আগের পর্বের লিংক: [লপসি ও লপ্সিকার জন্য বিপ্লব]
মুখের বাংলায় ‘ঘরযোগ’ বেশ চালু শব্দ। আগেকার দিনে মা-মাসিরাই আনন্দ-উৎসবে একান্নবর্তী পরিবারে ঘরযোগে রান্না করতেন। নিত্যদিনের রান্নাও এক অর্থে ঘরযোগের রান্না। ঘরযোগের সেই রান্নার বিনিময়ে কোনও মজুরি অবশ্য পাওয়া যেত না। ঘরের কাজে গতর খাটিয়ে মেয়েরা কবেই বা আর মর্যাদা বা বেতন পেয়েছেন? নারীবাদীদের ন্যায়সংগত দাবিতে ইদানীং মেয়েদের গৃহশ্রম, ঘরের কাজ খানিকটা মর্যাদা আর গুরুত্ব পেলেও বঙ্গসমাজ মোটের ওপর যে-তিমিরে সে-তিমিরেই। মেয়েদের ঘরযোগের কাজকর্ম আমরা চোখেও দেখি না, দেখলেও সে-সবের গুরুত্ব স্বীকার করি না। অথচ বারযোগে গতর খাটিয়ে যখনই মজুরি আদায়ের কথা ওঠে, তখনই ঘরে যে কাজ বিনা পারিশ্রমিকে মেয়েদের দিয়ে করানো হয়, সে কাজই মজুরির বিনিময়ে পুরুষেরা বারযোগে করেন। বাড়ির মা-মাসিরা ঘরযোগে বিনি-পয়সার রাঁধুনি-বামুনি, বারযোগে পাচক ঠাকুর থেকে হাল আমলের শেফ, কেউই কিন্তু সচরাচর আর মা-মাসি নন; তখন সেখানে পুরুষদেরই প্রাধান্য। এই ট্রাডিশন মহাভারতের যুগ থেকে সমানে চলেছে।
পঞ্চপাণ্ডবের বনবাস তখন শেষ হয়েছে। পাশাখেলায় হেরে যাওয়ার ফলে এবার শর্ত অনুযায়ী একবছর অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার কথা। ঠিক হল, বিরাট রাজ্যে তাঁরা অজ্ঞাতবাসে যাবেন। বিরাটের রাজসভায় প্রবেশ করে এক একজন পাণ্ডব তাঁদের ছদ্ম-পরিচয় দিচ্ছেন। যুধিষ্ঠিরের পর এলেন ভীম। রাজশেখর বসু তাঁর মহাভারতের সারানুবাদে লিখেছেন,
‘তারপর সিংহবিক্রম ভীম এলেন, তাঁর পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র, হাতে খন্তি হাতা ও কোষমুক্ত কৃষ্ণবর্ণ অসি। বিরাট সভাস্থ লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, সিংহের ন্যায় উন্নতস্কন্ধ অতি রূপবান কে এই যুবা? ভীম কাছে এসে বিনীতবাক্যে বললেন, মহারাজ, আমি পাচক, আমার নাম বল্লব, আমি উত্তম ব্যঞ্জন রাঁধতে পারি, পূর্বে রাজা যুধিষ্ঠির আমার প্রস্তুত সূপ প্রভৃতি ভোজন করতেন।’
রাজসভায় ভীমের প্রবেশের ছবি একলহমায় তপন সিংহ পরিচালিত ‘গল্প হলেও সত্যি’ (১৯৬৬) ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। ভীমের হাতে ‘খন্তি হাতা’ যেমন বারযোগে রান্নার অস্ত্র, তেমনি তপন সিংহের ছবিতেও হঠাৎ আসা রাঁধুনি ও গৃহ-সহায়ক ধনঞ্জয় (রবি ঘোষ) বাক্সভর্তি করে তাঁর রান্নার ‘অস্ত্র’ এনেছিলেন। বাড়ির মা-ঝিরা অবাক চোখে সেই বিশেষ হাতা-খুন্তি দেখতে থাকেন। রাঁধুনি ধনঞ্জয় (রবি ঘোষ) তাঁর হাতা-খুন্তির সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে প্রায়-মহাকাব্যিক গল্প ফাঁদেন। কৈলাসের পথে চলেছেন, চারিদিকে ধূ ধূ করছে বরফ। মাঝখানে কুলকুল করছে মানস সরোবর। সেখানে এক মায়ের সঙ্গে দেখা। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। মায়ের আদেশে সরোবর থেকে ব্রহ্মকমল নিয়ে এলেন। সেই ব্রহ্মকমলের রেণু আর চমরি গাইয়ের দুধ দিয়ে মা পায়েস রান্না করে খাওয়ালেন– অপূর্ব সে অমৃতময় পায়েস। পায়েস খেয়ে ছেলে আবদার করলেন, যে হাতায় এমন পায়েস রান্না করেছেন সেই হাতাটি চাই। ছেলের আবদার কি মা ফেলতে পারেন? সেই এক কৈলাসের অন্নপূর্ণার হাতা ভেঙে এই সব হাতা-খুন্তি তৈরি। এক অনেক হয়েছে। এমন হাতা-খুন্তির অধিকারী যে, তারই তো বারযোগে রান্না করা সাজে। তপন সিংহ বাস্তবের রাঁধুনিকে মহাকাব্যিক মহিমা প্রদান করেছেন।
ভীম তো এমনিতেই মহিমময়– পবনপুত্র হনুমান তাঁর অগ্রজ। অসম্ভবকে সম্ভব করার সামর্থ তাঁরও আছে। বিরাট রাজা ভীমকে দেখে আর তার কথা শুনে খুব খুশি। বল্লবরূপী ভীমকে বিরাট বললেন, ‘তোমাকে আমি পাকশালার কর্মে নিযুক্ত করলাম, সেখানে যেসব পাচক আছে তুমি তাদের অধ্যক্ষ হবে।’ বিরাট রাজার পাকশালায় পাচকদের প্রধান হিসেবে তাঁর চাকরি পাকা হয়ে গেল। হেডকুক ভীম! কিন্তু প্রশ্ন হল, ভীম কি ঘরযোগে কখনও রান্না করেছেন? ভালোবেসে বিনিপয়সায় রেঁধে খাইয়েছেন তাঁর প্রিয় দ্রৌপদীকে? ব্যাসদেব সে কথা লেখেননি, কারণ ঘরযোগের রান্নায় স্বভাবতই মহাভারতীয় বীরের মতি ছিল না। ব্যাসের লেখা থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না, পাণ্ডবদের বনবাসে রান্নার দায়িত্ব সম্পূর্ণ দ্রৌপদীর।
দুর্যোধন দ্রৌপদী-সহ পঞ্চপাণ্ডবকে বিপদে ফেলার জন্য একবার দুর্বাসাকে পাঠিয়েছিলেন কাম্যকবনে। অযুত শিষ্য নিয়ে দুর্বাসা বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে হাজির। মুনি হিসেবে সাধারণ মানুষজনকে জ্বালাতন করা দুর্বাসার নাছোড় স্বভাব। দুর্যোধনের আতিথ্যে হস্তিনাপুরে যখন তিনি ছিলেন, তখন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যা করতেন, তা সচরাচর করেন হাড়জ্বালানে ভারতীয় শাশুড়িরা। পুনশ্চ রাজশেখর বসু। দুর্বাসা ‘কোনো দিন বলতেন, আমি ক্ষুধিত হয়েছি, শীঘ্র অন্ন দাও; এই বলেই স্নান করতে গিয়ে অতি বিলম্বে ফিরতেন। কোনও দিন বলতেন, আজ ক্ষুধা নেই, খাব না; তারপর সহসা এসে বলতেন, এখনই খাওয়াও। কোনো দিন মধ্যরাত্রে উঠে অন্নপাক করতে বলতেন কিন্তু খেতেন না, ভর্ৎসনা করতেন।’ এই শাশুড়িকল্প দজ্জাল অভিশাপপ্রদায়ী খরবাক্য মুনিটিকে বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে পাঠিয়ে দুর্যোধন ভাবলেন, এবার ব্যাটারা মজা টের পাবে। মুনিকে বিশেষ করে বলে দিয়েছিলেন, ‘যখন সকলের আহারের পর নিজে আহার করে দ্রৌপদী বিশ্রাম করবেন সেই সময়ে আপনি যাবেন।’ রান্না-বান্না করে, স্বামীদের আগে খাইয়ে শেষে নিজে খেয়ে মেয়েটি যে একটু বিশ্রাম করবে, তা নারীলোলুপ দুর্যোধনদের সইবে কেন!
আরও পড়ুন: ইফতারের খাওয়া নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা
দুর্বাসাকে সশিষ্য আসতে দেখে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির খুশি, আহ্নিক করে খেতে আসতে বললেন। বলে তো দিলেন, কিন্তু আহ্নিকের পর খাবেন কী? অন্নের আয়োজন কোথায়? দ্রৌপদীরও খাওয়া হয়ে গেছে, কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে-সব অবশ্য যুধিষ্ঠির ভাবেননি, মেয়েদের ছোট-ছোট সুবিধে-অসুবিধের কথা ধর্মপুত্ররা কবেই বা আর ভাবেন! বলশালী ভীম, যিনি হাতা-খুন্তি নিয়ে পাচক পরিচয়ে বিরাট রাজ্যে আত্মগোপন করেছিলেন, সেদিন দ্রৌপদীর বিপদের মুহূর্তে অসির মতো অনায়াসে হাতা-খুন্তি চালিয়ে রান্নার কাজে হাত লাগানোর কথা অবশ্য একবারও ভাবেননি। দ্রৌপদীকে ‘অলৌকিক’ ক্ষমতাবলে বাঁচিয়েছিলেন কৃষ্ণ। দ্রৌপদীর থালার কানায় সামান্য একটু শাক-ভাত লেগেছিল। তাই মুখে দিয়ে কৃষ্ণ পরিতৃপ্ত। সেই পরিতৃপ্তি জগতে ব্যাপ্তি লাভ করল। নদীতে নেমে দুর্বাশা মুনি আর তাঁর শিষ্যরা স্নান-আহ্নিক করছিলেন। হঠাৎ তাঁদের পেট ভরে গেল, ঢেঁকুর উঠতে লাগল। পাছে পাণ্ডবদের কাছে আবার ভরাপেটে খেতে বসতে হয়, সে-ভয়ে সদলে তিনি পালিয়ে গেলেন।
প্রশ্ন হল, মহাভারতে না-হয় নেই, কিন্তু সেকালের বাংলা কাব্যে কোথাও কি আছে ঘরযোগে পুরুষদের রান্না করার কথা? বাংলা ভাষা তো এমনিতে সংস্কৃতের তুলনায় অর্বাচীন। মোটের ওপর দশম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যখন বাংলা ভাষা আত্মপ্রকাশ করে ক্রমে স্বাবলম্বী হয়েছে, অথচ বাংলা ভাষার ছাপাখানার জন্ম হয়নি, সে-সময় বাংলা ভাষার সেকাল। সেই সেকালের বাংলা কাব্যে কি আছে ঘরযোগে পুরুষের রান্না করার কথা? সকলে না-হলেও কেউ কেউ কিন্তু রান্না করতেন, পুরুষের সেই রান্না করার নিদর্শন বহন করছে সেকেলে বাংলা কাব্য। সে রান্নায় মিশে ছিল পুরুষের সোহাগ, আদর, মায়া, মমতা।

এমনিতে সেকালের বাংলা সাহিত্যের আখ্যানকাব্যগুলি পড়লে পুরুষ-চরিত্রগুলিকে কেমন যেন নিরেট, মনহারা বলে ভাবতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে দাম্পত্যজীবনে স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র মমত্ববোধও যেন তাদের নেই। দেবতা কিম্বা অভিশপ্ত দেবপুরুষ, সবাই সেই একই গোত্রের মানুষ– স্ত্রী কী খেল কী পরল, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র খোঁজ রাখার প্রয়োজনও তাঁরা বোধ করেন না। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে পার্বতী কীভাবে সংসার চালাবেন, অলস শিব তা ভাবেনই না। যেদিন ভিক্ষে জোটে সেদিন পার্বতী রান্না করেন, শিব খান– পার্বতীর খাওয়ার মতো কিছু রইল কিনা, সে-বিষয়ে একটি বাক্যও দেবাদিদেব মহাদেব ব্যয় করতে নারাজ। রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’ কাব্যের শিব যেমন স্বার্থপর, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতুও তেমন আত্মকেন্দ্রিক। এক-একদিন ব্যাধ কালকেতুর খাওয়ার বিপুল আয়োজন– গপাগপ খাচ্ছে, সেই গোগ্রাসে খাওয়াই যেন তার বীরত্বের দেখনদারি। অমন গপগপিয়ে সাধারণ মানুষ খেতে পারে না, বীর কালকেতু পারে। খাদ্যের পরিমাণ ও বহর দেখানো যে পুরুষ চরিত্রের বীরত্বের সূচক, একথা সেকালের বাঙালি কবিরা বোধহয় ভাবতেন। তা না হলে কৃত্তিবাসী রামায়ণে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙানোর পর অমন দানবীয় খাবার ব্যবস্থা কেনই বা করা হবে!
শয্যা হৈতে উঠি বীর চক্ষে দিল পানি।
ভক্ষণের দ্রব্য দিল থরে থরে আনি।।
মদ্য পান করিলেক সাতাশ কলসী।
পর্ব্বত প্রমাণ মাংস খায় রাশি রাশি।।
হরিণ মহিষ বরা সাপটিয়া ধরে।
বারো তের শত পশু খায় একেবারে।।
সেকালের আসরে শ্রোতারা এইসব খাদ্যবিবরণ বিস্ময়াবিষ্ট মন নিয়ে যতই শুনুন না কেন, ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকদের পক্ষে এই খাদ্যবিবরণ খুবই অরুচিকর। রবীন্দ্রনাথ চাঁচাছোলা ভাষায় লিখেছিলেন ‘বাঙালি কবি নয়’ নামের প্রবন্ধ। তাঁর অভিমত,
“প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে মহাকাব্যই নাই। কবিকঙ্কণচণ্ডীকে কি মহাকাব্য বল? তাহাকে উপাখ্যান বলা যাইতে পারে কিন্তু তাহা কি মহাকাব্য? কালকেতু নামে এক দুঃখী ব্যাধ কোনোদিন বা খাইতে পায় কোনোদিন বা খাইতে পায় না। যেদিন খাইতে পায়, সেদিন সে চারি হাঁড়ি ক্ষুদ, ছয় হাঁড়ি দাল ও ঝুড়ি দুই-তিন আলু-ওল পোড়া খায়। “ছোটো গ্রাস তোলে যেন তেআঁটিয়া তাল।” “ভোজন করিতে গলা ডাকে হড় হড়।”
মস্ত বড় হাঁ করে খাবার গেলার আর খাবার সময় হড় হড় শব্দ করার মধ্যে ‘এটিকেট’ (etiquette)- এর বালাই নেই। কুম্ভকর্ণও যেভাবে মদ্য আর মাংস খেয়েছে, তার মধ্যে একরকম উদগ্রতা আছে। এই উদগ্রতার মধ্যে প্রয়োজনই হয়ে উঠেছে প্রধান, খিদেটাই প্রকাশ পেয়েছে– রবীন্দ্রনাথ ভাবেন খিদে মানুষ ও পশু উভয়েরই পায়, কিন্তু মানুষের খিদে মেটানোর মধ্যে পশুর কেড়ে-খাওয়ার ভাব থাকার কথা নয়, যদি থাকে তাহলে তা পাশবিক। খাবার প্রাচুর্য ও সেই খাবার পাওয়ার নিশ্চিত নিরাপত্তা থাকলেও কৃত্তিবাসের কুম্ভকর্ণের ভঙ্গিতে রুচিহীন বুভুক্ষাই প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই এই খাওয়াকে সভ্য বীরের খাওয়া বলে মানতে পারছেন না।
পাশ্চাত্যের ঘোড়ায়-চাপা নাইটদের মধ্যে যে শিভালরির আদর্শ গড়ে উঠেছিল, তা সেখানকার মধ্যযুগীয় সমাজ সংসারে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে এই আদর্শ পুরুষদের শোভন-সভ্য করেছিল– ‘এটিকেট’-এর আদর্শ তাদের কথা ও ক্রিয়ার সামাজিক শোভন বিধি গড়ে তুলেছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে শোভন-সভ্য পুরুষের দেখা মিললেও সেকালের বাংলা সাহিত্যে ভদ্র-পুরুষ বিরল। শূদ্রক রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে চারুদত্ত ভদ্রপুরুষ, রাজশ্যালক শর্বিলক অভদ্র। তাদের কথাবার্তা-কাজকর্ম একেবারেই বিপরীত, শূদ্রক চোখে আঙুল দিয়ে নাটকে ভদ্র-অভদ্রের ভেদ দেখিয়েছেন।
চারুদত্ত আচারে-ব্যবহারে, আহারে-বিহারে, সজ্জায়-বাচনে নাগরিক। শর্বিলক একেবারেই তা নয়। এই সংস্কৃত ভব্যতার নিদর্শন বাংলা-সাহিত্যে কোথায়! প্রাগাধুনিক বঙ্গদেশে মরমিয়া ভক্তির ধারা সমাজজীবনে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটালেও পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পুরুষকে ছোট ছোট ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি সংবেদনশীল, ভদ্র করে তুলতে পারেনি। তাই যখন সেখানে এক-আধজন সংবেদনশীল পুরুষের দেখা মেলে, তখনই প্রাপ্তিতে মন ভরে যায়। কালকেতুর বাবা ধর্মকেতুই বেশ সংবেদনশীল পুরুষ। খাওয়া-দাওয়ার বিচারেই পুরুষ ধর্মকেতুর সেই সংবেদনের পরিচয় পাওয়া যায়।

নিদয়ার পেটে তখন কালকেতু ন-মাসের। ধর্মকেতুকে নিদয়া বলেছে, কী তার খাবার সাধ। দীর্ঘ সে তালিকা। আমিষ নিরামিষ দুয়ের কথাই আছে। পোড়া মীনে জামিরের রস, খই সঙ্গে মহিষের দই, মিঠা ঘোল, পাকা চালিতার ঝোল, চিঙ্গড়ির বড়া, নেউল গোধিকা পোড়া, হাঁসের ডিমের বড়া – পড়তে পড়তে মনে হয় এ-সব রান্না করা খুব সোজা কথা নয়। আমিষের চাইতে নিরামিষ রান্না আরও কঠিন। নিদয়া তাই নিরামিষ রান্নার নামই কেবল বলেনি, কীভাবে রান্না করতে হয় তাও বলে দিয়েছে।
আমার সাধের সীমা ইঙ্গিচা পলতা গিমা
বোয়ালি ঘাঁটিয়া কর পাক
ঘন কাঠি খর জ্বালে সান্তলিবে কটু তৈলে
দিবে তায় পলতার শাক।
পুই ডগি থুপি কচু ফুলবড়ি দিবে কীছু
দিবে তায় মরিচের ঝাল।
অরুচি মুখে পোয়াতি মেয়েটির টক-ঝাল খাওয়ার সাধ হয়েছে। বর ধর্মকেতু সেই সাধ পূর্ণ করেছে। মুকুন্দ লিখেছেন,
নিদয়ার সাধ হেতু ঘরে জায় ধর্মকেতু
চাহিয়া আনিল আয়োজন
আপনি রাঁধিয়া ব্যাধ নিদয়ারে দিল সাধ
বিরচিল শ্রীকবিকঙ্কণ।।
সেকালের বাংলা সাহিত্যে ধর্মকেতুর মতো রন্ধনপটু পুরুষ দ্বিতীয়টি চোখে পড়বে না। সেকালের খাই-খাই পুরুষের দলে ধর্মকেতুই কেবল আদর করে রান্নাবান্না করা পুরুষ। সে কেবল কেড়ে খায় না, দিতেও জানে। এই আদরের রান্নায় সে তার নিজের স্বার্থসীমাকে অতিক্রম করতে পেরেছে। তার ধর্ম নামটি সার্থক। ধর্মের মধ্যে ঔচিত্যের আদর্শ থাকে। পারিবারিক জীবনে সেই আদর্শ থেকে আমাদের মহাকাব্যের নায়কেরা অনেক সময় বিচ্যুত হন। প্রজানুরঞ্জক রাম গর্ভবতী সীতাকে নির্বাসন দেওয়ার সময় একবারও ভাবেননি সন্তানসম্ভবা সীতা কেবল তাঁর স্ত্রী নন, প্রজাও বটে।
নবনীতা দেবসেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মহাকাব্যগুলি বিচার করতে গিয়ে খেয়াল করেছিলেন, এই মহাকাব্যগুলি মেয়েদের জীবনের ঐকান্তিক মুহূর্তে শরীর-মনের যে পরিবর্তন হয়, সেগুলিকে প্রকাশ করে না। সে-সব বিষয় নিয়ে মহাকাব্যের পুরুষ লেখকেরা মাথাও ঘামান না। তাই নবনীতা মেয়েদের লেখা রামকথা যা প্রকৃত অর্থে ‘সীতাকথা’ তা সংগ্রহে মন দিয়েছিলেন। মেয়েরা যখন ঋতুমতী হচ্ছেন, গর্ভবতী হচ্ছেন, সেই ঐকান্তিক মুহূর্তের অনুভূতি মেয়েদের গাওয়া রচনায় ধরা পড়েছে। সেজন্যই বাংলায় লেখা চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পুরুষ সাহিত্য-সমালোচকদের কাছে গুরুত্ব না-পেলেও নবনীতার কাছে গুরুত্ব পায়।
নবনীতা-র লেখা ‘বামাবোধিনী’ নানাকারণে এ-বিষয় নিয়ে লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। সে উপন্যাসে নবনীতাকল্প চরিত্র ‘অংশুমালা’ বাল্মীকি রামায়ণ নিয়ে গবেষণার কাজ থামিয়ে সারা ভারতের মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত সীতার গান সংগ্রহ করছে। বর মলয় এতে খুবই বিরক্ত। স্ত্রীকে বলে,
‘তোমার আগেকার রামায়ণ গবেষণার সঙ্গে এই কাজের কোনও তুলনা হয় না। তার জাতটাই ছিল আলাদা। অ্যাকাডেমিকালি হাইলি চ্যালেঞ্জিং। একটা পিয়োরলি ইনটেলেকচুয়াল একসারসাইজ, ওয়ার্ল্ডে পাইওনিয়ারিং ওয়র্ক করছিলে। সব চুলোয় দিয়ে এখন কী করছ? না, ধানগাছ পোঁতবার, আর যত আগাছা ওপড়াবার গান।’
অংশুমালা অবশ্য এতে দমে যায় না। তার সংগৃহীত দক্ষিণভারতীয় গানে গর্ভবতী সীতা লক্ষ্মণকে বলে,
আরও একটি সাধ আছে লক্ষ্মণ দেবর
দরিয়ার মাঝে আছে মস্ত বালুচর
বালুচরে সেগুনের মহাবৃক্ষ আছে
আশ্চর্য মৌচাক ঝোলে সেই বৃক্ষমাঝে
সেই সে মৌচাকের মধু নিয়া আইস ভাই
সেই মধু দিয়া তবে সাদা দোসা খাই।

সীতা সেগুন গাছের মৌচাকের মধু দিয়ে দোসা খেতে চেয়েছে শুনে শাশুড়ি কৌশল্যা রেগে আগুন। মেয়েরাই তো মেয়েদের শত্রু, পিতৃতন্ত্র তো সেভাবেই মেয়েদের মগজ ধোলাই করেছে। সীতার প্রতি লক্ষ্মণের সমমর্মিতা থাকলেও কৌশল্যার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। মুখ ব্যাঁকা করে রামজননী বলেন,
এ হেন বিদঘুটে ইচ্ছা সাতজন্মে শুনিনি
আমাদেরও গর্ভাবস্থা হয়েছিল বাছা
খাইয়াছি খোলামকুচি, তেঁতুলের আচার
কাঁচা আমে নুন লংকা মাখিয়ে খেয়েছি
শাকে আর বাসি ঘোলে সাধ মিটায়েছি
রাম-লক্ষ্মণের জন্ম দিয়েছি তো আমি
শুনিনি দেখিনি কভু এহেন ন্যাকামি
ভাবখানা এই, আমি যা পাইনি তুমি তা পাবে কেন! এই ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা রান্নাঘরে শাশুড়ি-বউয়ের লড়াইয়ের মুখ্য কারণ। ধর্মকেতুর মা ছিলেন না, কাজেই আদর করে নিদয়াকে সে যখন রান্না করে খাইয়েছিল তখন অহেতুক কোনও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়নি। লক্ষ্মণ সীতার সুবিধে-অসুবিধের দিকে নজর রাখে, রামের চাইতে সে সীতার প্রতি তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল। তবে সীতাকে শেষ অবধি রক্ষা করার সামর্থ রামানুজের ছিল না। মহাকাব্যের প্রচলিত রূপ-রীতির মধ্যে ঘর-সংসারের এই কথাগুলি ঢুকিয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই বলেই সীতার গানে বিকল্প রামকথার আভাস পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ মুকুন্দের কাব্যকে মহাকাব্য বলতে নারাজ, সে কাব্যে ও অন্যান্য সেকেলে কাব্য-আখ্যানে মহাকাব্যের বড়ত্বকে খুঁজে পাওয়া যায় না বটে, তবে ধর্মকেতুর মতো ঘরযোগে রান্না করা এক পুরুষের ছবি মুকুন্দের কাব্যকে সমমর্মী মানুষের কথা করে তোলে। সেই সত্যটুকু রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। মুকুন্দের কাব্যে রবীন্দ্রনাথ দারিদ্রের স্পষ্ট ছবি দেখতে পেয়েছেন। দারিদ্রের সেই স্পষ্টতায় কাব্য খুঁজে পাননি। এ কাব্য কেবল স্পষ্ট দারিদ্রের কাব্য নয়, অসংবেদনশীল ব্যাধ কালকেতু, কায়স্থ ভাঁড়ু দত্ত, স্বর্ণবণিক মুরারি শীলের কাব্য নয়– সমমর্মী ধর্মকেতুরও কাব্য। মহাভারতের বনপর্বে ছিল ধর্মব্যাধের কাহিনি। ধর্মব্যাধ দয়াধর্ম বা সমমর্মিতার ধর্ম অনুশীলন করতেন। তিনি, ‘দেবতা অতিথি ও ভৃত্যদের ভোজনের পর অবশিষ্ট অন্ন’ গ্রহণ করতেন। খাওয়ার বিষয়ে এই সংযমই ধর্মব্যাধকে অপরের প্রতি সমানুভূতিসম্পন্ন করে তুলেছিল। ধর্মব্যাধের গল্প বঙ্গদেশে খুবই জনপ্রিয় ছিল। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, উনিশ শতকে মহাভারতের ধর্মব্যাধের গল্প বঙ্গদেশে ‘কাগিবগির গল্প’ নামে সুপরিচিত ছিল। ধর্মকেতুর মধ্যে ধর্মব্যাধের আদল রয়েছে। খাওয়া, স্বার্থপরের মতো খাওয়া, ধর্মব্যাধের স্বভাব নয়। অতিথি ও ভৃত্যদের খাবার দিয়ে যেটুকু থাকে তাই তিনি গ্রহণ করতেন।

মহাপ্রস্থানের পথে যখন ভীম পড়ে গেলেন তখন যুধিষ্ঠির তাঁকে বলেছেন, ‘তুমি অত্যধিক ভোজন করতে’। খাদ্যলোলুপতা রিপু বিশেষ– অন্যের কথা না ভেবে নিজে খাওয়া, সব খাবার নিজের জন্য দখল করা পাপ। অত্যধিক ভোজনের ইচ্ছে সামাজিক অসামঞ্জস্য তৈরি করে। কেউ বেশি খায়, কেউ খাবার পায় না। ফরাসি বিপ্লবের আগে, সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে খাদ্যের সারিতে আর অভিজাতবর্গ ফেলা-ছড়া করে খাচ্ছেন। খাদ্যরতি থেকে মুক্তির প্রাথমিক উপায় হতে পারে অন্যের জন্য নির্লোভ চিত্তে রান্না করা। ঘরযোগের রান্না, যেহেতু সেখানে মজুরির প্রশ্ন ওঠে না, নিঃস্বার্থ রান্না। মজুরিহীন এই রান্নার অনুশীলনে মানুষের আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের বদল ঘটে। ধর্মকেতুও রান্নার আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাঁর স্ত্রীর প্রতি সমমর্মী হয়ে উঠেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী আরেকজন সমমর্মী মানুষের কথা এই সূত্রে মনে পড়বে, তিনি কাব্যের চরিত্র নন, বাস্তব মানুষ। তিনিও ঘরযোগে রান্না করতেন, দয়াধর্মের অনুশীলন করতেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্রের ছাত্রজীবন দারিদ্রের মধ্যে কেটেছিল। কায়িক শ্রম তাঁর জীবনে অনিবার্য। উনিশ শতকের আর কোনও বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তককে বিদ্যাসাগরের মতো এইরকম গৃহশ্রম করতে হয়নি। বিদ্যাসাগরের মুখ থেকে তাঁর সেই জীবনযাপনের কথা শুনেছিলেন জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। লিখেছেন,
‘তিনি বলিয়াছেন, কখন অন্ন জুটিত কখন জুটিত না; যখন জুটিত তখন সকল সময় পেট ভরিয়া খাইতে পাইতেন না। যখন পেট ভরিয়া অন্ন জুটিত, তখন আবার অনেক সময়ে ব্যঞ্জনের অভাবে, কেবল নুন ভাতে দিনপাত করিতেন; যখন তরকারি ও মৎস্য পাইতেন, তখন মৎস্যের ঝোল রাঁধিয়া এক বেলা ভাত আর সেই ব্যঞ্জনের ঝোল খাইয়া, বৈকাল বেলার জন্য তরকারী ও মৎস্য রাখিয়া দিতেন, বৈকালে সেই ব্যঞ্জনের তরকারী দ্বারা অন্ন উদরস্থ করিয়া, মাছগুলি পরদিনের জন্য রাখিয়া দিতেন; পরদিন সেই মাছের অম্বল রাঁধিয়া তাহার দ্বারাই সেদিনকার আহার সমাপন করিয়া পরিতৃপ্তি লাভ করিতেন।’
এই দারিদ্র কিন্তু বিদ্যাসাগরকে আত্মকেন্দ্রিক করেনি। শ্রমনিষ্ঠ বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাসাগরও গৃহশ্রম করতে দ্বিধা করতেন না, রান্না ও অন্যান্য কাজে হাত লাগাতেন। তাঁর দয়াধর্মের ভিত্তি এই ঘরের কাজের পারঙ্গমতা।
রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে বিদ্যাসাগর ‘সীতার বনবাস’ রচনা করেছিলেন। তাঁর ‘সীতার বনবাস’-এর রাম খুবই কোমল চরিত্র। বাল্মীকি রামায়ণ নয়, বিদ্যাসাগরের অবলম্বন ভবভূতির নাটক। বিদ্যাসাগরের রচনায় দুর্মুখের মুখে রামসীতার অপবাদের কথা শুনেই ‘ছিন্ন তরুর ন্যায় ভূতলে পতিত হইলেন।’ বিদ্যাসাগরের এই কোমলহৃদয় রামচন্দ্রকে বঙ্কিমচন্দ্র পছন্দ করতেন না। ভবভূতি ও বিদ্যাসাগর, দু’জনকেই বঙ্কিম সমালোচনা করেছেন। ‘উত্তরচরিত’ প্রবন্ধে বঙ্কিম লিখেছিলেন, ‘সীতার অপবাদ শুনিয়া ভবভূতির রামচন্দ্র যে প্রকার বালিকাসুলভ বিলাপ করিলেন, তাহাই ইহার উদাহরণস্থল।… এত বালিকার মত কাঁদিলে রামচন্দ্রের প্রতি কাপুরুষ বলিয়া ঘৃণা হয়।’ বঙ্কিমচন্দ্র যখন এই প্রবন্ধ লিখছিলেন, তখন দেশকালের অবস্থা তাঁকে চেতনে-অবচেতনে প্রভাবিত করেছিল। মেকলের মতো ইংরেজ শাসকেরা সে-সময় ভারতীয়দের মেয়েলি বলে চিহ্নিত করতেন। সাহেবরা মনে করতেন ও প্রচার করতেন, মেয়েদের মতো রোদন-পরায়ণ বলেই ভারতীয়দের, বিশেষ করে হিন্দুদের, এই দুরবস্থা– যুদ্ধে পরাভূত হয়েছে মেয়েলি হিন্দুর দল। বঙ্কিমচন্দ্র সাহেবদের এই অভিযোগ খণ্ডন করতে চান, ভবভূতির ও ভবভূতির নাটক অবলম্বনে রচিত বিদ্যাসাগরের রামের কান্নাকাটিতে বঙ্কিম তাই বিরক্ত। পুরুষালি রামই তাঁর আদর্শ।
সেকালের বাংলা সাহিত্যে ধর্মকেতুর মতো রন্ধনপটু পুরুষ দ্বিতীয়টি চোখে পড়বে না। সেকালের খাই-খাই পুরুষের দলে ধর্মকেতুই কেবল আদর করে রান্না-বান্না করা পুরুষ। সে কেবল কেড়ে খায় না, দিতেও জানে। এই আদরের রান্নায় সে তার নিজের স্বার্থসীমাকে অতিক্রম করতে পেরেছে। তার ধর্ম নামটি সার্থক। ধর্মের মধ্যে ঔচিত্যের আদর্শ থাকে। পারিবারিক জীবনে সেই আদর্শ থেকে আমাদের মহাকাব্যের নায়কেরা অনেক সময় বিচ্যুত হন।
অথচ আর এক দিক দিয়েও এই কান্নার বিষয়টি ভাবা চলে। ভবভূতির কথা থাক, বিদ্যাসাগরের দয়াধর্মে কান্নার ভূমিকা গভীর। মহাভারতে ‘অনুক্রোশ’ বলে একটি ধারণা রয়েছে। অনুক্রোশের সোজা-সাপটা অর্থ সহ-ক্রন্দন। মহাভারতে ধর্মব্যাধের কাহিনিতে এই অনুক্রোশের কথা এসেছে। কোনও মানুষ বা প্রাণি কষ্ট পাচ্ছে প্রত্যক্ষ করলে যে সহবেদনা, তার থেকেই সহ-ক্রন্দন। বিদ্যাসাগর বিধবার দুঃখে কেঁদেছেন, দুর্ভিক্ষের সময় খেতে না-পাওয়া মানুষের জন্য কেঁদেছেন। বাগদি বউ-এর রুক্ষচুলে নিজের হাতে তেল মাখিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। সাঁওতালরা এই বিদ্যাসাগরকে কতটা কাছের মানুষ ভাবতেন ও বিদ্যাসাগর কী যত্ন নিয়ে তাদের খাওয়াতেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নিজের চোখে তা দেখেছেন, লিখেছেন।

ছেলেবেলা থেকে রান্নাবান্না ও অন্যান্য গৃহশ্রম করতেন বলেই বিদ্যাসাগরের পুরুষের অহং প্রশমিত হয়েছিল, তাঁর আত্মকেন্দ্রিকতার প্রাচীর ধূলিসাৎ হয়েছিল, তিনি অন্যের দুঃখ স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। তাঁর মায়া-মমত্ব-দয়ার অনুশীলন এই ঘরযোগে রান্না করা, খেতে দেওয়া থেকেই শুরু হয়েছিল। দয়াবৃত্তি যে তিনি মেয়েদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন, তা বহুবার স্বীকার করেছেন। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস একবার ক্ষুধার্থ অবস্থায় দুপুরবেলায় একটি দোকানে এসে জল চেয়েছিলেন। সেই দোকানে সেই সময় যে মধ্যবয়সী বিধবা রমণী ছিলেন, তিনি দই এনে ক্ষুধার্থ ঠাকুরদাসের ফলাহারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই রমণীর প্রতি বিদ্যাসাগরের কৃতজ্ঞতা গভীর। নিজের অসম্পূর্ণ জীবনচরিতে লিখেছিলেন, ‘এই দোকানের মালিক, পুরুষ হইলে, ঠাকুরদাসের উপর কখনই, এরূপ দয়াপ্রকাশ বা বাৎসল্যপ্রদর্শন করিতেন না।’ বিদ্যাসাগর সারাজীবন মেয়েদের মতো দয়াপ্রকাশ ও বাৎসল্যপ্রদর্শন করেছেন– পৌরুষের যে চরিত্র বঙ্কিমের পছন্দ, তার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মিল নেই, মিল থাকার প্রয়োজনও নেই। বিদ্যাসাগর বাঙালি মেয়েদের ঘরের মমত্বকে তাঁর সমাজসংস্কার কার্যে ও দয়াবৃত্তির অনুশীলনে ব্যবহার করেছিলেন।
