সম্প্রতি ফিরোজ খানকে নিয়ে গণমাধ্যম তোলপাড়। না, তিনি বলিউডের তারকা নন।
তিনি একজন তরুণ অধ্যাপক, সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিরোজ আচার্য হওয়ার পর অর্থাৎ এমএ পাশ করার পর পিএইচডি করেছেন জয়পুর থেকে। অধ্যাপনার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়ে বারাণসী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে সহকারী অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছেন। ফিরোজ ভারতীয় নাগরিক।
একদল লোক আপত্তি তুলেছে ফিরোজকে তাঁরা বারাণসীতে পড়াতে দেবেন না। কী কারণ? ফিরোজ ধর্মে মুসলমান। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো?
হ্যাঁ, এও ‘যুক্তি’ হতে পারে আজকের ভারতবর্ষে। এবং কী আশ্চর্য, রাজ্য সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও কেষ্টবিষ্টু ফিরোজের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন না। ক্ষমতাধররা আপত্তিকারীদের বলছেন না যে তোমরা অন্যায় করছো! তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ফিরোজকে কাজ করতে দাও। না, কেউ বলছেন না। হ্যাঁ, এটাই আজকের উত্তরপ্রদেশ, এটাই আমাদের দেশ ভারতবর্ষ!
এবং এ নিয়ে লিখতে গিয়ে উদারপন্থীদের বলতে হচ্ছে, অমুক সময় তমুক খ্রিস্টান, অমুক মুসলমান সংস্কৃত পড়িয়েছেন। বলতে হচ্ছে, একজন ব্রাহ্মণকন্যা আরবি পড়াতেন, এ নজিরও আছে এই দেশে। এই সব উদাহরণ টেনে আনাও লজ্জার!
কেশবচন্দ্র সেনের মিশনারিতে হিন্দু ধর্ম পড়াতেন সুফি ওয়াজিদ আলি, ইসলাম ধর্ম পড়াতেন গিরীশচন্দ্র সেন, খ্রিস্ট ধর্ম প্রতাপচন্দ্র মজুমদার আর বৌদ্ধ ধর্ম পড়াতেন অঘোর গুপ্ত। সেটা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দী। এবং ঠাকুর রামকৃষ্ণ সুফি সাধনা শিখেছিলেন ওয়াজিদ আলির কাছে।
না, হিন্দু ধর্মের তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি, বরং তার সহিষ্ণুতার চেহারা প্রকট হয়েছে। গিরীশচন্দ্রের অনূদিত কোরান অশুচি অবস্থায় স্পর্শ করেন না ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাঁরা ভালবেসে সেন মশাইকে বলেন ‘ভাই গিরীশচন্দ্র’।
এই সমস্যা আদপেই সামাজিক সমস্যা নয়। এ হল আদ্যান্ত রাজনৈতিক সমস্যা। যে ঘৃণ্য রাজনীতির আমদানি মাত্র কয়েক দশক। অবশ্য সে রাজনীতি ঘুমন্ত ছিল বহু কাল।
ফিরোজ খানের পিতা রমজান খান সংস্কৃত ভাষার স্নাতক, তাঁর পিতামহও সংস্কৃত ভাষা জানতেন। ভাইও পড়েন এই ভাষাই। পিতা হলেন ভজন গায়ক, তিনি গোশালা রক্ষণাবেক্ষণও করেন। এমন ‘মিত্র’ মুসলমানকে তো পছন্দ করার কথা ছিল আপত্তিকারীদের! যে মুসলমান ‘হিন্দু’ ঐতিহ্য পালন করে থাকেন।
সমস্যা এত হালকা নয়
সমস্যার মূল আরও গভীরে প্রোথিত। এই হিন্দুত্ব আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী, যেখানে কোনও অব্রাহ্মণ বেদ পড়বেন না, পড়ানো তো দূর অস্ত! এ সেই রামরাজ্য যেখানে ফিরোজ খান আসলে শম্বূক। অবশ্য শম্বূক হত্যার বিষয়টি পরবর্তী সংযোজন বলে পণ্ডিতদের ধারণা। সে তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী?
না, এর থেকে ফেরার কোনও রাস্তা নেই। ফেরার যে রাস্তা ছিল তাও সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমাদের চালনা করে যে শক্তি সে তো জ্ঞান বুদ্ধি বা যুক্তি নয়, এমনকি স্বাভাবিক ন্যায্যতার ধারও ধারি না আমরা। নইলে বাংলার শিক্ষক যখন বৈষ্ণব পদাবলী পড়ান তখন কেন দেখতে যাই যে তিনি মুসলমান কিনা! ইসলামের ইতিহাস পড়ান যে ইতিহাসের শিক্ষক তিনি কি হিন্দু, এই প্রশ্ন তুলেছি কি এতকাল? খ্রিস্টীয় দর্শন বা বৌদ্ধ দর্শন কারা পড়ান? ম্যাক্স মুলর কেন ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্রের চর্চা করেছিলেন? পরাগল খাঁ কেনই বা অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের!
যে দেশে কল্পনা কিংবা মহাকাব্যের নায়কের জন্মস্থান পরাজিত করে ইতিহাসকে, যে ভূমির আইনে যুক্তির উপরে স্থান পায় বিশ্বাস, সেখানে ফিরোজ খানকে সংস্কৃত পড়াতে দেওয়া হবে না এবং কেন তিনি বৈদিক সাহিত্য পড়াবেন, এমন সব প্রশ্ন তোলা সহজ এবং তার ‘বৈধতা’ পাওয়া আরও সহজ। কোন দিন শুনব, উত্তরপ্রদেশে এত এত যে শিশু মরছে তার কারণ ওই অব্রাহ্মণদের বেদপাঠ। সত্যি তো, রাজ্যে অধর্ম না হলে শিশু মরবে কেন! এখন রামরাজত্বের সৈন্যসামন্ত সব সদা সতর্ক। শম্বূক খুঁজছেন তাঁরা!
কিন্তু মান্যবরেরা, এই দেশে কজন হিন্দু শুদ্ধ সংস্কৃত জানেন, কজনই বা জানেন বৈদিক শাস্ত্রসমূহের নিবিড় অর্থ! কজন পড়েছেন মহাভারতের লক্ষাধিক শ্লোক এবং তার টীকা টিপ্পনি! বেশির ভাগই পড়েননি এবং সেটা দোষেরও নয়। কিন্তু যাঁরা সারস্বত চর্চা মগ্ন থেকে এইগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, বজায় রাখছেন গুরুকুল পরম্পরা—সেই সব চর্চাকারীদের ধর্ম কী, তাঁরা কী আদৌ অধিকারী এই সব পড়ার বা পড়ানোর, সেই প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা ওই আকাট মূর্খদের হয় কী করে? বিশ্বামিত্র অব্রাহ্মণ থেকে ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন, শূদ্র মাতঙ্গ হয়েছিলেন দেবতা—এও তো মহাকাব্যের শিক্ষা। প্রশ্ন হল, কোন শিক্ষা আমরা নেব? কে ঠিক করে দেয় সেটা?
রাজনীতি। নেতা। সংখ্যাগুরুকে ধর্মীয় অচলায়তনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে ধর্ম-ধর্ম রাজনীতির উদয় হয়েছে আজকাল তা সব থেকে ক্ষতি করছে সংখ্যাগুরু সমাজের। এই সত্যটি আমরা কবে বুঝবো! যত দেরি হবে তত অমঙ্গল এই দেশের, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু উভয়ের।
শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।