আগুন, বই আর গোলাপ

আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] []

নকশালদের বোমা, ধোঁয়া, গোলাগুলি, অ্যাকশনের পাশাপাশি আর এক রাজনীতি বহাল ছিল কলেজপাড়ায়। হপ্তায় বার দু’য়েক অন্তত ইউনিভার্সিটির ক্লাস ভাঙলে জনাকয়েক ছেলেমেয়ে নিয়ে কংগ্রেসের চিত্রিতা ব্যানার্জি হইহই করে ঢুকে পড়বে ক্লাসে। আর শুরু করে দেবে প্রচার।
– এই যে এক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি এর কি পরিবর্তন হবে না? সে পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের এবং তোমাদের…
ইত্যাদি, ইত্যাদি।
ক্লাসের ব্রেক, একটু পরেই আবার নতুন পিরিয়ড, কে আর বসে রোগা, ফর্সা চিত্রিতার ঝোড়ো প্রচার শুনবে? ক্লাসও খালি হচ্ছে, চিত্রিতাও বক্তব্য গোটাচ্ছে, একসময় ক্লাসরুমের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছেন অধ্যাপক। দেখতে দেখতে এই ক্যানভাসিংয়ের নামকরণই হয়ে গেছিল ব্রেক ডান্স।

কলেজ স্ট্রিটের বিশ পা অন্তর অন্তর তখন কোনও না কোনও পার্টির ছোকরাদের জটলা। থেকে থেকে স্লোগান। সবই যেন ভর বিকেলের কিছু না কিছু অ্যাকশনের পূর্বরাগ। পূর্বরাগের আর এক নিপুণ ছবি ইউনিভার্সিটির মেন গেটের মুখেই। যেখানে এক অত্যন্ত রূপসী তরুণী মস্ত কৌটো ঝাঁকিয়ে পয়সা চায় হর হপ্তা। চোখকাড়া সুন্দরী বলে একবারের জায়গায় দু’বার দেখে অনেকে আর খেসারতের কয়েন ফেলে কৌটোয়। আমার কপাল, এক আধবার চার আনা কী আধুলি ফেলেছিলাম ওর কৌটোয়, তারপর আর ছাড়েই না। ছুট্টে এসে ‘দাও, দাও’ করে চার, ছ’আনা নেবেই। পরে হিসেব কষতাম ক’কাপ কফির দাম গলল। তবু নিয়তি বলে কথা! হাল্কা পাড়ের সাদা শাড়ির যে-নিয়তির নাম– বান্ধবী বন্দনার কাছে জেনেছিলাম— বৃন্দা দাস। 

Gopalan and Karats Kolkata
ডাকসাইটে বাম নেতা এ কে গোপালন (ডাইনে দ্বিতীয়) ও তাঁর স্ত্রী সুশীলা গোপালন (একেবারে বাঁয়ে) তরুণ নেতা-নেত্রী বৃন্দা দাস (কারাট) ও প্রকাশ কারাট

একদিন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ইউনিভার্সিটি ঢুকছি, বৃন্দা কৌটো ঝাঁকিয়ে এসে পড়ল মুখে। পকেটে হাত গলিয়ে কোনও কয়েন পেলাম না। উঠল গোটা কয়েক এক টাকার নোট। তখন সটকে পালাবার চেষ্টা করছি, বৃন্দা ধেয়ে এসে বলা ধরল,
– কী আছে? একটা নোটই দাও।
বলা বাহুল্য, দিলাম এবং বিকেলের কফি কার্টেল করলাম। বান্ধবীর মন্তব্যও শুনতে হল,
– সিপিএমের এই ফিমেল ব্রিগেড কিন্তু খুব কাজে দিচ্ছে।
কিছুদিনের মধ্যেই খবরে এল বৃন্দা। কাগজেই জানা গেল কী কারণেই যেন পুলিশ আটকেছিল বৃন্দাকে এবং স্বয়ং জ্যোতি বসুর টেলিফোন পেয়ে ওকে ছেড়ে দেয়। এরপর যা দেখা গেল তাকে বলা যায় ‘the rise and rise and rise of Brinda Das’ এবং একসময় প্রথম শ্রেণির নেত্রীও হল, আর আরও পরে প্রকাশ কারাটের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে বৃন্দা কারাট। এই প্রকাশ কারাটদের আপত্তিতেই সে-সময় জ্যোতি বসুর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া হল না আর বিষণ্ণ জ্যোতিবাবু ব্যাপারটাকে বর্ণনা করলেন ‘a historic blunder’ বলে। আমার মনে পড়েছিল বৃন্দাকে ছাড়াতে ওঁর ফোনের কথা। এবং কেন জানি না মনে হয়েছিল ওঁর এই মন্তব্যের গুরুত্বও ঐতিহাসিক, ইতিহাস যা প্রমাণও করেছে। 

Desmon Doig Kolkata
দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার ডাকসাইটে সাহেব এডিটর ডেসমন্ড ডয়েগ

এইভাবেই আগুন, বই আর গোলাপ নিয়েই চলছিল কলেজ, ইউনিভার্সিটির দিনগুলো। হঠাৎ কী ভেবে জানি ইংরেজিতে একটা প্রেমের কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলাম জুনিয়র স্টেটসম্যান (JS) পত্রিকায়। এবং ক’দিন বাদে তা ছেপে বেরিয়েও গেল। একটা কমপ্লিমেন্টারি কপিও এল বাড়িতে। পাড়ার বন্ধু শ্যামল, চন্দন, খোকন ধরল কবিতার পেমেন্টের টাকায় ওদের মাল খাওয়াতে হবে। কিন্তু আমি তো জানিই না কবিতার কোনও পেমেন্ট হয় কিনা, এবং তা হলে কত হয়। তা শুনে চন্দন ওর বাপি বাড়ি যা মুডে চলে গেল। 
– হার্গিস দেবে ওরে ন্যাকা। একটা ফোন তো কর ভালমানুষের পো।
করেছিলাম। ধরেছিল ওদের এডিটিং স্টাফের এক ছোকরা চার্লি বোস, যার আসল নাম নাকি সাধন বোস। পত্রিকার ডাকসাইটে সাহেব এডিটর ডেসমন্ড ডয়েগ-এর খুব কাছের মানুষ। ও বলল,
– তোমার চেক চলে গেছে। ডেসমন্ডের খুব ভাল লেগেছে। তুমি যদি অন্য কিছু লিখতে চাও ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারো।
কবিতার পঁচিশ টাকায় এক সন্ধ্যায় প্রচুর বাংলা খাওয়া হল বন্ধুদের সঙ্গে। ওঁরা উস্কোলো,
– দেখা কর সাহেবের সঙ্গে। ফায়দা আছে। ভাল মালফালও তো খেতে হবে, নাকি?

পূর্বরাগের আর এক নিপুণ ছবি ইউনিভার্সিটির মেন গেটের মুখেই। যেখানে এক অত্যন্ত রূপসী তরুণী মস্ত কৌটো ঝাঁকিয়ে পয়সা চায় হর হপ্তা। চোখকাড়া সুন্দরী বলে একবারের জায়গায় দু’বার দেখে অনেকে আর খেসারতের কয়েন ফেলে কৌটোয়। আমার কপাল, এক আধবার চার আনা কী আধুলি ফেলেছিলাম ওর কৌটোয়, তারপর আর ছাড়েই না। ছুট্টে এসে ‘দাও, দাও’ করে চার, ছ’আনা নেবেই। পরে হিসেব কষতাম ক’কাপ কফির দাম গলল। তবু নিয়তি বলে কথা! 

বুঝলাম হক কথা। কিন্তু ভাবনা হল কী লেখার কথা বলব? ডয়েগের ঘরে যখন ঢুকছি আমার জগত থেকে দুটো বিষয় উঠে আসছে। সেতার শিল্পী উস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহেবের বাড়িতে খুব যাতায়াত আমার। শিল্পীর ন’বছরের ছেলে সুজাতের দুর্ধর্ষ প্রথম সেতার অনুষ্ঠান শোনা হয়েছে। সেই থেকে মাথায় ঘুরছে ওকে নিয়ে কিছু লেখার কথা। আর দ্বিতীয় ভাবনাটা প্রফেসর পি লালকে নিয়ে, যিনি মহাভারত চর্চার জন্য নেহরু স্কলারশিপ পেয়েছেন এবং খুব শিগগির আমাদের এমএ-র ক্লাস নেওয়া ছেড়ে দেবেন। শোনামাত্র ডয়েগ বললেন,
– দুটোই চাই। কোনটা আগে দেবে বলো?
– লালের লেখাটা। কারণ ওটা বাড়ি গিয়েই বসে লিখে ফেলতে পারব। সুজাতের লেখাটার জন্য আমায় বিলায়েত খাঁ সাহেবের বাড়ি যেতে হবে। আর আর উনি ও সুজাত কলকাতায় আছেন কি না তাও দেখতে হবে।
– ফাইন! তুমি লেখাটাই আগে দাও।

খুব শিগগিরই দিয়েছিলাম এবং ‘পোয়েট প্রফেসর পি লাল’ হেডিং দিয়ে ডয়েগ সেটা বার করলেন। আমি দেখা করতে সাহেব ওঁকে লালের লেখা একটা চিঠি দেখালেন। কবি-অধ্যাপক লিখছেন, ‘Doig Sahib! Thanks for making some room for me in your JS.’ তারপর চিঠিটা মুড়ে দেরাজে রাখতে রাখতে বললেন,
– আশা করি তুমিও খুশি। এবার তুমি জে এস-এর জন্য জুনিয়র জিনিয়াসটার খোঁজে বেরোও। I mean Shujat. 

Purushottam Lal Kolkata
স্যর পুরুষোত্তম লালের বাড়ির দেওয়াল বলতে বই, বই আর বই

ক’দিন বাদেই দ্বারভাঙা হলে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল প্রফেসর লালকে। ওঁকে ভাল চিনি বলে আয়োজকরা আমাকেই জিজ্ঞেস করল কী বই দেওয়া যায় স্যরকে। বলেছিলাম,
– স্যরের বাড়ির দেওয়াল বলতে বই, বই আর বই। বই দিলে জেনে নেওয়া ভাল কী বই পেলে খুশি হবেন।
সেই মতন ওরা ওঁকে জিজ্ঞেস করাতে উনি চেয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে চার খণ্ডের মহাভারত। আমাকে কোনও কবিতা বা গদ্য পাঠ করার জন্য বলা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। শুভরঞ্জন একটা ছোট বক্তৃতা করেছিল স্যরের ক্লাস করা নিয়ে। আমার ইচ্ছে ছিল স্যরের ইংরেজিতে অনুবাদ করা মহাভারতের দু’এক পাতা পড়ব। পরে ভাবলাম স্যর নিজেও হয়তো তেমন কিছু পড়তে পারেন। তারপর ভাবলাম স্যরের অনুবাদে কবি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ পড়ব। পরে সেই চিন্তাও বাতিল করে এক অদ্ভুত নির্বাচন করলাম। অনুষ্ঠানের মাত্র এক বছর আগে আততায়ীর গুলিতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের অসাধারণ বক্তৃতা ‘I have a dream.’ যা তিনি ১৯৬৩-তে ওয়াশিংটনে সিভিল রাইটস মার্চের বিপুল জনসমাবেশে করেছিলেন। বক্তৃতাটা পড়ার সময় গলা কীরকম কেঁপে উঠল যখন পড়ছি : 

“I have a dream that my four little children will one day live in a nation where they will not be judged by the color of their skin, but by the content of their character. I have a dream today, a dream deeply rooted in the American dream— one day this nation will rise up and live up to its creed, ‘we hold these truths to be self-evident : that all men are created equal’.” 

