‘আপনাদের তো বর্ষায় খুব মুশকিল, বন্যা হয় শুনেছি‘…
বাড়ি ঘর ভেসে যায়–টা আর বললাম না।
কারণ এটুকু বলতেই আমাকে নস্যাৎ করে দিয়ে উত্তর এল,
— না না, কষ্ট নাই, আমাদের অনেক সুবিধা হয়। আপনারা, ইন্ডিয়ার লোক, ঠিক বুঝেন না।
এরপর আর কিছু বলার থাকে না।
কথাবার্তা চলছে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে।
— গরমের সময়, শীতে খুব কষ্ট। হাইট্যা হাইট্যা যাইতে হয় কতদূর। বর্ষায় জলে জলে নৌকা নিয়ে চলে যাই, কোনও কষ্ট নাই। বলতেই শুদ্ধদা ঝাঁপিয়ে পড়লেন,
— বলেছিলাম না, বাংলাদেশের গল্পটাই আলাদা। তুমি কলকাতার ঘটি, এসব বুঝবে কী করে?
ঠিক কথা।
চোখে দেখে, ওই বাংলায় লেখা গাড়ির নাম্বার প্লেট বাদ দিলে চট করে সীমানার অপর পারে বাংলার তফাৎটা বুঝতে একটু সময় লাগে। কান খোলা রাখলে বোঝা যায় তাড়াতাড়ি, এদিককার মেজাজটা অন্য গোত্রের। বর্ডার পেরনো মাত্র হৈহৈ করে এসে পড়া কালচার শক দ্রুত মধুর হয়ে ওঠে। বুঝি, এটাই বাংলা, আমাদেরটা ঠিক নয়।
— এই যে রবীন্দ্রনাথ, মানিকবাবু, সবই আদতে এদিককার, এজন্যে তোমার দুঃখিত হবার, লজ্জা পাবার কোনও কারণ নেই, তাই না? নিজের এলাকায় পেয়ে শুদ্ধদা আমার ওপর তুমুল বর্ষাচ্ছে, আমিও ক্রমাগত ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছি, আবার বিভোরও হয়ে আছি। কোনও প্রতিরোধ করার চেষ্টাই করছি না। বুঝতে পারছি, বিস্ময়ের পর বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
এবারে ঢাকা নয়, পৌঁছে গেছি বরিশাল। শুদ্ধদার গেস্টরা আসবেন পরে। আগে নিজে এসে সব দেখে শুনে, থাকা খাওয়া, ঘোরার ব্যবস্থা পাকা করে যাবেন। সঙ্গে জুটিয়েছেন আমাকে।
— আজ যেখানে নিয়ে যাব, সেটা তোমাদের কেরলের, ওই কী যে বলে, গডস ওন কান্ট্রিকে দশ গোল দেবে, বুয়েচো ?
বরিশাল এঁদের অবশ্যই, কিন্তু কেরল কী বাবদ পশ্চিমবঙ্গীয়দের হল, কে জানে। কথা বাড়ালাম না। গ্রামের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলেছে, একটু পরেই নামব। গুগলের কু–অভ্যাসে একটু জেনে ফেলেছিলাম, দেখেও ফেলেছিলাম আমাদের গন্তব্যের চেহারাটা। একটাই শব্দ মাথার চারপাশে বিন বিন করে ঘুরছিল – ভিমরুলি।
**
— ছেলে ছোকরা দিয়ে হবে না, বুড়ো চাই।
এক জায়গা থেকে আমরা ছোট নৌকোয় চাপব।
খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছব ভিমরুলিতে। সেখান থেকে ফের গাড়ি ধরে ব্যাক।
কথাটা বলা হল নৌকার মাঝি সম্পর্কে। কারণটা জানি, বয়স্ক মানুষের কাছে গল্পের স্টকটা বেশি, প্রাচীনের ফ্লেভারে ম ম করবে, এটা আন্দাজ করেছিলাম।
পেয়ে গেলাম পছন্দসই মানুষ, নৌকোয় উঠে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়লাম।
চাচা দড়ি টেনে জাপানি ইঞ্জিন চালু করে দিলেন, আমরা ভেসে গেলাম।
আমাদের তাড়া নেই, হেলে দুলে, দেখতে দেখতে, আড্ডা মারতে মারতে যাওয়া হবে।
দেখে নিলাম, ফোন–এ টাওয়ার টৈ টম্বুর। গ্রামীণ ফোন, কি সুন্দর নাম। বাংলাদেশে এটা একটা চমকপ্রদ ব্যাপার।
চোখে দেখে, ওই বাংলায় লেখা গাড়ির নাম্বার প্লেট বাদ দিলে চট করে সীমানার অপর পারে বাংলার তফাৎটা বুঝতে একটু সময় লাগে। কান খোলা রাখলে বোঝা যায় তাড়াতাড়ি, এদিককার মেজাজটা অন্য গোত্রের। বর্ডার পেরনো মাত্র হৈহৈ করে এসে পড়া কালচার শক দ্রুত মধুর হয়ে ওঠে। বুঝি, এটাই বাংলা, আমাদেরটা ঠিক নয়।
বড় নদীতে একটু এগিয়ে ঢুকে পড়লাম ছোট খাঁড়িতে। দু’পাশে বসতি, কাপড় ঝোলানো উঠোন, উদাস গরু, ছাগলছানাকে অস্থির করে তোলা দুষ্টু বাচ্চা, আমাদের এদিককার মতোই। তবে, সবই যেন জলের অনেক কাছাকাছি। পাশ দিয়ে একের পর এক নৌকো যাচ্ছে আসছে, ভর্তি সবজি, ফল, সাইকেল, মানুষ। ভালোই স্পিড, দারুণ দাপট। নৌকোর অনেক রকমফের আছে। নামও আছে, শুনছিলাম। নাক–গলুই। পিনিস। শুধু নৌকো দেখতেই আসা যায় এদেশে। ছোট থেকে শুনছি, চন্দ্রবিন্দুর গানেও আছে ‘আদরের সাম্পান।‘ সেই সাম্পান দেখতে অনেক বছর আগে দৌড়েছিলাম রাঙামাটি, কাপ্তাইতে। স্টিমারের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সারেংয়ের রান্নার রোমান্সের প্রসঙ্গটা এখানে আর তুলছি না।
মাথার ওপর দিয়ে সরে যাচ্ছে একের পর এক সাঁকো।
তার ওপরে সিল্যুটে মোটরবাইক, ছাতা মাথায় লোকজন।
বৃষ্টি হোক বা না হোক, ছাতাটি মাথায় রাখে অনেকে।
এই টিপটিপ করে বৃষ্টি, তো ওই সাদা মেঘ ফুটো হয়ে যাওয়া নীল আকাশ।
দুপাশে উথলে উঠছে সবুজ আর সবুজ।
**
চাচা হাল ধরে বসে আছেন, নৌকো চলছে নিজের মত, মুগ্ধ হয়ে জলে নিজের ছায়ার ভাংচুর দেখতে দেখতে। হাত বাড়িয়ে অনেকক্ষণ ডুবিয়ে জলে বিলি কাটলাম। যদি কোনও জলজ উদ্ভিদের স্পর্শ পাই।
আমরা প্রথম দিকে একটু আধটু কথা বলছিলাম, জিজ্ঞেস করছিলাম এটা কী ওটা কী।
মাঝি আপন মনে বলছিলেন অনেক গল্প। প্রথমে জায়গা চেনাচ্ছিলেন,স্থান মাহাত্ম্য বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
একসময় আমরা সবাই চুপ করে গেলাম, সিনেমাটা সাইলেন্ট হয়ে এল প্রায়।
পাশ দিয়ে যাওয়া নৌকোর ইঞ্জিনের শব্দ বা জলের কিনারায় ছোটদের দাপাদাপি কানে এলে একটু ঘোর কাটছিল।
যা দেখতে সবাই আসে, বিখ্যাত পেয়ারার বাজার, সবটাই জলে ভাসা, সেটা আর দূরে নয় আন্দাজ করা যাচ্ছিল।

থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেটের ব্যাপারে জানি, ছবি দেখেছি।
কাশ্মীরে ডাল লেকেও আছে।
তবে এখানকার চরিত্র আলাদা।
এই মুহূর্তে চারপাশের নৌকোয় শুধু টন টন পেয়ারা আর পেয়ারা।
লক্ষ লক্ষ টেনিস বলের মতো দেখাচ্ছে।
হলুদ, সবুজের যতরকম মাত্রা হয়, সব উপচে পড়ছে নৌকো থেকে।
চলছে হাঁকাহাঁকি, নিলামের ব্যাপার।
শুনেছি হিমাচলের আপেল বাগানে গিয়ে বাঙালি ট্যুরিস্ট বাগানে ঢুকে গাছের দিকে আঙুল তুলে ‘আপেল আপেল‘ বলে খুব চিৎকার চেঁচামেচি করে। না বলে দুম করে পেড়ে খাবার মতলব করে। স্থানীয় একজন দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আপনাদের আমবাগানে কেউ এমন করলে কেমন লাগবে বলুন?’
এখানে কী হয় জানি না। বিদেশিরা আসে তো বটেই।
আমরা একবার নৌকো থামালাম। একজন হাসিমুখে একগাদা পেয়ারা দিল, কিছুতেই দাম নিল না।
এমনিতেই বাংলাদেশে ইন্ডিয়ানদের প্রতি একটা অকারণ ভক্তির স্রোত বয়। আমরা যেমন করি আমেরিকানদের দেখলে। তবে পাশাপাশি যথেষ্ট আপত্তি ও উদ্বেগের ব্যাপার আছে। দু’দেশের রাজনৈতিক তরজা, পদ্মার জল, হাজারও ইস্যু।
আমি আগেও বাংলাদেশে এসেছি, অনেক জায়গায় ঘুরেছি। বরাবরই মনে হয়েছে এখানকার সর্বস্তরের মানুষের ভদ্রতা, আন্তরিকতা আমাদের চেয়ে বেশি।
পদ্মা, ইলিশ, মুজিব, মৌলবাদের প্যাকেজে আমরা এই দেশটাকে মুড়ে ফেলি নিজেদের ইচ্ছেমত।
এঁরা আমাদের সম্পর্কে ঠিক কী ভাবেন সেটা জানার কৌতূহল হচ্ছিল।
**
দুপুরের সূর্য হেলে পড়ল একদিকে। জলে আকাশের নীল আর রোদের সোনালী ডুরের ক্রমাগত বদলাতে থাকা ঢেউছবি দেখতে দেখতে খেয়াল হল, খাওয়া দাওয়া হয়নি।
লজ্জার মাথা খেয়ে চাচাকে বললাম সে কথা, উনিও একনাগাড়ে চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুই বলেননি।
এর মধ্যে আমরা শুনেছি যে ওঁর পরিবারে আর কেউ নেই, বৃদ্ধা মা ছাড়া।
শুনে বললেন ‘ভিমরুলিতে খাবেন, ভালো দোকান আছে।‘
একটু পরেই আবার বললেন, ‘ত্যাল শ্যাস।‘
এটাও জানালেন যে ভুল রাস্তায় চলে এসেছি।
রাস্তা কথাটা অদ্ভুত শোনাল। পাড়ে হাঁক পেড়ে কোন জল–গলিতে ঢুকলে সুবিধে হবে জেনে নিলেন, নৌকো ঘুরিয়ে চললেন আবার, গতি কমে এল, ভুকভুক করে চলছে এখন।
দু’পাশের অজস্র ফলের বাগানের মাথায় রোদের মুকুট দেখতে ইচ্ছে করছে না আর। খিদেটাও যেন মরে গেছে।
কলকাতার রক ফাটানো লোক আমি, এখন অথৈ জলে স্মার্টনেস বাষ্পীভূত। শুদ্ধদা চাপা স্বরে বললেন
— শ্যামবাজারের লোকও কিন্তু বাগবাজারে গুলিয়ে ফেলে।
— তেল কোথায় পাবেন? জিজ্ঞেস করলাম বিড়বিড় করে। ভাবতে ইচ্ছেও হল না, এখানে ফ্লোটিং পেট্রল পাম্প থাকে কি না। চাচা নির্বিকার মুখে সামনে ইশারা করে বললেন
— চায়ের দোকানে।
আবার শুদ্ধদার হিসহিসে উচ্ছাস শুনলাম, ‘সাব্বাশ‘! তেল পাওয়ার পরে চাচা বললেন,
— না পেলেও আপনাদের ভিমরুলি পৌঁছায়ে দিতাম। কোনও সমস্যা নাই।‘
এমনিতেই বাংলাদেশে ইন্ডিয়ানদের প্রতি একটা অকারণ ভক্তির স্রোত বয়। আমরা যেমন করি আমেরিকানদের দেখলে। তবে পাশাপাশি যথেষ্ট আপত্তি ও উদ্বেগের ব্যাপার আছে। দু’দেশের রাজনৈতিক তরজা, পদ্মার জল, হাজারও ইস্যু। আমি আগেও বাংলাদেশে এসেছি, অনেক জায়গায় ঘুরেছি। বরাবরই মনে হয়েছে এখানকার সর্বস্তরের মানুষের ভদ্রতা, আন্তরিকতা আমাদের চেয়ে বেশি।
এই ‘সমস্যা নাই’–টা বাংলাদেশের ট্রেডমার্ক মন্তব্য, ব্যবহার হয় অকাতরে।
মাঝে মাঝে শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। নির্বিকারত্বের সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ের মারাত্মক মিশেল, এই বরিশালেই সম্ভব।
এখানকার মানুষ ঢাকাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না, নিজের অঞ্চল নিয়ে গর্বে থাকে। কিছুটা যেতেই আরও একটা কংক্রিটের ব্রিজ চোখে পড়ল, অর্থাৎ বড় জায়গা।
এখানেও নৌকোর বাজার গমগম করছে।
জল-ছোঁয়া দোকানপাটের সাইনবার্ড দেখে বুঝলাম, ভিমরুলি পৌঁছে গেছি। নৌকো যাত্রা সাধারণত এখানেই শেষ হয়, ট্যুরিস্টরা খাওয়াদাওয়া সারে। সারাদিন ধরে অভুক্ত রাখা চাচা কে পাশে বসিয়ে সাধ্যমত খাওয়ালাম। শেষে জিজ্ঞেস করলাম,
— আর কী খাবেন‘?
— মিষ্টি বলেন।
মিষ্টি এল, নিজে খেলেন না। দোকানের মালকিনকে ডেকে বললেন,
— দুইটা রসগোল্লা প্লাস্টিকে দিয়েন। তারপর আমাদের জানালেন ‘মা খাবে।‘
প্লেটের ওপর পড়ে থাকা এক দু’টো ভাতের দানা নিয়ে অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে খেয়াল করলাম, আমাদের গাড়ি এসে গিয়েছে। টাকাকড়ি আগেই মিটিয়ে দিয়েছিলাম।
গাড়িতে ওঠার সময় আমরা যেখানে খেলাম, সেই দোকানের নামটা দেখতে পেলাম।
ভাসমান বৌদির হোটেল।
শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।
খুবই চমত্কার বর্ণনা,অপূর্ব
শুভময়দাকে চিনতাম ওঁর তোলা ছবির মাধ্যমে । এখানে দেখছি উনি শব্দ দিয়ে ছবি এঁকেছেন । ভালোবাসা ।
কেরলের জলপথঅলিগলি ঘুরে এসে ফেবুতে লেখা নামিয়েছিলাম, ভালোবেসে ভাসমান । বন্ধুদের বাহবায় মাটিতে পা পড়তেই চায় না !
আজ এই লেখা পড়ে নিজের লেখা মনে হচ্ছে খোলামকুচি ।
শুধু কিবোর্ডের ঠকঠক বা কলমের ঘসঘস না । সাটারের শব্দ শোনার জন্যও হয়ে রইলাম উন্মুখ ।
ভালো থাকবেন ।
দারুণ
শিকড়ের খোঁজে গিয়েছিলাম বরিসাল। হাতে সময় ছিল বড় কম। এই লেখা পড়ে আরও একবার যাবার ইচ্ছেটা বেড়ে গেল।
খুব ভালো লাগলো।