আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯]

জ্যোতিবার মৃতদেহ অপেক্ষা করছে। দাহকার্যের সব প্রস্তুতি শেষ। সাবিত্রীবাঈ, যশবন্তরাও, রাধাবাঈ সবাই উপস্থিত শেষযাত্রায়। তবু শুরু হচ্ছে না অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। কারণ ‘যশবন্তরাও মুখাগ্নি করবেন কোন অধিকারে? সে আমাদের পরিবারের কে?’ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ফুলে পরিবার। পুণের সেই ফুলে পরিবার, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের কথন। দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও অর্থশালী ছিল ফুলে পরিবার। রাজবাড়িতে ফুল সরবরাহ করত তারা। সেই বাড়িতেই বিয়ে হয়ে আসে সাবিত্রী, সেই সাবিত্রী, যিনি এখন শ্মশানের একদিকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। তাঁর এতদিনের সহযোদ্ধা, শিক্ষক এবং স্বামী শায়িত– মুখাগ্নির অপেক্ষায়। অপেক্ষা– কারণ কে মুখাগ্নি করবে, অন্ত্যেষ্টির অধিকার কার, তা নিয়ে তখনও চলছে তুমুল তরজা। 

ফুলে পরিবার যশবন্ত রাওয়ের অধিকার মানতে নারাজ। কে কোন বিধবার সন্তান, তাঁকে জ্যোতিবা ফুলের মতো মানুষের মুখাগ্নির অধিকার দিতে হবে? তাও কি সম্ভব? এদিকে যশবন্তরাও শুধু জ্যোতিবা সাবিত্রীর দত্তক সন্তান নন, তাঁদের মানসপুত্রও বটে। তাঁর পালক পিতামাতা জ্যোতিবা ও সাবিত্রীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ডাক্তারির ছাত্র সে। একাধারে ডাক্তারির পড়াশোনা, সত্যশোধক সমাজের কাজ সামলান তিনি। কোনওমতে নতুন বউয়ের সামনে নিজেকে শক্ত রাখেন যশবন্ত। বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েক বছর। স্বয়ং জ্যোতিবা সাবিত্রী দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁদের বিয়ে তৈরি করে নতুন এক ইতিহাস। 

কী ইতিহাস? আর কেনই বা তার ইতিহাস গৌরবপ্রাপ্তির?

সেই ১৮৮৮ সালে, আজ থেকে ১৩৩ বছর আগে যশবন্ত আর রাধার বিবাহ সম্পন্ন হয় সম্পূর্ণ ধর্মহীনভাবে। হিন্দু বা মুসলিম, দলিত বা ব্রাহ্মণ কোনও পরিচয়ই সেই বিবাহে ছিল না, সত্যশোধক সমাজের নিয়ম অনুসারে একরকম আইনি বিয়ে বা রেজিস্ট্রি হয় তাঁদের। মনে রাখতে হবে, সময়টা ১৮৮৮। ব্রাহ্মসমাজ বা ব্রাহ্মমতে বিয়ের প্রচলন, এবং সেই সংক্রান্ত আইন পাশ হয় ১৮৭২ সালে। সেই বিবাহে কিন্তু অনুসরণ করা হত বৈদিক নীতি। কাজেই সে অর্থে হিন্দু সমাজের এবং বেদের সমস্ত ধর্মীয় রীতিনীতি বিসর্জিত বিবাহ, শুধুমাত্র আইনি কাগজে সই করে কোনও ধর্মের কোনও আচরণ না মেনে বিবাহে এই সত্যশোধকী বিবাহই প্রথম। আরও অনেক কিছুর মতই জ্যোতিবা সাবিত্রী এই ব্যাপারেও অগ্রদূত।

আর শুধু বিয়ে তো নয়, সব বিষয়েই যশবন্তরাও যে ছিলেন জ্যোতিবা-সাবিত্রীর আদর্শে প্রাণীত, সে কথা আমরা আগেও বলেছি। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর অর্থাৎ ১৮৮৩ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত জ্যোতিবার সর্বপ্রকার কাজে সহায়ক ছিলেন যশবন্ত। এই কয়েকটি বছরে জ্যোতিবা তাঁর আগের সব লেখা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন তিনটি বই– ‘সর্বজনীক সত্য ধর্ম পুস্তক’, ‘সত্যশোধক সময়োক্ত’ এবং ‘গ্রামযোশ্য সাম্বন্ধী জাহির কাবার’। এছাড়া সাবিত্রীবাঈয়ের আরও একটি কবিতার বই ‘বাভান কাশী সুবোধ রত্নাকর’ প্রকাশিত হয়।  আগের কবিতার বইটির প্রেক্ষাপট হয়তো ভুলিনি আমরা। বিধবা আশ্রয় কেন্দ্র, দলিত মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে উত্তাল তখন চারপাশ। ফতিমা শেখ, সাবিত্রীর সেই কাহিনি, যেখানে তাঁদের শাড়ি কর্দমাক্ত, ক্লিন্ন হত প্রতিদিন, কিন্তু পরেরদিন আবার একই ঘটনা হত। আবারও দুটি করে শাড়ি নিয়ে বেরতেন ফতিমা, সাবিত্রীরা। 

Jyotiba and Savitri Phule
অন্ত্যেষ্টিতেও জ্যোতিবার উত্তরাধিকার অক্ষুণ্ণ রাখলেন সাবিত্রীবাঈ

 জনমত গড়ে তোলার জন্য ‘তামাশা’ বা পথনাটিকার সাহায্য নেন জ্যোতিবা। প্রদর্শনের সময় সঙ্গে যেত ছোট্ট যশবন্ত, সে স্মৃতিও আমাদের অজানা নয়। এই সময়ই জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন সাবিত্রীবাঈও। যতই অন্যায্য, অন্যায় আচরণ করেছে মানুষ, তাঁদের মন পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন মনীষীরা। সাবিত্রী জ্যোতিবাও তার ব্যতিক্রম নন। ছোট ছোট ছড়ায় নানা সামাজিক বার্তা প্রচার করার চেষ্টা করতেন সাবিত্রীবাঈ। ছড়া ও কবিতা নিয়ে প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৮৫৪ সালে, আর দ্বিতীয় বই ১৮৮৬ সালে অর্থাৎ কর্মজীবনের এই দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে নিজেদের সৃষ্টি সংকলিত করতে থাকেন দুজনেই।  সব কর্মকান্ডেই সমানভাবে যুক্ত থাকেন যশবন্তরাও। 

সেই যশবন্ত এখন শ্মশানের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে ফুলে পরিবারের অন্য সদস্যরা। তুমুল বাকবিতন্ডা তখনও চলছে। কিন্তু সাবিত্রীবাঈ কোথায়? তিনি তো চুপ করে থাকার মানুষ নন। হয়তো, যশবন্তরাওয়ের মতো স্মৃতিভারাক্রান্ত সাবিত্রীও। এক বালিকা বধূর, বয়সে সামান্য বড় কিশোর স্বামীর কাছ থেকে ইংরেজি শিক্ষার স্মৃতি। স্বামীর উৎসাহে দলিত মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর স্মৃতি । স্বামীসঙ্গ এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার স্মৃতি। কত দূরের শহরে বৃহত্তর শিক্ষার স্মৃতি। জীবনের প্রতিপদে, প্রতিটি যুদ্ধে একসঙ্গে পা ফেলার স্মৃতি।

এমন সহজীবন কতজনের আছে? সহজীবনই তো সত্য, সহমরণ তো নয়। আর সাবিত্রী জ্যোতিবার মতো মানুষের কাছে তো নয়ই। তাই শোক নয়, সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন সাবিত্রী। শোকপালন, সহমরণের সিদ্ধান্ত নয়, সহজীবনকে সম্মান জানাবার সিদ্ধান্ত। সবাই তখন উত্তর-প্রত্যুত্তরে ব্যস্ত। যশবন্তরাও বোঝাবার চেষ্টা করছেন, কেন মুখাগ্নিতে তাঁর অধিকার। প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন উত্তেজিত ফুলে পরিবার। কেউ লক্ষ করেনি, এই সময় নিঃশব্দে জ্যোতিবার মৃতদেহের দিকে এগিয়ে যান সাবিত্রী। কেউ বোঝার আগেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। 

হ্যাঁ, স্বামীর মুখাগ্নি করেন সাবিত্রীবাঈ। দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন, তোমাদের মধ্যে উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, তোমাদের অধিকার আছে বা নেই– এই নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু আমার অধিকার নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না, নেই। আজ, সেই ঘটনার দেড়শো বছর পরেও কতজন মহিলা মাথা উঁচু করে এই অধিকারের কথা বলতে পারেন? পুত্র ও কন্যা দুই থাকলে, পুত্র বয়সে ছোট হলেও তারই অন্ত্যেষ্টিতে অগ্রাধিকার। পুত্র না থাকলে জামাতার অন্ত্যেষ্টিতে অগ্রাধিকার, তবু কন্যার সে অধিকার নেই। আর কন্যারই যেখানে অধিকার নেই– স্ত্রীর অধিকারের তো প্রশ্নই নেই। 

savitribai Phule
১৮৯০ সালের পর থেকে শুরু সাবিত্রীর একক যাত্রা

যৌথ জীবনের শুরু থেকে সমাজকে প্রশ্ন করেছেন জ্যোতিবা সাবিত্রী, যৌথ জীবনের শেষেও আবারও সমাজের দিকে স্পর্ধার অঙ্গুলি তোলেন তারা। সমাজ শুরুতেও নিরুত্তর ছিল, এখনও নিরুত্তর থাকে। 

১৮৯০ সালের পর থেকে শুরু সাবিত্রীর একক যাত্রা। জ্যোতিবার যে উত্তরাধিকারের জন্য ফুলে পরিবারের আগ্রাসন, তা যে প্রকৃতপক্ষে আর্থিক উত্তরাধিকার নয়, তা বোঝার ক্ষমতা তাদের ছিল না। সেই উত্তরাধিকার প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার উত্তরাধিকার, দলিতের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের উত্তরাধিকার। নারীশিক্ষা শুধু নয়, নারীর সামগ্রিক সম্মান রক্ষার জন্য লড়াইয়ের উত্তরাধিকার। বিধবা মা ও তাঁর পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের সম্মানজনক জীবনের ব্যবস্থা– এতবছর পরেও এতটাই বিরল, যে তাকে অসম্ভবও বলা চলে। 

এই উত্তরাধিকারের কিছুটা বোধ, কিছুটা হলেও আভাস ছিল দত্তকপুত্র যশবন্তের। তাই সাবিত্রীবাঈয়ের এককজীবনের সংগ্রামে সঙ্গী ছিলেন যশবন্তই। জ্যোতিবার মৃত্যুর পর সত্যশোধক সমাজের এক সর্বভারতীয় কনভেনশন আহ্বান করেন সাবিত্রী নিজে। জ্যোতিবার উত্তরাধিকারকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা নয়, তাকে সারা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে যান শেষপর্যন্ত। এর কিছুদিনের মধ্যেই মহারাষ্ট্রে আছড়ে পড়ে বিউবনিক প্লেগ, তার ভয়াবহতার কথা ইতিহাস মনে রেখেছে। হয়তো মনে রাখেনি সেই ঘটনার কথা, যেখানে ৬৫ বছরের সাবিত্রীবাঈ এক অসুস্থ বালককে কাঁধে নিয়ে পায়ে হেঁটে পুণেতে পৌঁছন। বালকটি প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু প্লেগ আক্রমণ করে সাবিত্রীবাঈকে। আক্ষরিক অর্থেই মানুষের জন্য মৃত্যুবরণ করেন সাবিত্রীবাঈ, তা আমাদের আর অজানা নয়। 

জ্যোতিবা মারা গেছেন আগেই। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাবিত্রীবাঈও। আর নিয়তির পরিহাস, সেই একইভাবে ডাক্তারির ছাত্র যশবন্ত মানুষের সেবা করতে করতেই আক্রান্ত হন প্লেগে। মৃত্যু হয় তাঁরও। রাধিকাবাঈ, তাঁর শিশুপুত্র এই বিশাল পৃথিবীতে মানসপুত্রের উত্তরাধিকার হয়ে বেঁচে থাকেন। শেষ পর্যন্ত রাধিকাবাঈয়ের পুত্র বা তারও কোনও পরের প্রজন্ম জ্যোতিবার উত্তরাধিকার বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে কিনা, তা জানা নেই। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক খননের প্রয়োজনীয়তা আগেও বলেছি আমরা। 

তবে উত্তরাধিকার তো শুধু বংশের নয়, রক্তেরও নয়। এমনকী সরাসরিভাবে গুরুশিষ্যেরও হয়তো নয়। এ উত্তরাধিকার প্রকৃতপক্ষে আদর্শের উত্তরাধিকার। যে পতাকা কাঁধে তুলে নেন ছত্রপতি সাহু, আরও কয়েক দশক পরে। জ্যোতিবা, সাবিত্রী, ফতিমা শেখ, যশবন্তরাও, ছত্রপতি সাহু– আরও কত জানা, না-জানা নাম। ইতিহাসের উত্তরাধিকারের এই কথনে কোনও ইতি নেই, দাঁড়ি নেই। চরৈবতি, চরৈবতি।

 


ছবি সৌজন্য: The satyasodhak, Republicworld

Isha Dasgupta Author

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *