সিমলেপাড়ার বিখ্যাত দাদার দীর্ঘ ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছেন এক বাঙালি বিপ্লবী, যাঁকে চিঠি লিখেছিলেন স্বয়ং ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন! ইতিহাস তাঁকে সে ভাবে মনে রাখেনি ঠিকই, কিন্তু তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রবাসী বিপ্লবীর স্মৃতি, অজস্র আত্মত্যাগের ঘটনা! আজ, ৪ সেপ্টেম্বর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মদিন। ১৮৮০ সালে উত্তর কলকাতার নামজাদা দত্ত পরিবারে জন্মানো ভূপেন্দ্রনাথ ভারতের সাম্যবাদ চর্চার আদি পর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের এক জন। ভূপেন্দ্রনাথের জন্মদিনে এক বার ধুলো ঝেড়ে তাকানো যাক ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠায়।
ভূপেন্দ্রনাথের রাজনৈতিক জীবনের শুরু ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে। যুগান্তর পত্রিকার শুরুর দিকে তিনি সম্পাদক ছিলেন কিছু দিন। সিস্টার নিবেদিতা, ব্যারিস্টার পি মিত্র, অরবিন্দ ঘোষদের সংস্পর্শে এসেছেন। সোনার বাংলা নামে ব্রিটিশবিরোধী একটি প্যামফ্লেট প্রকাশের অপরাধে ১৯০৭ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমে লুকিয়ে আমেরিকা চলে যান। কিছু দিন ইন্ডিয়া হাউজে আশ্রয় নেন। সেখানে তখন বামপন্থী দল গদর পার্টির শক্তপোক্ত সংগঠন গড়ে উঠেছে। এই গদর পার্টিকেই পরে ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে বিভিন্ন বাঁকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখব। আমেরিকায় থাকাকালীন ভূপেন্দ্রনাথ গদর পার্টি এবং সোস্যালিস্ট ক্লাবের সঙ্গেই ছিলেন। সেই সময়েই তিনি কমিউনিস্ট হন। এর পর মহাযুদ্ধ শুরু হলে আরও অনেক প্রবাসী বিপ্লবীর মতোই আমেরিকা ছাড়েন ভূপেন্দ্রনাথ। কিছু দিন গ্রিসে ছিলেন, তার পর জার্মানি চলে যান। সেখানে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে প্রচার শুরু করেন। ঐতিহাসিক বার্লিন কমিটির সচিব ছিলেন দু’বছর। এই সময়েই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় বার্লিন কমিটির কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি পদক্ষেপে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পথহাঁটার সেই ইতিহাস এখন আর খুব বেশি চর্চিত নয়।
১৯২১ সাল। জার্মানি ছেড়ে ভূপেন্দ্রনাথ চলে আসেন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায়। কমিউনিস্টদের আর্ন্তজাতিক সংগঠন কমিন্টার্নের হয়ে কাজ শুরু করেন। সরাসরি যোগাযোগ হয় ভ্লাদিমির লেনিনের সঙ্গে। আর এক বিখ্যাত বাঙালি বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও তখন মস্কো। গোটা দুনিয়া অবশ্য তাঁকে চেনে মানবেন্দ্রনাথ রায় ছদ্মনামেই। এর বছর চারেক আগেই রায় মেক্সিকোয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেনিনের কাছে ভূপেন্দ্রনাথ একটি রিপোর্ট জমা দেন। লেনিন ভূপেন্দ্রনাথকে একাধিক চিঠি লিখেছিলেন।
রাশিয়া থেকে ভূপেন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসেন বিশের দশকের মধ্যভাগ। কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গোটা বাংলা চষতে থাকেন তিনি। কংগ্রেসের মঞ্চে বার বার শ্রমিক, কৃষকের দাবি তুলে ধরেছেন সেই সময়। পরবর্তীকালের অসংখ্য দিকপাল কমিউনিস্ট নেতাকে রাজনীতিতে এনেছেন তিনি। তবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা থাকলেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) বা অন্য কোনও দলের সদস্যপদ নেননি। তাঁদের সিমলেপাড়ার দত্ত বাড়ির একটি ঘর সে সময় বাম-গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সরোজ মুখার্জি, বিনয় চৌধুরির মতো অনেক বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতাই ভূপেন্দ্রনাথের হাতে গড়া। পরবর্তীকালে ভিন্ন রাজনীতির স্রোতে চলে গেলেও অতুল্য ঘোষ সে সময় বহু দিন ভূপেনবাবুর সংস্পর্শে ছিলেন। অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-সহ বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর।
১৯৬০ সালে আশি বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত ভূপেন্দ্রনাথ অসংখ্য শ্রমিক, কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে শেষ দেড় দশক তিনি কিছুটা ঘরবন্দি করে নিয়েছিলেন নিজেকে। সে সময়টা বাম রাজনীতি তথা গোটা দেশেরই বাঁকবদলের মহালগ্নও বটে। তার আগে ভূপেন্দ্রনাথ দু’বার এআইটিইউসি’র সভাপতি হন, কৃষক সভারও শীর্ষ দায়িত্বে ছিলেন।
ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠক ভূপেন্দ্রনাথের আজ ১৩৯ তম জন্মদিবস। প্রসঙ্গত, তাঁর এক দাদার নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। যিনি পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন।
এই নিবন্ধটি পড়ে খুব সমৃদ্ধ হলাম। এর সাথে তথ্যসূত্র দিয়ে দিলে আরো ভালো হতো