ঋতু বদলের সময়টায় রোদ্দুরের কমবেশি চলতেই থাকে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে ঠান্ডা-গরমের চোখরাঙানি। এই মেঘ করা গুমোট, তো এই উজ্জ্বল রোদ। আচমকা বৃষ্টি! আবার তারপরেই ফিরে আসা শীত। এমনি করতে করতেই একসময় বিদায় নেয় শীতকাল। আমাদের পরম আদরের শীত ফুরিয়ে এলেই মনখারাপের ওপর প্রলেপ দিতে প্রস্তুতি নিই আমরা। 

বিদায়ী শীতের প্রস্থান আগেভাগেই যেন ঘোষণা করে দেয় মাঘী পঞ্চমীর পরদিন শীতলষষ্ঠির মেনু। বাসি গোটাসেদ্ধর সঙ্গে পান্তাভাত আর সজনেফুল ছড়ানো কুলের অম্বলের কম্বোমিল যেন জানান দেয় পেট ঠান্ডা রাখতে হবে এবার। বেশি গরম জামাকাপড় আর নয়। এর ক’দিন বাদেই গায়ে আছড়ে পড়বে দখিনের হাওয়া। উত্তুরে হাওয়াকে সি অফ করতে না করতেই আমাদের সেই শীতবসন্ত সন্ধিক্ষণে ঠান্ডা-গরমে অসুস্থ হবার জন্য সিঁটিয়ে থাকা তখন। পড়ুয়াদের সব পরীক্ষা। মাধ্যমিক। উচ্চমাধ্যমিক। মায়েদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সুস্থ রাখতে হবে ছেলেপুলেকে। তাই মা শীতলাই যেন ভরসা। আর ভরসা আমাদের গ্রামবাংলার প্রকৃতির অকৃপণ দানে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় সেগুলো রেঁধে, খেয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা। 

কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, রসুনের কোয়া, কয়েকটা তুলসিপাতা সারাবছর খাওয়া যায় খালিপেটে। তবে এই বিশেষ সময়টায় চাই শরীরের সম্বচ্ছরিক ধৌতিকরণ। বর্ষশেষের ঝাড়াপোঁছার মতো হাতের কাছের সহজলভ্য ওষধির বাৎসরিক টীকাকরণ । শুধু শরীরের জন্যই নয়। রসনার জন্যও। মানে এইসময় স্বাদ বদল কিন্তু বাঙালীর রান্নাঘরে নতুন নয়। সেকালে ঠাকুমা দিদিমারা এই নিয়ে ঘরে বসেই বিস্তর গবেষণা করতেন। মগ্ন থাকতেন আয়ুর্বেদের বই নিয়ে। কিসে ছেলেপুলেরা সুস্থ থাকে, নীরোগ থাকে, সেই লক্ষ্যে তাঁরা অবিচল ছিলেন। 

ফাল্গুন মাস পড়ে গেলেই বাজারের বেরঙিন পসরায় আর যেন চোখ পড়েও পড়েনা। রক্তাল্পতায় ভোগা ফুলকপি, হলদে ছোপ ধরা ব্রকোলি কিম্বা ধুঁকতে থাকা শিষ বেরুনো পালং… সব যেন শুষ্কংকাষ্ঠং। নীরস কলেবর নিয়ে তাকিয়ে কটমট করে, অথচ ক্রেতার চোখ টানতে পারেনা। বিক্রেতা বলে নাওনা, নাওনা। আনাজ বলে, খেওনা, খেওনা। এ দিকে গিন্নিমায়েদের সকাল হলেই চিন্তা! ফ্রিজের সবজিবাক্স খুললেই এই সময়টায় গ্রাস করে বসে একরাশ হতাশা। নেই সেই শীতসবজির রূপ, নেই সেই নতুন শীতের আনাজপাতির ওপর আকর্ষণ। 

শাশুড়িমায়েরা এই জন্যেই বুঝি বলতেন, বাড়ির গিন্নিদের উচিত বাজার যাওয়া। ছেলেরা যদি বাজার সরকার হয়, তারা জীবনেও বুঝবেনা এই হেঁশেলের ঋতু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট। তারা বাজারে গিয়ে দামড়া বাঁধাকপি, অ্যানিমিক ফুলকপি, ছিবড়ের মত মূলো আর অন্তঃসারশূন্য কিছু পাকাপাকা ফেঞ্চবিনস এনে দিয়েই তাদের বাজার করার সাপ্তাহিক কর্তব্যে একঘটি জল ঢেলে যেন বেঁচে যায়। অথচ এই ছেলেদের পাতেই যখন থালা সাজিয়ে শাশুড়ি মা বেড়ে দেন নিম শুক্তো কিম্বা তেঁতুল দিয়ে টকের ডাল অথবা কোনোদিন মুচমুচে নিমবেগুণ আর মৌরলামাছের অম্বল তখন ছেলেরা মুখ ফুটে বলেই ফেলে, ” জানো মা? বডি চাইছিল ঠিক এমনটাই!” হ্যাঁ, আম বাঙালি বলতে বাধ্য সে কথা। গরমের দেশের মানুষের শরীর ঠিক তেমনিই তো চায়। 

আচ্ছা সব কাজ কি ছেলেদের দিয়ে হয়, বলুন তো? ওরা ভাবে সব পারি। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে মেয়েরাই এক্সপার্ট। তাই আমিও বলি, ব্যাগ দুলিয়ে মেয়েরাই বাজার যাক সিজন চেঞ্জের এই সময়। বাজার কোরও বুঝে, চিনে নিও খুঁজে। ঘুরে ঘুরে না দেখলেই হাপিশ তারা নিজে। 

সজনে ফুলের চচ্চড়ি drumstick flower curry
বসন্তের গোড়াতেই বাঙালির পাতে সজনেফুলের চচ্চড়ির সুগন্ধ! ছবি – youtube.com

অল্পদিনের জন্য আসে কিছু জিনিস বাজারে। সেগুলোয় চোখ না রাখলেই ম্যাজিকের মত ভ্যানিশ কিন্তু। তখন আবার অপেক্ষা একটা বছরের। হরেক কিসিমের স্বাস্থ্যকর অথচ মুখরোচক প্রাকৃতিক জিনিসের আয়োজন কিন্তু থাকে। বিশেষ করে দূরপাল্লার দিদি-মাসিদের কাছে, যাঁরা মাটিতেই উবু হয়ে ধপাস করে বসে পড়েন বাজারের ঝুড়ি নিয়ে এক কোণে। অথবা যাঁদের লোকাল দাদাদের “তোলা” দেবার ক্ষমতা নেই। তাঁরাই নিয়ে আসেন সেসব জিনিসপত্র। হটকেকের মতো বিক্রি হতেই ফিরে যান। দু’মুঠো সজনেফুল থেকে তিন প্যাকেট টোপাকুল, চার বান্ডিল কুমড়ো ফুল থেকে লকলকে লাউডগা, কচি কলমি শাকের লতা থেকে যুক্তি ফুলের গোছা, পলতা, ডুমুর, হিঞ্চে, নালতে, ভাটপাতা কিম্বা বকফুল নিয়ে আসেন অতি যত্নে শহুরেদের জন্য। আর ঝুড়ির কোলে আদরে রাখেন ক’টা তাজা মহার্ঘ্য দিশি মুরগির ডিম। সর্বগুণান্বিতা নিমপাতার আঁটি তো এইসময়ে প্রথমপাতে অগতির গতি। তাই বলাই বাহুল্য নিমপাতার আঁটি তো হাতের পাঁচ তাঁদের ঝুড়িতে। 

বনফুলের বিখ্যাত অণুগল্প “নিমগাছ” মনে পড়ে? শুরুতেই সেখানে নিমের প্রশস্তিবচন।
“পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ! কেউবা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকানিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ। কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে। এমনি কাঁচাই …কিম্বা ভেঙে বেগুন-সহযোগে। যকৃতের পক্ষে ভারি উপকার!” সব শেষে লেখক বাড়ির সর্বগুণান্বিত গৃহবধূকে তুলনা করছেন এই নিম গাছের সঙ্গে। সত্যিই তাই। সে ঘরে পড়ে থাকে নিজের মতো, কিন্তু তার গুণের শেষ নেই যেন। 

কথায় বলে, নিম নিসিন্দে যেথা, মানুষ মরে না সেথা। কিম্বা নিম তিতো, নিসিন্দে তিতো, তিতো মাকালের ফল, তার চেয়ে অধিক তিতো, বোন সতিনের ঘর। বিখ্যাত লোকগান নির্মলেন্দু চৌধুরীর। কিন্তু এই নিম আর বেগুন জুটি প্রথম পাতে ভাতে দিলে? জমে যায় খাওয়া! সুললিত বেগুনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন মুচমুচে নিমের গন্ধ। প্রতি গরাসে গরাসে এই তেতো এ সময়ে বড্ড মিঠে লাগে বাঙালির।  

মঙ্গল কাব্যে চোদ্দ শাকের বর্ণনাতেও সেই নিমের নাম আছে। আর হবে নাই বা কেন? নিম-বেগুনে মজেছে মন, গরম আসছে বুঝবে তখন।  এমন কি শ্রীচৈতন্যচরিতামৃততেও উল্লেখ আছে নিম-বেগুন ভাজার। “নূতন নিম্ব পত্রের সহিত ভর্জিত বার্তাকী।” সেই কারণেই বুঝি শীতের অবসান মানেই বাঙালীর ঘরে নিম-বেগুনের গন্ধ। কারণ নিম গাছে কচি কচি সবুজ নতুন পাতার আগমন হয়। গরমের দেশে জন্মেছি আমরা। নিমের হাওয়া গায়ে লাগানোও স্বাস্থ্যকর। হাম-বসন্ত হয় না নাকি। হলেও অবশ্য সেই নিমই ভরসা। নিমের জলে স্নান করে তবেই শুদ্ধি।

প্রকৃতির এই অকৃপণ দান এড়াবে সাধ্য কার? তাই তো নিম-বেগুন হল বসন্তের আগমনীর মধ্যাহ্নভোজের অন্যতম শুরুয়াত, শরীর সুস্থ রাখার জন্য। আর রান্না করতেও ঝামেলা কম। এই নিমপাতা ভেজে শুক্তুনিতে ছড়িয়ে দিলেও অমৃতসম মনে হয় গরম পড়ার সময়।

ওষধি গুণে ভরপুর এই নিমপাতার মানিকজোড় হল সজনে। সারাবছরের মোটামোটা ড্রামস্টিক নাজনের ছুটি তখন। মোটামোটা নাজনে দেখে দেখে থকে যাওয়া চোখ লিকলিকে সজনে খুঁজে হাপিত্যেশ করে সারাবছর। পুষ্টিকর সজনে অনেক সুস্বাদু। সেই যদ্দিন না চৈত্রমাসে বাসন্তীপুজোর ঢাকে কাঠি পড়বে, তদ্দিন কচি লকলকে সজনে খাওয়া যায় কবজি ডুবিয়ে। তবে সজনের সাথি হল হিং দেওয়া কলাইডালের বড়ি। তা যেন অতি অবশ্য‌ই মজুত থাকে ঘরে । আলু-বেগুন দিয়েই হোক কিম্বা কুমড়ো! এই সজনেডাঁটার চচ্চড়ি চড়ানোর সময় পাঁচফোড়ন আর নামানোর সময় সর্ষেবাটা মাস্ট কিন্তু। জমে যাবে। 

সজনে ডাঁটা, আলু দিয়ে পোস্ত? সঙ্গে পাতলা কাঁচা মুগের ডাল আর এক খন্ড গন্ধরাজ লেবু। আর কিছু লাগে বলুন তো? কাঁচামুগের ডালে লাউ ফেলে দিয়ে, উচ্ছেভাজা ছড়িয়ে তেতোর ডালও উপাদেয় গরম পড়ার এই সময়টায়। সঙ্গে যদি কুমড়ো, বক, সজনে কিম্বা যুক্তি ফুলের বেসন, চালের গুঁড়ো, কালোজিরে, পোস্ত ছড়িয়ে ভাজা থাকে তাহলে মাংস, মাছ সরিয়ে রেখেই খাওয়া শেষ করা যায়।  

মৌরলার টক sour curry with mourala fish
তেঁতুল বা কাঁচা আম দিয়ে মৌরলার টক ছাড়া বাঙালির বসন্তপাব্বণ অসম্পূর্ণ। ছবি – bongeats.com

দিদার মেনু এই সময় বরাদ্দ ছিল প্রথম পাতে নিমবেগুন অথবা উচ্ছে আলু সেদ্ধ কিম্বা পলতার বড়া। এরপর পেঁপে অথবা লাউ দিয়ে কাঁচামুগ ডাল আর এমন সব মুখরোচক ভাজা। সঙ্গে ঝিঙে অথবা সজনে ডাঁটা দিয়ে পোস্ত চচ্চড়িতে টাকনা। কাঁচা সর্ষের তেল ছড়ানো পোস্ত চচ্চড়ি অরুচির রুচিকারক। কাঁচা মুগডালে কালোজিরে কাঁচা লংকার ফোড়ন আর নামিয়ে আদাবাটা দিলে তবে হবে তার। আদা-মৌরিবাটা দিয়ে কলাইয়ের ডালও চলতে পারে তবে শেষপাতে অম্বল মাস্ট। টক, অম্বল নাকি নতুন গরম পড়াকে স্বাগত জানিয়ে শরীর ঠান্ডা রাখে। পরে বুঝেছি তার কারণ। এগুলো ভিটামিন সি এর উৎস। ঠান্ডা লাগবে না তাই বুঝি আমাদের খেতে বলা হত ছোটবেলায়।   

এই সময় অগতির গতি হল কাঁচা পোস্ত বাটা। সামান্য নুন, সরষের তেল আর কাঁচা লংকা ছড়িয়ে এই পোস্তবাটার সঙ্গে কচি লাউশাকের ডগাসেদ্ধর রসায়ন খুব জমে। এই দিয়ে এক থালা ভাত উড়িয়ে দেওয়া যায়। আরেকটা পেট ঠান্ডা রাখার জন্য অব্যর্থ রান্না হল লাউশাকের ডগা অথবা কলমিশাকের ডগা দিয়ে আলু বেগুন, পোস্তবাটা দিয়ে সাদা সাদা দুধ লাউশাক অথবা দুধ কলমি। পাঁচফোড়ন দিয়ে সরষের তেলে আলু, বেগুন আর শাক দিয়ে নুন, মিষ্টি। সেদ্ধ হলে পোস্তবাটা। থকথকে হয়ে এলে দুধে ময়দা গুলে নামিয়ে দেওয়া ঝোলা ঝোলা এই উপাদেয় তরকারি। পেট ঠান্ডা রাখে, বলতেন ঠাম্মা। 

নিমপাতা পাকতে শুরু করলেই ঠাম্মা প্রথম পাতে রাঁধতেন কচি কচি উচ্ছে আর আলু দিয়ে সদ্য ওঠা নটেশাকের চচ্চড়ি। অপূর্ব খেতে গরম ভাতের সঙ্গে। শুধুই পাঁচফোড়ন দিয়ে চড়াতেন আর নুন দিয়ে ঢাকাচাপা দিয়ে উচ্ছে, আলু আর নটেশাক কে ন্যায়দম খাইয়ে ভাজা ভাজা করে নামিয়ে একটু ঘি ছড়াতেন ওপর থেকে।   

ফাগুন ফুরোতে ফুরোতে কাঁচা আম এসে গেলেই আমার ঠাম্মার চৈত্রে আমবারুণী ব্রত পালন। সদ্য-ওঠা কাঁচা আম গঙ্গায় ফেলে পুজো করেই আম দিয়ে টক ডাল হবে বাড়িতে। তার আগে বাড়িতে কাঁচা আমের নো-এনট্রি। এই সময়টাকে ঠিক যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখতে রাখতে বলি, বসন্ত এসে গেছে! সর্ষে ফোড়ন দিয়ে এই কাঁচা আমের অম্বল অথবা আম দিয়ে মৌরলা মাছের টক থাকলে আর কী চাই এই বসন্তে?

শীত ফুরোক আপত্তি নেই! টক ডাল, নিম-বেগুন, সজনে ফুলের গন্ধ আর পোস্ত বাটায় কাঁচা সরষের তেলের ঝাঁঝ নিয়ে বাঁচো বাঙালি, বাঁচো আরও বেশি করে। রেজুভিনেট করে নাও নিজেকে! হাতের কাছে সহজলভ্য সস্তা রাঁধাবাড়ার ভেষজ উপকরণ দিয়ে। বিরিয়ানি, কোর্মা, পটলের দোরমা তো রইলই সারাবছরের জন্য তোলা। এই সময়টায় একটু সুরক্ষা কবচ নাও না হাতে তুলে, তোমার আদরের দেহ আর মনের জন্য!    

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *