“বাংলা উপন্যাসকে সেই অভাবিত ও অনিশ্চিত পথে বিকশিত হতে হচ্ছিল। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসের বা কাহিনীগদ্যের যে-ধরনটি, যে-ফর্মটি প্রতিষ্ঠিত করলেন তার ভিতরে কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না, কোনো দ্বিধা বা সঙ্কোচ ছিল না। কারণ তাঁর কাছে ইউরোপীয় উপন্যাসের মডেলটিই ছিল একমাত্র মডেল। সে-রকমভাবে উপন্যাস লিখলেই বাংলায় উপন্যাস হবে, নইলে হবে না – বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস ফর্ম সম্পর্কে ছিলেন এমনিই স্থিরজ্ঞান ও স্থিতসিদ্ধান্ত। তাই তাঁর প্রথম উপন্যাসই পুরো উপন্যাস। তাই বছরের পর বছর তিনি যে-উপন্যাসের পর উপন্যাস লিখে যান – তাতে উপন্যাসের সংজ্ঞা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বা অনির্দিষ্টতা সচেতনভাবে কাজ করে না।” (উপন্যাস নিয়ে, দেবেশ রায় পৃ ২২)

এই অংশটিই কেন তুলে ধরলাম দেবেশ রায় সম্পর্কে এই লেখাটি লিখতে গিয়ে, প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু আমার কাছে, দেবেশ রায়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের লেখক সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাওয়া মানে, তাঁর ভাবনাচিন্তার জগৎকেই আরও একবার ধরার চেষ্টা করা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে! ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ বা ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ বা ‘মানুষ খুন করে কেন’ এই উপন্যাসগুলি বা তাঁর অগণিত সার্থক ছোটগল্পগুলি নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি যা প্রয়োজন বলে মনে হয়, তা হল দেবেশ রায়ের উপন্যাস-ভাবনা নিয়ে আমরা যদি নতুন করে ভাবার মতো অভিনিবেশের মধ্যে যেতে পারি, তবে, বাংলা সাহিত্যে আগামী সময়ে তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া ব্যাটনটি তুলে নেওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব আবার উঠে আসবেন, এই আশা করা যায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে উপন্যাস রচনা এবং উপন্যাস পাঠের যে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাস বাঙালি পাঠকদের মধ্যে বিষক্রিয়ার অভ্যেসের মতো সেঁধিয়ে যাচ্ছিল, দেবেশ রায়ের কলম এবং রচনাশৈলী তার বিরুদ্ধে এক ভিন্ন সন্দর্ভের জন্ম দেয়। উপন্যাস রচনার ভাষা, আঙ্গিক, বিষয়, গঠনের স্থাপত্য যে ক্রমান্বয়ে এক অনিশ্চয়তার দিকে যায়, যেখানে গল্প কোথাও গৌণ হয়ে যায়, চরিত্রটি পড়ে থাকে, ইতিহাস পড়ে থাকে, সেই অনিশ্চিত প্রাঙ্গনের কথা বারবার দেবেশ রায় তাঁর কলমে নিস্পৃহ কথকের মতোই তুলে আনেন। বাঘারুর শেষ পর্যন্ত কী হয়, আমাদের জানা হয় না। তিনি ঘোষণা করেই সরে যান সেই গল্পের প্রবহমানতা থেকে। পাঠককে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা, বঙ্কিমচন্দ্র সৃষ্ট বাংলার উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল না। কিন্তু দেবেশ রায় সেই ধূসর অনিশ্চয়তার অঞ্চলেই লেখক হিসেবে প্রথম থেকেই পা রাখেন।

বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বরং মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর “ ইউরোপের ফর্ম ভেঙে ফেলেছিল প্রায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারননি। যতটা পেরেছেন তা স্থায়ী করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধিতেই সমাপ্তি ঘটে।”

শুধু উপন্যাসেই নয়, ছোট গল্পগুলিতেও এই শৈলীর অনিশ্চয়তা আমরা দেখতে পাই। ‘উপন্যাস নিয়ে’ শীর্ষক গ্রন্থে তিনি লিখছেন “মধুসূদন কবিতায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যেমন, তেমনি, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে স্থাপন করলেন। মধুসূদনের কাছে ভারতচন্দ্র-ঈশ্বরগুপ্ত ধারাই ছিল কবিতার আধুনিকতার প্রতিপক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে আলাল-হুতোমই ছিল উপন্যাসের আধুনিকতার প্রতিপক্ষ।” আমার মনে হয় দেবেশ রায়ের উপন্যাসকে এবং সারাজীবনের কাজকে বুঝতে গেলে আমাদের এই জায়গাটিকে বুঝতে হবে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র যে নিজস্ব ঐতিহ্য ও আঙ্গিক রয়েছে, তা ইউরোপীয় আধুনিকতার বিপরীত। কিন্ত দেবেশ রায়ের মতে, বঙ্কিমচন্দ্রই ভারতীয় আধুনিকতা এবং ইউরোপীয় আধুনিকতার মধ্যবর্তী ‘খাদ’ তৈরি করেছেন। ফলে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ফর্ম গড়ে উঠল না।

দেবেশ রায়ের এই ভাবনার সঙ্গে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর এই ভাবনাবিশ্বই যে তাঁর রচনার প্রাণকেন্দ্র, তাকে মনে হয় অস্বীকার করা যাবে না। বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বরং মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর “ ইউরোপের ফর্ম ভেঙে ফেলেছিল প্রায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। যতটা পেরেছেন তা স্থায়ী করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধিতেই সমাপ্তি ঘটে।” তাঁর ভাবনার এই প্রেক্ষাপটেই রয়েছে তাঁর নিজস্ব লেখার ভুবনের বিস্তৃতি।

একদিকে যেমন রুশ ক্লাসিক উপন্যাসগুলির নির্মিতি, যেমন সেই সব উপন্যাসগুলির মধ্যে পাতার পর পাতা চলে আসে লেখকের দার্শনিক বা রাজনৈতিক ভাবনার মনোলগ, ঠিক তেমন ভাবেই এক অনবদ্য স্থাপত্যে রচিত হয় দেবেশ রায়ের এক একটি উপন্যাস। তিনি যে নিজস্ব আধুনিকতার কথা বলেন, (যা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, আধুনিকতার নিজস্ব বা পর আদৌ হতে পারে কি? কিন্তু হতে যে পারে, তা চিনুয়া আচেবের লেখা ও নুগি উয়া থিয়াঙ্গোর ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু সে প্রসঙ্গ অন্যত্র আলোচনাযোগ্য) সেই আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের নির্মাণের কাজটিই তিনি করে গেছেন চিরকাল তাঁর রচনাগুলির মধ্যে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে যে দু’টি নাম আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে আসে তাঁরা হলেন মার্কেজ এবং দস্তয়ভস্কি। যদি দেবেশ রায়কে তুলনাই করতে হয়, তবে দস্তয়ভস্কির সঙ্গেই করতে হবে এবং উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য ও আঙ্গিকের ভাবনাচিন্তার জগতের কথা ভাবলে মার্কেজের সঙ্গে তুলনা করতে পারলেই আমি আনন্দিত হব। গল্প বা চরিত্রের দ্রুত পরিণতি নয়, বরং তার চারপাশের, তার অবস্থার, তার বাস্তবতার ডিটেলিং, নিখুঁত স্থাপত্যের সঙ্গে উপন্যাসে লিখে রাখার যে গদ্যরীতি দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাসগুলিতে সৃষ্টি করলেন, তা বাংলা সাহিত্যে তুলনাবিহীন এবং তাঁর পরেও আর কেউ এই ডিটেলিং-এর ম্যাজিকের মধ্যে প্রবেশ করেননি বলেই মনে হয়। উপন্যাসের ক্ষেত্রে দেবেশ রায়ের ধারাকে যে পরবর্তী কেউ এগিয়ে নিয়ে গেলেন না এখনও, তার বেশ কয়েকটি কারণ আছে হয়তো। সেগুলির মধ্যে যেমন একটি হল, এখনও সময় আসেনি, তো আর একটি হল, ডিটেলিং-এর চূড়ান্ত যে জায়গাটি দেবেশ রায় নিজেই স্পর্শ করে গিয়েছেন, তারপর আর ডিটেলিং নিয়ে কাজ করার মধ্যে কোনও নতুনত্ব নেই। আবার তিনি নিজেই তাঁর উপন্যাসে নিজের এই আঙ্গিককে ভেঙে দিয়েছেন। ‘মানুষ খুন করে কেন’ বা ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ বাংলা সাহিত্যে নিখুঁত ন্যারেটিভ এবং আণুবীক্ষণিক ডিটেলিং-এর এক মহৎ উদাহরণ। যেখানে ব্যক্তি বারবার প্রতিফলিত হয় শ্রেণিতে।

রাজনৈতিক দর্শন দেবেশ রায়ের উপন্যাস এবং উপন্যাস-চেতনার এক অনিবার্য অংশ। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন তাঁকে শ্রেণিসচেতন করলেও, রাজনৈতিক ডগমা-আচ্ছন্ন করেনি কখনও। এখানেই একজন প্রকৃত লেখক সমসময়কে ধারণ করেও রাজনৈতিক ভাবে চিরসময়ের কথা বলেন। শ্রেণিকে তাত্ত্বিক ভাবে নয়, বরং অনুভব করা যায় মর্মে মর্মে। লেখার মধ্যে রক্তমাংসের এক চেতনাপ্রবাহ চলতে থাকে। আমি পাঠক হিসেবে কখনওই বাঘারুর সঙ্গে একাত্মবোধ করিনি। বা যখন পড়েছি তাঁর শেষ মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’, তখনও সেই চরিত্রটির সঙ্গে আমার এক দূরত্ব থেকেই গেছে। পাঠক হিসেবে আমার মনে হয় দেবেশ রায় যেমন উপন্যাস রচনার সময় তাঁর চরিত্রগুলির শ্রেণিগত অবস্থান স্পষ্ট করেন, তেমন রচনাশৈলীতেই এমন এক রাজনীতি থাকে, যার ফলে পাঠক তার নিজের শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কেও বারবার সচেতন হয়ে যান। এই দূরত্বটা লেখক খুব সচেতন ভাবেই সৃষ্টি, লালন এবং প্রতিষ্ঠিত করার ফলে, উপন্যাসটি পাঠকের কাছে এক রাজনৈতিক সন্দর্ভ এবং ইতিহাস-চেতনার সমুদ্রে পরিণত হয়। এই ইতিহাস কিন্তু বই পড়ে বা ন্যশনাল লাইব্রেরিতে বসে লেখা ইতিহাস নয়। দেবেশ রায়ের লেখা, তাই আমার মতে, জাতিসত্ত্বার ইতিহাসের এক অমোঘ দলিল, যেখানে ইতিহাসের আবহমান স্রোতটিকে এক সচেতন দ্রষ্টা সুনিপুণ ডিটেলিং-এর মাধ্যমে ধরে রাখেন। কিন্তু শুধু এই বিষয়ের গভীর আত্মানুসন্ধানই নয়, সেই বিষয়কে গদ্যে এবং উপন্যসের আঙ্গিকে ধরে রাখার লিখনশৈলীতে তিনি রেখে যান এক ভিন্ন  ও নিজস্ব আধুনিকতার ছাপ। যার মডেল ইউরোপীয় নয়, খুব বেশিরকম ভাবেই আমাদের।

“মধুসূদন কবিতায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যেমন, তেমনি, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে স্থাপন করলেন। মধুসূদনের কাছে ভারতচন্দ্র-ঈশ্বরগুপ্ত ধারাই ছিল কবিতার আধুনিকতার প্রতিপক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে আলাল-হুতোমই ছিল উপন্যাসের আধুনিকতার প্রতিপক্ষ।”

আকস্মিক ভাবে তো তাঁর মনে নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার বিষয়টি গড়ে ওঠেনি। তাঁর এই ভাবনা আমরা নিতে পারি বা না নিতে পারি, কিন্তু তিনি আজীবন তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে দিয়ে এই নতুন ধরনের ঐতিহ্য নির্মাণ ও উপন্যাসের অন্বেষণই করে গেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। উপন্যাস নিয়েও যেসব চিন্তাভাবনার রসদ তিনি রেখে গেছেন তাঁর উপন্যাস বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে ( সেগুলির মধ্যে একটি হল উপন্যাসচিন্তা, সময় ও সমকাল), সেগুলি নতুন করে পড়ার দরকার আছে এই সময় এবং আগামী সময়ের লেখকদেরও। এখানেই তিনি বলেছেন ‘‘বাংলা সাহিত্যের ছোট সীমায় নববাবু, নববিবি, আলাল-দুলাল, নিমচাঁদ, বুড়ো শালিখ ইত্যাদি অনেক দূর এসেছিল-প্রায় যেমন ইউরোপীয় পিকারস্কেরই নায়ক। কিন্তু এরা টিকতে পারল না। কমলাকান্তে এরা সবাই এক হয়ে গিয়ে বাংলা কাহিনী থেকে চলে গেল।’

দেবেশ রায় আর আমাদের মধ্যে নেই এটা যেমন মর্মান্তিক সত্য, তেমন এও সত্য, তাঁর লেখা ও ভাবনার এক বিশাল জগতের সামনে আমরা আজও দাঁড়িয়ে আছি। আগামী সময় এই সমুদ্র থেকে নতুন কোনও অমৃত খুঁজে পাবেই। একজন সামান্য পাঠক হিসেবে দেবেশ রায়ের রচনার সামনে নতজানু হয়েই আগামী সময়ের লেখকদের কাছে আশাবাদী হয়ে রইলাম। অন্তত দ্বন্দ্ব হোক তাঁর ভাবনার সঙ্গে। আর সেই দ্বন্দ্বটি হওয়ার জন্যেও তো তাঁকে পড়তেই হবে আমাদের।

Hindol Bhattacharjee হিন্দোল

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।

4 Responses

  1. দেবেশ রায়ের উপন্যাস নিয়ে এই লেখাটি সাহিত্যের পাঠকের পড়া দরকার। উপন্যাস এক অনিশ্চিত যাত্রা, এই বিশ্বাস্টুকু আমি দেবেশ পড়েই অর্জন করেছি। এই লেখাটি গভীর। রুশ উপন্যাসের উত্তরাধিকার তাঁর লেখায়। দস্তয়েভস্কি। লাতিন আমেরিকার উপন্যাসও নিজস্ব চলনে দস্তয়েভস্কির কথা মনে করিয়ে দেয়।

  2. সমস্ত সাহিত্য-প্রেমীর কাছে খুব মূল্যবান লেখা। লেখক দেবেশ রায়কে এমন গভীর ভাবে জানা এবং জানানো ইতিহাসে সম্পদ হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে। অনুরাগী পাঠক সমৃদ্ধ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *