নাটককার, অভিনেতা মনোজ মিত্রের জন্ম ২২ ডিসেম্বর ১৯৩৮, অবিভক্ত বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) খুলনা-সাতক্ষীরার ধূলিহর গ্রামে। সেখান থেকে কলকাতা। ক্রমশ, তাঁর নাট্যকার হয়ে ওঠা, নাট্যদল গড়া, মঞ্চ এবং চলচ্চিত্র উভয় মাধ্যমেই নিজের অভিনয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা…। এই দীর্ঘ ঘটনাবহুল যাত্রা পথের কয়েক ঝলক উদ্ধার করবার চেষ্টা এই সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা লাইভের প্রতিনিধি অন্যমন রায়চৌধুরী।
অন্যমন: কিন্তু আপনি আপনার ঠাকুরদাকে দেখলেন, বলা যায় তাঁকে নকল করলেন, তাতেই হয়ে গেল? গলার চর্চা করতে হল না? কীভাবে হাঁটবেন চলবেন, তার অভ্যাস করতে হল না? আচ্ছা, ধরলাম আপনি না হয় এমনি এমনিই পেরে গেলেন, কিন্তু অন্যদের কীভাবে শেখালেন? ট্রেনিং তো লাগে, তাই না?
মনোজ মিত্র: হুম, তা তো লাগেই। তারপর ১৯৬০ সালে পড়ানোর চাকরি পেলাম রানিগঞ্জের কলেজে। ব্যস, নাটক শেষ। পরে জেনেছিলাম কলকাতার কাছে একটি কলেজের চাকরির চিঠিও এসেছিল, বাবা দেখতে পেয়ে আমার হাতে পড়বার আগেই সোজা ছিঁড়ে ফেলে দেন। কলকাতায় থাকলেই আবার নাটকের ভূত চাপবে মাথায়, সেইজন্যেই। রানিগঞ্জে গিয়ে কলেজের পক্ষ থেকে এলেবেলে কিছু অনুষ্ঠান করা ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি তেমন। প্রায় বছর চারেক পরে এলাম কলকাতার ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজে, তার পরের বছর ১৯৬৫-তে নিউ আলিপুর কলেজ। গবেষণার কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু কলকাতায় ফেরা মানেই আবার নাটকের নেশা।

কাছেই আমার পুরনো নাট্যদলের দফতর, কলেজের পর প্রায় প্রতিদিনই সুন্দরমে যাওয়া শুরু হয়ে গেল। গবেষণা চুলোর দোরে পাঠিয়ে নাটক নিয়ে মেতে গেলাম; এর আগে ১৯৫৭ থেকে তিন বছর কাটিয়েছিলাম সুন্দরম-এ। ১৯৬০-এ আমি আর অতনু দল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। কিছুদিন অভিনয় করেছিলাম শ্যামল ঘোষের ‘গন্ধর্ব’-তে। গন্ধর্ব নাট্যপত্রিকার তখন খুব নামডাক। ওইখানে আমার ‘মোরগের ডাক’ আর ‘নীলকণ্ঠের বিষ’ নাটকদুটো ছাপা হয়েছিল। তারপরেই তো ওই আগে যা বলেছি, চলে যাই রানিগঞ্জ কলেজে। অভিনয় বন্ধ হল, তবে লেখালেখির সময় পেলাম প্রচুর।
বছর তিনেক রানিগঞ্জে কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে দেখি শ্যামল ঘোষ ‘গন্ধর্ব’ থেকে বেরিয়ে ‘নক্ষত্র’ নামে নতুন দল গড়েছেন। উনি ডাকলেন নক্ষত্রে, পার্থ সুন্দরমে। কোথাও না গিয়ে এবার নিজেরা কয়েকজন মিলে দল গড়লাম—‘ঋতায়ন’। অবিশ্যি সে দল বেশিদিন চলেনি। তেমন কিছুই করতে পারছিলাম না, মনে হল আর চেষ্টা করে লাভ নেই। একদিন মিটিং ডেকে দলের সমাধি ঘোষণা করা হল। তারপর কলেজ করি আর বাড়িতে বসে নাটক লিখি, এমনভাবেই ‘চাকভাঙা মধু’ লেখা চলছিল।
মনোজ মিত্র: এমনই এক গ্রীষ্মের দুপুরে পার্থ এল আমাদের বেলগাছিয়ার বাসায়। ‘চাকভাঙা মধু’ যতটা লেখা হয়েছিল পড়লাম, বাকিটা মুখে-মুখে শোনালাম। পার্থর চোখ চকচক করছিল, হঠাৎ খাতাটা টেনে নিয়ে বলল, ‘এটা আমার নাটক, আমায় দে, আমি করব চাকভাঙা মধু।’ বলল, ‘বহুরূপী, নান্দীকার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, চেতনা, নক্ষত্র সবাই কেমন হইচই জুড়ে দিয়েছে, আমরাই কিছু করতে পারলাম না… তুই আবার সুন্দরমে ফিরে আয়। ছেলেবেলায় গড়া দল, তোর মায়া হয় না?’ আমার টেবিলে বসেই কাকে দিয়ে কোন চরিত্র করাবে সব ঠিক করে ফেলল পার্থ। মাতলা- কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, জটা-আমি, অঘোর ঘোষ- জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, বাদামি-অপর্ণা সেন, দাক্ষায়ণী-সোহাগ সেন। আমাকে রাজি করিয়ে ফেলল পার্থ।
অল্পদিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। সুন্দরমের অবস্থা তখন ছন্নছাড়া। যারা নিষ্ঠাবান সদস্য, প্রায় সবাই দল ছেড়ে চলে গেছে। যে দু’-চারজন ছিল, নাটকে কাজ না-পেয়ে দল ছেড়ে চলে গেল। রিহার্সালে লোক হয় না। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় উৎসাহ হারালেন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় সময় দিতে পারবেন না জানালেন, পার্থ নিজেও আসে না, ফিল্মের কাজে ব্যস্ত। সময়মতো আসতেন শুধু অপর্ণা সেন। অনেকদিনই এমন হয়েছে যে, কেবল আমরা দু’জনে রিহার্সাল করেছি। অপর্ণার ধৈর্য অপরিসীম, নিজের হাতে নাটকটা কপি করেছিলেন। শেষে অপর্ণাই একদিন বললেন, ‘সময় অনেক আছে, নষ্ট করা যেতেই পারে, কিন্তু নাটকটা এভাবে নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না…’

হঠাৎ একদিন ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এর বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজরক্ত’ করবার পরে ওর তখন কারও কোনও নাটকই আর পছন্দ হচ্ছে না। কী ভেবে আমায় বলল, কী লিখছেন শোনান না। ‘চাকভাঙা মধু’ শোনালাম। ও বলল, ‘আমি কিন্তু এ নাটক ছাড়ব না।’ কী করব ভাবছি, এর মধ্যে কার কাছে শুনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় খবর পাঠালেন– নাটকটা একদিন অভিনেতৃ সঙ্ঘের ঘরে পড়ে যাও। পড়লাম। সৌমিত্রদা বললেন, ‘আমি করব, তুমি দীপার সহপাঠী, তোমার লেখায় আমার দাবি আগে…’ এ-কথা তো একটু আগেই বলেছি।
এ দিকে বিভাস আর অশোক মুখোপাধ্যায় নাটকটি ছাড়তে নারাজ। সৌমিত্রদা বললেন, ‘তবে দাও, এক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশ করি।’ তাই হল শেষ পর্যন্ত। নির্মাল্য আচার্য, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত এক্ষণে ছাপা হল ‘চাকভাঙা মধু’ আর বিভাসের নির্দেশনায় সেটা মঞ্চস্থ করল থিয়েটার ওয়ার্কশপ। নাটক দেখে বেরিয়ে অপর্ণা বলেছিলেন, ‘অন্তর থেকে বলছি মায়া ঘোষের বাদামির মতো ভাল হত না আমার বাদামি, নাটকটা বেঁচে গেছে।’
অন্যমন: আপনার অনেক নাটকে বৃদ্ধরা কেন্দ্রীয় চরিত্র, যেমন মৃত্যুর চোখে জল, সাজানো বাগান… আবার অনেক নাটকেই বৃদ্ধরা বিশেষ ভূমিকায় যেমন পরবাস, দম্পতি, কেনারাম বেচারাম ইত্যাদি। বৃদ্ধদের এত গুরুত্ব দেওয়া কেন?
মনোজ মিত্র: হ্যাঁ ঠিকই। ঊনষাট সালে, যখন আমি একুশ, লিখি, ‘মৃত্যুর চোখে জল’, যার কেন্দ্রে এক বৃদ্ধ, যার স্থান সিঁড়ির পাশের ঘুপচি কুঠুরিতে। সে মরল না বাঁচল ছেলেমেয়েদের কোনও ভাবনা নেই। এদিকে বুড়ো সর্বক্ষণ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, নিজের ওষুধ, নিজের লণ্ঠন, নিজের হাতপাখা, নিজেই নিজের রোগযাতনা সামলায়। বৃদ্ধের একমাত্র পৌত্র আজ মৃত্যুশয্যায়। নাটকের শেষে শিশুটি মারা গেল, বৃদ্ধের স্ত্রী এসে তাকে বলে, ‘কাঁদো, কেঁদে জানিয়ে দাও তুমি এখনও বেঁচে আছ’। নাতির জন্য সাহস করে কাঁদতেও পারে না বুড়ো, পাছে আবেগের প্রাবল্যে তার হৃদযন্ত্র অচল হয়ে যায়।

পরের অনেক নাটকেও এরকম আছে। শৈশবে আমার এক বড় ভয় ছিল, এখন এই বয়সে অনেক ফিকে, যখন সত্যি-সত্যিই জরাগ্রস্ত হব, অকেজো-অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাব, তা সামলাব কী করে? মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে এইসব ভয় ধরানো কথা মাথায় ঘুরত। এই ভয় ভাঙাতেই আমার বুড়োদের নিয়ে লেখা, বুড়ো সেজে অভিনয় করা। ভালবেসে নয়, আতঙ্কেই শুরু করেছি এইসব। সে যে-যাই বলুক, আমি তো জানি আমার মনের ভেতরে কী চলেছে! একটু ভাবলেই বোঝা যাবে যে, বাইরের যতই অমিল থাক, ভেতরে-ভেতরে ‘মৃত্যুর চোখে জল’-এর বৃদ্ধ আর ‘সাজানো বাগান’-এর বাঞ্ছারাম আদতে অভিন্ন…
অন্যমন: ‘সাজানো বাগান’ রচনা করবার ব্যাপারটা কী, আলাদা করে বলতে পারেন, কীভাবে এলেন এমন গল্পে…
মনোজ মিত্র: রানিগঞ্জে আমার সহকর্মী হিন্দি সাহিত্যের অধ্যাপক নারায়ণ পাণ্ডে লোকসাহিত্যের গবেষক ছিলেন। ওঁর সংগ্রহে ছিল দেশবিদেশের অনেক নীতিকথা, লোককথার বই… সাজানো বাগানের ওই মরতে-মরতে না-মরা বুড়োর গল্পটা পাই ওরই সংগ্রহের কোনও সংকলনের মধ্যে। দু’তিন পাতার ছোট্ট শিশুপাঠ্য গল্প, যার শেষে একটি নীতিবাক্য– লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু; এ এমন কিছু নয় যে, পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে নাটক লেখার কথা মনে হবে, হয়নিও তা।
তবে গল্পের ওই বুড়োকে খুব চেনা লেগেছিল, হয়তো তাকে আমাদের খুলনায় দেখেছি কখনও…। আসলে যে কোনও গল্প উপন্যাস পড়লেই পাঠক তার স্মৃতি-অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করে, আমারও তাই হয়েছিল। কিন্তু ওই নীতিকথার বুড়োকে নিয়ে লেখার কথা তখন ভাবিনি, তারপর ভুলেও গেছি; কিন্তু অবচেতনে ছিল হয়তো। তাই প্রায় তেরো বছর পরে ১৯৭৬-এর শেষের দিকে আচমকাই লিখে ফেলি ‘সাজানো বাগান’, অবিশ্যি কিছুটা চাপে পড়েও…।
ওই সময়েই সুন্দরমে ‘নরক গুলজার’-এর রিহার্সাল চলছিল। নাটকের দলগুলির একটা অলিখিত নিয়ম আছে যে, মঞ্চে হবার আগে মহড়ার সময় কী নাটক হচ্ছে কাউকে বলা চলবে না। আমি অত চেপে-চুপে রাখতে পারি না। বিভাসকে ‘নরক গুলজার’ শোনালাম, ও বলল ‘আমায় দাও আমি করব।’ বিভাস আমাদের সময়ের শক্তিশালী প্রযোজক, ওকে নাটক দিতে ইচ্ছে হবে সব নাট্যকারেরই, কোনও কিছু চিন্তা না করেই আমি ওকে দিয়ে দিলাম।

ব্যস সুন্দরমের সবাই খেপে গেল– আমি খেয়ালি, আমি বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি। ওদেরও রাগ হওয়া স্বাভাবিক, কারণ এর আগেও তো আমি এমনভাবে ‘চাকভাঙা মধু’ দিয়ে দিয়েছিলাম থিয়েটার ওয়ার্কশপকে; সুন্দরমের সবাইকে শান্ত করতে আবার তাড়াতাড়ি একটি নাটক লিখতে হয়। ভাবতে গিয়ে দেখলাম ওই তেরো-চোদ্দো বছর আগে পড়া নীতিকথাটি ভুলিনি, মনের মধ্যে সে বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে;
পূর্ববঙ্গে আমাদের গাঁয়ে ভূতও ছিল, চোরও ছিল। তাহলে ওদের নাটকে জায়গা দিতে হবে। দিলাম; আর ঠাকুরমার মুখে গল্প শুনতাম গাঁয়ের এক বাগান নিয়ে, সেখানে নাকি ভূতপ্রেত থাকে, দিনের বেলাতেও সে বাগানে ঢুকতাম না। একজন সাদা দাড়িওলা ফকফকে বুড়ো মানুষ, সে বাগানে চালা বেঁধে থাকত, হাঁটতে পারত না, মাটিতে বসে-বসে চলত। নাম ছিল বাঞ্ছারাম। গাছপালাকে সে বড় আদর-যত্ন করত, পানের বরজের ঘন সবুজ পাতায় সে হাত বুলাতো। এই বাঞ্ছারামই আমার নাটকে ঢুকে পড়ল। এ বুড়ো মরেও মরে না, যে ওর মৃত্যু কামনা করে সেই শেষ পর্যন্ত পটল তোলে। এইসব মিলেমিশে সাজানো বাগান হয়ে উঠল। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: mubi.com, youtube, wikimedia commons
আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১]
অন্যমন দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করে আপাতত অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। ভালবাসেন বাংলা নাটক, কবিতাও। সময় কাটাতে নানা লিটল ম্যাগাজিনে টুকটাক লেখালিখি তাঁর শখ। বই পড়া আর বন্ধুদের সঙ্গে রবিবারের আড্ডাটি ছাড়া তাঁর এক মুহূর্ত চলে না।