মধুবনী চট্টোপাধ্যায়।
শিল্পজগতে এই নামটির সঙ্গে প্রায় সকলেই পরিচিত। এই নৃত্যশিল্পী মধুবনীদিকে, মঞ্চের মধুবনীদিকে, চিনতাম আমিও বহুদিন ধরেই। নাচের ছন্দে, মঞ্চের আলো-আঁধারিতেও নজর কাড়ত তাঁর কমনীয়তা, তাঁর অভিজাত লাবণ্য। তারপর খানিকটা কাছ থেকে চেনার সৌভাগ্য হল তাঁকে। মঞ্চের বাইরে, মানুষ হিসেবে। খুলে গেল আলো-আঁধারির ঘেরাটোপ। দেখা দিল, ‘আকাশের মত নীল, বাতাসের মত ফুরফুরে, জলের মতো চিকন’ এক মানবী। মাধুর্য্য এবং আত্মবিশ্বাসের মেলবন্ধন এই নারী। স্বচ্ছতা তাঁর ভূষণ। দেখেছি, নাচকে বন্ধু ভেবে ভালোবেসে, তাঁর সাধনাকে কী ভাবে প্রায় অনায়াস করে তোলেন তিনি। ছোটদের সঙ্গে হৈহৈ করতে করতে কখন যে গল্পচ্ছলে দেশের ইতিহাস শিক্ষা দেন, কখন যে প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়ে দেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ছোটদের রূপকথার রাজকন্যা আর বড়দের মায়া-মানবী এই নারী। রাজকন্যা মায়া ছড়ান তাঁর কাজ দিয়ে। রঙিন, বহুমুখী তাঁর বিচরণক্ষেত্র। মন খুলে আড্ডা দিলাম মধুবনীদির সঙ্গে। মহালয়ায় ভাগ করে নিই সেই গল্প।
প্র: তোমাকে যদি পাঁচটা শব্দে নিজের পরিচয় দিতে বলা হয়, কী বলবে?
উ: অবাস্তবের জগতে যার সহজ বিচরণ ।
প্র: আজকের নৃত্যশিল্পী মধুবনী চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠতে তোমার স্কুলের প্রভাব কতটা?
উ: আমার স্কুল পাঠভবন। এই স্কুলের পরিবেশ সেখানকার পড়ুয়াদের সাংস্কৃতিক মনন তৈরি করে এসেছে চিরকাল। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে মা যখন আমাকে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যার অধিকাংশই নৃত্যকেন্দ্রিক পড়াশুনা, আমার স্কুল সেই সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। আমার শিক্ষিকাদের কাছ থেকে বরাবর উৎসাহ পেয়েছি। এখনও পাই। এটা আমার বিশাল প্রাপ্তি।

প্র: হঠাৎ নাচে এলে কেন? ভালো লাগলেও, অত ছোট বয়সে ভবিষ্যতে নাচই করবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া তো সহজ নয়। সেই সময়ের কথা একটু জানতে ইচ্ছে করছে।
উ: খেলার ছলে নাচ শেখা শুরু আমার দিদার উৎসাহে। ধীরে ধীরে সেটা অভ্যাসে পরিণত হল। আর তারপর ভালোবাসায়। সেখান থেকেই এই সিদ্ধান্ত। তখন বারো তেরো বছর বয়স হবে। নাচের প্রতি আমি অসম্ভব অনুগত ছিলাম, যেটা আমার মা বাবা লক্ষ্য করেছিলেন। ওঁরা দু’জনেই শিল্পী। তাই সেই বোঝার মনটা তাঁদের ছিল। সেখান থেকেই এই সিদ্ধান্ত এবং জীবনের অভিমুখ বদলে যাওয়া ।
প্র: তোমার প্রথম মঞ্চে উপস্থাপনা কত বছর বয়সে? কেমন সে অভিজ্ঞতা?
উ: ন’বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে দু’ঘণ্টার পূর্ণ শাস্ত্রীয় নিবেদন। সত্যি কথা বলতে, তখন এতটাই ছোট যে অনুভূতি বোঝার বয়স ছিল না। মনের আনন্দে নেচেছিলাম। আসলে নাচ আমার সবচেয়ে আপন বন্ধু। তাকে কোনওদিন ভয় করিনি। পরবর্তী কালে ভয় করেছি মঞ্চকে, যেখানে ভালোবাসার বিচার হয়।

প্র: প্রথম কার কাছে তোমার নাচে হাতেখড়ি? তোমার নৃত্যগুরুদের কথা যদি বল।
উ: আমার প্রথম গুরু গীতা মহাদেবন যিনি আমায় নাচের সঙ্গে, ছন্দের সঙ্গে পরিচয় করান সেই ছোট্ট বয়সে। তারপর আমার গুরু থাংকমণি কুট্টি , যাঁর ছায়ায় নৃত্যজীবন শুরু। পরবর্তীতে পদ্মভূষণ আলারমেল ভাল্লি এবং পদ্মবিভূষণ কলানিধি নারায়ণের কাছে
নৃত্য ও অভিনয় শিক্ষা।
প্র: মধুবনী চট্টোপাধ্যায়ের নিজস্ব একটা ধরন আছে, যা স্বতন্ত্র। বলা চলে তিনি নিজেই এক নতুন নৃত্য ঘরানার জন্মদাত্রী। এই সন্তানের সম্পর্কে তোমার মুখ থেকে জানতে চাই।
উ: নৃত্যের নিজস্ব একটা গতি আছে, যা শাস্ত্রের যাবতীয় বিধিনিষেধ, ঠিক ভুলের ঊর্ধ্বে। প্রকৃতিই এর আসল স্রষ্টা। পরে মানুষ তাকে বেড়া দিয়ে ঘিরেছে। সেই পেলবতা, সেই বলিষ্ঠতার নিজস্ব এক সতস্ফূর্ত ভাষা আছে। সেখানে কোনও স্বেচ্ছাচারিতা চলে না। তাকে একমাত্র আপন করা যায় নিবেদনে। আমি সেই নৃত্যে বিশ্বাসী। তার ভাষা শেখার চেষ্টায় থাকি। ঘরানা শব্দটা একটা সাজানো সরোবরের মতো। শিল্প স্রোতস্বিনী। আমি স্রোতে বইতে ভালোবাসি। সে প্রতিমুহূর্তে নতুন ভাবে জন্ম নিচ্ছে, আমি শুধু সেই সৌন্দর্যে অবগাহন করি মাত্র।

প্র: তোমার নৃত্য রচনা ও নৃত্য ভাবনার অনুপ্রেরণা কে?
উ: পুরাণ, সাহিত্য এবং রবীন্দ্রনাথ। শাস্ত্রীয় নৃত্য সাহিত্য-নির্ভর। পুরাণ তার বিশাল অংশ জুড়ে আছে। কিন্তু যখনই জীবনমুখী ভাবনা আসে, তখন সেখানে রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ান।
প্র: তোমার অন্যান্য বেশ কিছু শখ আছে, যেমন লেখালিখি। সেগুলোর কথা যদি পাঠকদের একটু বল। এগুলো কি তোমার নাচকে আরও সমৃদ্ধ করে?
উ: লেখা, আঁকা…. এরা সব আমার নাচের বৃহত্তর আঙ্গিক বলা যায়। শিল্প এক, তার প্রকাশ আলাদা। এরা নৃত্যের বা চিত্রের আলাদা প্রকাশ।

প্র: গত পাঁচ বছরে তোমার নৃত্য জীবনের যে সফর, সেটা কী ভাবে বদলেছে?
উ: গত পাঁচ বছরে শুধু নৃত্য-জীবন নয়, আমার জীবনই বদলে গেছে। যে কোনও উত্থান পতন জীবনের অঙ্গ। তারা অনেককিছু শেখায়, ঋদ্ধ করে। এখন আমি জানি, পরিষ্কার করে জানি, ঠিক কী চাই। নৃত্য-জীবন নিয়ে আমার ভাবনা এখন পরিষ্কার। আমি মনে করি, শুধুমাত্র মঞ্চই একজন শিল্পীর জীবনের শেষ কথা হতে পারে না। মঞ্চের বাইরে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার এক বিশাল মঞ্চ আছে, যেখানে নিজস্ব ক্ষুদ্রতায় নয়, জীবনের ব্যপ্তিতে বাঁচতে হয় সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে। সেটাই এখন শিখছি, এবং আনন্দে শিখছি।
প্র: খুব মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নাচের ক্ষেত্রে নিশ্চই অনেক। তার মধ্যে একটা বেছে নিতে হলে কোনটা বাছবে। কেন?
উ: অপূর্ব অভিজ্ঞতার সংখ্যা অনেক অনেক। তারমধ্যে একটি অভিজ্ঞতা আমি কখনও কারো সঙ্গে ভাগ করিনি… আমার রক্তকরবী নৃত্য নাটকটি দেখতে এসেছিলেন মৃণাল সেন। তারপর আমাকে ওঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন। ওই স্তরের এক বিশ্ববন্দিত স্রষ্টা যে এমন শিশুর মতো হতে পারেন এবং এমন ভাবে এক নবীনকে সম্মান ও ভালোবাসা দিতে পারেন, ওঁকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। চলে আসার আগে আমায় জড়িয়ে ধরে একটি কথা তিনি বলেন, যা আমার শিল্পী জীবনের এবং নারীত্বের বিশাল প্রাপ্তি। কথাটি চিরকাল আমার কাছেই থাকবে। তাই এখানে বললাম না।

প্র: আর নাচের ক্ষেত্রে বাধা? কখনও কোনওদিন কি এসেছে? কী ভাবে?
উ: না। এই একটি জায়গায় কেউ সেইভাবে হাত দিতে সাহস করেনি। আর করলেও সেটা টেঁকেনি।
প্র: অন্য অনেক কিছুর মত নাচেরও এখন রিয়ালিটি শো খুব জনপ্রিয়। তোমার কেমন লাগে?
উ: ওটা নাচ নয়, এটুকু বলতে পারি। ক্ষণিকের উত্তেজনা কখনও নাচ হয় না। আমি এই ব্যাপারে বড্ডো সেকেলে। নিতে পারি না।
প্র: তুমি নাচ ছাড়াও ভীষণ ভালো ছবি আঁকো, লেখ, বাগান কর, আবৃত্তি কর, এমনকি বড্ড সুন্দর করে সাজো। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিজেকে প্রকাশ করতে পার কোনটাতে?
উ: এগুলো প্রত্যেকটা আমার ভালোবাসা। আর সাজটা সবথেকে ফাঁকিবাজির কাজ। খুব বেশি হলে দশটা মিনিট। বাকিগুলো নিয়ে সারাদিন কেটে যায়। ছবি আঁকায় আমার সবচেয়ে বেশি সুখ। লিখতেও ভালোবাসি। আসলে যখন যেটা সহজভাবে আসে… জোর করে কিচ্ছুটি হয় না আমার।

প্র: ছোটদের সঙ্গে নানান ধরনের কাজ কর তুমি, যেমন রবি-কবির পাঠশালা, নালক, ইত্যাদি। এগুলো সম্পর্কে একটু জানাও পাঠকদের।
উ: ছোটদের নিয়ে আমার এক বিশাল জগৎ। ওদের স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা এখন ক্রমশ জটিল অঙ্কে পরিণত হচ্ছে, পৃথিবী এবং সামাজিক অসুস্থতার কারণে। রবি কবির পাঠশালা ওদের শিকড়ে জুড়ে রাখতে চেষ্টা করে, সাহিত্য, শিল্প, গান গল্পের হাত ধরে রবি কবির ছায়ায়। আর নালক ওদের একটি ডিজিটাল মাধ্যম, যেখানে ওরা ওদের ভাবনা, ওদের সৃষ্টি উজাড় করে দেয়। খুব সম্প্রতি শুরু হল নালকের অনলাইন সাহিত্য সভা। ছোটদের উৎসাহ ভাবা যায় না। ওরা ভালো থাকলে, সুস্থ মনে বড়ো হলে সমাজের ব্যধি, পৃথিবীর রোগ নিরাময় হবে দ্রুত।
প্র: এখনকার এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তোমাকে অনলাইন নাচের ক্লাস নিতে হচ্ছে। এই নতুন পদ্ধতি কেমন? সুবিধা-অসুবিধা কী?
উ: বড়ো জটিল। বিশেষ করে নৃত্য মাধ্যমের জন্যে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখে নিচ্ছি। এবং স্বাভাবিক সময়ে ফেরার অপেক্ষা করছি।

প্র: মানুষ কী ভাবে তোমাকে মনে রাখুক, তুমি চাইবে? নৃত্যশিল্পী না নৃত্য শিক্ষিকা? কেন?
উ: মানুষ আমাকে তাঁদের একজন হিসেবে মনে রাখুন। শিল্পী, শিক্ষিকা তারপরে।
প্র: যে ছোটরা বড় হয়ে নৃত্যশিল্পী হতে চায়, তাদের কী বলবে?
উ: এ বড়ো ভালোবাসার জিনিস। যদি মন প্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবেসে শেখা যায়, আপন করে নেওয়া যায়, জানবে চিরকালের বন্ধু পেলে। শুধু নাম যশ অর্থের জন্যে শিল্প হয় না, শিল্পী হতে নেই। তার বাইরে আরও অনেক অনেক বেশি কিছু সে দেয়। যদি তার জগতে নিজেকে সঁপে দাও, তাকে নেওয়ার জন্যে নিজেকে তৈরি কর, তখন বুঝবে সেই পাওয়া ঠিক কতখানি।
শ্রীমন্তীর জন্ম আর স্কুলের পড়াশোনা কলকাতায়। স্নাতকস্তরে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসে পাড়ি। পেশায় সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও বৃষ্টিভেজা দিনে এতোল বেতোল ভাবনা ভাবতে আর সুর ভাঁজতে ভালোবাসেন। কলম ছুঁইয়ে চেনাকে অচেনা আর অচেনাকে চেনা করে তোলা তাঁর প্রিয় শখ। ভালোবাসেন ছোটদের সঙ্গে সময় কাটাতে, বই পড়তে আর বেড়াতে।
ভারি চমৎকার মানুষীর কথা আরেকজন আমাদের কাছে নিয়ে এলেন। শিল্পীকে অকুণ্ঠ ভালোবাসা। সাক্ষাৎগ্রহীতাকে নমস্কার।
খুব ভালো লাগল প্রিয় শিল্পীর সাথে কথোপকথন ।
একজন শিল্পী কে ভেতর থেকে ধরবার একটা চেষ্টা আছে। যেটা খুব বড় কথা। শিল্পীকে যতটা জানলাম তাতে শিল্পের প্রতি প্রত্যয়কে বাড়িয়ে দিল। আর এ ব্যাপারে সেতুবন্ধের কাজটা করলো এই সাক্ষাৎকার।
Priyo Madhubani tomaar ankano lekha dutoi bhison bhabe ekhane dekhte chaayi. Bhison nijer minay korayi tumi bollam, aar arthoniti r chhatri r mastermoshai porichoy ta aaro kachher kore nilo. Bhalobasa aphuran.❤️
khub halo laglo lekha ta
খুব ভালো লাগল সাক্ষাৎকারটি। শৈল্পিক দৃষ্টি কোণ থেকে দেখা এক মনোজ্ঞ উপস্থাপন
Amer prio modhubonidi.Tar kotha aro janle aro bhalo lagbe.Valo thakben sustho thakben.Amer nijer ei echha gulo 19bochhor por r bikoshito korer sujog pai ni to!
KHUB BHALO LAGLO… ARO JANTE CHAI EI BIKHATTO NRITTOSHILPI R SAMADHE