বিলায়েত খাঁ সাহেবের পার্ক সার্কাস অঞ্চলের মেহের আলি লেনের বাড়িতে গিয়ে বেশ হতাশই হতে হল। সপ্তাহখানেক আগেই তিনি ছেলে সুজাতকে নিয়ে দেরাদুন রওনা হয়ে গেছেন, যেখানে তাঁর নিবাস এখন। কলকাতায় আসেন বছরে বার পাঁচেক, বিশেষত শীতকালে। যখন জলসায় জলসায় বাজনা থাকে। ওঁরই পিতৃপীঠ পার্ক সার্কাসের এই বাড়ি। লম্বা বৈঠকখানার গোটাটাই গালিচা পাতা। আর দেওয়াল জুড়ে মস্ত মস্ত অয়েল পেইন্টিং। বাবা উস্তাদ এলায়েত হুসেন খাঁ, ঠাকুর্দা উস্তাদ এমদাদ হুসেন খাঁ, বড় ঠাকুর্দা উস্তাদ শাহাবদাত খাঁ সবাই শোভা পাচ্ছেন সেই সব ছবিতে। আমার সামনে এক পেয়ালা চা, এক প্লেট মেঠাই আর খাঁ সাহেবের ছোট ভাই সেতারি উস্তাদ ইমরাত হুসেন খাঁ। আমি খুব চুপচাপ দেখে বললেন,
– এত কী ভাবছ শঙ্করবাবু?
তখন বললাম ব্যাপারটা। শুনে বেশ আওয়াজ করে হাসলেন ইমরাতভাই,
– তাতে অত কী প্রবলেম? দাদার ছেলে নেই তো কী? এই ভাই তো আছে। এই তো ইংল্যান্ড ট্রিপ করে এলাম সুরবাহার আর সেতার বাজিয়ে। তা আমাকে নিয়ে লেখা যায় না? দাদা আর সুজাতকে নিয়ে তো পরে লিখতেই পারো। 

Imrat Khan
ছত্রিশ বছর বয়েস তখন ইমরাত খাঁর। বিশ্ববিখ্যাত দাদার ছায়ায় ঢাকা

ছত্রিশ বছর বয়েস তখন ইমরাত খাঁর। বিশ্ববিখ্যাত দাদার ছায়ায় ঢাকা। ভাবলাম এও তো এক স্টোরি অ্যাঙ্গেল। তাই কথাও শুরু হয়ে গেল। তখনও টেপ রেকর্ডারের যুগ আসেনি। আমার প্রশ্নের জবাবে জবাবে ইমরাত বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে যা-যা বলছেন আমি সবটাই ইংরেজি করে লিখে যাচ্ছি। যা দেখে ইমরাতভাই একবার বলেও বসলেন,
– এ তো দেখছি সেতারের সাপাট তান নিচ্ছ বাবু! 
বলাবলি, লেখালিখির শেষে ইমরাত কতকগুলো চমৎকার সাদা-কালো ফটোগ্রাফ দিয়েছিলেন ওঁর। লেখার সঙ্গে সে-সব দিয়ে এসেছিলাম ডয়েগ সাহেবকে। ডয়েগ মুচকি মুচকি হেসে কপিটা পড়লেন এবং ছবিগুলো দেখলেন। শেষে যা বললেন শুনে গায়ে কাঁটা দিল। ওপরে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে বললেন,
– এখন দ্যাখো আমি কী করি এই স্টোরি নিয়ে। কিন্তু তুমি খেয়াল রেখো বিলায়েত আর ওঁর ছেলে কবে ফিরছে। আর… 
উত্তেজনা চাপতে না পেরে বলে ফেললাম,
– আর?
– সুযোগ এলে তোমাকে দিয়ে একটা ইন ডেপথ স্টোরি করাতে চাই রবিশঙ্করকে নিয়ে। 
ফের উত্তেজনায় উগরে দিয়েছি,
– রবিশঙ্কর! 
ডয়েগ শান্ত দৃষ্টিতে, ঠোঁটে একটা সরু হাসি রেখে বললেন,
– Yes, Ravi Shankar.   (চলবে)

 

*ছবি সৌজন্য: Starsunfolded, Chandrakantha, Nepali Times, Indiaonline

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

3 Responses

  1. ইতিহাস খুড়ে খুড়ে এই যে ঘটনা গুলো আমাদের সামনে তুলে ধরা,এটা একটা অসাধারন কাজ। বোধহয় বৃন্দা কারাত কে এইভাবে পরিচিত কেউ করায় নি , অন্তত আমি পাইনি । অশেষ ধন্যবাদ স্যার!! সন্তোষ বন্দোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *