অ্যাংরি ইয়ং ম্যান। এক্কেবারে টকটকে লাল রাগি যুবকের চেহারা। ঝাঁঝাঁলো, তীব্র, জেদি। বাইরেটা এমন হলেও স্বাদগুণে খুব সহজেই মানুষের মন জয় করে নেয় সে! অতি স্বল্প উপকরণেই স্বচ্ছন্দ। হাজারও আয়োজনের দরকার পড়ে না। আর এইটাই অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের ইউএসপি। পদ্মায় ভাসমান স্টিমারযাত্রীরা তো বটেই, দুই বাংলার আপামর মানুষজনের হৃদয়হরণ করেছে ঐতিহাসিক এই চরিত্র। নাম? গোয়ালন্দ স্টিমার কারি। মতান্তরে স্টিমার ফাউল কারিও বলা হয়ে থাকে।

আমি কখনও এই স্টিমারে চড়িনি। মাঝিমাল্লাদের হাতের ‘তার’ আর মশলার ম্যাজিক চেখে দেখার সুযোগও হয়নি। কিন্তু যেহেতু রাঁধতে ভালোবাসি, বিভিন্ন রান্নার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসি, তাই নানা তথ্য ঘেঁটে, বাংলাদেশের বন্ধুদের থেকে শুনে যা আহরণ করেছি, তারই ভিত্তিতে এই লেখা। কোনওরকম অথেন্টিসিটির দাবি রাখি না। আমি মনে করি রান্নার কৌলীন্য স্বাদে। আর তার সঙ্গে একটু কমন সেন্স মিশিয়ে নিলে তার যুক্তিগ্রাহ্যতা অনেকটাই বেড়ে যায়।

Goalondo Steamer Curry
আমার রান্না গোয়ালন্দ স্টিমার কারি।

ভোগৌলিক ইতিহাস বলে, ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ রেলপথে যাতায়াত ছিল। উনিশ শতকের শেষদিকেই শিয়ালদহ থেকে পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৮৭১ সালে সেই রেলপথই এগিয়ে যায় গোয়ালন্দ পর্যন্ত। সেখানে ট্রেন থেকে নেমে স্টিমারে আর স্টিমার থেকে নেমে ট্রেনে চড়ে দুই বাংলার অন্দরে যাতায়াত করতেন সাধারণ মানুষ। নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, এমনকি বর্মা অঞ্চলে যেতে হলেও যাত্রীদের পদ্মাপাড়ে এই গোয়ালন্দ ঘাট থেকেই স্টিমার ধরতে হত। আর সেই দীর্ঘ জলপথেই পরিবেশিত হত এই অসামান্য মুর্গির ঝোল। যে সে ঝোল নয়! এ এমনই এক পদ, যে তার স্বাদে, বর্ণে, গন্ধে, সহজ স্বাভাবিকতায়, পাকশৈলির ইতিহাসে এক কায়েমি জায়গা করে নিয়েছে। স্টিমারের খালাসিরা নিজেদের জন্যই মূলত তৈরি করতেন এই কারি। যদিও পরে স্টিমারঘাটার ভাতের হোটেলেও একচেটিয়া জায়গা করে নেয় এই পদ। শোনা যায়, ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পদ্মার সমস্ত স্টিমারযাত্রীকে খাওয়ানো হয়েছেল গোয়ালন্দ স্টিমার কারি আর ভাত!

Goalondo
গোয়ালন্দের ঘাটে স্টিমারের সারি। ছবি সৌজন্য – facebook.com

আদত চেহারাটা কেমন ছিল সেই কারির? টকটকে লাল ঝোলে ভাসমান লাল-সবুজ লঙ্কা, পেঁয়াজকুচি, রসুনকুচি, আদাকুচি আর সরষের তেলের ঝাঁঝালো উপস্থিতিতে মুর্গির টুকরোরা স্বমহিমায় বিরাজমান। আবার এই রগরগে মেজাজকে ব্যালেন্স করতেই যেন ঝোলের মাঝে নিরীহ গোল আলুর আগমন! পুরনো বাংলা ছবির জীবেন বসুকে মনে পড়ে? ভালো বন্ধু, দাদা জাতীয় মুশকিল আসানের চরিত্রে অব্যর্থ ছিলেন তিনি। সর্বদাই সবকিছু সামলানোর দায় পড়ত তাঁর উপর। গোয়ালন্দ স্টিমার কারিতে এদিক ওদিক ভেসে বেড়ানো আলুর চরিত্রও ঠিক তেমনই!


কী করে রাঁধবেন গোয়ালন্দ স্টিমার কারি? 

উপকরণ – মুরগি ৫০০ গ্রাম, আলু – তিনটে (দু’টুকরো করা), পেঁয়াজ তিনটে, রসুন দশ বারো কোয়া, আদা এক ইঞ্চি, বড়ো কাঁচালঙ্কা পাঁচ ছটা, শুকনোলঙ্কা দু’তিনটে, হলুদ এক চা চামচ, নুন স্বাদমতো, সরষের তেল পরিমাণমতো, কুচো চিংড়ি – ১০০ গ্রাম (থেঁতো করা)।

প্রণালি – মাংস আর আলু ভালো করে ধুয়ে সব উপকরণ একসঙ্গে দিয়ে মেখে নিন। আঁচে কড়াই বসিয়ে মশলামাখা মাংস ও আলু দিন। ভালো করে নাড়াচাড়া করে, মাঝারি আঁচে ঢাকা দিয়ে দিন। প্রয়োজনে জল দিন। মাংস সুসিদ্ধ হয়ে এলে ঝোল ঝোল থাকতেই নামিয়ে নিন।


গোয়ালন্দ স্টিমার কারির অনবদ্য স্বাদের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। সাধে কী আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসেছিলেন তাকে? খাদ্যরসিক সৈয়দ মুজতবা আলি পর্যন্ত বারবার একে মনে করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। কে ভুলতে পারে ‘নোনাজল’ গল্পে তাঁর বর্ণনা – “সেই গোয়ালন্দ চাঁদপুরী জাহাজ। ত্রিশ বৎসর ধরে এর সঙ্গে আমার চেনাশোনা। চোখ বন্ধ করে দিলেও হাতড়ে হাতড়ে ঠিক বের করতে পারব, কোথায় জলের কল, কোথায় চা-খিলির দোকান, মুর্গীর খাঁচাগুলো রাখা হয় কোন জায়গায়। অথচ আমি জাহাজের খালাসী নই-অবরের-সবরের যাত্রী মাত্র । ত্রিশ বৎসর পরিচয়ের আমার আর সবই বদলে গিয়েছে, বদলাইনি শুধু ডিসপ্যাচ স্টীমারের দল। এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনো আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই। কীরকম ভেজা-ভেজা, সোঁদা-সোঁদা যে গন্ধটা আর সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুর্গী-কারি রান্নার। আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সমস্ত জাহাজটাই যেন একটা আস্ত মুর্গী, তার পেটের ভেতরে থেকে যেন তারই কারি রান্না আরম্ভ হয়েছে। এ-গন্ধ তাই চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, যে-কোন স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই পাওয়া যায়।”

Goalondo Steamer Curry
ঝালই মূল স্বাদ স্টিমার কারির। কিন্তু সে ঝালকে ব্যালেন্স করে ঝোলে ভাসানো আলুর টুকরো। ছবি – লেখক।

বলুন তো কী আছে এই রাগি যুবকের অন্তরে, যা কেউ উপেক্ষা করতে পারে না?

আমি নিজে রেঁধে দেখেছি, সত্য়িই অনন্য এর স্বাদ। মুর্গির ঝোল তো কতই হয়। কিন্তু বারবার এই রাগি যুবকের কাছেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। তার চড়া মেজাজের সঙ্গে কোথায় যেন মিশে রয়েছে এক স্নিগ্ধতাও। ঝাল এই রান্নার বৈশিষ্ট হলেও ঝালের চোটে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে যায় না কখনওই। কোনও বাটা মশলার ব্যবহার হয় না স্টিমার কারিতে। শুধুই কুচনো মশলা। কোনও শৌখিন উপকরণেরও ব্যবহার নেই। স্টিমারে মাঝিদের কাছে যা সহজলভ্য, তা-ই দিয়েই কম সময়ে রেঁধে ফেলা যায় স্টিমার কারি। আর তাই দিয়ে একথালা গরম গরম সাদা ভাত ভোজবাজির মতো নিমেষে উধাও।

Goalondo Steamer Curry
খোদ কবিগুরুও মজেছিলেন এই রান্নার স্বাদে। ছবি সৌজন্য – bbc.co

আমার স্বাদকুঁড়ি বলে, স্টিমার কারির অসামান্যতা লুকিয়ে আছে এর ঝাঁঝ এবং সারল্যের বৈপরীত্যে। আর আছে লুকনো একটি তুরূপের তাস। কুচো চিংড়ি বাটা! এক চাপানের রান্না এই স্টিমার কারিতে মাংসে সব কুচো মশলা, নুন, সরষের তেল আর সামান্য চিংড়ি বাটা মেখে রান্না করা হয় এই পদ। তবে এই কুচো চিংড়ি মেশানো নিয়ে আবার নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন এই প্রণালি অথেন্টিক নয়। কেউ বলেন চিংড়ি ব্যবহারের এই বিলাসিতা কোথায় পাবে স্টিমারের মাঝিরা? আমি বলি, জলে ভেসে থাকা মাঝিমাল্লাদের কাছে কুচো চিংড়ি বিলাসিতা হতে যাবে কোন দুঃখে? অর্থাৎ আমার কমন সেন্স আমাকে তা-ই ভাবাচ্ছে। তবে ওই যে গোড়ায় বলে নিয়েছি, অথেন্টিসিটি নিয়ে কোনও যুদ্ধে নামতে রাজি নই। আমি বুঝি খাবারের স্বাদ। আর এই স্টিমার কারির স্বাদ এমনই জোরদার যে এখনকার বিস্বাদ, বিদঘুটে, রাক্ষুসে সাইজের চিকেন, যাকে দেখে কোনও শ্রদ্ধাভক্তি জাগে না, ঝোল রান্নার কথা তো দূর অস্ত্, সে হেন বিস্বাদ মুরগিও কী সুন্দর বর্ণে গন্ধে স্বাদে আহ্লাদে সেজে ওঠে এই অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের সাহচর্যে।

একে কুর্ণিশ জানাবেন না!

সাংবাদিক, প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যসমালোচক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সানন্দা পত্রিকা। যদিও কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল দর্শনের অধ্যাপনা দিয়ে। পরে প্রাণের তাগিদে সাংবাদিকতাকেই পাকাপাকি ভাবে বেছে নেন। অবসর নেওয়ার পরও তুমুল ব্যস্ত। রান্নাবান্না, বেড়ানো, সাজগোজ নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, ভালো সিনেমা দেখতে আর খাওয়াতে। নিবিড় ভাবে বিশ্বাস করেন ভালো থাকায়, জীবনের রোম্যান্টিকতায়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *