শিল্পী মানেই কি পথিক নয়? তিনি আনমনে ঘুরে বেড়ান পাহাড়ে-জঙ্গলে-নদীতে। নিজের সঙ্গে একা। কাঁধঝোলায় পেন্সিল-রবার-রং-তুলি। যেমন ইচ্ছে থামেন। জীবন দেখেন। পথ দেখেন। আলস্য দেখেন। প্রকৃতির গায়ে ঠেস দিয়ে ভাবনের নাও ঠেলে দেন আলগোছে। কখন যেন স্কেচের খাতা ভরে ওঠে পাথেয়তে। ঘরে ফিরে এসে একলা অন্দরে মন মথিয়ে বের করে আনেন সে সব সকাল-দুপুর-বিকেলের রঙিন নুড়ি পাথর। দেবাশীষ দেবের স্কেচের খাতা আর ভাবনপথের যাত্রা ধরা রইল বাংলালাইভের পাতায়!
শীতের মরসুমে অযোধ্যা পাহাড়ের এ পথ সে পথ ধরে নিজের মনে ঘুরে বেড়ানোর যে কী আনন্দ সেটা লিখে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। মূলত এখানে এসেছি ছবি আঁকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমার হাতে রয়েছে কুল্লে দেড়দিন। অর্থাৎ এর মধ্যে হাত আর পা দুটোকেই চালাতে হবে যথাসম্ভব জোরকদমে। সিরকাবাদ থেকে যে পিচের রাস্তাটা উঠে এসেছে পাহাড়ের মাথায়, সেটাই এঁকেবেঁকে অন্য ধার দিয়ে নেমে গেছে বাঘমুন্ডি অবধি।এই রাস্তা ধরে এগোলেই দু’পাশে দেখা যাবে ডালপালার মত ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মেঠো পথ, যার একটা চলে গেছে ময়ূর পাহাড়ের দিকে। বাকি সব পাক খেয়েছে ছোট ছোট সাঁওতাল গ্রামগুলোকে ঘিরে।

এখানকার সব বাসিন্দারা আবার মুর্মু, ওঁরাও, মান্ডি, লোহার এই ধরনের আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে আছে। যদিও বাইরের লোকের কাছে সেটা বোধগম্য নয়। আমাকে গাড়ি করে এখানে পৌঁছে দিয়েছিলেন যিনি, সেই সহৃদয় আমলা সাহেবের কাছ থেকে এই তথ্যটুকু সংগ্রহ করেছিলাম। আমার তেমন নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য ছিল না। মিঠে রোদের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে খড়ে ঢাকা খোলার চালওলা মাটির বাড়ি আর এক টুকরো অলস জীবনযাত্রার ছবি আঁকব বলেই এসেছি।
ভরদুপুরে প্রায় জনশূন্য হয়ে থাকে চারপাশ। সমর্থ পুরুষেরা এ সময় কাম-ধান্দায় বেরিয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া কিছু মহিলাকে দেখলাম কাপড়ে মাথা আর মুখ ঢেকে ঝপাস ঝপাস শব্দে ধান ঝাড়াই করতে ব্যস্ত। বাকিরা যে কোন অন্তঃপুরে সেঁধিয়ে রয়েছে কে জানে।

লোকজন বাদ দিয়ে একেবারে ন্যাড়া বাড়ি ঘর আঁকতে তেমন ভালো লাগে না। দু’একজন বাচ্চা ছেলে এদিক ওদিক করছে দেখে এক জায়গায় বসে পড়লাম। সাইকেল নিয়ে যে ছোকরাটি ঘরে ঢুকবে ঢুকবে ভাবছিল তাকেও বললাম দাঁড়িয়ে যেতে। একজন বয়স্ক লোককে দেখলাম নেশার ঘোরে খাটিয়ায় বসে ঝিমোচ্ছে, একেও আঁকতে ছাড়লাম না।
বিকেল হয়ে আসছে, এবার ময়ূর পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখতে হবে। ফিরলাম বড় রাস্তার দিকে, যেখানে ছোট একটা শিব মন্দিরের চত্বরে জোর তাসের আড্ডা জমিয়েছে একদল চ্যাংড়া ছেলে। পাশে পুঁচকে ট্রানজিস্টার থেকে তারস্বরে বাজছে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া বহু পুরনো হিন্দি ছবির একটা গান। বেশ লাগছিল কিন্তু শুনতে। এর উল্টো দিকে রাস্তায় প্লাস্টিক বিছিয়ে বসেছে কৃষ্ণ মাখোয়া। সামনে টুলের ওপর রাখা ছোট ছোট টুকরো করা মুর্গির মাংস। রোজ বিকেলে এইখানে বসেই কাটা কুটি করে বিক্রি বাট্টা সেরে বাড়ি ফিরে যায় ও। আমি অবশ্য কিছুক্ষণ থেকেও একজন খদ্দেরের টিকিও দেখতে পেলাম না। ওকে আঁকছি বুঝতে পেরে কৃষ্ণ মুখে দেঁতো হাসি ফুটিয়ে একটু গুটি সুটি মেরে বসল।

ওখান থেকে আরও কিছুটা পথ এগোতেই দেখি পাগড়ি মাথায় কাঁচাপাকা দাড়িওলা একজন সুঠাম চেহারার লোক এগিয়ে আসছে। কাঁধে ফেলা তরোয়াল গোছের একটা জিনিস, যার আবার দুটো ফলা। লোকটাকে দাঁড় করিয়ে জেনে নিলাম একে দাউড়ি বলে এবং মহাশয়ের নাম পাহাড়ি সিং। জঙ্গলে জঙ্গলে গিয়ে গাছের ডাল কেটে বেড়ায়। নামটা বেশ মানানসই বলতে হবে।

চট করে এর একটা স্কেচ না করলেই নয়! দেখলাম প্রস্তাবটা গম্ভীর মুখে মেনে নিলেন সিংজি। ছবি তো আঁকছি, এদিকে খেয়াল নেই এক অল্পবয়েসি টুরিস্ট বর-বৌ যেতে যেতে কখন থেমে গিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি সামান্য উচ্ছল গোছের। পাহাড়িকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল… ‘আরে! তুমি তো একেবারে কবি জয় গোস্বামীর মতো দেখতে! পাহাড়ি নয় আজ থেকে সবাই তোমায় ওই নামেই ডাকবে।’পাহাড়ি কিছু না বুঝে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আর আমিও সেই ফাঁকে স্কেচ খাতা ব্যাগে ভরে হাঁটা দিলাম।
সামনেই পড়ল বাগান্ডি গ্রাম। দেখলাম একটা দোকান মতো রয়েছে। মনে হল চা পাওয়া যেতে পারে। ঢুকে পড়লাম ভেতরে। ঘরটা বেশ বড়। এক কোণে দুটো ছেলে, যার একজন বড় কড়ায় গোল গোল বড়ার মত কিছু একটা ভেজে তুলছে। এগুলোকে এরা বলে গুড়গুড়ি! গুলগুলাও বলে। কামড়ে খেয়ে দেখলাম কিছুটা শুকনো আর মিষ্টি মিষ্টি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ছেলে দুটোর নামও জেনে নিলাম। ছোটু আর আনন্দ।
আজ থেকে পনেরো বছর আগে অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম স্থানীয় লোকেদের মধ্যে গাছ বাঁচানো নিয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা জোরকদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে স্লোগান আর রংচঙে ছবিতে জঙ্গল, হাতি, চাষি এইসব পরিপাটি করে আঁকা। বুঝতে অসুবিধে হয়নি বিশেষ কোনও সংগঠন এর পিছনে যথেষ্ট সক্রিয়। সম্প্রতি এই অঞ্চলে আবার বেড়াতে গিয়ে দেখলাম অবস্থা বেশ ঘোরালো। বাঁধ তৈরি হবে বলে সরকার থেকে নাকি গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে। ফলে সবার চোখে মুখে বেশ আতঙ্কের ছাপ। এর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে বড় রকমের একটা আন্দোলন গড়ে উঠছে সেটাও চোখ এড়াল না।
যাই হোক, এবার আর না থেমে চললাম ময়ূর পাহাড়ের উদ্দ্যেশ্যে। এ দিকটায় জনবসতি ধীরে ধীরে কমে এসেছে। গাছপালাও বিশেষ নেই। ফলে অনেক দূর অবধি চোখ চলে যায়। বেঁটে বেঁটে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে পাহাড়ের একেবারে টং-এ পৌঁছোতে গেলে বেশ ভালোই দম খরচ হয়। তবে এখান থেকে চারধারে ছড়িয়ে থাকা পাহাড় আর জঙ্গল মিলিয়ে গোটা অযোধ্যা রেঞ্জটা দেখা যায়, এক কথায় মন ভরিয়ে দেওয়ার মতো দৃশ্য বটে। চুড়োর একেবারে মাঝ মধ্যিখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে এরা হনুমানজির পেল্লায় একটা মূর্তি বানিয়ে রেখেছে। দেখে মনে হল নিয়মিত পুজো-আচ্চাও হয়। তবে আমার সৌভাগ্য গদা হস্তে এই বজরঙ্গি দেবতাটি ছাড়া আমি সেদিন সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে শান্ত মনে উপভোগ করেছিলাম গোধূলির সেই আলোর অপূর্ব রেশ। মাটির সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত গাছপালা যে কতখানি রাঙা হয়ে উঠতে পারে, সেটা বোধহয় জীবনে প্রথমবার দেখার সুযোগ ঘটেছিল।

ওখানে সেবার উঠেছিলাম মালবিকা লজ-এ, যার তিনতলার ছাদের ওপর একটা ওয়াচ টাওয়ার ছিল। ভেবেছিলাম সন্ধের পর ওখানে উঠে চাঁদের আলোয় প্রকৃতির আলো আঁধারি নিস্তব্ধ পরিবেশটা দেখে কাটাব। তখন কি ছাই জানতাম যে এই লজে এমন কিছু ব্যস্তবাগীশ লোক এসেছে্ন যাঁরা সকাল থেকে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক না পেয়ে অগাধ জলে পড়ে আছেন এবং ঠিক ওই সন্ধেতেই ছাদে উঠে আবিষ্কার করবেন যে তাঁদের ফোনগুলি আবার সজীব হয়ে উঠেছে! ফলে আমার নির্জনতাটুকু বেমালুম কেড়ে নিয়ে এঁরা মহোল্লাসে এবং উচ্চৈস্বরে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন এঁদের গোটা দিনের ফিরিস্তি! এমনকি সকালে খেতে বসে ভাতের মধ্যে কটা কাঁকর পেয়েছেন, বাদ গেল না সেই গুরুতর তথ্যও। পরদিন দুপুরে বাসে চেপে পুরুলিয়া ফেরার পথে একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল… শুধুমাত্র অফিসের বস বা বউ নয়, হোটেলের অন্য বোর্ডার ভালো পাওয়াটাও কিন্তু নেহাতই কপালের ব্যাপার!!
(চলবে)
স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |
অসাধারণ! ঠিক যেন জীবন্ত এক চিত্রকাহিনী।??
এক নি:শ্বাসে পড়ে,আর দু’চোখ ভরে দেখে ভারি একটা আরাম হলো।
as I know purulia very closely,,,I can assure no one can define its spirit so lively as Mr..Dev has done..blessings from my heart ….
Opurbo
Porer sonkhar opekhaye roilam
ek niswase pore fellam, opurbo bolleo kom bola hoi