ঘরযোগে আমরা যা শিখি বারযোগেও তা ব্যবহার করা চলে। ঘরযোগের শিক্ষাকে বারযোগে ব্যবহার করেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসের হাজারি ঠাকুরও। হাজারি ঠাকুর বিদ্যাসাগরের মতো রান্না-খাওয়ার বৃত্তিকে দয়াবৃত্তির বৃহৎ সামাজিক পরিসরে অবশ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, সকলে এক মাপের মানুষ হন না। হাজারির রান্নার ঘরানায় এড়শোলা গ্রামের এক ব্রাহ্মণ বিধবার শিক্ষা মিশেছিল। বিভূতিভূষণ লিখেছেন,
‘সেই বৃদ্ধা হাজারির মাকে একটিমাত্র জিনিস শিখাইয়াছিলেন এবং সেই একটি জিনিস রাঁধিবার গুণেই হাজারির মায়ের নাম ও-দিকের আট-দশখানা গ্রামে প্রসিদ্ধ ছিল। শুনিতে অতি সামান্য জিনিষ – নিরিমিষ চচ্চড়ি, ওর মধ্যে আছে কি? কিন্তু এ-কথার জবাব পাইতে হইলে হাজারির মায়ের নিরিমিষ চচ্চড়ি খাইতে হয়।’
সেই ব্রাহ্মণের বিধবা কিম্বা হাজারির মা তাঁদের রান্নার বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করতেন না। ঘরযোগের রান্না তো টাকার জন্য নয়। বঙ্গীয়সমাজ ব্যক্তি মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমের সহযোগে দীর্ঘদিন সজীব ছিল, নিজেদের দায়-দায়িত্ব নিজেরাই তাঁরা গ্রহণ করতেন। সামাজিক উৎসবে বাড়ির মেয়েদের দলবেঁধে রান্নার চল ছিল। পরিবেশন ইত্যাদির কাজে অনেক সময় ছেলেরা হাত লাগাতেন। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ও পুঁজির হিসেবের বাইরের সমাজজীবনের এই যৌথতার কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশি সমাজের ভাবনায় উচ্চারণ করেছিলেন।
মায়ের হাতের ঘরযোগের রান্না হাজারি বারযোগে নিয়ে এসেছিল। প্রথম যে হোটেলে হাজারি চাকরি নিয়েছিল, সেই হোটেলের মালিক বেচু চক্কোত্তি ও তার অপকর্মের শরিক পদ্ম ঝি হাজারির মর্ম বোঝেনি। বেচু আর পদ্ম ঝি মিলে বেশি পয়সা নিয়ে খারাপ খাবার দিত খদ্দেরদের। হাজারি তার ঘরযোগের রান্নার গুণ যখন বারযোগে লাগাল, তখন সে বেচু চক্কোত্তির মতো হোটেলের ব্যবসাকে লোক ঠকানোর ব্যবসা হিসেবে দেখল না। স্বপ্ন দেখত হাজারি, তার হোটেলের বাইরে লেখা থাকবে, ‘হাজারি চক্রবর্তীর হিন্দু হোটেল /রাণাঘাট/ ভদ্রলোকের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান।’ পথে নানা কাজে বেরিয়েছে যারা, তাদের যত্ন করে খাইয়ে দাইয়ে বিশ্রাম করার পরিসরটুকু দিতে চেয়েছিল হাজারি। এ তো কেবল তার বারযোগের রান্না কিম্বা ব্যবসা নয়, এর মধ্যে মায়েদের ঘরযোগের সেবাধর্ম আর দয়াব্রত মিলে মিশে আছে। ঘর আর বার, দুয়ের সহযোগেই গড়ে উঠেছিল হাজারি ঠাকুরের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। বাঙালি পুরুষের রান্নার মাধ্যমে সমানুভূতির অনুশীলনের সামাজিক ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে কেন! বরং নতুন সমাজের house husband-রা এই সমাজ-ইতিহাসের অনুসারী হতে পারেন।
*ছবি সৌজন্য: Star of Mysore, Vam.ac.uk, The Statesman
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২ মে ২০২২।
বিশ্বজিৎ রায়ের জন্ম ১৯৭৮-এ, কলকাতায়। রামকৃষ্ণ মিশন পুরুলিয়ায় স্কুলজীবন কাটিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশুনো। উভয় পর্যায়েই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। বর্তমানে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যজগতে সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ: স্বদেশে সমকালে’, ‘সচলতার গান’, ‘সব প্রবন্ধ রাজনৈতিক’। এর বাইরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুক্তগদ্যের বই ‘ঘটিপুরুষ’, ‘অন্দরবেলা’ ও ‘ইস্কুলগাথা’ এবং পদ্যের বই ‘বিচ্ছেদ প্রস্তাব’ ও ‘গেরস্থালির পদ্য’। ‘ঘটিপুরুষ’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন নীলাঞ্জনা সেন স্মৃতি পুরস্কার।