৮৭৫ সালে তাঁর রচিত ‘হীরক–চূর্ণ‘ নাটকে। নাটকের পটভূমি রচিত হয়েছিল বরোদারাজ মলহর রাও গাইকোয়াড়কে রাজ্যচ্যুত ও নির্বাসিত করার যে ষড়যন্ত্র রেসিডেন্ট কর্ণেল ফেয়ার করেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করে। ব্রিটিশ শাসকদের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের নগ্ন রূপ আমজনতার মধ্যে সর্বপ্রথম প্রকাশ করে দেওয়ায় শাসকের রোষের শিকার হন অমৃতলাল। পরবর্তী একটি ঘটনায় সুযোগ বুঝে উপেন্দ্রমোহন দাস ও ভুবনমোহন নিয়োগীর সঙ্গে তাঁকেও কারারুদ্ধ করে ব্রিটিশ রাজশক্তি। এর মধ্যে দিয়ে রঙ্গমঞ্চের অন্য একটা দিকও উদ্ভাসিত হল। শ্রীরামকৃষ্ণ আরও কিছুদিন পরে প্রমাণ করবেন, ‘নাটকে লোকশিক্ষে হয়।’ তার আগেই অমৃতলাল প্রমাণ করলেন নাটকে দেশপ্রেমের শিক্ষাও হয়।

কৈশোর–যৌবনে হিন্দুমেলা–খ্যাত প্রখর জাতীয়তাবাদী নবগোপাল মিত্রের (যিনি ‘ন্যাশানাল নবগোপাল‘ নামে সমধিক খ্যাতিমান ছিলেন) জিমন্যাসিয়ামের আখড়ায় যেতেন। শরীরচর্চার পাশাপাশি দেশানুরাগের অগ্নিশিখাও তাঁকে বিলক্ষণ স্পর্শ করেছিল। নাট্যকারের জীবন নতুন করে তাঁকে কৈশোর–যৌবনের ভালোলাগার অনুভূতির বাস্তবিক পরশ এনে দিল।
ব্যঙ্গের কষাঘাত
নবগোপালের আদর্শে স্থাপিত ‘ন্যাশনাল থিয়েটারে‘ অমৃতলালের সক্রিয় যোগ ছিল। ন্যাশনাল থিয়েটার দলাদলিতে ভেঙে যায়। গঠিত হয় ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার।‘ অমৃতলাল হলেন তার মূল চালিকাশক্তি। স্বদেশবোধের স্পর্শ থেকে তাই তাঁর নাট্যজীবন কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাই ব্যস্ততম নাট্যকার হয়েও স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যোগ অব্যাহত ছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে।
এই সময়ই তিনি অনুভব করেন, বাঙালিকে আত্মমর্যাদা সচেতন না করতে পারলে দেশপ্রেমের কোনও পাঠই কাজে লাগবে না। অমৃতলাল বসু তাই ব্যঙ্গের কষাঘাতে বাঙালিকে জাগাতে চাইলেন। তাঁর ‘রসরাজ‘ উপাধির সার্থকতা এবারেই বুঝতে পারা যাবে। তিনি বাঙালির প্রধান দুর্বলতার জায়গাটা বুঝেছিলেন। সেটা হলো মাত্রাতিরিক্ত রাজনীতিতে আকৃষ্ট হাওয়া। যে রাজনীতি আজও বাঙালির ক্ষতি করে আসছে। ‘অমৃত–মদিরা‘য় ‘বঙ্গের আর এক রঙ্গ‘ অধ্যায়ে তিনি শাণিত ব্যঙ্গে লেখেন:
খাইয়া গোরার কিক, জেগে ওঠে পলিটিক
শিখের বাহুর বল এলো রসনায়
চ্যাটার্জি বনার্জি বাসু, খেলারাম ফেলু রাসু
প্রস্তুত ‘ঘোষা‘র সনে রণঘোষণায়
বাক্যবীর নববঙ্গে, ঐক্য হ‘য়ে জাতিভঙ্গে
জাতীয় একতা করে আকাশে স্থাপন
বাঙালির তথাকথিত উচ্চবর্ণের ‘মুখেন মারিতং জগত‘ যে আদতে সার্বিকভাবে জাতির সর্বনাশ করছে, অমৃতলাল ধ্যাননেত্রে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আপাদমস্তক দেশপ্রেমের প্রতি আজীবন আনুগত্য দেখানো অমৃতলাল রীতিমত কটাক্ষ করেছেন তাঁর স্বজাতিকে।কটাক্ষের মাধ্যমে তিনি যেমন দেশপ্রেমের পাঠ দিয়েছেন, আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন একদিকে ব্রিটিশদের অনুকরণ, অপরদিকে মুখে তাদের দেশ ছাড়ার ডাক দিলে বাঙালির চরিত্রবোধের উন্মেষ হবে না, দ্বিচারীর গণ্ডিতে ফেলা যেতে পারে মাত্র। বঙ্গভঙ্গ–বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ‘সঙের ছড়া‘ কাব্যগ্রন্থে বাঙালির এই মানসিকতার প্রতি তাঁর শাণিত কটাক্ষ:
সাহেব সাজো মোগল, সাজো সাজো ইন্ডিয়ান
বাঙালি নামের করো নাক গয়ায় পিণ্ডিদান
রাখো বাংলার পাল–পার্বণ, খেলাধুলো
নিজের জেতের ভাতের থাল—
ভাড়াটে কোটার চেয়ে অনেক ভালো বাস্তুভিটের খড়ের চাল

নেতানেতৃ–ভিত্তিক দলীয় রাজনীতির চেহারা যে কতটা কদর্য হতে পারে, আজকে বাঙালি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু সেকালের আদর্শপ্রিয় বাঙালির রাজনীতির মাঝেও এই আজকের রাজনৈতিক অবয়বটা সেদিন অমৃতলাল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এই দূরদৃষ্টি বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় বৈকি। ‘দ্বন্দ্বে মাতনম‘ নাটকে ‘ভোটেশ্বরী দেবী‘র সামনে তিনি অনায়াস ভঙ্গিতে গান বেঁধেছিলেন:
জোটে ইষ্ট, নেতা তুষ্ট, দল পুষ্ট, কষ্টে কাতরং
দ্বন্দ্বে গন্ধে অন্ধ তাই বন্ধ ‘বন্দেমাতরম‘।
ছোটবেলা থেকেই অমৃতলালের মধ্যে দেশজ কৌতুকের ঝোঁক, তাঁর ভাষায় ‘নেটিভ উইট‘। এ ব্যাপারে তাঁর শিক্ষাগুরু প্যারীমোহন বসু। আর পিতৃবন্ধু গৌরীশঙ্কর (গুড়গুড়ে) ভট্টাচার্যের সুবিখ্যাত কাগজ ‘সম্বাদ ভাস্কর‘-এ মাইকেল মধসূদন দত্তকে নিয়ে প্রকাশিত প্যারোডি, শিশিরকুমার ঘোষের বাংলা ‘অমৃতবাজার পত্রিকা‘য় হাস্যোদ্দীপক ‘বিবিধ‘ স্তম্ভের প্রতি তাঁর ঋণ অমৃতলাল স্বীকার করেছেন। অল্প বয়সেই তাঁর কিছু কিছু ‘নেটিভ উইট‘-এর পরিচয় তিনি ‘পুরাতন প্রসঙ্গ‘-এর লেখক বিপিনবিহারী গুপ্তের কাছে দিয়েছিলেন।
‘গ্রাম্য বিভ্রাট‘ প্রহসনে তিনি দেখিয়েছিলেন, অগ্র–পশ্চাৎ বিবেচনা না করে রাজনীতির প্রতি আমাদের মাত্রাতিরিক্ত মোহগ্রস্ততা কেবল স্বাদেশিকতার মূলেই ক্ষতি করছে না, তা আমাদের আত্মবঞ্চনারও সামিল। তাঁর ‘সাবাস বাঙালি‘ নাটকেও বাঙালির ইংরেজানুকরণকে তীব্র বিদ্রুপ–বাণে বিদ্ধ করেছিলেন অমৃতলাল। ১৮৯২ সালে স্টারে অভিনীত ‘কালাপানি‘ প্রহসনে বাঙালির হুজুগ–প্রিয়তাকে কটাক্ষ করেছিলেন। বিখ্যাত রম্য রচনা ‘কৌতুক–যৌতুক‘ (১৯২৬)- এ ‘বিদ্যা অমূল্যধন‘ প্রবন্ধে তাঁর লক্ষ্য ছিল কেরানিগিরির প্রতি বাঙালির মোহ। ‘ব্যাপিকা বিদায়‘ প্রহসনে পরিণয়–প্রসঙ্গে বাঙালির রক্ষণশীলতাকে পরিহাস করেছেন তিনি। স্বজাতির আত্মপ্রবঞ্চনা তাঁর কাছে কতটা অসহ্য ছিল, তা বেশ বোঝা যায় তাঁর আত্ম–পরিচয়বাহী ‘ মদিরা‘ পড়লে। এইভাবে স্বদেশ ও স্বজাতির দোষ–ত্রুটি তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেষ্টার খামতি রাখেননি। আর এ কাজে তিনি তাঁর শাণিত ব্যঙ্গের সহায়তা নিয়েছিলেন।
দেশানুরাগের ক্ষেত্র থেকেই তিনি আশা করেছিলেন, দেশবাসী একদিন এসব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করবে। শেষ বিচারে মনে হয়, তাঁর এই আশা হয়তো ব্যর্থই হয়েছে। কারণ স্বজাতির চরিত্রের যে দোষ তিনি দেখিয়েছিলেন, আজও তার কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। আমাদের কর্ণকুহরে তাঁর বাণী না প্রবেশ করলেও কিংবা তা কানের মধ্যে দিয়ে মরমে না পশিলেও, বাঙালি তাঁর ‘রসরাজ‘ উপাধির মধ্যে দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকে, হয়তো কীর্তিকেও স্মরণ করার সুযোগ পায়। এখানেই তাঁর ‘রসরাজ‘ উপাধির সার্থকতা, যা বোধহয় নেহাত উপাধিমাত্র নয়, একপ্রকার সম্মাননা।

তবে স্বদেশানুরাগ–জাত শাণিত ব্যঙ্গ কেবল তাঁর স্বজাতির প্রতিই ধ্বনিত হয়নি, বিদ্রুপবাণ ধেয়ে এসেছিল ইংরেজ শাসকের প্রতিও, অবশ্যই তীব্র বিরূপতা ও বিদ্বেষে ভরা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর রচনা করা ‘প্রোক্লামেশন (বিজ্ঞপ্তি ও ইস্তেহার)’-এ বঙ্গভঙ্গের ফলে নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের ছোটলাট ব্যমফিল্ড ফুলারের প্রতি তীব্র শ্লেষ প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর রচনার এটাই বড়ো গুণ। স্বদেশবাসীর প্রতি কোনটা আর বিদেশি শাসকের প্রতিই বা কোন ব্যঙ্গটা, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। স্বজাতির আত্ম–সমালোচনার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর ব্যঙ্গে যেন সহমর্মিতার সুরটাও ধ্বনিত হত, আর বিদেশি শাসকদের প্রতি তাঁর ব্যঙ্গে শাণিত কটাক্ষটুকু ছাড়া আর কোনও কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। তাঁর প্রাসঙ্গিকতার একটি জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ দিই। ‘বিষম সমস্যা’ (১৯২২) রচনায় তিনি শুরু করেছিলেন: ‘এ কি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে!’ আজ এটি বাঙালির প্রিয় বুলি, কারও কথায়, কারও কাজে।
শেষ কথা
এতক্ষণ অমৃতলাল বসুর যে পরিচয় তুলে ধরা গেল, সেটি অবশ্যই একমাত্রিক। তাঁর বহুমুখী পরিচয় আছে। ‘রসরাজ‘-এর পরিচয় ছাড়াও তাঁকে পুরনো কলকাতার কথক বলা যেতে পারে। বিপিনবিহারী গুপ্তের কাছে করা তাঁর স্মৃতিচারণা (‘পুরাতন প্রসঙ্গ‘ নামক বিখ্যাত সিরিজের অন্তর্গত), কিংবা তাঁর আত্মস্মৃতি ‘পুরাতন পঞ্জিকা‘তে সেকালের বনেদি কলকাতার একটি নিটোল চিত্র পাওয়া যায় (দ্রষ্টব্য: ড. অরুণ কুমার মিত্র সম্পাদিত ‘অমৃতলাল বসুর স্মৃতি ও আত্মস্মৃতি‘)। নাট্যসমাজে রামকৃষ্ণদেবের ভাবমূর্তি দেবতাসম। সেই ধারাতেই অমৃতলাল রচনা করেছিলেন ‘ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাল্যলীলা‘ (১৯২৯)।
তবে তাঁর আত্মপরিচয়বাহী বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অমৃত–মদিরা‘। প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থায়, রোগ–যন্ত্রণায় কাতরতার মধ্যে তিনি এই কাব্য রচনা করেন। বইটির আখ্যাপত্রেই তিনি আত্ম–পরিচয় উদঘাটন করেছেন: ‘বাক্যরসাত্মকংকাব্যম‘। একটি ছড়া লিখেছিলেন তাতে:
পূরিবে কীটের পেট, কিছু বা পাঠাবে ভেট
পড়িলে পড়িতে পারে কোনো সুলোচনা
সমকালীন সময়ে সুলোচনাদের দৃষ্টি প্রসারিত করবারই অধিক প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী গতিপ্রকৃতি সাক্ষী দেয় তাঁদের দৃষ্টি মেলার এই আয়োজন ব্যর্থ হয়নি। যার হাত ধরেই হয়তো নবজাগৃতির ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নারী স্বাধীনতার রেশ উপভোগ করছি। তবে শুধু সুলোচনারাই নয়, সার্বিকভাবে বাঙালি পাঠক সমাজ অমৃতলাল বসুর রচনায় বুঁদ হয়ে থেকেছে। নিজের ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েও বাঙালিকে দূরদৃষ্টি দিয়েছেন। উপসংহারে শ্রীরামকৃষ্ণের শরণ নিই। তিনি গিরীশ ঘোষকে বলেছিলেন: ‘গিরীশ মদ খেও। কিন্তু দেখ পা যেন না টলে, আর মন যেন না টলে।‘ যেন সেই আদেশেরই মূর্ত রূপ অমৃতলাল বসু। মদে মাতাল না করেও মদিরা–সিক্ত বাঙালিয়ানায় বাঙালি জাতিকে শুচি স্নিগ্ধ করেছেন। এখানেই তাঁর বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিকতা।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার বনেদি ঘরানায়। সেইসূত্রেই বাংলা ও বাঙলির সাংস্কৃতিক অনুসন্ধানের সূত্রপাত। প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকের পর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুস্তক প্রকাশনা বিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। ফিচার-ধর্মী প্রতিবেদন থেকে ক্রমে গবেষণায় মনোনিবেশ। বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী হিসেবে কর্মরত।
পড়লাম ।তথ্য সমৃদ্ধ লেখা আজকের দিনে বড্ড উপকারী ।