ভালবাসা পর্ব ১ 

(লীনা উঠে চলে যায়। শেখর হতাশ নয়নে সেদিকে চেয়ে থাকে। তারপর ব্যাগ থেকে আর একটা চকোলেট বার করে খাওয়া শুরু করে। পীযুষ এতক্ষণ সব শুনছিলেন। একটু ইতস্তত করে, উঠে দাঁড়ালেন। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে শেখরের পাশে এসে দাড়িয়ে, একটু মৃদু স্বরে গলা খাঁকারি দিলেন। শেখর চমকে ফিরে তাকায়।) 

 

শেখর: কিছু বলবেন? 

পীযুষ:হ্যাঁ মানে – আমি ওই পাশের বেঞ্চে বসে ছিলাম – 

শেখর: সে তো দেখলাম। আপনার জন্য কেসটা কেঁচিয়ে গেল।  যাক গে, কি বলবেন বলুন। 

পীযুষ: আসলে – ইয়ে মানে, আমি তোমাদের কথা শুনছিলাম – 

শেখর: আপনি আড়ি পাতছিলেন? আপনি তো মহা ডেঞ্জারাস লোক! 

পীযুষ: না না আড়ি পাতিনি। বেশি তো দূর নয় – এমনিতেই শোনা যাচ্ছিল – 

শেখর: অবশ্য আপনার দোষ কি। লীনার যেরকম বাজখাঁই গলা, মাইল খানেক দূরের লোকও শুনতে পাবে। বললাম সুবীর দার ফ্ল্যাটটা খালি আছে – 

পীযুষ: আমি সব কথা শুনতে পাই নি। ওই অল্প স্বল্প – ভাঙা ভাঙা ।  আসলে, তোমার একটা কথা আমায় ভাবাচ্ছে – 

শেখর: কোন কথা? ওই সোহিনীর ব্যাপারটা ? 

পীযুষ: না না, সোহিনীর ব্যাপারটা নয়। তবে সমীর বাবু মানুষটা কিন্তু সুবিধের মনে হল না। ওঁকে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। 

শেখর: ও বাবা, আপনি তো সবই শুনেছেন দেখছি। 

পীযুষ: তখন তোমরা একটু উত্তেজিত ছিলে তো, গলাটা বেশ জোরালোই ছিল। তাছাড়া হাওয়াটাও বোধহয় এদিক থেকে বইছিল। আমাকে ভাবাচ্ছে অন্য একটা কথা। তুমি বললে দশ দিনের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কথাটা কি ঠিক? 

শেখর: নিউজ সাইট গুলো তো তাই বলছে। আপনার ফোনে সার্চ করে দেখুন না। 

পীযুষ: আসলে আমার ফোনটা একটু পুরনো মডেলের। ঠিক স্মার্ট ফোন যাকে বলে, তা নয়। 

(শেখর পকেট থেকে ফোন বার করে দেখায়)

শেখর: এই তো, দেখুন না। (পীযুষ ফোন হাতে নিয়ে পড়ে।)  আরও অনেক সাইটে আছে। সারা পৃথিবীতে নাকি হইচই পড়ে গেছে। 

পীযুষ: এ তো সাঙ্ঘাতিক খবর। এই খবর সত্যি বলে মনে হয় তোমার? 

শেখর: কে জানে? মানুষকে ভয় পাওয়ানোর জন্য হয়ত এই সব ছাপাচ্ছে। 

পীযুষছ কিন্তু সবাই কি ভয় খাচ্ছে? তোমার বান্ধবী তো তেমন ভয় পেয়েছে বলে মনে হল না। 

শেখর: ভয় পেয়েছে। বুঝতে দিচ্ছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুক কেঁপে উঠেছে। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। 

পীযুষ: তাহলে চলে গেল কেন? 

শেখর: সে তো আমি জোর করছিলাম বলে। এখন রাগ করে চলে গেল, কিন্তু একটু বাদে ও এই নিয়ে ভাববে। আর যত ভাববে তত ওর মনে ভয়টা জাঁকিয়ে বসবে। আর তখন ও পস্তাবে। খুব অপরাধ বোধ হবে। দোনামনা দোনামনা করে, শেষ পর্যন্ত আমাকে একটা ফোন করবে। আর তারপর আমরা সুবীরদার ফ্ল্যাটে মিট করব – ওফ ভাবতে পারছি না। 

পীযুষ: বাঃ, তুমি দেখছি মহিলাদের সাইকোলজিটা বেশ ভাল বোঝ। 

শেখর: বুঝতে হয় কাকা! বুঝতে হয়। এইসব মেয়ে তো আপনাদের জেনারেশনের ব্ল্যাক-এন্ড- হোয়াইট সুচিত্রা সেন টাইপ নয়। এরা হল আইটেম নাম্বার যুগের মেয়ে। এদের সাইকোলজি বুঝে না চললে আপনাকে এরা কিমা করে ছেড়ে দেবে। 

পীযুষ: তুমি বলছ এই পৃথিবী ধ্বংসের থ্রেট-টা কাজ করবে? 

শেখর: আলবাত করবে। নাইনটি নাইন পারসেন্ট মেয়ে ভীষণ সেন্টিমেন্টাল, আর ভিতু। আমাদের ছেলেদের প্রব্লেমটা কি বলুন তো? আমরা সেই সেন্টিমেন্টটা ঠিক ঠাক আমাদের ফেবারে ইউজ করতে পারি না। বরং উলটে ওরাই আমাদের সেই সেন্টিমেন্টের ট্র্যাপে ফেলে কেস খাইয়ে দেয়।  কিন্তু আপনি হঠাত্‍ এত ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়লেন কেন বলুন তো দাদু? 

পীযুষ: আবার দাদু কেন? কাকাটাই তো বেশ ছিল। 

শেখর: সে তো – যাকগে কাকাই বলব আপনাকে।  তা কাকা, কেসটা কী? 

পীযুষ কেসটা – মানে – অনেকটা তোমার মতোই।  মানে, কি বলব তোমাকে, আমি একজনের প্রেমে পড়েছি। অথচ তাকে পাচ্ছি না। 

শেখর: করেছ কি কাকা? খুলে বল, খুলে বল। 

পীযুষ: হ্যাঁ খুলেই বলি। তুমি হয়ত তোমার অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। দেখ, আমার বয়স এখন ষাট। পনের বছর আগে আমার পত্নীবিয়োগ হয়েছে। তারপর থেকে আমি একাই থেকেছি। নিজের কাজ কর্মের মধ্যে ডুবে থেকেছি। কোনও সঙ্গিনীর অভাব বোধ করিনি এতদিন। কিন্তু গতবছর রিটায়ার করার পর  থেকেই ভীষণ একা বোধ করছি।  মনে হচ্ছে কেউ একজন সঙ্গী পাশে থাকলে সময়টা কাটত ভাল।   

শেখর কাকা, এই সব ফ্ল্যাশব্যাক ছেড়ে আসল কথাটা বলবে? 

পীযুষ: হ্যাঁ বলছি। সম্প্রতি এক মহিলাকে দেখে আমার হৃদয় একটু দুর্বল হয়েছে। ভদ্রমহিলা রোজ বিকেলে এই পার্ক দিয়ে হেঁটে যান, হেঁটে ফেরেন। 

শেখর: ওই ঝিঙ্কু দেখতে মহিলা? রোজ বিকেলে সেজে গুজে হাঁটতে বেরন তো? চোখে সানগ্লাস, হাতে একটা কালো ব্যাগ। আমি দেখেছি ওকে। তোমার টেস্ট কিন্তু  ফাটাফাটি গুরু। 

পীযুষ: ধন্যবাদ। সত্যি কথা বলতে কি, ও আমাকে পাগল করে দিয়েছে। ওঁকে দেখলে আমার ভেতরটা এমন করে –  নিজেকে ষোল বছরের কিশোর মনে হয়। আমি ওকে দেখবার জন্য রোজ এই বেঞ্চে এসে বসে থাকি। কখনও বই পড়ার ভান করি, কখনও ফোনে কথা বলার ভান করি। কিন্তু আমার চোখ সব সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে চেয়ে থাকে পথের দিকে – তাকে দেখবার আশায়। আমার সারাটা দিন কাটে এই মুহূর্তটুকুর অপেক্ষায়। 

শেখর: আরে বাঃ কাকা বাঃ! কেস তো একেবারে জমে ক্ষীর। তা কতদূর এগিয়েছ? খালি বেঞ্চে বসেই কাটিয়েছ নাকি বিছানা টিছানার দিকে পা বাড়িয়েছ? 

পীযুষ: কী যে বল। আজ পর্যন্ত একটা কথা বলতে পারলাম না – 

শেখর: সেকি? কথা বলনি? এতদিন খালি ঝাড়ি করে গেছ? তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না কাকা। 

পীযুষ: কিন্তু আজ একটা ঘটনা ঘটেছে। 

(পীযুষ পকেট থেকে লিপস্টিকটা বার করে দেখায়।) 

শেখর: এটা কী? লিপস্টিক? গিফট দেবে? প্রথমেই লিপস্টিক? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না। 

পীযুষ: আঃ, আমার কথাটা আগে শোনোই না। লিপস্টিক আমি আনিনি, এটা ওর লিপস্টিক। আজ ব্যাগ থেকে ও ফেলে দিয়ে গেছে। 

শেখর: ইচ্ছে করে, না এক্সিডেন্টালি?   

পীযুষ: কী করে বলব? তবে, একেবারে আমার সামনে এসেই ফেলল তো, তাই ভাবছি এটা কোনও একটা সঙ্কেত হলেও হতে পারে। 

শেখর (গেয়ে ওঠে): যারা যারা টাচ মি টাচ মি টাচ মি, যারা যারা কিস মি কিস মি কিস মি – 

পীযুষ: আঃ কি হচ্ছে? (থেমে)  আমার এখন কী করা উচিৎ বলে মনে হয় তোমার? 

শেখর: খুব সোজা। ম্যাডাম যখন আবার আসবেন, ওনাকে এই লিপস্টিকটা দিয়ে বলবে, আই লাভ ইউ ডার্লিং। 

পীযুষ: আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরাশি শিকার থাপ্পড় আমার গালে, এই পাবলিক প্লেসে। নাহ, আমি উঠি। ভেবেছিলাম তুমি কিছু একটা ভাল এডভাইস দেবে। 

শেখর: কেন সেন্টি খাচ্ছ কাকা? বসো বসো। আমি জানি তোমাদের জেনারেশনের কেসটা আলাদা। কিন্তু লাভ ইস লাভ! সে ওই জেনারেশনই হোক আর এই জেনারেশন। কিন্তু সব জেনারেশনের মেয়েরাই কি সবচেয়ে ভালবাসে বল তো? বার খেতে।

পীযুষ: বার? চকোলেট বার? কিন্তু আমার কাছে তো – 

শেখর: আরে না কাকা, আমি চকোলেট বারের কথা বলছি না। বার খেতে, মানে ভাল ভাল কথা শুনতে ভালবাসে।  এই ধর বললে, তোমাকে খুব ঝাক্কাস দেখাচ্ছে মাইরি। কিম্বা, তোমার মত ঝিঞ্চ্যাক মেয়ে আর দুটো নেই – এই সব কথা ওরা শুনতে খুব ভালবাসে। 

পীযুষ: এসব তুমি কি বলছ কী? ঝক্কাস, ঝিঞ্চাক – মানে কি? 

শেখর: তুমি মাইরি রিপ ভ্যান উইঙ্কিল নাকি? কি করছিলে এতদিন? ঘুমোচ্ছিলে? এখন যদি আমি তোমাকে বাংলা ভোকাবুলারি শেখাতে বসি তাহলে তো সন্ধে হয়ে যাবে। আর ওদিকে তোমার ব্যথা তোমাকে লেঙ্গি মেরে কেটে পড়বে।  

ছব সৌজন্য: Pxhere

সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *