হাঙ্গেরির রাজার অধীনে থেকেও ড্রাকুলের ক্ষমতা বাড়ছিল ক্রমাগত। ট্রানসিলভানিয়াকে পুব দেশের তুর্কি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন তিনি। সফলও হয়েছিলেন। ফলে পবিত্র রোমান সম্রাট তাঁকে সামন্ত থেকে পদোন্নতি ঘটিয়ে পড়শি দেশ ওয়ালাচিয়ার রাজপুত্রের স্বীকৃতি দিলেন। সঙ্গে পেলেন ‘অর্ডার অফ দ্য ড্রাগন’- এর সর্বাধিনায়কের পদ। ১৩৮৭ সালে সম্রাট সিসিগমুন্ড আর তাঁর স্ত্রী বারবারা ভন সিলি মিলে এই অর্ডারটি সৃষ্টি করেন। সামরিক আর ধর্মীয়, এই দুই ধরনের মত এসে মিশেছিল এখানে। মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্যাথলিক চার্চকে বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করা, আর দরজায় কড়া নাড়া ক্রুসেডের জন্য সামরিক বাহিনী তৈরি। তুর্কিরা ততদিনে বলকান পেরিয়ে এসেছে।

তবে এর চেয়েও বড় একটা মাথাব্যথা ছিল সম্রাটের। পাশের রাজ্য ওয়ালাচিয়ার রাজপুত্র আলেকজান্দ্রু আলদিয়া রোমের রাজার হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছিলেন। তাঁর স্বেচ্ছাচার সীমা ছাড়িয়েছিল। মূলত তাঁকে জব্দ করতেই আলদিয়ার সৎ ভাই ড্রাকুলকে নতুন রাজপুত্রের মর্যাদা দেন রাজা। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা খুব গুরুত্বপুর্ণ। এই যে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ শুরু হল, তাতে সবার অজান্তে ইতিহাসের মোড় ঘুরতে চলেছিল। 




২৭১ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ট্রানসিলভানিয়া আক্রমণ করলে সেখানের স্থানীয়রা সোজা পাহাড় বেয়ে ওয়ালাচিয়ার দিকে আশ্রয় নেয়। পাহাড়ে লুকিয়ে থাকার জন্য রোমান সংস্কৃতির কোনো প্রভাব তাঁদের উপর পড়েনি। পরে একের পরে এক গথ, হূন, স্লাভিক, বালগেরিয়ানরা আক্রমণ করলেও সেটা এই জনগোষ্ঠীকে খুব বেশি নাড়া দিতে পারেনি। কিন্তু যেটা হয়েছিল, ওয়ালাচিয়া আর ট্রানসিলভানিয়ার মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক এক অদ্ভুত যোগাযোগ গড়ে ওঠে। উল্টোটাও সত্যি। ওয়ালাচিয়ার রাজধানীও তৈরি হয়েছিল ট্রানসিলভানিয়ার সীমান্তে। ওয়ালাচিয়ার প্রথম রাজধানী সিম্পুলাং ছিল ট্রানসিলভানিয়া আল্পসের মাথায়। ক্রমাগত যুদ্ধ চলতে থাকে আলদিয়া আর ভ্লাদের মধ্যে। প্রায় পাঁচ বছর টানা যুদ্ধের পর ১৪৩৭-এর শীতে ভ্লাদ ড্রাকুল আলদিয়াকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে টারগোভিস্টে নতুন রাজধানী স্থাপন করলেন। টারগোভিস্ট ছিল পাহাড়ের সানুদেশে। কারণ একটাই। ট্রানসিলভানিয়ার জনবল যাতে বজায় থাকে। 

Wallachia
ওয়ালাচিয়ার প্রাসাদে ভ্লাদের আবক্ষ মূর্তি।

সিংহাসনে বসে একটু থিতু হয়েই ভ্লাদ প্রথমেই তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানটা সমঝে নিলেন। রোমান সম্রাট সিসিগমুণ্ড ততদিনে মারা গেছেন। এদিকে তুর্কীর সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছেন। সার্বিয়া, বালগেরিয়ার রাজাদের হারিয়ে তিনি গ্রিকদের আক্রমণে উদ্যত। একের পর এক রাজা তাঁর সামনে হাঁটু মুড়তে বাধ্য হচ্ছেন। চতুর ড্রাকুল বুঝলেন হাওয়া বদলেছে, আর হাওয়া বদলালে নিজের অবস্থানও যে বদলাতে হয়, তা তাঁর চেয়ে ভাল কেউ জানত না।  তিনি তাঁর অনেক বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে প্রথমটা সেরে ফেললেন। হাত মেলালেন সুলতান মুরাদের সঙ্গে। শুধু হাতই মেলালেন না,  সুলতান মুরাদ যখন ট্রানসিলভানিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তাঁকে স্বাগত জানালেন স্বয়ং ড্রাকুল। তিনি আর তাঁর বড় ছেলে মিরসিয়া মিলে খুন, লুট, বাড়িঘর পোড়ানো, নারীধর্ষণ করে ট্রানসিলভানিয়াকে প্রায় শ্মশান বানিয়ে দিলেন। সেই প্রথম ইতিহাস এমন এক শাসককে দেখল যিনি দায়িত্ব নিয়ে নিজের রাজ্যকে শেষ করতে উদ্যত হলেন।

ট্রানসিলভানিয়ার দুর্ভাগ্যের সেই শেষ না। তবু যেমন হয়, তাঁদের বিশ্বাস ছিল শাসক হিসেবে তাঁদের স্বদেশি ড্রাকুল আর যাই হোন, ভিনদেশি তুর্কিদের চেয়ে অন্তত ভাল হবেন। তাই এর পরেও তাঁরা ড্রাকুলকেই সমর্থন জানালেন। আশেপাশের স্লাভিক আর সার্বরাও ড্রাকুলার প্রতি আনুগত্য জানায়, যাতে তুর্কিদের দাস হয়ে তাঁদের জীবন না কাটাতে হয়। ড্রাকুলও এই সুযোগে খ্রিস্টধর্মের মসীহা সেজে প্রাণপণে জনগণের শোষণ চালিয়ে যেতে লাগলেন। 




ধূর্ত ড্রাকুল রোমান সম্রাটের সঙ্গেও তলেতলে আঁতাত রেখে যাচ্ছিলেন। তাঁর দেশের অভিজাতদের দিয়ে তিনি এক চিঠি লিখালেন, যার মূল বক্তব্য, তুর্কিদের কবল থেকে একমাত্র তিনিই উদ্ধার করতে পারেন, আর করছেনও। ফলে সম্রাট বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি। সম্রাট না করলেও সুলতান মুরাদের গুপ্তচরদের কাছে এই সংবাদ ছিল। তাঁরা মুরাদকে জানালে তিনি সরাসরি ড্রাকুলকে ডেকে পাঠালেন। ড্রাকুল বুঝতেই পারেননি সুলতান সব জানতে পেরেছেন। তাই  ১৪৪২ সালের এক বসন্তের দিনে ড্রাকুল তাঁর মেজ ছেলে ভ্লাদ আর ছোট ছেলে রাদুকে নিয়ে রওনা হলেন। এই যাত্রা তিনজনের জীবন বদলে দিতে চলেছিল।

তুর্কিরা ততদিনে বলকান পেরিয়ে এসেছে। তবে এর চেয়েও বড় একটা মাথাব্যথা ছিল সম্রাটের।  পাশের রাজ্য ওয়ালাচিয়ার রাজপুত্র আলেকজান্দ্রু আলদিয়া রোমের রাজার হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছিলেন। 

তুর্কিদের সীমানায় ঢুকতেই তাঁদের বন্দি করা হল। তিনজনকেই শিকলে বেঁধে হাজির করা হল সুলতানের দরবারে। সুলতান শুরুতেই জানিয়ে দিলেন, চালাকি করে লাভ নেই। তাঁর কাছে সব খবর আছে। ড্রাকুলের কিছু বলার থাকলে বলুন। বুদ্ধিমান ড্রাকুল বুঝলেন সুলতানকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। ফলে তাঁর কথা মেনে নেওয়াই ভাল। এবার তিনি উলটো চাল চাললেন। বললেন, “হে মহান সুলতান, আমি আগাগোড়াই আপনাতে অনুগত। কিন্তু আমাকে তো একটা রাজ্য চালাতে হয়, যে রাজ্যে প্রায় সবাই খ্রিস্টান। তাই তাদের বোঝাতে হবে আমি ওই ধর্মের রক্ষাকর্তা, নতুবা ওরা রোমান সম্রাটকে বলে নতুন রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসাবে।” চিঁড়ে তাতেও ভিজল না; তখন তুরুপের শেষ তাস ফেললেন ভ্লাদ। প্রস্তাব দিলেন তাঁর দুই সন্তান বন্দি থাকবে তুর্কি সুলতানের কাছে। তিনি ফিরে যাবেন নিজের রাজ্যে। প্রমাণ দেবেন নিজের আনুগত্যের। সুলতান দেখলেন অচেনা শয়তানের চেয়ে চেনা শয়তান ভাল। আর দুই ছেলেও তাঁর হেফাজতে থাকছে। ফলে গালিপলির কারাগারে কিছুদিন বন্দিদশা কাটানোর পর ছেড়ে দেওয়া হল ড্রাকুলকে। 




ড্রাকুলের দুই ছেলেও মুক্তি পেলেন, তবে তাঁদের রেখে দেওয়া হল স্বয়ং সম্রাটের প্রাসাদে, নজরবন্দি করে। কিছুদিন পরে অবশ্য সুলতান তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন এশিয়া মাইনরে এগ্রিগস প্রাসাদে। ১৪৪৮ সালে ভ্লাদকে ছেড়ে দিলেও রাদু স্বেচ্ছায় সুলতানের অধীন থেকে গেলেন। সুলতান আর রাদুর পারস্পরিক সম্পর্ক ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। পরবর্তীকালে রাদু সুলতানের সবচেয়ে কাছের পরামর্শদাতা হয়ে উঠলেন। শুধু তাই নয়, সুলতান তাঁকে বোঝালেন ধৈর্য ধরতে পারলে ড্রাকুলের মৃত্যুর পর বড় ভাইদের বদলে তিনিই যাতে ওয়ালাচিয়ার শাসক হন, সুলতান তা দেখবেন। সুলতানও জানতেন শরিকি ঝামেলাকে কী ভাবে নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে হয়। আর অন্যদিকে ভ্রাতৃবিরোধ দিয়ে যে রক্তাক্ত অধ্যায় শুরু তা যে আরও ভয়ঙ্কর দিকে মোড় নেবে, তা হয়ত বিধাতাপুরুষ আগেই জানতেন।

চতুর ড্রাকুল বুঝলেন হাওয়া বদলেছে, আর হাওয়া বদলালে নিজের অবস্থানও যে বদলাতে হয়, তা তাঁর চেয়ে ভাল কেউ জানত না।  তিনি তাঁর অনেক বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে প্রথমটা সেরে ফেললেন। হাত মেলালেন সুলতান মুরাদের সঙ্গে। 

ছয় বছর বন্দিকাল ভ্লাদ ড্রাকুলার জীবনটা বদলে দিল একেবারে খোলনলচে সমেত। তুর্কিদের অত্যাচার খুব কাছ থেকে দেখে মানুষের প্রতি সামান্যতম বিবেকবোধও হারিয়ে ফেলেন তিনি। জীবন তাঁর কাছে বড় সস্তা, কেটে ছড়িয়ে দেবার মতো। প্রতি মুহূর্তে ভয়। এই বুঝি বাবা কোন বেচাল করে ফেলেন আর তাঁকে সেই ভুলের মাসুল চোকাতে হয়। তুর্কিদের সঙ্গে থেকে তিনটি জিনিস একেবারে তাঁদের মতো রপ্ত করে নেন ভ্লাদ ড্রাকুলা। তাঁদের ভাষা, তাঁদের যৌনজীবন আর তাঁদের অত্যাচার। বন্দি হলেও তুর্কি হারেমে ড্রাকুলার অবাধ যাতায়াত ছিল। বিভিন্ন বিচিত্র এবং বীভৎস উপায়ে নিজের কাম চরিতার্থ করতে শিখেছিলেন ভ্লাদ ড্রাকুলা। নিজের প্রাণ বাঁচাতেই মিথ্যে বলা, ছলনা, আত্মরক্ষার নানা কৌশল শিখতে হয়েছিল তাঁকে, যা পরে অন্য অনেকের থেকে তাঁকে এগিয়ে রেখেছিল।

তবে এই সবকিছুর উর্ধ্বে দুটো ঘটনা তাঁর জীবনদর্শন পালটে দেয়। বাবা ভ্লাদ তাঁদের দুই ভাইকে নিয়ে আসার সময় একবারও ইঙ্গিত দেননি, তিনি কেন তাঁদের নিয়ে যাচ্ছেন। আর যখন ড্রাকুল বিপদে পড়লেন তখন ছেলেদের গচ্ছিত রেখে নিজের প্রাণ বাঁচালেন। মেজ ছেলে ভ্লাদ সেই থেকে বুঝে গেলেন কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। নিজের বাবাকেও না। আর এই সন্দেহের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল নৃশংস এক প্রতিশোধস্পৃহা। ড্রাকুলার বাকি জীবনের গোটাটাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এই সন্দেহ আর প্রতিশোধের অদম্য ইচ্ছেয়।

 

*ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ ও womanaroundtown.com  

পরবর্তী পর্ব: ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

তথ্যঋণ

১। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ইন সার্চ অফ ড্রাকুলা: দ্য হিস্ট্রি অফ ড্রাকুলা অ্যান্ড ভ্যামপায়ারস (১৯৯৪), হটন মিলিফিন কোং
২। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ড্রাকুলা: আ বায়োগ্রাফি অফ ভ্লাড দ্য ইমপেলর (১৯৭৩), হথর্ন
৩। লেদারডেল, ক্লাইভ, ড্রাকুলা, দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য লেজেন্ড: আ স্টাডি অফ ব্র্যাম স্টোকার্স গথিক মাস্টারপিস (১৯৮৫), উইলিংবরো নর্থহ্যামপ্টনশায়ার, ইউকে
৪। রিকার্ডো, মার্টিন, ভ্যাম্পায়ার্স আনআর্থড (১৯৮৩), গারল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক
৫। ট্রেপ্টো, কার্ট এডিটেড ড্রাকুলা এসেজ অন দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ ভ্লাড টেপেস (১৯৯১), কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *