হে বন্ধু নূতন করে আরোগ্যের স্বাদ দিলে মোরে…

তুমি এলে এখানে যে জায়গা হবেনা তা নয়। তোমার যখন ইচ্ছা আসতে পার।

আজ থেকে একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে যাঁর কাছে এমন উদার আমন্ত্রণ এসেছিল, তিনি তখন সবে উনিশ-কুড়ি বছরের এক তরুণ। বিশ্বভারতীতে যোগ দেবার জন্য এমনও কবি লিখেছিলেন

তুমি এম.এ দেবে বলে তোমার বিশ্বভারতীতে যোগ দেবার কোনো বাধাই হবেনা। বরঞ্চ এখানে তুমি যে-কোনো সুবিধা চাও তা পাবে।

শেষ পর্যন্ত সেই তরুণ শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন এবং ১৯২৬ সালে কবির সাহিত্য-সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন দীর্ঘ সাতটি বছর। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে একাধিকবার পাড়ি দিয়েছেন। পরে সেই তরুণ ১৯৩৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনের মায়া কাটিয়ে পাকাপাকিভাবে অক্সফোর্ডে পাড়ি দেবেন ঠিক হলে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে তাঁকে লিখলেন

‘…তোমার কথা বারবার মনে পড়ে। তুমি আমাকে যেমন ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছিলে পেয়েছিলে, এমন কারো পক্ষে সম্ভবপর নয়, এইজন্যে আমি তোমার পরে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পেরেছি। এরকম সঙ্গ আমি আর কারো কাছ থেকে আশা করি নে।…

এও বলেছিলেন,

‘…তুমি আমার অনেক করেচ, অনেক ক্লান্তি থেকে বাঁচিয়েছ — তোমার সহযোগিতা আমার পক্ষে বহুমূল্য হয়েছিল সে কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না — কোনোদিন তোমার অভাব পূর্ণ হবে না।…

এই মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে পথসঙ্গী’ কবিতায় লিখেছেন,

শ্রীযুক্ত অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী

বাহিরে তোমার যা পেয়েছি সেবা
অন্তরে তাহা রাখি,
কর্মে তাহার শেষ নাহি হয়
প্রেমে তাহা থাকে বাকি।
আমার আলোর ক্লান্তি ঘুচাতে
দীপে তেল ভরি দিলে।
তোমার হৃদয় আমার হৃদয়ে
সে আলোকে যায় মিলে।’

Tagore hand writing
কবির রোগশয্যায় অমিয় চক্রবর্তীর উদ্দেশে লিখিত

 

কবির এই অসমবয়সী বান্ধবটি হলেন শ্রী অমিয় চক্রবর্তী। তিনি নিজেও একজন কবি। তাঁর লেখা ‘খসড়া’ এবং ‘এক মুঠো’ কবিতাগ্রন্থ দু’টি রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা কুড়োয়। রবীন্দ্রনাথ এই বন্ধুর অনুরোধেই ১৯৩৭ সালের ৮/৯ ফেব্রুয়ারি ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রচনা করেন। চিঠিতে তাঁকে সে কথা লিখেওছিলেন, “আফ্রিকার উপরে কবিতা লিখতে অনুরোধ করেছিলে। লিখেছি।” এর আগে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর মা অনিন্দিতা দেবীর একাধিকবার পত্রালাপ হয়েছে।

১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ডেনমার্কে হিয়োর্ডিস সিগোকে অমিয় চক্রবর্তী বিয়ে করবেন বলে স্থির করলে কবি খুব খুশি হন। স্বভাবসিদ্ধভাবে সেই হিমদেশের কন্যার হৈমন্তী নামও দিলেন। তাঁদের বিবাহোপলক্ষে একটি কবিতাও লিখেছিলেন। পরিণয়মঙ্গলনামের কবিতাটি পরিশেষকাব্যগ্রন্থভুক্ত হয়েছে…

উত্তরে দুয়াররুদ্ধ হিমানীর কারাদুর্গতলে
প্রাণের উৎসবলক্ষ্মী বন্দী ছিল তন্দ্রার শৃঙ্খলে।
যে নীহারবিন্দু ফুল ছিঁড়ি তার স্বপ্নমন্ত্রপাশ
কঠিনের মরুবক্ষে মাধুরীর আনিল আশ্বাস,
হৈমন্তী নিঃশব্দে কবে গিয়েছে তাহারি শুভ্রমালা
নিভৃত গোপন চিত্তে; সেই অর্ঘ্যে পূর্ণ করি ডালা
লাবণ্যনৈবেদ্যখানি, দক্ষিণসমুদ্র-উপকূলে
এনেছে অরণ্যচ্ছায়ে, যেথায় অগণ্য ফুলে ফুলে
রবির সোহাগগর্ব বর্ণগন্ধমধুরসধারে
বৎসরের ঋতুপাত্র উচ্ছলিয়া দেয় বারে বারে।
বিস্ময়ে ভরিল মন, এ কী এ প্রেমের ইন্দ্রজাল,
কোথা করে অন্তর্ধান মুহূর্তে দুস্তর অন্তরাল,–
দক্ষিণপবনসখা উৎকণ্ঠিত বসন্ত কেমনে
হৈমন্তীর কন্ঠ হতে বরমাল্য নিল শুভক্ষণে।

কবি অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথকে এমনই ভক্তি করতেন যে ১৯২৭-২৮ সাল নাগাদ সজনীকান্ত দাস যখন শনিবারের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা শুরু করেছিলেন তখন অমিয় চক্রবর্তী খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সেই সময় বিচিত্রাপত্রিকায় অমিয় চক্রবর্তী সাহিত্য ব্যবসায়নামক প্রবন্ধে তাঁর এই প্রসঙ্গে মনোভাব পোষণ করেছিলেন। লিখেছিলেন

ব্যবসায়বিলুব্ধের হাতে সাহিত্য, শিল্প, সংগীতের সদগতি প্রত্যাশা করা চলে না; কিন্তু বৈশ্য যুগধর্মের প্রভাবে, জীবনে যা-কিছু অমূল্য তাকেও পণ্য দ্রব্যের মূল্য দিয়ে মানুষ পণ্যবীথির সামগ্রী করে তুলেছে।

বিদেশে থাকাকালীন অমিয়বাবু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য, ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলিত গ্রন্থ দ্য গোল্ডেন বুক অফ ট্যেগর।এবং এই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনাপত্র ইউরোপে প্রচার করার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলেন। এই ব্যাপারে ১৯২৯ সালের ১৪ মার্চ অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি পড়া যাক্…

অনেক ইংরেজ যাত্রীর সঙ্গে আমার বই আছে।… আমার রচনা আমার মত প্রভৃতি সম্বন্ধে এদিককার এত লোকের জানা আছে হঠাৎ তার পরিচয় পেয়ে মাঝে মাঝে চমকে উঠতে হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে যেখানে আমার যথার্থ পরিচয় ও আমার আলোচনা কম সে হচ্চে শান্তিনিকেতন। কিন্তু এই শান্তিনিকেতনের কোনো লোক যখন য়ুরোপ যাবে তখন তাদেরি কাছ থেকে আদর পাবে যারা তাদের চেয়ে যথার্থভাবে আমাকে শ্রদ্ধা করে এবং ভালো করে জানে।‘ 

Amiya Chakraborty
বিদেশে কবির সঙ্গী অমিয় চক্রবর্তী (পিছনের সারিতে)

এ তো গেল অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা কবির চিঠির কথা। একইভাবে অমিয় চক্রবর্তীর চিঠিও আমরা পাই যা কিনা রবীন্দ্রনাথকে লেখা হয়েছিল এই প্রসঙ্গে। ১৯৩০ সালের ১ এপ্রিল অমিয় চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘এখানেও নানা কাগজে আপনার কথা রোজই বেরোচ্চে– যা পেয়েছি cuttings তৈরি করে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিয়েছি সেখানকার বইয়ে রাখবার জন্য।‘ 

পরের চিঠিতে জানিয়েছেন,

এখানে প্রত্যহ অসংখ্য চিঠি আসচে। ইংল্যান্ডের নানা জায়গা থেকে সবাই জানতে চান আপনি কখন এখানে আসবেন, আপনাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চান।’

এছাড়াও বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশ এবং বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও এই দুই অসমবয়সী বন্ধুর আশঙ্কা এবং উদ্বেগ আমরা তাদের চিঠির মাধ্যমে পেয়েছি। যত দিন এগিয়েছে, কবি ততই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অবর্তমানে বিশ্বভারতীর অবস্থার কথা।‌ অমিয় চক্রবর্তীকে অকপটে জানিয়েছেন সেকথাও। 

আমার অনুপস্থিতিতেই তোমাদের দায়িত্ব আরো অনেক বেশি এই কথাটি ভুলোনা।’

Amiya Chakraborty Poet
দেশিকোত্তম পুরস্কার নিচ্ছেন অমিয় চক্রবর্তী

আরও বলেছেন,

অনেকদিন থেকে তোমার প্রতীক্ষা করে আসচি।… আমার মুশকিল, আমার দেহ ক্লান্ত, তার চেয়ে ক্লান্ত আমার মন, কেননা মন স্থানু হয়ে আছে, চলাফেরা বন্ধ– তুমি থাকলে মনের মধ্যে স্রোতের ধারা বয়– তার প্রয়োজন যে কত তা আশেপাশের লোকে বুঝতেই পারেনা।‘ 

এখানেই বোঝা যায় দুইজনের মধ্যে কতটা পারস্পরিক নির্ভরতা ছিল। পরবর্তীকালে ‘দেশিকোত্তম’ এবং ‘পদ্মভূষণ’ পদক পান অমিয় চক্রবর্তী।‌

গ্রন্থঋণ: 

১) কবি অমিয় চক্রবর্তী। সুমিতা চক্রবর্তী। জিজ্ঞাসা এজেন্সিস লিঃ
২) রবীন্দ্রনাথ ও অমিয় চক্রবর্তী। নেপাল মজুমদার। দেজ পাবলিশিং
৩) চিঠিপত্র। একাদশ সংখ্যা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
৪) কবির চিঠি কবিকে: রবীন্দ্রনাথকে অমিয় চক্রবর্তী ১৯১৬-১৯৪১। নরেশ গুহ (ভূমিকা-টীকা-সম্পাদনা) । প্যাপিরাস

Pitam Sengupta

প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *