আমার পরিচিত এক সত্তরোর্ধ্ব অধ্যাপক দিনকয়েক আগে বলেছিলেন, চিতাকাঠের আহ্বান শোনার জন্য আমার গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়ানোর দরকার নেই। ‘আয় আয় আয়’ শোনার জন্য হলুদ হয়ে যাওয়া বইয়ের পাতার মধ্যে যে মন খারাপ করা একটা মাদকতা লুকিয়ে থাকে, তার তুলনা আমি খুঁজি না কখনও। রং বদলানো পাতাগুলো যেন জানান দেয়, সময় ক্রমে কমিয়া আসিতেছে। তৈরি হও এবারে।

সদ্য কেনা যে বইটা বাড়িতে নিয়ে আসার পরে গন্ধ নিয়েছি প্রাণভরে, দুধসাদা পাতার উপরে কালো অক্ষরগুলোতে চুমু খেয়েছি প্রেমিকার ঠোঁটের মতো, কালের নিয়মে তার উপরে দীর্ঘশ্বাসের মরচে পড়ে। সময়ের দীর্ঘশ্বাস। রং বদলে যাওয়া, হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো যেন প্রশ্ন করে, কটা ক্যালেন্ডার ফসিল হল ঘরের দেওয়ালে? ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পাওয়া জন্মদিনের বইগুলো হলদেটে পাতা নিয়ে দুয়ো দিয়ে বলে, আমি তো চললাম, সক্কলে যায়। ফ্যাকাশে হওয়া কাগজের সর্বাঙ্গে যেন বলিরেখা লেপ্টে থাকে। 

বই বুড়ো হয়। ওই বইয়ের সঙ্গে আঠার মতো একদিন লেগে ছিল যারা, তাদেরও বয়স থেমে থাকে না। উপহার পাওয়া বইগুলোর মলাট উলটোলেই যাঁদের স্নেহাশীর্বাদ লেখা লাইনগুলো দেখতে পাই, তাঁদের এখন একটিবার দেখার শখ হলে কম্পিউটারের ফোল্ডার খুঁড়তে হয় পাগলের মতো। স্ক্যান করা ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকে সাদা কালো প্রিয়জনের ছবি। ‘কল্যাণ হোক’ লিখে ফেলুদার রবার্টসনের রুবি কিংবা কাকাবাবু সমগ্রের প্রথম খণ্ড উপহার যিনি দিয়েছিলেন আমায়, বইয়ের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোর মতোই তাঁর স্মৃতিও কেমন সেপিয়া মোডের মতো লাগে। 

posters-grunge-pages-from-old-book
বইয়ের পাতাও বুড়ো হয়, গাছের পাতার মতোই

রসায়নবিদ্যার ফর্মুলা আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষজনের কাছে এই পাতা হলুদ যাওয়ার ঘটনাও এক সামান্য বিক্রিয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। কেটে রাখা আপেলের কালো হয়ে যাওয়ার মতো এই পাতা হলুদ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিও তাঁদের কাছে নিছকই এক সমীকরণে বাঁধা। তাঁরা বলেন, কাগজ বানানোর জন্য যে মণ্ড প্রস্তুত করা হয়, তার একটা বড় অংশই কাঠ থেকে আসে। আর কাঠ মানেই সেলুলোজ় ও লিগনিন। সেলুলোজ় হল বর্ণহীন এক যৌগ। কাগজের পাতার রং সাদা রাখার জন্য এই যৌগের ভূমিকা অনেক। যেহেতু সেলুলোজ় বর্ণহীন, ফলে আলো প্রতিফলনের ক্ষেত্রে প্রায় সেরার তকমা পায়। কাগজের রংটিও আমাদের সাদা বলে মনে হতে থাকে। সেলুলোজ় তো আসলে আলোর কোনও রংই শোষণ করে না। পুরোটাই ফিরিয়ে দেয়, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। বিজ্ঞানের নিয়মে তাই তো এর রং সাদা। 

আর সাদা মনে কাদা নেই বলেই সেলুলোজ় কাগজের মূল রং বজায় রাখার চেষ্টায় এক বড় ভূমিকা নেয়। তবে সমস্যা হল, সেলুলোজ়ের সঙ্গে থাকা লিগনিন নিয়ে। সততার প্রতীকের মাঝে এ যেন বেনোজল। আলো এবং অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসার পরে সেলুলোজ়ের মতো নিষ্পৃহ হয়ে থাকার গুণ লিগনিনের নেই। এর মধ্যে রয়েছে পলিমারের যে কঙ্কাল, অক্সিজেন তার উপরে প্রভাব ফেলতে সফল হয় পুরোমাত্রায়। আর অক্সিজেনের এই সাফল্য যে দাগ রেখে যায়, তার ফলেই লিগনিনের বর্ণ পরিবর্তন হতে থাকে ক্রমশ। সাদার উপরে ভর করে হলুদের ছায়া।

সময় যত এগোয়, ছায়া প্রকট হয়। কেমিস্ট্রির পরীক্ষায় এমন উত্তর দিলে পরীক্ষক ঘ্যাঁচ করে কেটে দিয়ে হয়তো পাল্টা লিখে দিতেন, ‘শূন্যের উৎপত্তি কীভাবে হইয়াছিল জানার জন্য তোমার এই উত্তরপত্রটি রেফার করা যাইতে পারে।’ তবে সোজা কথায় বলতে গেলে, পাতা হলুদ হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে যে খলনায়কটি আছে, তা হল এই লিগনিন। বাতাসের অক্সিজেন তার উপরে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ফটো তোলে। 

কর্পোরেট জীবনের বারকোড লাগানো আই কার্ডটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে অতীত হয়ে আসা দিনগুলোর ওম্ মাখার বড় সাধ হয়। ঝুলে ভরে যাওয়া বইয়ের আলমারির দিকে চেয়ে থাকি যখন, ভিতরে সাম্রাজ্য গড়ে নেওয়া মাকড়সাগুলোকে হিংসা করতে কেন ইচ্ছে হয় কে জানে! শখ হলে একটা দুটো বই নামিয়ে হাতের উপরে রাখি। লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোগোর হাতের মতো তাতে আদর মেশাই। দেখি একই বছরের বইমেলা থেকে কেনা কোনও বইয়ের পাতা গাঢ় হরিদ্রাভ, আবার অন্য বইয়ের পাতা তার মৌলিক রং যেন বাঁচিয়ে রাখতে যুদ্ধ করে চলেছে প্রাণপণ। 

Old journal pages
যে কাগজে যত বেশি লিগনিন, তার তত বেশি হলুদ হওয়ার প্রবণতা

উপনয়নের সময় পিতামহ একটা খাতার মধ্যে পরম স্নেহে লিখে দিয়েছিলেন গায়ত্রীমন্ত্র। সেই রুলটানা খাতার ভিতরে থাকা ফুলের পাপড়িগুলো যেমনভাবে প্রাগৈতিহাসিক হয়ে গিয়েছে, একইরকমভাবে যেন ইতিহাস গায়ে মেখেছে আমার পূর্বপুরুষের হাতের লেখা মাখা পাতাও। পাতাগুলো উল্টোতে বড় মায়া হয়। যেন চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়। ওই তো তাকের উপরে, বইয়ের এক কোণায় ভাঁজ করে রাখা আছে সেদিনের খবরের কাগজ। টাইটান কাপ জেতা ভারতের ছবি। খেলছে শচীন খেলছে শচীন মারছে শচীন ছয়। কাগজটা মেলে ধরতেই তার অন্তঃস্থল থেকে হাহাকার ভেসে আসে। সেদিনের ধবধবে খবরের কাগজটা আজ গাঢ় হলুদ। জীবনের পঁচিশটা বছর ধূসর হয়ে যায় মুহূর্তে। তৈরি হও এবারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সবই লিগনিনের খেলা রে ভাই। বইয়ের কাগজে যে পরিমাণ লিগনিন থাকে, খবরের কাগজে থাকা লিগনিনের পরিমাণ তার থেকে অনেকটাই বেশি। আর যে কাগজে যত বেশি লিগনিন, তার তত বেশি হলুদ হওয়ার প্রবণতা। নিউজ়প্রিন্ট, যা দিয়ে খবরের কাগজ তৈরি হয়, তার দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আর কম দাম হওয়ার কারণেই এর মধ্যে লিগনিনের বাড়বাড়ন্ত। বইয়ের পাতার থেকে খবরের কাগজের পাতার হলুদ মাখার আসক্তি বেশি এই কারণেই। সংবাদপত্রের মধ্যে তো আসলে জমা থাকে স্মৃতি। পরম আদরে জমিয়ে রাখা কাগজের পাতাগুলো বহু বছর পরে যখন মেলে ধরি আবার, ফোটোর ক্যাপশনগুলো পাথরের গায়ে খোদাই করা রাখা কোনও লেখার মতো কেন মনে হয় কে জানে!

বাড়ির বিশাল লাইব্রেরিতে প্রায় হাজার তিনেক বই নিয়ে থাকা আমার এক বন্ধু জানিয়েছিল ওর আশ্চর্য পর্যবেক্ষণের কথা। হয়তো ঠিক পর্যবেক্ষণ নয়, উপলব্ধি। বলেছিল, ক্লাসিকস বলে যে বইগুলোকে জেনে এসেছি সেই ছোটবেলা থেকে, সেগুলোর পাতাই যেন হলুদ হয়ে আসে জলদি। বলেছিল, ক্লাসিকস-এর তকমা পাওয়া বইয়ের মধ্যেই কেমন যেন মিশে থাকে হলুদ রং, আরও বেশি করে। ওর এই কথাগুলো ভাবিয়েছে বহুদিন। 

Opened Old Book
ইংরিজি ক্লাসিকসের পাতাগুলোই যেন হলুদ হয়ে আসে জলদি

নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি, ইংরিজি ক্লাসিকস্-এর যে বইগুলো জমা করেছি এত বছর ধরে, তাদের পাতাগুলোই যেন হলুদ হয়ে আসে জলদি। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ কিংবা ‘গ্রেট এক্সপেক্টেশানস্’-এর পাতারা যত তাড়াতাড়ি হলুদ হয়, হ্যারি পটার কিংবা সিডনি শেলডনের এমন হয় না কেন? একই বছরে কিনেছিলাম যে! সবকটাই তো পেপারব্যাক। তাহলে কি ক্লাসিকস্-এর নিজের শরীরে হলুদ মেখে নেওয়ার কোনও আশ্চর্য গুণ আছে? অনেক বছর পর বইগুলোর পুনর্পাঠ করি যখন, হলদেটে পাতাগুলোর অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা বাণী কেন নাড়া দিয়ে যায় আরও? ধবধবে সাদা অবস্থায় যখন পড়েছিলাম প্রথমবার, এমন উপলব্ধি হয়নি তো! কালজয়ী বইয়ের ওজন বাড়ার সঙ্গে কি পাতার রংয়ের কি কোনও অলিখিত সম্পর্ক আছে? প্রশ্নগুলো কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

টেকনোলজির অলিগলিতে টহল দেওয়া মানুষরা বলেন, সম্পর্ক আছে তো! হলুদ রং হলে যে পড়ার আনন্দ বেড়ে যায় অনেক। হাল আমলের মোবাইল ফোনগুলোতে রিডিং মোড বলে যে অপশনটি রয়েছে সেটিকে আরও একটু ‘কালচার’ করার কথা বলেন তাঁরা। রিডিং মোড আইকনে ক্লিক করা মাত্রই পুরো স্ক্রিনে কেউ যেন বিছিয়ে হলুদরঙা এক স্বচ্ছ চাদর। স্ক্রিন হলুদ বর্ণ নিলে আর ব্রাইটনেসটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে গেলে চোখের উপরে নাকি চাপ কম পড়ে। পাতার পর পাতা বাইনারি উপায়ে উল্টে গেলেও চোখে ক্লান্তি আসে না। তাই তো অনেক গবেষণা করে ফোনের রিডিং মোডকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন হলুদ অলংকার।

রং-সম্রাটরা বলেন, হলুদ মানেই তো আনন্দ। হলুদ মানে সাহস। উষ্ণতাও। স্ক্রিনের পর্দা হলুদ হয়ে গেলে পড়ার সময় শরীরের অন্দরমহল থেকে যে আনন্দ উথলে পড়ে, তা আমাদের পাতার পর পাতা এগিয়ে নিয়ে যায়। ক্লান্তি আসে না। এর অবশ্য পাল্টা মত আছে। বিশেষজ্ঞদের অন্য একটা শিবিরের মতে, হলুদ হয়ে যাওয়া পর্দায় সাময়িক আনন্দ হতে পারে বটে, কিন্তু চোখের আখেরে কিছু লাভ হয় না। 

বই নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে যাঁরা, তাঁরা অবশ্য পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া আটকানোর জন্য নানা উপায় বাতলেছেন। টোটকা দিয়েছেন, প্রাণাধিক বইগুলো ছোট ছোট বাক্সে ভরে ফেলুন। তার পরে ওই বাক্সের থেকে অক্সিজেন বের করে নিয়ে ভরে দিন নাইট্রোজেন। এই গ্যাস বইয়ের পাতার বন্ধু। হলুদ হবে না কোনওদিন। এসব করার জন্য যন্ত্রের অভাব নেই বাজারে। তবে অন্য প্রেমের মতো বইয়ের প্রতি ভালোবাসারও তো বিভিন্ন স্তর রয়েছে। অনেক বইপাগল পরম স্নেহে, আদর করে বলেন, আমি বুড়ো হতে পারি যদি, আমার চিরসঙ্গীরও বয়স থেমে থাকবে কেন। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে দুজনেই প্রাজ্ঞ হব আরও। 

আমার বার্ধক্যের রং সাদা। আমার মননসঙ্গীর, আমার চিরসখার তা হলুদই হোক। এই বার্ধক্য শুধু মন খারাপের নয়, উদযাপনেরও। 

 

*ছবি সৌজন্য: Pexels, atlasobscura, yingmart

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *