আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] []

দু-ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল কি পড়ল না মাঠে মাঠে সবুজ ঘাসের জাজিম পেতে দিল কে জানি। সে জাজিমে কত না নকশা কত না ফুলকারির কাজ। ভেষজ গুল্ম আর গাছগাছালির বুননে ভরে উঠেছে সেসব,পৃথিবীর কোন আদিম মন্ত্রে। সেসব মন্ত্র কি মানুষেরা জানে? পায়ের তলায় দলে যাওয়া কত না বনৌষধি তলিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে। স্মৃতির দেরাজখানা খুলে তাকে যত্নের আখরে সাজিয়ে তুলতে চায় না কি কেউ? চায় বই কী। অন্তত তেমন একজন মানুষকে আমি চিনতাম। খুব গভীর করে চেনা আসলে। বাছুর যেমন করে তার মায়ের গন্ধ চেনে, তেমন করেই। তার নাম ছিল বটে কুমুদিনী, সে নিজেও ভুলেছিল বোধহয় সে নাম। আমরা তাকে চিনেছি খোকারমা পিসি বলেই। পুব-বাংলার কোনও এক গাঁ-ঘরে বেড়ে ওঠা একরত্তি মানুষ। অথচ কী প্রখর তার উদ্ভিদ-জ্ঞান! ঘন বনছায়ায়, মজা পুকুরের পাড়ে পাড়ে সারাদিন এমন সব গাছেদের দেখে বেড়ানোর কী আকূলতা ছিল তার। কোঁচড় ভরে শাক তুলে নিয়ে আলপথ বেয়ে হেঁটে আসছে ওই! কোনওদিন বউটুনি, কোনওদিন নুনিয়া, কোনওদিন বা কানাই শাক তুলেছে মাঠঘাট ঘুরে ঘুরে। কোথায় হাতির শুঁড়, কোথায় দণ্ড কলসের গাছ গজিয়েছে সেসব তার স্মৃতি ভরিয়ে রাখত প্রতিদিন। 

পাড়ার বউ মানুষেরা, বিটিছেলেরা ডাক্তারের কাছে আর কে যেত! মেহেদীর পাতা থেকে শ্বেত বেড়েলার মূল কত না ঔষধি জ্ঞানে ভরে উঠেছিল তার কোঁচড়খানা। আমরা তাকে গেঁয়ো যোগী ভেবেছিলাম কি! তা তো না। আমরা জানতাম, অমন মলিন শাড়ি পরা একজন বেঁটেখাটো মানুষ জ্ঞানের পাহাড়ে ডুবে যেতে যেতেও হলুদ বাটে, মাছ কোটে, ভরা সন্ধ্যায় বসে বসে নারকেল পাতা কেটে কাঠি তোলে। দিন মাস বছরের কত না হিসেব তার মনের মধ্যে জেগে বসে থাকত রোদ্দুরে বর্ষায় শরতে। ঘোর লাগা বর্ষার দিনে এ বাগান সে বাগান ঘুরে ঘুরে পাতাল ফোঁড় (মাশরুম) তুলে তুলে কড়াই ভরে রান্না করেছে কত কত দিন! সেসব অধিত বিদ্যার সামনে নত হয়ে বসতে ভুলে গেছি আমি। কোলে-কাঁখে করে ঘুরে ঘুরে কেবল তার কোবরেজ দিদিমার গপ্পো শুনেছি মন ডুবিয়ে। মেয়ে-ডাক্তারদের ইতিহাসে এমন সব মেয়েছেলে-কোবরেজদের গপ্পো লেখা নেই বোধহয়। গাঁ-গেরামের এমন সব ঔষধির হাল-হদিশ, সেও কি লেখা নেই! আছে হয়তো বা কিন্তু সেসব গাছ চিনে বেড়াবার, দেখে বেড়াবার সাধ মানুষের আছে কি! এই যেমন খোকারমা পিসি, ওর দিদিমার থেকে পাওয়া অধিত জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রেখেছিল, সেও তো দেখবার মতো! শিখেছিল মরশুমে মরশুমে গাছের বীজ কেমন করে শুকিয়ে রাখতে হয়। মাথার মধ্যে আস্ত একখানা ক্রপ ক্যালেণ্ডার অটুট ছিল তার চিরকাল। সংরক্ষণের এই যে ইচ্ছে সে তো সকলের থাকে না!আমসত্ত্ব, ছড়া তেঁতুল, আমসি, পলতা পাতা – এসবই তো কেবলমাত্র সংরক্ষণের একক নয়! খোকারমা পিসিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি যখন খুব করে মা-হারা বাছুরের মতো সেই মানুষী-সত্তার কাছে ফিরে যেতে চাই তখন আমার মনে পড়ে অল্পনা রাণী মিস্তিরির কথা। অমন ঘামজলে ভিজে থাকা সিঁদুরের টিপ, ছাপা শাড়ি, অমন ঢলোঢলো মুখে কী যে মায়া! 

অল্পনা রাণী মিস্তিরি। বীজ সংরক্ষক।

অল্পনা রাণী কিষাণী। আমার তাঁকে অবশ্য কিষাণ বলতেই ইচ্ছে করে। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা উপজেলার ধুমঘাট গ্রামে অল্পনা রাণীর সংসার। লোনাজল আর ঝড়-বাদলের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার জীবনই তাঁর। সে জীবনে দারিদ্র্য ছিল, অনাহার ছিল, সংসারের দায় ছিল। হেরে যাবে বলে তো মানুষ লড়াই শুরু করে না! আয়লায় ধুয়ে মুছে যাওয়া ৩৩ শতক জমিতে আমাদের এই লড়াকু কিষাণী তাই বুনে দিতে পেরেছিলেন ফসলের গান। সে গানের সুর একদিনে বাগান ভরিয়ে তুলতে পারবে না জেনে শুরু করেছিলেন সংরক্ষণের কাজ। বীজ সংরক্ষণ। কেবল মাত্র আঞ্চলিক দেশি বীজ সংরক্ষণে আগ্রহ তাঁর। শাক সবজি ফল ফলাদি আর ঔষধি গাছ-গাছালির বীজ। হাইব্রিড ফসলে সার লাগে বেশি, প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝায় সে টিকে থাকতে পারে না। তাই চাই আঞ্চলিক দেশি বীজ। চাই বনৌষধির সংরক্ষণ। যেখানে মানুষের জীবনে খোকারমা পিসির কোবরেজ দিদিমার মতো মেয়েজীবনের অধিতজ্ঞান অসুস্থ মানুষের শিয়রের পাশে দাঁড়ায় সেখানে হাতির শুঁড় আর দণ্ডকলসের গাছের প্রয়োজনীয়তা হাইব্রিড ফসলের চেয়ে বেশি বৈকি! অল্পনা রাণীর নিজের ভাষায় তাঁর ভাবনা গুলো এইরকম – ‘গাছপালা, মাটি, পানি, পক্ষী, গোরু, সব নিয়েই আমাদের গ্রামীণ সংসার। এইখানে একজনের কথা ভাবলে হয় না, সবার কথা ভাবতে হয়। এই শিক্ষা আমি আমার গ্রাম থেকে পাইসি। …আমাদের গরীবের যে নানা সম্পদ আছে সেইটা নিয়া কী ভাবে ভালো ভাবে কাজ করা যায় সেইটা বুঝতে পারসি।’ অল্পনা রাণীর এই ভাবনার মধ্যে নিঃসন্দেহে আয়লার বিভীষিকা ছায়া ফেলে গেছে, সেই নিঃসম্বল জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস তাঁকে দিয়ে অনেক কিছু ভাবিয়ে নিয়েছে। তাই না সাড়ে তিনশো থেকে চারশো বীজের সংগ্রাহক তিনি! মানুষ তাঁর কাছে বীজ চাইলে তিনি অল্প বীজ দেন, মানুষকে দিয়ে সংরক্ষণের কাজ করিয়ে নিতে চান। তিনি চান মানুষ শিখুক এসব, ভাবুক। গাঁয়ের কৃষকেরা, মহিলারা তাঁর থেকে প্রতিদিন শিখছেন, জানছেন – এই আনন্দের কি শেষ আছে?

  অল্পনা রাণী কি পৃথিবীর বীজকোষের কথা জানেন? কেমন করে সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর প্রাণভোমরা গচ্ছিত আছে, সেকথা বোধহয় তাঁর জানা নেই। জানা থাক বা না থাক, এতে সত্যিই তাঁর কিছু যায় আসে না। পৃথিবীর ইতিহাসে আয়লায় সর্বস্বান্ত হওয়া একজন মানুষ তাই নিজেই আস্ত একজন নোয়া হয়ে ওঠেন। তার সামান্য পুঁজি – শিশি বোতলে ভরা বীজ, সেই কি আরেকখানা নোয়ার নৌকা নয়! একজন মায়ের হাতে কী আশ্চর্য ভাবনায় গড়ে উঠছে আস্ত একখানা প্রাণ বীজের লাইব্রেরি। সেসব প্রাণ আসলেই মানুষের জীবনে আস্ত একখানা সবুজ জাজিম মেলে দিক। এইটুকুই তো চাওয়া। গ্রাম জীবনের মেয়েবেলার ঔষধি-বন্ধু গুল্ম-সকল ভালো থাকুক, বেঁচে থাকুক। অল্পনা রাণীর তৈরি করা বীজ-বাঁচানোরর গল্প যেন একখানা রূপকথা। জিয়নকাঠি আর প্রাণ ভোমরার কী অপূর্ব সংমিশেল। সে তো আসলে রাজপুত্তুরের রাজকন্যে উদ্ধারের গপ্পো নয়! বরং এ খানিক উলটো। এবং অলপনা রাণী একা নন– লক্ষ্মীরাণী মণ্ডল, চন্দনা সরকার এঁরাও আছেন। রাজকন্যেরাই মরুবিজয়ের কেতন উড়িয়েছেন বাংলাদেশের আকাশে। জয় হোক মানুষের। জয় হোক জীবনের। 

Amrita Bhattacharya

অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্‌জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *