‘পঞ্চম আরব সাগরের সাইক্লোন। বঙ্গোপসাগরে ঢেউ তুলে, ভারত মহাসাগর কে উত্তুঙ্গ করে আটলান্টিক-প্যাসিফিক ছুটেছিল। ছন্দের জাদুকর, মেলডি কিং পঞ্চম এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা।’ এসবই বলেছিলন পথিকৃৎ সঙ্গীতজ্ঞ সলিল চৌধুরি।
গত শতকের ছয়ের দশকে হিন্দি গানের মোড় ঘুরিয়ে নতুন ঢেউ এনেছিলেন রাহুলদেব বর্মণ। সত্তরের দশকে তিনিই সম্রাট। সে সময় লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল জুটির লক্ষ্মীকান্ত বলেছিলেন ‘পঞ্চম নে হাম সবকো হিলাকে রাখ দিয়া।’ তেত্রিশ বছর সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সক্রিয় রাহুল দেব বর্মনের মিউজি-ম্যাজিক, তাঁর প্রয়াণের পঁচিশ বছর পরও ফুরিয়ে যায়নি। এই একুশ শতকের স্যাটেলাইট শাসিত বিশ্বায়নের যুগে নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছেও রাহুলদেবের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। আজও লঘু সঙ্গীতের শ্রোতাদের সিংহ ভাগ আর ডি বর্মনের শাসনে সুখী।
‘পঞ্চমী’ সুরের এক মেরুতে যদি ‘দম মারো দম’ থাকে, তাহলে অন্য মেরুতে ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই’, কেউ মাতছে ‘পিয়া তু’ গানে তো কেউ ‘ রায়না বিত যায়ে’। কেউ আছন্ন ‘রুবি রায়’-এর মোহে, আবার কারও প্রিয় ‘ফুলে গন্ধ নেই’। এভাবেই কেউ ‘এক চতুর নার’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তো কেউ মগ্ন ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ’ গানে। কেউ নাচেন ‘জয় জয় শিব শঙ্কর’ বা ‘আজা আজা ম্যায় হুঁ প্যার তেরা’ চালিয়ে। কেউ বুঁদ – ‘হামে তুমসে প্যার কিতনা’, ‘মেরে নয়না শাওন ভাদো’ বা ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’র নেশায়। কেউ তাঁর মেলোডিতে আক্রান্ত তো কেউ অর্কেস্ট্রশনে। কেউ সাউন্ড ডিজাইনে বা ছন্দের দোলায়, কেউ আবার যৌবনের উত্তাপ খুঁজে পান রাহুল দেবের কম্পোজিশনে।
আর ডি বর্মন সুর করেছেন দু’হাজারেরও বেশি গানের। যদি বাড়িয়ে ধরা যায় তবে কপি গানের সংখ্যা একশো, নিজের প্রতি সুবিচার করতে না পারা গানের সংখ্যা আরও শ’চারেক। তাহলেও বাকি থাকে দেড় হাজারের বেশি গান। যদি হাজার গানের একটি সুবিবেচিত তালিকা করা যায় তাহলেও সেই দৃষ্টি সম্ভারের সৌজন্যেই অল টাইম গ্রেট কম্পোজারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তাঁর নামটি জ্বলজ্বল করবে।
ত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের সন্তান রাহুলদেবের শরীরে ছিল রাজরক্ত। আবার সঙ্গীতের এক রাজা শচীন দেব বর্মণের পুত্র হিসাবে হৃদয়ে জ্বলেছিল সুরের আগুন, মেধায় সৃজনশীলতার তাগিদ। সঙ্গীত রচনা রাহুল দেবের লক্ষ্য নয়, ছিল নিয়তি। কিশোর রাহুল দেবকে পিতা প্রশ্ন করেছিলেন ‘তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও’? রাহুল জবাব দেন ‘তোমার চেয়ে বড় সুরকার হতে চাই।’ বাবার চেয়ে বড় সুরকার তিনি হতে পেরেছিলেন কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাপ কা বেটা রাহুল দেব ট্রেন্ড সেটার যে হয়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রক্ষণশীল সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদকে এক সময় বলতে হয়েছে ‘এদেশের ফিল্ম মিউজিকে বিপ্লব’ এনেছে পঞ্চম। ওঁর পরে যারা কাজ করছে, তারা ওঁরই পথ ধরে বা তাকে খানিকটা বিকৃত করে ছাড়ছে — বেরিয়ে আসার পথ পাচ্ছে না।’ দিকপাল গায়ক গায়িকাদের মতে কম্পোজার  রাহুল দেবই ‘লাস্ট অফ দ্য ওরিজিন্যালস’।
তবে রাহুল দেব তাঁর পিতার ঘরানার উত্তরসূরি হবার পথে হাঁটতে চাননি। ফানটুস ছবিতে শচীন দেব রাহুল দেবের করা সুর কাজে লাগিয়ে ছিলেন (আয়ে টোপি পলট কে আ)। রাহুল তখন টিনএজার। ওই গানটা যে ছবির অন্য গানগুলোর চেয়ে আলাদা গোত্রের, তা সহজেই ধরা পড়ে। আবার অন্যদিকে বাবার সংগৃহীত লোকসুর কিংবা প্রিলুড ইন্টারলুড থেকে সুর রচনা করে রাহুল দেব বার বার বুঝিয়েছেন যে তিনি বাবার ছায়ায় ঐতিহ্যের অনুগত থেকেও তৈরি করতে পেরেছেন নিজস্ব আইডেন্টিটি।
বাবা শচিন দেব বর্মণের সঙ্গে রাহুল
৩৬/১ সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে কেটেছে রাহুল দেবের (ডাকনাম টুবলু) শৈশব-কৈশোর। ১৯৩৯ সালের ২৭ জুন সেখানেই তাঁর জন্ম। তাঁর সাত বছর বয়সেই বাবা বোম্বাই হিন্দি-বৃত্তে সক্রিয়। সঙ্গীতে ছেলের সহজাত আগ্রহ দেখে তাঁকে ব্রজেন বিশ্বাসের কাছে তবলা শিখতে পাঠিয়েছিলেন শচিন দেব। পরে আলি আকবর খানের কাছে সরোদও শিখতে পাঠান। তবে তখন খাঁ সাহেবের কনসার্টের ব্যস্ততা দেশ জুড়ে, ফলে আশীষ খানের কছে রাগ সঙ্গীতের তালিম পেয়েছিলেন রাহুল দেব। অনেক বাদ্যযন্ত্র নিজেও বাজাতে শিখেছিলেন। বেশ ভালো মাউথ অর্গান বাজাতে পারতেন। হারমোনিয়ম এবং পার্কশন গোত্রের নানা বাদ্যযন্ত্রে অভ্যস্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে কৈশোরেই রাহুল দেবের কম্পোজার মন ডানা মেলেছিল। বোম্বাই যাওয়ার পর বাবার যোগ্য সহকারি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সহজেই। কিন্তু সারাজীবন ধরে সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য লুকোচুরি খেলেছে রাহুল দেবের সঙ্গে।
কুড়িতে পা দেবার আগেই এসেছিল স্বপ্ন পূরণের হাতছানি। গুরু দত্ত তাঁর একটি ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাহুল দেব বর্মণকে। চারটে গান তৈরিও হয়ে গেল, কিন্তু খামখেয়ালি গুরু দত্ত দিলেন সে ছবির কাজ বন্ধ করে। বছর খানেক পরে মেহেমুদ ছবি প্রযোজনায় এসে সঙ্গীত পরিচালনার প্রস্তাব দিলেন শচীন দেব বর্মণকে। শচীন দেব রাজি হলেন না। মেহেমুদ রাহুল দেবকে দিলেন সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব। সে ছবি তৈরি হল বটে, তবে চলল না। মেহেমুদ আবার রাহুলকে সুযোগ দিলেন ‘ভূত বাংলা’ ছবিতে। সে ছবির গান খানিকটা জনপ্রিয় হলেও ছবিটি ব্যবসা পেল না। এবার কয়েকটি ব্যর্থতা পেরিয়ে ছাব্বিশ বছর বয়েসে রাহুল দেব পেলেন নাসির হুসেনের “তিসরি মঞ্জিল” ছবির সঙ্গীত রচনার কাজ যা যথার্থই সৌভাগ্য হয়ে এল। ছবি জুবিলি হিট। প্রত্যেকটা গান দারুণ জনপ্রিয়তা পেল। শুরু হল দিগ্বিজয়।

বাহারোঁ কে সপনে, পড়োসন, কটি পতঙ্গ, ক্যারাভ্যান, হরে রাম হরে কৃষ্ণ, অমর প্রেম, আপনা দেশ, বম্বে টু গোয়া, মেরে জীবন সাথি, জওয়ানি দিওয়ানি, সীতা ঔর গীতা, আপকি কসম, দিওয়ার, শোলে, মেহবুবা, হম কিসিসে কম নেহি থেকে গোলমাল, খুবসুরত, আঁধি, শান, কুদরত, রকি, সনম তেরি কসম, অগর তুম না হোতে, কিনারা, মাসুম, নমক হারাম, ইজাজত… এক এর পর এক হিট। ভারতীয় রাগ সঙ্গীত আর দেশজ লোকসুর প্রয়োগে অসাধারণ সব কম্পোজিশন রয়েছে রাহুল দেব বর্মণের। কিন্তু নতুন যুগের সঙ্গীতে নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতেই হয়। একদিকে বিদেশী বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগ করেছেন গানে, অন্যদিকে নেপালি মাদলে যে ছন্দ তুলেছেন তার নামই হয়ে গেল পঞ্চমের তাল। চিঙ্গারি কোই গানে ভৈরবীর ট্রিটমেন্ট নিয়ে স্বয়ং আলি আকবর খান প্রশংসা করেছেন পঞ্চমের। শেকল কর্ড নিয়ে যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, গ্লাস-চিরুনি-চামচ-বোতলের মত তুচ্ছ উপকরণ নিয়ে তৈরি করেছেন শব্দের অন্য জগত। এদেশে ছবির গানে সিন্থেসাইজার এবং ইকোলাই প্রথম ব্যবহারের কৃতিত্ব রাহুল দেবের। বেস গিটার প্রয়োগেও তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
বিদেশি গানের অনুসরণে গান তৈরির কথা রাহুল দেব নিজেই বলেছেন ‘ট্রান্সক্রিয়েশন’-এ। যুগ যুগ ধরে এমন ঘটে চলেছে, কিন্তু রাহুল দেবের গানের পাশাপাশি অরিজিন্যাল বিদেশি গান বসিয়ে বেশ আকর্ষণীয় অডিয়ো-ভিস্যুয়াল ট্রেন্ড চালু হয়েছিলো ইন্টারনেটের হাত ধরে। কিন্তু এভাবে শিল্পীর প্রতিভা এবং সৃজনশীলতকে খাটো করে দেখবার উদ্যোগ শুভ নয়। কারণ ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার সম্ভাবনা। তবে এর প্রভাব শ্রোতাদের উপর তেমন পড়েছে বলে মনে হয় না। আর ডি বর্মন সুর করেছেন দু’হাজারের বেশি গানের। যদি বাড়িয়ে ধরা যায় তবে কপি গানের সংখ্যা একশো, নিজের প্রতি সুবিচার করতে না পারা গানের সংখ্যা আরও শ’ চারেক। তাহলেও বাকি থাকে দেড় হাজারের বেশি গান। যদি হাজার  গানের একটি সুবিবেচিত তালিকা করা যায় তাহলেও সেই দৃষ্টি সম্ভারের সৌজন্যেই অল টাইম গ্রেট কম্পোজারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তাঁর নামটি জ্বলজ্বল করবে। যদিও সে স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠা অনেক বোদ্ধাদের।
কিশোর কুমারের কন্ঠে দিয়েছেন অসংখ্য সুপারহিট গান
একদিন যাঁর পরিচয় ছিলো শচীন কর্তার পুত্র পঞ্চম, সেই কীর্তিমান পিতা স্বকর্ণে শুনে গিয়েছেন তাঁর পরিচিতি নতুন প্রজন্মের কাছে আর ডি বর্মণের বাবা। এই একুশ শতকের ইন্টারনেট শাসিত জমানাতেও আর ডি বর্মণের চাহিদা বেড়েছে বৈ কমেনি। ছাব্বিশ বছর আগে প্রয়াত সঙ্গীতের রাজপুত্র রাহুল দেবকে আজকের সঙ্গীত পরিচালকেরাও ‘আইডল’ বলেই মানে। রাহুলদেবের প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কম্পোজ করা গান রিমেকের সূত্রে কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর গানের বাজার আজও অন্যদের থেকে চড়া। আজকের সিনেমা থেকে টিভি শো – রাহুল দেবের গানের হাত ধরে টিআরপি গড়ায়। ড্রইং রুম থেকে ডিস্কো থেক, এফ এম থেকে ডট কম সর্বত্র রাহুল দেবের সুর ভেসে আসে। লতা-আশা-কিশোর-রফি এবং স্বয়ং কম্পোজারের কণ্ঠে। রিয়ালিটি শো থেকে মাচা, কোথায় নেই পঞ্চম। অদূর ভবিষ্যতেও রাহুল দেবের এই চাহিদা হ্রাসের কোনও সংকেত মেলেনা।
চলমান সময়ের কষ্টিপাথরে তাঁর মিউজি-ম্যাজিকেই রাহুল নায়ক। তাঁর রমরমার সময় রাহুল দেবকে বলা হতো ‘জেট সেট কম্পোজার’। কেউ মজা করে বলতেন আর ডি র প্রতিভার বিস্ফোরণ। এবং অতিরিক্ত গতির জন্যই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনও প্রেরণার আশ্রয় পাননি। ১৯৯২ সালে মুসাফির ছবির জন্য গানের সুর করেছিলেন রাহুল দেব – “বহুত থক গয়া হুঁ, জো জানে দো মুঝে।” ১৯৯৪-এর চার জানুয়ারি চির বিশ্রামের দেশে পাড়ি দিয়েছেন রাহুল দেব। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির ঔজ্জ্বল্য আজও কমেনি।
তবে যারা এই পথিকৃৎ কম্পোজারের সৃষ্টিকে নানা আঙ্গিকে নতুন মোড়কে মুড়ে লাভের কড়ি গুনে চলেছেন? তাঁরা অরিজিন্যাল কম্পোজারের স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠা না করেন! উত্তরকালের কাছে রাহুল দেব বর্মনের মত মহৎ শিল্পীর এইটুকু নিশ্চই প্রাপ্য।
চল্লিশটা ছবির কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গিয়েছেন রাহুল দেব বর্মণ। সেই সব ছবির জন্য ছ’শোরও বেশি গান রেকর্ড করা হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে তাঁর নিজের স্টুডিয়োতে রেকর্ড করা বহু সুরের হদিশ নেই। কিন্তু গ্রেট হিসাবে চিহ্নিত করার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট।
একসময় রাহুল দেবকে এক বছরে কুড়িটা সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে। এই অত্যধিক চাপ তাঁর শরীর এবং কাজের ওপর প্রভাব ফেলেছে। চাহিদার সূত্রে উপরোধ অনুরোধ পরিস্থিতির দাবি মেটাতে, এই বিপুল পরিমাণ সরবরাহের দায় সামলাতে গিয়ে সবক্ষেত্রে নিজের ওপর সুবিচার করতে পারেননি। বাণিজ্যিক চাপে তাঁর প্রতিভা পুড়েছে, অনেকের এমন মত। পিতা বছরে দু চারটি ছবির গান করার সুবাদে যে সৃজনশীলতার অবকাশ পেয়েছেন, পুত্র তা পাননি। অনেক গড়পড়তা ছবিতে তাঁকে সামর্থ্য বিনিয়োগ করতে হয়েছে, যদিও তার ভেতর থেকেই রাহুল দেবের কম্পোজিশানে বিশেষত্ব-সাউন্ড নিয়ে নিরীক্ষা-যৌবনের উচ্ছাস-ছন্দের বৈচিত্র ধরা পড়েছে অধিকাংশ কম্পোজিশনে। তৈরি হয়েছে আর ডি ট্রেন্ড। পশ্চিমী প্রভাবের জন্য যাঁরা তাঁর সমালোচনা করেছেন (তাঁদের মধ্যে স্বয়ং শচীন কর্তাও একদা ছিলেন) তাঁদের উদ্দেশে রাহুলদেব বলেছিলেন-‘ একদিকে গ্লোবালাইজেশনের ধ্বজা উড়বে, জীবনযাপনে পশ্চিমি পোশাক, বিলেতি ভাষা, ফিউশন, ডিস্কো কালচার চলবে আর গানটা থেকে যাবে আদ্যিকালের। তাই হয় নাকি? হরে কৃষ্ণ হরে রাম ছবিতে হিপিদের কণ্ঠে কীর্তন শোনালে কেমন হত? আমি বাবার মতো সুর করব, আমার ছেলে দাদুর ধারায় সুর করবে, এটা হয় নাকি?”

নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে রাহুল দেব সাফল্যের আকাশ ছুঁয়েছিলেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্যের নিচেই দুর্ভাগ্যের অন্ধকার। আঠারোবার বর্ষসেরা সঙ্গীত পরিচালকের নমিনেশন পেলেও পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র দু’বার। তাঁর কম্পোজিশন জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যায়। কিন্তু রাহুল বঞ্চিত হন। আশির দশকে তাঁর বহু গান জনপ্রিয় হলেও ছবি চলেনি। পরপর তেইশটা ছবির বাণিজ্যিক ব্যর্থতায়, ভেঙে পড়েছেন, হার্ট অ্যার্টাকে আক্রান্ত হয়েছেন। বাইপাস সার্জারির পর তিন বছর গৃহবন্দি থেকেছেন।
হৃদয় ঘটিত অপ্রাপ্তি অন্য ভাবেও এসেছে। জীবনে দু’টি বিবাহ করেও সুখী দাম্পত্য মেলেনি। সুরের সঙ্গে ক্রমশ বেশি করে সুরার সঙ্গে জড়িয়েছেন। স্বার্থান্বেষী কিছু সঙ্গী জুটেছে বন্ধুবেশে। সব মিলিয়ে সে ছিল বড় দুঃসময়। হাত থেকে এক এর পর এক কাজ চলে যাচ্ছে । তবু বিশ্বাস ছিল আবার ফিরে আসবেন স্বমহিমায়। ফিরে এসেছিলেন রাহুল দেব বর্মণ।  চরাচরে ছড়িয়ে পড়েছিল ১৯৪২ আ লাভ স্টোরি ছবির গান বাহার। কিন্তু স্রষ্টা দেখে যেতে পারেননি, তাঁর বিশ্বাস সত্যি হয়েছে। এখানেও সেই দুর্ভাগ্য আর সৌভাগ্যের তত্ত্ব।
চল্লিশটা ছবির কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গিয়েছেন রাহুল দেব বর্মণ। সেই সব ছবির জন্য ছ’শোরও বেশি গান রেকর্ড করা হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে তাঁর নিজের স্টুডিয়োতে রেকর্ড করা বহু সুরের হদিশ নেই। কিন্তু গ্রেট হিসাবে চিহ্নিত করার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট। বিশুদ্ধবাদী সঙ্গীত পরিচালক বা রক্ষণশীল কিছু বোদ্ধা যাঁরা রাহুল দেবের অপচয় দেখে একদা দুঃখিত হতেন, তাঁরা দেখে গিয়েছেন কী ভাবে একজন মর্ডান কম্পোজারের জন্ম হয়, কী ভাবে একজন সাহসি স্রষ্টা শুধু ভালোর বদলে হয়ে ওঠেন অন্য রকম ভালো। যিনি নিজের সময়কে শাসন করার পাশাপাশি হয়ে উঠতে পারেন উত্তর প্রজন্মের প্রেরণা।
আশা ও কিশোরের সঙ্গে। ছবি পিনটারেস্ট।
রাহুল দেব পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলা গানে আগ্রহী হননি। রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হবার পর একরকম বাবার উপরোধেই লতা মঙ্গেশকরের জন্য প্রথম বাংলা গান সুর করেন ‘আমার মাধবী লতা’ এবং প্রথম গানেই দেখিয়ে দেন নিজের মুন্সিয়ানা । এরপর আশা ভোঁশলের জন্য ধারাবাহিক ভাবে বাংলা গান সুর করে একটি ধারা তৈরি করে দিয়েছিলেন রাহুল। পপ বাংলা গানের পাশপাশি সেই সম্ভারে রয়েছে ‘বাঁশি শুনে কি’, ‘ যেতে দাও আমায় ডেকো না’, ‘ ‘ছন্দে ছন্দে গানে গানে’, ‘ চোখে নামে বৃষ্টি’, ‘ না এখনই না’, ‘ ফুলে গন্ধ নেই’, এমন হীরক খণ্ডের মতো কম্পোজিশন। কিশোরকুমারের জন্যও করেছেন ‘একদিন পাখি উড়ে’ বা ‘আকাশ কেন ডাকে’র মতো গান। আর রাহুল দেবের স্বকণ্ঠে গাওয়া ‘রুবি রায়’ তো বাংলা গানের একটা টার্নিং পয়েন্ট। ‘তুমি কত যে দূরে’ নতুন ধারায় আর একটি গান। ‘যেতে যেতে পথে হল দেরি’র কম্পজিশন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই’ ভার্শানে।
বাংলা ছায়াছবিকেও রাহুল দেব সমৃদ্ধ করেছেন। উত্তম কুমারের লিপে কিশোরকুমারকে কাজে লাগিয়েছেন রাজকুমারী ছবিতে। কলঙ্কিনী কঙ্কবতী ছবিতে পরভিন সুলতানাকে দিয়ে বাংলা গান গাইয়েছেন ‘বেঁধেছ বীণা’ অনুসন্ধান ছবির ‘হায় রে পোড়া বাঁশি’, ‘ওঠো ওঠো’ দু’টি অসাধারণ কম্পোজিশন।
একদিন যাঁর বিরুদ্ধে পশ্চিমী গান অনুকরণের অভিযোগ আনা হত, সেই রাহুল দেবের কম্পোজিশন পশ্চিমী শিল্পীরাই রিমেক করেছেন। আশাকে দিয়ে গাইয়েছেন নানা অ্যালবামে। নিজেও বিদেশি শিল্পীদের সঙ্গে যুগ্মভাবে অ্যালবাম করেছেন। একই সঙ্গে ‘দিল পড়োশি হ্যায়’ নন-ফিল্ম ডাবল অ্যালবামে ধরা আছে রাহুল দেবের ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য ও প্রাকৃতিক শব্দ
মালা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
Atanu Chakraborty

অতনু সঙ্গীতের নানান দিক নিয়ে লেখালেখি করে চলেছেন কয়েক দশক ধরে। বাংলা ও হিন্দি চলচিত্রের গান থেকে শুরু করে মার্গসঙ্গীতে অনায়াস যাতায়াত। 'পঞ্চম' ও 'মুখোমুখি বিলায়েৎ' ওঁর দুটি জনপ্রিয় বই। কলকাতায় মাইফেলের ইতিহাস নিয়ে ওঁর কাজ পাঠকদের মধ্যে সমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *