আমার জন্ম ঢাকুরিয়ায়। ছেলেবেলায় পুজো বলতে ঢাকুরিয়ার পুজোকেই বুঝতাম। আমার বাবা শৈল চক্রবর্তী ছিলেন স্বনামধন্য কার্টুনিস্ট। বাবা খুব ভাল চোখ আঁকতেন। বাবা বলতেন মানুষের চোখ খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। চোখ দিয়ে মানুষ চেনা যায়। সে রকমই মূর্তি গড়ার সময় শেষে দুর্গা প্রতিমার চক্ষুদান করা হয়। ঠাকুর দেখার সময় আমার তাই দুর্গা ঠাকুরের চোখ নজরে পড়ত। আমাদের তখন খুবই সাধারণ অবস্থা। আজকের এই বৈভব ছিল না। দুর্গা পুজোর সাজসজ্জায় একমাত্র সেই বৈভব পেতাম। দেবী দুর্গা-র অস্ত্রধারণ,অসুর নিধন- সমস্ত কিছুই আমাকে রূপকথার খুব কাছে নিয়ে যেত। দুর্গা তো নারী সমাজের প্রতীক।সেই নারী আবার মুকুট পরিহিত। আমার ছেলেবেলায় আশেপাশের কোনও মহিলাকে মুকুট পরা অবস্থায় দেখিনি। আর এই দেখাটা হোত বছরে এক বার মাত্র। সারা বছরের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের ক্লান্তি দূর হোত ওই কটা দিনে। ওই তিনটে দিন যেন আমার শ্বাস প্রশ্বাসে অক্সিজেন দিত। এক সময়ে আমাদের বাড়ি বদল হোল। আমরা এলাম গোলপার্কে। গোলপার্কের দুর্গা পুজোয় আলোর রোশনাই অনেকটাই অন্য রকম। আমরা কে-কটা ঠাকুর দেখেছি,সেটা নিয়েই চলত কাউন্টিং। অনেকেই ঠাকুর দেখায় সেঞ্চুরি করে ফেলত। আমি কোনওদিনই অনেক ঠাকুর দেখতে পারিনি। আমার অত এনার্জি ছিল না।

একটা মজার ঘটনা বলি। আমি আর মিঠুন চক্রবর্তী এক বার রাত দুটোর সময় ঠাকুর দেখা শুরু করি। মিঠুন ওর শোভাবাজারের পুজোয় ঢাকের তালে একটু নেচেও ছিল। মিঠুন সেই সময় মৃগয়া,সুরক্ষা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করেছে। ওর মা বোন টালিগঞ্জে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। আমি ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওখানে যেতাম। ঘড়ির কাটায় ভোর পাঁচটা। শেষ হোল আমাদের ঠাকুর দেখা। মিঠুন ওর গাড়িতে এয়ারপোর্টে গেল। বোম্বে যাবে। ওর গাড়ি আমাকে বাড়ি ছাড়ল। জনপ্রিয় হওয়ার পরে আমি ইচ্ছে থাকলেও প্যান্ডেলে গিয়ে ঠাকুর দেখতে পারি না। তবে ছেলেবেলায় ঠাকুর দেখার কথা বললে আর একটা ঘটনা আজও খুব মনে পড়ে। গোলপার্কে চলে আসার পরে আমি আমার মা-কে হারাই। আমার বয়স তখন মাত্র বারো। মা-র আঙুল ধরেই আমি ঠাকুর দেখতাম। মা-র আঙুল ছুঁয়েই আমি দেবী দুর্গা -কে চিনেছি। মা দুর্গা ঠাকুরের দিকে দেখিয়ে বলতেন —‘প্রণাম করো। উনি সকলের মা’। আজ নিউইয়র্কে, হিউস্টনে প্রবাসী বাঙালিদের দুর্গা পুজোয় ঠাকুরের মুখের দিকে তাকালেই আমার মা-র কথা মনে পড়ে। এখন থিম পুজোর জন্য অনেক সময় দুর্গার মুখশ্রী পরিবর্তন হয়। ছেলেবেলায় যে দুর্গার রূপ দেখেছি, সেটা পটুয়া পাড়ার দুর্গা। সেই দুর্গা অনেক উজ্জ্বল। অনেক বাস্তবের কাছাকাছি।মা দুর্গা-র মুখের প্রতিটি মাংস পেশী জীবন্ত। মা-র ত্রিশুল অসুরের বুক বিদ্ধ করছে। মা-র মুখে শাসনের ভাষা স্পষ্ট। মা কি আমাদের ওপর রুষ্ট? এই মুখভঙ্গির রহস্য আজও আমি খুঁজছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *