কোনও স্মৃতিকথা লেখেননি। এমনকি কর্মজীবনের টুকরো অভিজ্ঞতাও নয়।
কিন্তু কর্মজীবনকে এমনই নানা সৃষ্টি কর্মে ভরিয়ে রেখেছিলেন যে নিজের সম্পর্কে কিছু লেখার কথা মনেই হয়নি।
তাঁর অবসর জীবনও ছিল সৃষ্টিবৈচিত্র্যে ভরপুর। আমৃত্যু।
মানুষটি আমাদের কলকাতা বেতারের পুরোধা পুরুষদের একজন, দীপনারায়ণ মিঠোলিয়া (১৯১৯-২০০৩), যাঁর হিন্দি ও উর্দু অনুষ্ঠান সারা দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
অনুষ্ঠান বলতে শুধু তাঁর প্রযোজিত অনুষ্ঠান নয়, তাঁরই লেখা, তাঁরই বিন্যাস, বেশিরভাগ সময়ে তাঁরই উপস্থাপনা।
এতেও ঠিক বোঝানো গেল না। তিনি ছিলেন গীতিকার, অনুবাদক, নাট্যকার, নাট্য প্রযোজক, বেতারের নানা আসরের পরিচালক।

বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র দীপনারায়ণ যখন হিন্দিতে সাহিত্যালঙ্কার সম্মান নিয়ে কলকাতা বেতারে কাজ করতে এলেন, তখন তাঁর বয়স পঁচিশ। ১৯৪৩ সাল। ১, গারস্টিন প্লেসের অফিসে তিনি নাট্যশিল্পী, উপস্থাপক এবং কপিরাইটার হিসেবে নিযুক্ত হলেন। স্বাধীনতার পর হিন্দি ও উর্দু অনুষ্ঠানের জন্য তিনি একের পর এক সহকারী প্রযোজক ও প্রযোজক পদে উন্নীত হয়েছেন। কিন্তু প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ কি শুধু পদাধিকারের বাঁধা কাজটুকুর সীমায় নিজেকে আটকে রাখতে পারেন?
দীপনারায়ণও পারেননি।
অনেকেরই মনে পড়বে আকাশবাণীতে পঞ্চাশ-ষাট দশকের ‘সুগম সংগীত’, ‘রম্যগীতি’, ‘সুর ও বাণী’ অনুষ্ঠানের কথা।
এইসব অনুষ্ঠানে অনেক গানই দীপনারায়ণ মিঠোলিয়ার লেখা। ঘোষণায় সব সময় গীতিকারের নামও বলা হত না। তাঁর গানে সুর দিয়েছেন প্রখ্যাত সুরকারেরা। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান, ‘থকে পাঁও, লেকিন বহুৎ দূর যানা – আশিয়ানা।’ গায়ত্রী বসুর গাওয়া ‘ময়ূরী নাচ মগন নাচ’, আবার সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের নিজের সুরে ‘হসকা জিন্দগি হ্যায়, রোনেকো হ্যায় জাঁহা’ – গানগুলির কথা অনেকেরই মনে পড়বে। সুধীন দাশগুপ্তর সুরে গাওয়া দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘ভাঙা তরী শুধু এ গান’, তাঁরা ভুলতে পারবেন কী? এই গানেরই হিন্দি: ‘টুটে দিল কি ইয়েহি হ্যায় গান’ – এরকম কত গান আমরা প্রাণভরে শুনেই গেছি, কিন্তু গীতিকারের নাম জানতে পারিনি। দু’একবার বলা হয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু কতটাই বা মনে রেখেছি।

বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র দীপনারায়ণ যখন হিন্দিতে সাহিত্যালঙ্কার সম্মান নিয়ে কলকাতা বেতারে কাজ করতে এলেন, তখন তাঁর বয়স পঁচিশ। ১৯৪৩ সাল। ১, গারস্টিন প্লেসের অফিসে তিনি নাট্যশিল্পী, উপস্থাপক এবং কপিরাইটার হিসেবে নিযুক্ত হলেন। স্বাধীনতার পর হিন্দি ও উর্দু অনুষ্ঠানের জন্য তিনি একের পর এক সহকারী প্রযোজক ও প্রযোজক পদে উন্নীত হয়েছেন। কিন্তু প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ কি শুধু পদাধিকারের বাঁধা কাজটুকুর সীমায় নিজেকে আটকে রাখতে পারেন?

এরকম অসংখ্য গান লিখেছেন দীপনারায়ণ, নিজেও তা সংরক্ষণ করেননি, তার পূর্ণ তালিকাও নেই। আকাশবাণীর আর্কাইভে নিশ্চয়ই কিছু থাকতে পারে, কিন্তু তা মনে রেখে, নির্বাচন করে, গীতিকারের পরিচয় শ্রোতাদের সামনে রেখে ক’টাই বা পরিবেশন করা হয়? শিল্পী ও সহকর্মী মহলে তিনি ছিলেন সকলের মিঠুদা। তাঁর বেশ কিছু গান স্বরলিপি-সহ বেতারজগৎ পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। একটা গান তো মনেই পড়ছে: ‘জীবনকে সুনেপন মে / খোয়া হ্যায় মেরা মন / চুপকে চুপকে তড়পা হ্যায় / রোয়া হ্যায় মেরা মন।’ সুর দিয়েছিলেন সুরেন পাল। এটা ‘রম্যগীতি’-র গান। দীপালি নাগের গাওয়া: রঙবে জবা কে পাইয়াঁ লাগুঁ / লাগে মোরি উমরিয়া রে, / সাঁবরিয়া কে সাবর রঙ্গমে / রঙ্গ দে মোরি চুনারিয়া রে।

Deepnarayan Mitholia
মজদুরমণ্ডলীর আউটডোর রেকর্ডিং-এর ছবি। লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

দীপনারায়ণের গানের তালিকা যেমন দীর্ঘ, তেমনি সেসব গানের সুরকারেরও। গানের কথাই ছিল এমন মন মাতানো, যে কথা হাতে পেলেই যেন সুর গুনগুনিয়ে উঠত। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, সতীনাথ শুধু নন, ভি বালসারা, ভূপেন হাজারিকা – এমন অনেকেই তাঁর গানে সুর দিয়েছেন। বিজনবালা ঘোষদস্তিদার, উৎপলা সেন-সহ অনেক বড় বড় গাইয়েরাই গেয়েছেন তাঁর গান। আর ছায়াছবির জন্য লেখা গানের কথা বললে তো আরও অনেক শিল্পীর নাম এসে যাবে। গত শতাব্দীতে বেতারের পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক যাঁদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল, তাঁরা মনে করতে পারবেন দীপনারায়ণের নানা সৃষ্টিকর্মের কথা।
লিখেছেন বাংলা গানও। যেমন, ‘মনে হয় মুঠো ভরে / আকাশকে নিই ধরে’ অথবা ‘জানি ঝড় উঠবে আমার ভালোবাসার জীবনে / তবে কেন ভেবে ভেবে মরি বসে অকারণে।’ আবার ভি বালসারা যে বাংলা গানে সুর দিয়েছেন, তার একটি ‘পারি গো পারি গো ভালবাসতে / আমিও পারি গো ভালবাসতে / কেঁদেছি যে কত রাত আর কত দিন / এখন যে দিল চায় হাসতে।’ গীতিকার হিসেবে তাঁর অনায়াস স্বভাবকবিত্বের টান, বম্বের সুরকারদেরও টেনেছিল। আমন্ত্রণ ছিল বম্বেতে গিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু আকাশবাণী ছেড়ে কখনও কোথাও যেতে চাননি মিঠুদা।

কলকাতায় বসেই যে সব ছায়াছবির জন্য তিনি গান লিখেছেন, সেগুলি হল, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, ঝিন্দের বন্দি, চিকমিকি বিজলি, চামেলি মেমসাহেব, এই পৃথিবী পান্থশালা, বীর পরশুরাম, জয় জগন্নাথ, বনবাসর, শহিদের ডাক, আজ কা রবিনহুড। এইসব ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, আলি আকবর খান, ভূপেন হাজারিকা, রাজেন সরকার, রঘুনাথ পানিগ্রাহী, অধীর বাগচি, নীতা সেন, তপন সিংহের মতো শিল্পীরা।
শুধু কী তাই!
হিন্দি মঞ্চ নাটকের জন্যও লিখেছেন গান। সেই নাটকগুলি হল সমাজ, অমর সিং রাঠৌর, পরিস্তান, মাঠা মাখন। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ডে সতীনাথ ও উৎপলার গাওয়া (সুর সতীনাথ) তাঁর লেখা দেহাতি গীত ‘হায়রে বিদেশিয়া’, ‘পিয়া রোয়া ঘরোয়া নাহি মোর’ স্মরণীয় হয়ে আছে।

দীপনারায়ণের গানের তালিকা যেমন দীর্ঘ, তেমনি সেসব গানের সুরকারেরও। গানের কথাই ছিল এমন মন মাতানো, যে কথা হাতে পেলেই যেন সুর গুনগুনিয়ে উঠত। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, সতীনাথ শুধু নন, ভি বালসারা, ভূপেন হাজারিকা – এমন অনেকেই তাঁর গানে সুর দিয়েছেন।

শুধু গীতিকার বললে তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে দেশের সমস্ত বেতার কেন্দ্র জুড়ে যে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা হয়েছিল, তার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তখন তাঁরই অনূদিত রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি গান ও নাটক দেশ জুড়ে পরিবেশিত হয়। পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেক বড়ো বড়ো গাইয়েই গেয়েছেন সেই গান। হিন্দিভাষী শ্রোতাদের অনেক কাছে নিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘মেবার পতন’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (হিন্দি নাট্যরূপ), তারাশঙ্করের ‘বিচারক’ নাটকের রূপান্তর ‘ন্যায়াধীশ’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রামমোহন’, বিধায়ক ভট্টাচার্যর ‘ডাকপিয়ন’ (ডাকিয়া), সত্যজিৎ রায়ের ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ (সেপ্টোপাস কা ভুখ) ও বনফুল (কানুন), কিরণ মৈত্র (বুলবুলা) দের নাটক অনুবাদ করেছেন বা গল্পের হিন্দি নাট্যরূপ দিয়েছেন এবং নিজে সেইসব নাটক প্রযোজনা করেছেন। তাঁরই করা ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র হিন্দি রূপান্তর পৌঁছে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

নানা সাময়িক পত্রপত্রিকায় নিয়মিত গল্প উপন্যাস লিখেছেন দীপনারায়ণ। ‘সন্মার্গ’ হিন্দি দৈনিকে লিখেছেন ধারাবাহিক উপন্যাস। ১৯৭৯ সালে আকাশবাণী থেকে অবসর গ্রহণের পর, গল্প উপন্যাসে মন দিয়েছিলেন বেশি। একই সঙ্গে কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম যুগে দীপনারায়ণ অনেক হিন্দি অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। অনুবাদের গুণে অবসরের পর তিনি বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্যও ফরমায়েসি কাজ করেছেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতোই তাঁর একাধিক ছদ্মনাম ছিল। কখনও শ্রীদীপ, কখনো দীপ দাহেলাভি।
একবার দীপনারায়ণের প্রযোজনায় হিন্দি নাটকে স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং করতে এসেছিলেন পাহাড়ি সান্যাল, গীতা দেবী ও আরও অনেকে। কথাবার্তার ফাঁকে পাহাড়ি সান্যাল দীপনারায়ণকে বলে উঠলেন, ‘আপনি হিন্দিটা বেশ ভালো বলেন তো।’ কিন্তু তিনি বোধহয় তখনও জানতেন না, একটি ছবিতে (রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত) সুচিত্রা সেনকে হিন্দি উচ্চারণ শেখানোর জন্য দীপনারায়ণেরই ডাক পড়েছিল।

Deepnarayan Mitholia
সংবাদপত্রের ছবিতে – স্বপ্না ঘোষ (মাঝে), ভি বালসারা ও দীপনারায়ণ (ডানদিকে)। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ দিকে কলকাতা কেন্দ্রের অধিকর্তা ছিলেন পি. বি. কৃষ্ণমূর্তি। সংগীতের ভিতরঘরের মানুষ। তিনি ভার দিলেন দীপনারায়ণকে, ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে গান লেখার। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ভারততীর্থ’। প্রতিটি রাজ্যে সেই অনুষ্ঠান প্রশংসিত হয়েছিল। আগেই বলেছি, স্বভাবকবিত্বের গুণ ছিল তাঁর। সেই জন্যেই সময়ের দাবিতে চটজলদি শুধু গান নয়, লিখতে পারতেন গীতি আলেখ্যও। কবি হিসেবেও সমীহ আদায় করেছিলেন হিন্দি সাহিত্যিক মহলে। সারা ভারত কবি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে কবিতা পড়েছেন, যেখানে উপস্থিত থেকেছেন খোদ হরিবংশ রাই বচ্চন, ফৈয়াজ আহমেদ ফৈয়াজ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কবি। আবার কবি মহাদেবী ভার্মা, তেনজিং নোরগের মতো ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নেবার ভারও পড়েছে তাঁরই ওপর।

নানা সাময়িক পত্রপত্রিকায় নিয়মিত গল্প উপন্যাস লিখেছেন দীপনারায়ণ। ‘সন্মার্গ’ হিন্দি দৈনিকে লিখেছেন ধারাবাহিক উপন্যাস। ১৯৭৯ সালে আকাশবাণী থেকে অবসর গ্রহণের পর, গল্প উপন্যাসে মন দিয়েছিলেন বেশি। একই সঙ্গে কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম যুগে দীপনারায়ণ অনেক হিন্দি অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। অনুবাদের গুণে অবসরের পর তিনি বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্যও ফরমায়েসি কাজ করেছেন।

যখন তিনি মজদুরমণ্ডলীর আসর পরিচালনা করতেন, তখন শ্রমজীবী শ্রোতাদের কাছে ‘ভাইয়া’। আবার হিন্দি শিক্ষার আসর পরিচালনার সময় তিনি ভাষাবিদ। সংস্কৃত, ফার্সি-সহ অনেকগুলো ভাষা জানতেন। বেতারে সংস্কৃত নাটক প্রযোজনার সময় তিনি অনেকবারই বাণীকুমারের সহায়তা করেছেন। রবীন্দ্রগানের হিন্দি অনুবাদে দীপনারায়ণের বড়ো ভক্ত ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। তিনি কবির একটি গানের অনুবাদ চেয়ে দীপনারায়ণকে যে চিঠি লিখেছেন, তা দিয়েই অনুমান করা যায়, রবীন্দ্রনাথের গানের অন্তঃস্থিত ধ্বনিটি কতখানি আত্মস্থ করতে পারতেন দীপনারায়ণ। কারণ গানের ভাব ও ভাবার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে সুরের খাঁচার মধ্যে শব্দবন্ধের বয়ন, অনুবাদের ক্ষেত্রে এক বিশেষ কুশলতা। পঙ্কজকুমারের চিঠিটি এখানে রাখছি-


12.3.1974

Preetibhajan Deepnarayanbabu parahitokameshu,

Namaskar, Hope you are hale and hearty. Selfish or self-interested man as I am I take the undue advantage of asking your gentle Self as to whether the Hindi translation or version (as it may be termed) of Rabindranath’s “Tomar Surer Dhara Jethay Jharay Tarri Paray” has been completed by you. If it is done by your intellectual Self. I shall remain much obliged to you if the composition can be handed over to my nephew Shri Sarat Kumar Dutta, the bearer hereof.
I beg to be excused the trouble I give you from time to time, with no benefit to your benedictory Self.
Thanking you ever So much.

Yours preetidhonyo
Pankaj Mullik


 

এই চিঠি পড়ে বোঝা যায়, শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের এই গানটি নয়, এর আগেও দীপনারায়ণের বেশ কয়েকটি অনূদিত গান পঙ্কজকুমার গেয়েছেন। সেইসব গান কি আছে কোথাও কোনও সংগ্রহে? বেতারের নিজস্ব সংগ্রহেই তো সবার আগে থাকার কথা। কিন্তু আছে কিনা সন্দেহ। প্রসঙ্গত আরও একটা কথা মনে হয়, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে শুধু দীপনারায়ণ নয়, কবির যত অনুবাদ কাজ এবং তা ভিত্তি করে যত অনুষ্ঠান হয়েছে, তা কি আজ আর আছে, আকাশবাণীর নিজস্ব সংগ্রহে? আরও মনে পড়ে কালিম্পং বেতারকেন্দ্র স্থাপনের সময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পঙ্কজ মল্লিক আকাশবাণী-কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতাটি (‘ধরার আঙিনা হতে উঠিল ঐ আকাশবাণী’) সুর দিয়ে পরিবেশন করেছিলেন। এই গানটিই যে তিনি সেই অনুষ্ঠানে গাইতে চান, সেটা পঙ্কজকুমারের একটা শর্তও ছিল। তাঁর গাওয়া সেই গানটি কি কোথাও আছে?

Deepnarayan Mitholia
দীপনারায়ণের লেখা জিন্দেগি নাটকের রেকর্ডিং। ছবিতে একদম ডানদিকে রয়েছেন দীপনারায়ণ। ছবির সৌজন্য – লেখক

দীপনারায়ণ মিঠোলিয়া সম্পর্কেও আমাদের হাতে তাই তথ্য বড় কম। এত কম পুঁজি নিয়ে মানুষটিকে ঠিক সম্পূর্ণ করে পাওয়া হয় না। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গলায় দীপনারায়ণের একটি গান ছিল, যার বাংলা, ‘যদি তুমি না এ গান কোনওদিন শোনো / তবে কী আসে যায়’। সত্যিই দীপনারায়ণ মিঠোলিয়ার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমাদের আসে যায়। কারণ তাতে অমন বহুমাত্রিক প্রতিভা যেমন আড়ালে চলে যায়, ওই সময়পর্বের ইতিহাসও। আমরা তো ভুলে থেকেছি তাঁর জন্মশতবর্ষও!

দীপনারায়ণ যখন অবসর নেন, তখনও বেতারে পেনশন-ব্যবস্থা চালু হয় নি। কারণ পদের নাম যাইহোক, তিনি যে স্টাফ আর্টিস্ট! ফলে প্রায় চার দশক ধরে আকাশবাণীকে পরিষেবা দিয়েও অবসরজীবন অর্থসঙ্কটে কেটেছে তাঁর। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকেও একই পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল। সারা জীবন কাজকে ভালোবেসেও এই প্রাপ্তির শূন্যতাকেই বোধহয় শম্ভু মিত্র বলেছেন, ‘প্রেমের পরিশ্রম’।

Bhabesh Das

আকাশবাণী ও দূরদর্শনের প্রাক্তন বার্তা সম্পাদক। সম্পাদনার কাজ করেছেন সংবাদ-সাপ্তাহিক ও দৈনিকেও। যাদবপুর, কলকাতা, বর্ধমান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস কমিউনিকেশন বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। কলকাতা বেতারের ইতিহাস, সম্প্রচারের ভাষা ও বেতার সাংবাদিকতা বিষয়ে একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন।বর্তমানে 'নান্দীপট' নাট্যপত্রের সম্পাদক।

5 Responses

  1. খুব ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে। হল দীর্ঘ স্মৃতির রোমন্থন। এই মানুষটিই আমাকে আকাশবাণীতে ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে তবলা বাজানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *