ভলফ্‌গাং বরশ্যর্টের ‘ডি ক্র্যাহেন ফ্লিগেন আবেন্ডস্‌ নাখ্‌ হাউসে’ছোটগল্পের অনুবাদ করেছেন  নন্দিনী সেনগুপ্ত। জার্মান সাহিত্যিক বরশ্যর্টের জন্ম হয়েছিল ১৯২১ সালে জার্মানির হামবুর্গে এবং দেহাবসান হয় ১৯৪৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাজেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিক হিসেবে ফ্রন্টে লড়াই করেছেন; চিরকাল তার লেখা গল্প, কবিতা এবং নাটকের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সওয়াল করে গিয়েছেন।

ওরা ব্রিজের পাথুরে ঠাণ্ডা পাঁচিলে বসে থাকে। সেই ব্রিজটা, যেটা প্রায় বেগুনি হয়ে যাওয়া দুর্গন্ধ নালাটার উপরে রয়েছে। ওরা নালার ধারের তুষারনিরোধক ধাতব গ্রিলগুলোর উপরে বসে থাকে। ওরা মাটির নিচের ঘরগুলোতে নেমে যাওয়ার ভাঙ্গাচোরা সিঁড়িগুলোর উপরে বসে থাকে।    

ওরা রাস্তার ধারে টিনের ফয়েলের উপরে, হেমন্তের ঝরে পড়া পাতার উপরে, কিংবা পার্কের অভিশপ্ত বেঞ্চগুলোর উপরে বসে থাকে।     

ওরা দরজাবিহীন ভাঙা বাড়িগুলোর দেয়ালের উপরে হেলান দিয়ে, কিংবা সামনে ঝুঁকে বসে। জলের ধারে জেটির উপরে, ঘাটের উপরে বসে থাকে।       

ওরা ঝুঁকে বসে থাকে। সমস্ত নষ্ট হয়ে যাওয়া আর একা হয়ে যাওয়া বিষাদগুলো অগোছাল ডানার পালকের মতো ওদের ছুঁয়ে থাকে, যেমন ধরো- হৃদয় ভেঙে যাওয়ার গল্প, কোনও মেয়ের একা হয়ে যাওয়ার কথা, তারা খসে পড়ার কথা – ইত্যাদি।   

ওরা গোধূলির আলোছায়ায় বসে থাকে, বাড়ির ঠাণ্ডা ছায়ায়, সদরদরজার ফাঁকে আলকাতরার মত নিকষ অন্ধকারে কিম্বা ক্লান্ত ফুটপাথে। ওদের ক্ষীণজীবী আত্মা ধূসর ছায়া মেখে বিকেলের আগে পৃথিবীর প্রথম কুয়াশায় বসে থাকে, বিগত কোনও স্বপ্নকে আঁকড়ে। ওরা অতল অন্ধকারের উপরে, বাড়ি ফেরার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ক্ষুধার্ত শরীরে বসে থাকে।         

ছুঁচল ঝুলে পড়া কাকের মত মুখ নিয়ে (এছাড়া আর কীভাবে?) ওরা উবু হয়ে বসে থাকে, বসে থাকে, বসে থাকতে থাকতে ঝুঁকে পড়ে। কে? কাকগুলো? হ্যাঁ, হয়তো কাকগুলোই। কিন্তু মানুষগুলোও বটে, ঐ মানুষগুলো। 

লালচে সোনালি সূর্যটা সন্ধে ছ’টা নাগাদ শহরের ধোঁয়ায় ঢেকে যায় ধূসর হয়ে। বাড়িগুলোর রং নীলচে ভেলভেটের মত হয়ে যায়, সেগুলোর ধারালো কৌণিক চেহারা সন্ধের মুখে কেমন নরম হয়ে যায়। 

কিন্তু কাকমুখো লোকগুলো ফ্যাকাসে জমে যাওয়া সাদাটে মুখ নিয়ে নিরাশার ভেতরে ঝুঁকে পড়ে, ওদের অবশ্যম্ভাবী মনুষ্যত্বের মধ্যে ঝুঁকে পড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যায় ছেঁড়া তাপ্পি দেওয়া বিবর্ণ কালচে নীল ইউনিফর্মের জ্যাকেটের মধ্যে। 

ওদের মধ্যে একজন গতকাল থেকে বন্দরের জেটিতে বসে আছে, জলের গন্ধ শুঁকে যাচ্ছে, ভাঙা পাঁচিলের টুকরোর ঢিল জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। সোফার ঝালরগুলো যেভাবে সোফার বাইরে ঝুলে পড়ে, ওর হতাশ ভ্রুযুগল ঠিক সেরকমভাবে ওর কপালের বাইরে ঝুলে পড়েছে।  

সেখানে তার কাছে এসে দাঁড়ায় এক ছোকরা, হাতের প্রায় কনুই অবধি প্যান্টের পকেটে ঢোকানো,  জ্যাকেটের কলারটা একদম পাতলা হয়ে ঘাড়ের চারপাশে গুটিয়ে গেছে। লোকটা মুখ তুলে তাকায়না, দেখতে থাকে ক্ষয়ে যাওয়া বিষণ্ণ একজোড়া জুতোর সামনের সরু অংশ, আর লোকটার সামনের জলে একটা দুঃখী পুরুষের আঁকাবাঁকা ঢেউখেলানো ছায়া কেঁপে কেঁপে ওঠে। লোকটা জানে, টিম আবার এসেছে।         

-‘তাহলে, টিম’… সে বলে ওঠে… ‘আবার ফিরে এলি? কাজ শেষ হল?’ 

টিম কিছু জবাব দেয়না। লোকটার পাশে জেটির দেওয়ালের উপরে বসে। নিজের লম্বা হাতদুটো দিয়ে নিজের গলা, কান জড়িয়ে বসে; ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলো সে।     

-‘বিছানাটা যথেষ্ট চওড়া ছিল এবার?’ বেশ কয়েক মিনিট পরে লোকটা কথা বলে ওঠে।

-‘বিছানা? বিছানা?’- টিম রাগী রাগী গলায় বলে, ‘আরে, আমি ওকে ভালোবাসি!’       

-‘নিশ্চয়ই ভালবাসিস! কিন্তু আজ রাতে ও তোকে আবার দরজার বাইরে বের করে দিয়েছে। তার মানে রাতের গপ্পো নেই কিছু। আমি নিশ্চিত, তুই সেজেগুজে পরিষ্কার হয়ে যাসনি, আর পরিষ্কারভাবে কিছু বলিসও নি। রাতে দেখা করবার ব্যাপার মানে, সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার, টিম! শুকনো ভালোবাসায় কিছু হয়না! ও ভালো কথা, তুই জানিস তো যে বিছানায় গেলে কী করতে হয়? জানিস না? তাহলে, তুই এখানেই থাক! নাকি, ওকে এখনো ভালবাসিস?’

টিম ওর লম্বা হাতদুটো গলায় ঘষে, জ্যাকেটের কলারের মধ্যে গুঁজে দেয়।        

-‘ও টাকা চায়’… অনেক পরে টিম মুখ নিচু করে বলে…  ‘কিম্বা সিল্কের মোজা! তাহলে আমাকে থাকতে দিতো।’ 

-‘ওহ, তুই এখনো ওকে ভালবাসিস’… বলে ওঠে লোকটা,…’অবশ্য, আর কীই বা করবি যদি টাকা না থাকে!’     

টিম কিছুই বলেনা। একথাও বলেনা যে ওকে এখনো ভালোবাসে; কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে বলে ওঠে, ‘ওকে স্কার্ফটা দিয়ে দিলাম, জানো? লাল রঙেরটা। আমার কাছে আর কিছু ছিল না যে। কিন্তু একঘণ্টা পরে হঠাৎ বললো যে ওর আর সময় নেই।’     

-‘লাল স্কার্ফটা?’… লোকটা জিজ্ঞেস করলো। ওহ না, এতো ভালোবাসে!- ভাবতে লাগলো লোকটা, এভাবে  ভালোবাসে কেউ! আবার জিজ্ঞেস করে লোকটা… ‘ওহ, তোর সেই অত সুন্দর লাল স্কার্ফটা? তারপরে তুই ফিরে এলি এখানে? এই কনকনে ঠাণ্ডায়, রাত হয়ে আসছে, এখানে?’      

-‘হ্যাঁ!’… টিম বলে ওঠে-  ‘রাত হয়ে আসছে আবার! আর… আর আমার ভীষণ শীত করছে…  এই গলার কাছটা… যেখানে আমি স্কার্ফটা জড়িয়ে রাখতাম! উফফ… বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে… উহ… বলে বোঝাতে পারছি না!’   

তারপর তারা দুজনেই জলের দিকে চেয়ে বসে থাকে, জেটির দেওয়ালের উপরে পা ঝুলিয়ে। একটা বার্জ হুইসল বাজিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে যায়। বিশাল একটা ঢেউ ফিরে আসে পাড়ের কাছে, ধীরে ধীরে ছোট ছোট ঢেউয়ে ভেঙে যায়। তারপরে আবার সবকিছু চুপচাপ হয়ে যায়, শুধু শহরটা জেগে থাকে। দুটো লোক উবু হয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় বসে থাকে দেওয়ালে, স্বর্গ আর পৃথিবীর মাঝখানে; একঘেয়েভাবে বসে থাকে, কালচে নীল পোশাকে কাকমুখো দুটো লোক বসে থাকে সন্ধের মুখে। ঘণ্টাখানেক পরে ওদের কাছে একটুকরো লালরঙের কাগজের টুকরো ঢেউয়ে ভেসে আসে। ধূসর সীসারঙের ঢেউয়ে ভেসে আসে অদ্ভুত দেখতে লাল কাগজের টুকরো। টিম কথা বলে ওঠে, ঐ লোকটাকেই বলে, – ‘আরে, আমার কাছে আর কিছুই ছিল না। ঐ স্কার্ফটাই শুধু ছিল।‘    

লোকটা উত্তর দেয়,- ‘হ্যাঁ, আর খুব সুন্দর লাল রঙের, তাই না? মনে আছে। টিম, রঙটা লাল, তাই না বাছা!’    

-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, লাল, লাল রঙের ছিল’… টিম হতাশভাবে বলে, ‘উফফ, এখন আমার ঘাড়, গলা সব জমে যাচ্ছে বাপু!’              

তাতে কি বা এসে যায়… লোকটা ভাবতে থাকে! ভালবাসা, হুঁহুঁ , ভালোবাসা বলে কথা! একঘণ্টা মেয়েটার সঙ্গে কাটিয়ে এলে, বলছো ভালোবাসো, এখন ঠাণ্ডায় জমে হিহি করলে চলবে!! লোকটা হাই তুলতে তুলতে আলগোছে বলে, -‘রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটা অবশ্য খুব সুবিধের নয়!’       

-‘মেয়েটার নাম লিলা*!’ টিম বলে ওঠে, ‘ও সিল্কের মোজা পরতে ভালোবাসে। কিন্তু আমার কাছে ওসব কিচ্ছু নেই!’  

-‘লিলো!!’ লোকটা অবাক হয়… ‘আরে দূর্‌র্‌,  পাগল হলি নাকি? লিলা নয়, ওর নাম লিলো!’    

-‘অতি অবশ্যই ওর নাম লিলা!’ টিম উত্তপ্ত গলায় বলে, ‘শুনে রাখো, লিলো বলে কাউকে আমি চিনিনা! তাছাড়া আমি ওকে ভালোবাসি, বলে রাখলাম তোমায়!’   

টিম রাগত ভঙ্গিতে ছিটকে যায়, বন্ধুর পাশ থেকে একটু সরে বসে। হাঁটুদুটো ভাঁজ করে থুতনিতে ঠেকিয়ে বসে।  লম্বা লম্বা হাতদুটো গলায় জড়িয়ে বসে। সন্ধ্যা শুরুর হাল্কা অন্ধকার একটা জালের মত দিনের আলোর উপরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে; সূর্যের শেষ আলোকরশ্মি ধীরে ধীরে অজস্র আনুভূমিক সমান্তরাল রেখার সীমানা ধরে মিলিয়ে যেতে থাকে। লোকগুলো একা হয়ে বসে থাকে, আসন্ন রাতের অনিশ্চয়তার সামনে বসে  থাকে; শহরটা প্রচণ্ড প্রলোভন দেখিয়ে গুঞ্জন করতে শুরু করে। শহরটা টাকা অথবা সিল্কের মোজা চায়, এবং বিছানাগুলো চায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা রাতের চুক্তি।         

-‘টিম, শোন!’ … লোকটা আবার কথা বলতে চায়, কিন্তু একটা ডাক দিয়ে চুপ করে থাকে।  

-‘আবার কী হল?’ – টিম প্রশ্ন করে।

-‘বলছিস যে সত্যিই ওর নাম লিলা?’

-‘হাজারবার বলছি, ওর নাম লিলা!’ টিম বন্ধুর কথায় চিৎকার করে ওঠে, ‘লিলা ওর নাম, আর আমার যদি কিছু একটা হিল্লে হয়, আমি ফিরে যাবো ওর কাছে! ও আমাকে বলেছে, ‘আবার এসো প্রিয়তম!’… ‘প্রিয়তম’ বলেছে আমায়!’ 

-‘শোন, টিম!’ লোকটা কোনমতে সামলে উঠে বলতে থাকে, ‘ওর নাম যদি সত্যিই লিলা হয়ে থাকে, তাহলে ওকে লাল স্কার্ফটা দিয়ে ভালোই করেছিস। যদি ওর নাম লিলা হয়, তাহলে ও ওটা পাবার যোগ্য। যদিও রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটা বড্ড খারাপ… নাহ, টিম, ও লিলা হয়ে থাকলে ঐ লাল স্কার্ফ নিয়ে অত হা-হুতাশ করিস না তুই!’         

দুটো লোক ঘোলাটে জলের সামনে ধীরে নেমে আসা সন্ধ্যার দিকে চেয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকে; ওদের ভয় নেই, আবার সাহসও নেই। ওরা যেন সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বন্দরের জেটির দেওয়াল থেকে, জাহাজঘাটার লম্বা করিডর থেকে, গৃহহীনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ওদের নিজেদের ক্ষীণ আত্মা থেকে, ওদের শূন্য পকেটগুলোর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ওরা যেন একঘেয়েমির একটা গহ্বরের মধ্যে ঢুকে গেছে, যেখান থেকে বেরোবার কোনও রাস্তা নেই।           

এমন সময় কারা যেন কাকগুলোকে ছুঁড়ে দিলো এই দৃশ্যের মধ্যে। দিগন্তের মধ্যে ছিটকে এসে উড়তে উড়তে কা- কা করে ডাকতে লাগলো কাকগুলো। পরিষ্কার টিস্যুপেপারের মধ্যে যেভাবে কালির ফোঁটা ছিটকে ধেবড়ে ছড়িয়ে যায়, কাকগুলো সন্ধের আকাশে সেভাবেই ছড়িয়ে যেতে লাগলো। জীবনের ক্লান্তি নিয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে দূরে সন্ধের অন্ধকারের দিকে উড়ে যেতে লাগলো ওরা।   

ওরা কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কালচে নীল পোশাক পরা টিম এবং ঐ কাকমুখো লোকটা।  জলের গন্ধটা সম্পন্ন এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলো। শহরটার অজস্র চোখ স্তূপীকৃত চৌকোনা বাক্সের মত বাড়িগুলোর জানালার আলোয় পিটপিট করে জ্বলে উঠতে লাগল। ওরা কাকগুলোকে দেখছিল;  যদিও অনেক আগেই সন্ধের অন্ধকার কাকগুলোকে গিলে নিয়েছিল। লোকগুলো ওদের বুড়োটে ফ্যাকাসে গরিব মুখ নিয়ে বসে বসে দেখছিল। টিম- যে লিলাকে ভালোবেসেছে, টিম- যার বয়স মোটে কুড়ি, সে বলে উঠল…  

-‘কাক উড়ে গেলো, দেখলে তুমি? কাক দেখা ভালো।’         

লোকটা আকাশের হাল্কা আলোয় টিমের মুখের দিকে তাকাল। টিমের চওড়া মুখ আধো অন্ধকারে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে; ওর চওড়া মুখে ঠোঁটদুটো যেন বিষাদের রেখা, একাকী রেখা। কুড়ি বছরের মুখ, ক্ষুধার্ত, শীতার্ত এবং আরও কত অপূর্ণ ইচ্ছার তিক্ততায় শীর্ণ একটা মুখ।        

-‘কাক!’- টিমের চওড়া মুখটা খুব নরমভাবে আলতো করে উচ্চারণ করে; যে মুখটা কুড়ি বছর ধরে নানা ওঠাপড়া, আলো-ছায়া দেখেছে, সেই মুখটা বলে ওঠে, ‘কাক! কাক দেখলে শুভ হয়, ভালো হয়। ওরা বাসায় ফিরছে। সোজা ঘরের দিকে উড়ে যাচ্ছে।’       

দুটো লোক উবু হয়ে বসে আছে, ওরা জগতে সব জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত, হতাশ। নতুন এই আসন্ন রাতের সামনে ওরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, এই প্রচণ্ড হাড়কাঁপানো রাতের সামনে ওদের ভয়ও নেই, সাহসও নেই। রাতের ভীষণ কালিমা কেমন হয়, ওরা জানে। শহরটা রাত বাড়লে নরম উষ্ণ পর্দার আড়ালে লক্ষ লক্ষ চোখের মধ্যে ঝিমিয়ে পড়বে, ঘুমিয়ে পড়বে নিঃশব্দ রাতের রাস্তাগুলোর পরিত্যক্ত ফুটপাথে। লোকদুটো উবু হয়ে বসে আছে মাটিতে; ক্লান্ত, বিষণ্ণ স্তুপের মত বসে আছে। টিম, যার কুড়ি বছর বয়স সে কিনা বলে বসল… ‘কাক! কাক দেখা খুব শুভ। কাক সন্ধেবেলায় সোজা বাসায় ফেরে।’  আর পাশের কাকমুখো লোকটা নিজের মনেই ফাজলামোর সুরে বলতে লাগল… হে, হে, কাক! টিম… উফফ, ভগবান! উফফ, টিম, কেমন মানুষ… উফফ… কাক, হা হা হা… কাক!’        

ওরা ঐখানে বসে আছে উবু হয়ে। নষ্ট হয়ে যাওয়া ইতর জীবন নিয়ে বসে আছে। জলের একদম ধারে বন্দরের জেটির পাঁচিলে, পাথরের উপরে জবুথবু হয়ে বসে আছে। বাঁধের নিচের ধাপের সিঁড়ির উপরে বসে আছে। বয়ার কাছে, পন্‌টুনের উপরে বসে আছে। ঝরে পড়া ধুলোমাখা পাতা আর টিনের ফয়েলভর্তি রাস্তার কিনারে বসে আছে। কাকগুলো? নাহ, মানুষ! ওদের মধ্যে একজনের নাম টিম, যে একটা লাল স্কার্ফ দিয়ে এসে লিলোকে ভালোবেসেছে। আর এখন, এখন মেয়েটাকে একেবারেই ভুলতে পারছে না। আর কাকগুলো, কাকগুলো কর্কশসুরে ডাকতে ডাকতে বাসায় ফিরল। সন্ধের মুখে ওদের কা- কা ডাক বিশ্রী, কুৎসিত শোনাচ্ছিল।               

কিন্তু তারপরে একটা বার্জ ভেসে গেল আবার; ঢেউয়ের ফেনা ছড়িয়ে পড়লো জলে, বার্জটা লাল আলো ছিটিয়ে দিতে দিতে ভেসে যাচ্ছিল, আলোটা লাট খেয়ে ঠিকরে পড়ছিল বন্দরের ধূসর অস্পষ্টতায়। অল্প কিছুক্ষণ, এক দু সেকেন্ডের জন্য তখন সবকিছু লাল হয়ে উঠছিল। লাল… ঠিক আমার স্কার্ফটার মত, ভাবছিল টিম। ধীরে ধীরে বার্জটা দূরে চলে গেলো। চোখের সীমানার বাইরে। এবং টিম প্রায় অস্ফুটে বলছিল.. ‘লিলো… সবসময় থেকো…  লিলা লিলো লিলা লিলালিলো।’  

————————————————————–   

 *জার্মান ভাষায় ‘লিলা’(Lila) শব্দের অর্থ বেগুনি, লাইল্যাক ফুলের মত রং।           

জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *