প্রত্যেকটা শহরের একটা আলাদা গন্ধ থাকে। যে গন্ধ সেই শহরের আকাশে বাতাসে পাওয়া যায়। সেটা আমি পেয়েছিলাম বসফোরাসের পাড় ধরে, সুলতানামেট পেরিয়ে, টোপকাপি প্যালেসের ছড়িয়ে পড়া উদারতাকে সঙ্গে নিয়ে তাকসিম স্কোয়ারের দিকে। হারিয়ে যাওয়া সেই গন্ধ নিয়েই আমার গন্তব্য ইস্তানবুল। যদি কোনও মিউজিয়াম অফ ম্যাডনেস কংবা ইনোসেন্স তৈরি করা যায়, ফুসুন আর কেমাল বে-র সঙ্গে। ইস্তানবুল শহর জুড়ে ছডিয়ে থাকা কাবাবের কিসসা, তুর্কি কফি, বাকলাভা-ই কয়েকদিনের সঙ্গী আমার।

একটা শহর ঘুরে বেড়ানো মানে তার মানুষজনের সঙ্গে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সবকিছু মিলিয়েই। হাওয়ায় উড়তে থাকা সে সব গল্প নিয়ে নক্শিকাঁথায় ফুল তুলতে থাকি আমি।

শহরে যেদিন পৌঁছলাম, সেদিন বন্ধু মার্ভের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। গ্র্যান্ড বাজার থেকে বসফরাসের পাড়। একটু উঁচুনিচু হয়ে গড়িয়ে চলা শহর আর তার বিভিন্ন মোড়ে বসে থাকা মানুষজন আপনাকে পুরনো কলকাতার আড্ডার স্মৃতি উসকে দেবেই। যে স্মৃতি গঙ্গাপাড় হয়ে বয়ে চলবে বসফরাসের পথে। ইস্তানবুল আড্ডার শহর, ইতিহাসের শহর, খাওয়া দাওয়ার শহর। এমনকি শহরের মধ্যে হেঁটে চলে বেড়ানোতেও একটা মিউজিকাল ম্যাজিক আছে। প্রথমদিন মার্ভে আমাকে রাস্তাঘাটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পরের দিন থেকে আমি একাই ঘুরছি আর খুঁজে পাচ্ছি কত অজানা ইতিহাসের কিসসা।

Kebab Platter
নানা ধরনের কাবাবে ভরা তুর্কি কাবাব প্ল্যাটার। ছবি – লেখক

সুলতানামেট চত্বর সবসময়ই মানুষের ভিড়ে ভরা। আহিয়া সোফিয়া থেকে ব্লু মস্ক সবই এই জায়গায়। সকালে এইসব দেখে ঘুরতে ঘুরতে বেলা গড়াল। সেই বেলা-পড়ে আসা আলোয় আলাপ হল নূরের সাথে। নূর মানে আলো। সত্যিই সে আলোর মতই ঝকঝকে, শান্ত আর নিবিড় তার চোখ। যেন সেখানে লুকিয়ে আছে অনেক কিসসা।

নূর ইস্তানবুল শহরের মেয়ে, যদিও এখন থাকে ইটালির সিসিলিতে। গরমের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে এসেছে শহর ঘুরতে। প্রায় পঁচিশ বছর বাদে এ শহরে এলেন ওর মা। বিয়ের পর এখানেই থাকতেন। তারপর বিবাহবিচ্ছেদ। ওদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে মা চলে যান ইটালি। সেখানেই বড় করেছেন ওদের। হঠাৎ মায়ের ইচ্ছে হয়েছে ফেলে আসা শহরকে আর একবার দেখে আসার। নূরের বাবা যদিও এ শহরেই থাকেন, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তাই দেখা করার প্রশ্ন উঠছে না। ওর মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল নূরের মাধ্যমে। যে শহরকে উনি ফেলে গিয়েছিলেন তার কত পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের পোশাক পাল্টে গিয়েছে। মেয়েদের পোশাক অনেক খোলামেলা হয়েছে। ওঁদের সময় এতটা ছিল না।

Turkish coffee
কড়া তুর্কি কফি। ফুলকাটা পোর্সেলিনের পেয়ালা পিরিচে। ছবি সৌজন্য – wikimedia

খাবারদাবারও পাল্টেছে। তুর্কি স্বাদের প্রামাণ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অনেক ফিউশন ফুডের আমদানি ঘটেছে। এইসব নানা গল্প করতে করতে আমরা হাঁটতে থাকি গ্র্যান্ডবাজ়ারের দিকে। একটা ছোট্ট কফির দোকানে বসে কফি অর্ডার করি। আড্ডা চলতেই থাকে। তিনটে ছোট্ট কাপে টার্কিশ কফি হাজির হয়। কড়া কালো কফি। সঙ্গে মানানসই প্লেট। কিছুদিন আগে গ্রিস থেকে ফিরে আসার নস্টালজিয়ায় আমি বলে ফেলি গ্রিক কফিও তো একইরকমের। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হতে পারে, সেটা বুঝিনি! সেই শান্ত স্নিগ্ধ নূরের আলোর তীব্রতা যে কতখানি, বোঝা গেল। মা-মেয়ে দু’জনে একইসঙ্গে বলে উঠল, গ্রিকরা কী জানে কফির? এ তো একান্তই আমাদের জিনিস! কফি, বাকলাভা সবই চুরি করে এখন নিজেদের নামে চালাচ্ছে। বুঝতে পারলাম ভাবাবেগে হাত দিয়ে ফেলেছি। নূর উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করল যে তার নাকি প্রেম ভাঙবার একটা প্রধান কারণ ছিল এই ঐতিহাসিক শত্রুতা, যা এজিয়ান সাগরের এপার-ওপারকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। মা-মেয়ে এরপর কফি আর বাকলাভার ঐতিহাসিক প্রমাণ দিতে শুরু করল। আমার মজা লাগছিল।

বাকলাভার ইতিহাস তো আজকের নয়, অনেক পুরনো। ক্রমে সেটা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আর সেসব দেশও দাবি করতে শুরু করেছে বাকলাভা আবিষ্কারের। তবে নূর আর ওর মা বলছেন যে, বলছে বাকলাভা যখনই আবিষ্কৃত হোক না কেন, তাকে সবচেয়ে বেশি কদর করে রান্নাঘরে ঠাঁই দিয়েছিলেন অটোমান সম্রাটরা, পঞ্চদশ শতকে যখন তাঁরা কনস্টানতিনোপল (আজকের ইস্তানবুল ) দখল করে রাজত্ব করতে শুরু করেন। এর পরবর্তী পাঁচশো বছর টোপকাপি প্যালেসের রান্নাঘর ছিল এঁদের রসনাবিলাসের মূল জায়গা। বাকলাভার ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো তথ্য যা পাওয়া গেছে, তা টোপকাপি প্যালেসের রান্নাঘরের নোটবুক থেকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৪৭৩ সালে এই প্রাসাদেই প্রথম বাকলাভাকে পেস্ট্রি থেকে ডেসার্টের স্তরে উন্নীত করা হয় সম্ভ্রান্ত ও ধনী মানুষদের খাদ্যতালিকায়। তারপর থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আমজনতা এর ধারেকাছে আসতেই পারত না। সাধারণ মানুষ বলত, “আমি অত বড়লোক নই যে বাকলাভা খাব।” যারা খেতেন তারাও কিন্তু বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান বা বিয়ে উপলক্ষেই বানাতেন।

Baklava
বাকলাভা রুটি তুরস্কের গর্ব। ছবি – লেখক

যাইহোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই তো পাল্টায়। তার ফলেই ক্রমে বাকলাভা এসেছে আমজনতার হাতের নাগালে। নূর বলে ওঠে, “বোঝাই যাচ্ছে তাহলে এর উৎস কোথায়! তবে গ্রিকরা কেন দাবি করে? আসলে ওরা ব্যবসা করতে এসে বাকলাভা খেয়ে এর প্রেমে পড়ে যায় আর রেসিপি জেনে নিজেদের দেশে গিয়ে বানাতে শুরু করে।” নূরের মা-ও দেখলাম এই ব্যাখ্যায় বেশ সন্তুষ্ট। আলোচনা বেশ সিরিয়াস জায়গায় চলে যাচ্ছে দেখে আমি একটু হাল্কা করতে চাইলাম। ওঁরা কিন্তু তখনও ওই মুডেই আছেন। তবে তথ্য বলছে ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বাকলাভা এথেন্সে পৌঁছলেও এর আসল রহস্য লুকিয়ে মাখা বা ডো তৈরিতে। গ্রিকরা নিজেদের ভাবনার নতুনত্বের জোডে ডো তৈরি করল পাতলা করে। একদম গাছের পাতার মতো, যা পরতে পরতে মধুর সঙ্গে মিশে মুখের মধ্যে এক অনন্য স্বাদের জন্ম দিল।

Donar Kebab
তুর্কি দোনার কাবাব। ছবি – লেখক

মা-মেয়ের গল্প চলতেই থাকে। বাকলাভার পর কফি। নূর বলছে সারা পৃথিবীতে ইয়েমেনের পর টার্কি হল দ্বিতীয় দেশ, যারা এই কফি কালচার আয়ত্ত করেছিল। ১৫৪৩ সালে ইয়েমেনের অটোমান গর্ভনর এই বিশেষ কালো কফি পরিবেশন করেছিলেন তৎকালীন  কনস্তানতিনোপলের রাজা সুলেইমানকে।
ব্যাস। তারপর থেকেই তুর্কি অন্দরমহলে এর প্রবেশ।
তুর্কি কফি কালো হয়, কিন্তু তেতো নয়। এর সূক্ষ্মতা আলাদা। বসফোরাসের পাড়ে দাঁড়িয়ে তিন আউন্সের ছোট পার্সেলিন কাপে এই কফির স্বাদ নিতে নিতে আপনিও মনে মনে ছোটখাটো একটা ঐতিহাসিক ট্যুর সেরে ফেলতে পারেন।

গ্রিসে দীর্ঘদিন পর্যন্ত এটি টার্কিশ কফি নামে পরিচিত ছিল।
কিন্তু ১৯৭৪ সালে তুর্কিরা সাইপ্রাস আক্রমণ করলে তৎকালীন গ্রিক সরকার টার্কিশ শব্দটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
তখন থেকেই এটি হয়ে যায় গ্রিক কফি।
তবে নূররা যা-ই বলুক না কেন, গ্রিকদের মধ্যেও কফি কালচারের গুরুত্ব অপরিসীম। কফির কাপে তারাও কত যুদ্ধ, তর্ক বিতর্ক, দর্শন চর্চা করে সারা পৃথিবীকে দিশা দেখিয়েছে, ইতিহাস তো তা অস্বীকার করতে পারে না।

Turkish Tea
তুর্কি কফির মতো জনপ্রিয় না হলেও তুর্কি চায়ের বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ার মতো। ছবি – লেখক

এইসব ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো তর্ক বিতর্ক পেরিয়ে আমরা ঘুরে বেডা চ্ছিলাম ইস্তানবুলের এ গলি ও গলি। নান আর কাবাবের গন্ধে ভরপুর একটা ছোট্ট গলিতে ঢুকলাম। পাথরের রাস্তায় হাইহিলের শব্দ তুলে কোনও এক তুর্কি সুন্দরী চলে যাওয়ার রেশ রেখে গেছে। ছোট্ট ছোট্ট দোকান। পারলে সবাই হাত ধরে আপনাকে নিয়ে গিয়ে বসায়। আমরাও চেয়ার টেনে বসলাম একটায়। ভেতরে বসার জায়গাটা বেশ বদ্ধ। তাই বাইরেই বসলাম। আলো ঝলমলে দিনে আড্ডা গল্প সঙ্গে নিয়ে। মেনু ধরিয়ে দিয়ে গেল। কাবাবের লিস্ট দেখে মনে খুশি উপচোলেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী কী খাব। কত ধরনের কাবাব! কোনওটা গ্রিলড তো কোনওটা স্ক্রুড! সবমিলিয়ে আশ্চর্য কাবাব কাবাব গন্ধ গলিজুড়ে। অনেকটা পুরানি দিল্লির মতো। বেশ ঘিঞ্জি চারপাশ। মাঝে মাঝেই লোকজন জড়ো হয়ে আছে। গল্প করছে, চা খাচ্ছে, স্বচ্ছ কাচের গেলাসে তুর্কি চা।

Sheesh kebab
দেখতে ভারতের শিক কাবাবেরই মতো। তুর্কি নাম শিশ কেবাব। ছবি – লেখক

তুর্কি কাবাব নিয়ে যখনই কথা হয় তখনই শুধুমাত্র দোনার কাবাব আর শিশ কাবাবের কথাই ওঠে। কারণটা একেবারেই পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদ। যেহেতু ইউরোপ এ দু’টিকে জনপ্রিয় করেছে, অতএব জগৎসংসার জানল যে তুরস্কে শুধু দু’টি কাবাবই তৈরি হয়।
মোটেও না।
অনেক ধরনের কাবাব তৈরি হয়। আর এক একটির রূপ রস গন্ধ আর একটির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
সনাতনী যে কাবাব পাওয়া যায়, সেটা মূলত তৈরি হয় ভেড়ার মাংস দিয়ে।
তবে আজকাল গোরু, মুর্গি এমনকি মাছ ও বিভিন্ন সবজি দিয়েও কাবাব তৈরি করছেন এঁরা ট্যুরিস্টদের স্বাদকুঁড়ির কথা মাথায় রেখে।
অষ্টাদশ শতকে লেখা অটোমানদের ট্রাভেল বুক থেকে জানা যাচ্ছে, যে প্রথম কাবাব তৈরি হয়েছিল তুরস্কের ইরজুরুম প্রদেশে যা “কেগ কেবাব” নামে পরিচিত। মাংসগুলোকে জড়ো করে মাটির সমান করে রেখে কাবাব তৈরি। কিন্তু পরবর্তীকালে ডোনার কাবাব তৈরির আদি পুরুষ ইসকান্দার এফেনদি বলেছেন, তিনি ও তাঁর ঠাকুর্দা এ ভাবে না করে উল্লম্বভাবে ঝুলিয়ে কাবাব তৈরি করেছেন।

Nun Bread
শুধু বাকলাভা নয়, তুর্কি নান-ও অতি লোভনীয়। ছবি – লেখক

আমি ইস্তানবুল ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পেরেছি, কাবাব আর তার বিভিন্নতার সংখ্যার হিসেব করতে যাওয়াই বোকামি। কারণ বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন কাবাব ছড়িয়ে রয়েছে। আমি নিজে জেনে বুঝে বেশ কয়েকটা খেয়েছি। সেগুলোর কথাই বলতে পারি। যেমন আদানা কাবাব। তুরস্কের দক্ষিণ পূর্ব প্রদেশে তৈরি, খুব মশলাদার। মাংসের কিমা চারকোলে ওপর বসিয়ে গ্রিল করা হয়। এর আর একটি কম মশলাদার ভার্শানও আছে। তার নাম উর্ফা। চারকোলের ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধের সঙ্গে মিশে যাওয়া মশলা আপনাকে জন্নতের স্বাদ দেবেই। এ স্বাদের ভাগ তো হবেই না। তারপর সিগের, হুনকারি, টেস্টির মতো আরও কত অজানা অচেনা কাবাব পড়তে থাকবে আপনার পাতে!
কোনওটি নান দিয়ে তো কোনওটি র‍্যাপের মতো করে মুড়ে স্যালাড আর হামাস দিয়ে খাবেন।
আর ভুলে যাবেন পৃথিবীর যাবতীয় ঝগড়া, ক্লেদ, মালিন্য।

 

গবেষক, নারী ও শিশু অধিকারকর্মী। চার্লস ওয়ালেস ফেলোশিপ পেয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন উনিশ শতকের কলকাতা নিয়ে। আই ভি এল পি ফেলোশিপে আমেরিকা গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু পাচার নিয়ে দু দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। ভ্রমণ ও কালিনারি কালচার নিয়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত দুটি বই : ড্রিমস এর চিত্রনাট্য র বাংলা অনুবাদ “ড্রিমস” ঊর্বি প্রকাশনা। “বেশ্যা পাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ”, আনন্দ পাবলিশার্স।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *