“….তখন অর্জুন প্রশ্ন করিলেন, “হে কেশব! প্রকৃত সার্ব্বজনীন দুর্গাপূজা তবে কখন সম্পূর্ণতা লাভ করবে?” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হাসিয়া বলিলেন, “পার্থ, প্রত্যেকের সক্রিয় যোগদানেই পূজার সম্পূর্ণতা। কলিকালে মানুষের কাছে সময় বড়ই দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিবে, যার প্রধান কারণ ইম্প্লিমেন্টেশন ও ডেডলাইন নামক দুই মায়া। কিছু সময়ের জন্য হলেও, যখন সমগ্র মানবজাতি সেই মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হইয়া পরমানন্দের সন্ধানে যাত্রা আরম্ভ করিবে, তখন সার্ব্বজনীন পূজা সম্পূর্ণ হইবে।”

আতঙ্ক, দুঃখ ও হতাশার বছর ২০২০। কিন্তু সময় ও প্রকৃতি তো চলছে নিজের খেয়ালেই। তাই, এই বছরেও শরৎকাল এসেছে। এই বছরেও নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ চড়ে বেড়াচ্ছে। আপনিও হয়তো সময় বিশেষে ইউটিউবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে খুঁজেছেন। প্রতি বছরের মতো এই বছরেও প্রকৃতি প্রস্তুত হয়েছে মা-কে আবাহন জানানোর জন্যে। আর, আমরা?

লজিকাল ডিডাকশন এবং ডারউইনের থিয়োরি মেনে, আর তার সঙ্গে অল্প হাইজেনবার্গের আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপল মেশালে করোনার প্রকোপের মাঝে এই প্রতিবেদনের একটা বিষ​য়ই বারবার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে – হল্যান্ডে দুর্গাপুজো! আমার হল্যান্ডে পুজো-প্রস্তুতির অভিজ্ঞতা হৈচৈ-এর পুজোতেই সীমিত​। তাই সব পুজোর প্রস্তুতিপর্ব নিয়ে বিশদে লেখার সামর্থ্য বা জ্ঞান​, কোনওটাই নেই। তাই, বিধিসম্মত সতর্কীকরণ​, পাঠক এই লেখাকে হল্যান্ডে পুজো-প্রস্তুতির একটা স্যাম্পল চেক হিসাবে নিলেই ভালো। তুল্যমূল্য বিচারে যাওয়াটা আইনত দণ্ডণীয় হলেও হ​য়ে যেতে পারে। ওই, একটা চাল টিপে দেখলেই তো বোঝা যায় ভাত সিদ্ধ হ​য়েছে কিনা, তাই না?

***

পুজোর প্রস্তুতিতে যাওয়ার আগে একটু ইতিহাস​-চর্চা করে নেওয়া যাক​।

সাল ২০১৪; সবে পুজো শেষ হ​য়েছে। আমরা ক​য়েকজন দুর্ভাগা, যারা শর​ৎকালে নেদারল্যান্ডসের বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম​, ঠিক করলাম যে একটা ঘরোয়া বিজ​য়া সম্মিলনী করা যাক​। হোয়াট্স​অ্যাপের আলোচনা-মতো মেনু নিয়ে ভেন্যুতে পৌঁছে বেশ আনন্দ হচ্ছে, এমন সময় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল। কে বেশ বলল, এই আনন্দের পরিবেশটা আর​-একটু প্রসারিত করলে কেমন হ​য়​? বেশ​, ভালো কথা।

কিন্তু, সেই যে হীরক রাজা বলে গিয়েছেন​, “যার নাম নাই, তার কথার দাম নাই!” তাই সবার আগে দরকার এই  প্র​য়াসের একটা নামকরণ করা। চা আর ডাচ ফ্রাইজ় সহযোগে নামকরণ-প্রক্রিয়া শুরু হল। অনেক মাথা চুলকানোর পরে সেই বাবা মানিকনাথকে স্মরণ করে আলো জ্বলল – “হল্যান্ডে হৈচৈ”। অর্গানাইজ়েশন তৈরি হল, ফেসবুকে পেজ তৈরি করা হল – এবার দরকার ডাচ চেম্বার অফ কমার্সে রেজিস্ট্রেশন – নাহলে নাকি অর্গানাইজ়েশন বেআইনি। আবার চা, আবার ফ্রাইজ় – কোথায় করতে হবে, কী ভাবে করতে হবে, তাই নিয়ে আলোচনা। হুঁ হুঁ বাওয়া, আমরা নলেজ মাইগ্রেন্ট, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। ওই রেজিস্ট্রেশনের বৈতরণীও পার হল, আমরা এখন লিগাল​! এই কাগুজে প্রক্রিয়া চলাকালীন আমরা অবশ্য আমাদের প্রথম অনুষ্ঠান করে ফেলেছি – বিজ​য়া সম্মিলনী ২০১৫!

আমাদের ধারণা ছিল ছোট ঘরোয়া প্রোগ্রাম করব। সেই অনুযায়ী একটা ছোট কনফারেন্স রুম ভাড়া করেছিলাম​, যেখানে চেয়ার​-টেবিল সরিয়ে জায়গা করে একটু গানবাজনা, আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া হবে – এমনটাই প্ল্যান ছিল​। কিন্তু আমাদের সব পরিকল্পনাকে বানচাল করতে এগিয়ে এলেন বন্ধুরা, বন্ধুদের বন্ধুরা, বন্ধুদের বন্ধুদের বন্ধুরা… এবং তাঁদের পরিবারবর্গ​। সব মিলিয়ে দেড়শো রেজিস্ট্রেশন আসার পরেও যখন অনুরোধ আসতে থাকল, আমরা বুঝলাম যে ওই তিরিশ​-চল্লিশজনের কনফারেন্স রুমের মায়া ছাড়তে হবে। ব​ড় হল বুকিং করা হল – প্রায় দুশো মানুষ এলেন​, খেলেন​, প্রোগ্রাম দেখলেন​, ভালোবাসলেন​। এক কথায়​, সুপারহিট​!

Netherlands
হইচই-এর বিজয়া সম্মিলনী। সালটা ২০১৫। ছবি – লেখকের সৌজন্যে।

মাক​ড়সা-মানবের কাকা বলেছিলেন​, বিশেষ ক্ষমতার সঙ্গে আসে বিশেষ দায়িত্ব। তাই, প্রথম অনুষ্ঠানের সাফল্য আমাদের চিন্তা বাড়িয়েও দিল​। পরের অনুষ্ঠানে এই মান ধরে রাখতে হবে যে! ২০১৬ সালের শুরুতেই আমরা ঠিক করে নিলাম​, প​য়লা বৈশাখে অনুষ্ঠান করব। তার আয়োজন শুরু হ​য়ে গেল। সেই নিয়ে বেশ একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, যেটা বিশেষ কারণবশতঃ এখানে লিখতে পারব না। পাঠকদের মধ্যে কেউ আগ্রহী থাকলে আমাকে লাঞ্চে নেমন্তন্ন করুন​, নিশ্চ​য়ই শোনাব।

***

যাক সে কথা, ২০১৬-তে প​য়লা বৈশাখ হল, বিজ​য়া সম্মিলনী হল, বেশ হৈচৈ করেই হল আর কি! বন্ধুদের সংখ্যা বাড়তে থাকল, আর আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের মধ্যে অমলাশঙ্কর থেকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়​, মার্ক নফলার থেকে মারিয়া ক্যারে এক এক করে আত্মপ্রকাশ করতে থাকল। হৈচৈ আস্তে আস্তে হল্যান্ডে বাংলা সংস্কৃতির এক নির্ভরযোগ্য নাম হ​য়ে উঠল​। আর​, তার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধুদের আবদার​-অনুরোধ বাড়তে থাকল​। বাঙালির আবদার​, আর তাতে দুর্গাপুজোর উল্লেখ থাকবে না, তা কখনও হ​য়​? তাই অবধারিত ভাবেই “হৈচৈ-এর দুর্গাপুজো কবে হচ্ছে?”-জাতীয় প্রশ্নের সামনে কতদিন আর “প্রশ্ন করিয়া লজ্জা দিবেন না” মুখ করে থাকা যায়​?

তাই, ২০১৭ সালে সবাই মিলে ঠিক করলাম, হোক দুর্গাপুজো!

কিন্তু হোক বললেই তো আর হ​য়ে যায় না! একে তো দুর্গাপুজো আয়োজন করা চাট্টিখানি ব্যাপার ন​য়​। তার মধ্যে আমাদের কারওরই দুর্গাপুজো আয়োজন করার কোনও পূর্ব​-অভিজ্ঞতা নেই। তবে, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হ​য়​। শুরু হল প্রস্তুতি।

প্রথম কাজ​, প্রতিমা অর্ডার দেওয়া। কুমারটুলিতে কথা বলা হল। মূর্তি বানাবেন কৌশিক ঘোষ। বিগত ক​য়েক পুরুষ ধরে ওঁদের বানানো প্রতিমা বিদেশে পাঠানো হ​য়​। ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হওয়ার পরের চিন্তা, মূর্তি তো বানানো হল​, আনাব কী ভাবে? বিভিন্ন ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের খুঁটিনাটি ইত্যাদির দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন এক​-একজন সদস্য​। কিন্তু শুধু মূর্তি এলেই তো হবে না, তার সঙ্গে চাই একটা মন্ডপ​। এই দেশে তো আর মাঠে ম্যারাপ বেঁধে পুজো হবে না! তাই একটা কম্যুনিটি হল ভাড়া নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ​।

কিন্তু তার আগে একটা আলোচনা উঠে এল। পুজো কি তিথি মেনে চারদিন ধরে হবে, নাকি এন​-আর​-আই মেনে শুধু উইক​এন্ড (সেই অনুযায়ী হল বুক করা হবে তো)! আমার ব্যক্তিগত মত ছিল​, পুজো যখন করছি, নিয়ম মেনে তিথি অনুযায়ী করবো। দেখলাম​, মোটামুটি সবাই এই মতেই বিশ্বাসী। সেই মতো চারদিনের জন্যে হল খোঁজা শুরু হল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে মনমতো একটা জায়গা পাওয়া গেল, ওয়ান প​য়েন্ট ডাউন​।

কিন্তু, এ তো গেল বেসিক নেসেসিটি। পুজোর আনন্দ তো শুধু রোটি-কাপ​ড়া-মকানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ন​য়​! ঢাকের আওয়াজ চাই, ধুনোর গন্ধ চাই, অষ্টমীর সকালে পুষ্পাঞ্জলি চাই, সন্ধ্যায় নাটক চাই, মাইকে কুমার শানু চাই – না হলে আবার কিসের পুজো? তাই, প্রতিমা-হল​-পুজোর নৈবেদ্যর আলোচনার পাশাপাশি চলতে থাকল সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার প্রিপারেশন​। যাঁরা পাড়ার পুজোর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা রিলেট করতে পারবেন​, আসলের থেকেও বেশি আনন্দ হচ্ছে রিহার্সালে। ওই রিহার্সাল চলাকালীন এক​-একটা ছোট​-ছোট পরিবার তৈরি হ​য় যেন​। মহ​ড়ার পাশাপাশি আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, খুনসুটি মিলিয়ে-মিশিয়ে এক-একটা জমজমাট সন্ধ্যা। তারপর​, অনুষ্ঠান হ​য়ে যাওয়ার পরে খুব মনখারাপ হ​য়​, ইশ​, আর রিহার্সাল নেই! আমরা ক​য়েকজন মিলে যেমন ঠিক করলাম​, পুজোয় একটা নাটক করব​। প্রতি রবিবার রিহার্সাল​, এক​-একদিন এক​-একজনের বাড়িতে। আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম ওই দিনটার জন্যে।

Netherlands
নাটকের মহড়া চলছে। ছবি – লেখকের সৌজন্যে

এই আনন্দ​-মজা-টেনশন​-ঝগ​ড়ার মধ্যেই পুজোর দিন এগিয়ে আসতে থাকল​। প্রথম থেকেই হৈচৈ-এর পুজোর মূলমন্ত্র ছিল​, শুদ্ধ শুচি থেকে ফুলকো লুচি, মিষ্টি পান থেকে পুরোন গান – সবার জন্যে এক ছাদের তলায়​, এই বিদেশের মাটিতেও। সেই ধারা মেনে পুজোর সম​য়ে যখন বাড়ির মেয়েরা আনন্দনাড়ু গ​ড়ছে, কিংবা মায়ের ভোগ​-নৈবেদ্য সাজাচ্ছে, তখন সত্যি মনে হচ্ছিল – এ যেন নেদারল্যান্ডসের আমস্টেলভিন ন​য়​, কলকাতার কোনও পাড়ার পুজো।

Netherlands
মেয়েরা আনন্দনাড়ু গড়ার কাজে। ছবি সৌজন্য – লেখক

হৈচৈ আয়োজিত প্রথম দুর্গাপুজোয় তো সবাই খুব হৈচৈ করল। আমাদেরই এক বন্ধুর বাবা ছিলেন সেই পুজোর প্রধান পুরোহিত​ এবং ওঁর অভিজ্ঞ পৌরোহিত্যে বিদেশের মাটিতে কিছু অনভিজ্ঞ চাকুরিজীবির প্রথম পুজোর আয়োজন সাফল্যমন্ডিত হলো। এমনকি কলকাতার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত এবং প্রশংসিত হলো হল্যান্ডে হৈচৈ-এর প্রথম পুজোর প্র​য়াস​।

Netherlands
মায়ের আবাহন ঘিরেই যত হইচই। ছবি – লেখকের সৌজন্যে

দ্বিতীয় বছরের পুজোতেও, অর্থাৎ ২০১৮ সালেও অনেক আনন্দ আর সুখস্মৃতির সাক্ষর রেখেছে হৈচৈ। সেই বছর নাটক​, নাচ​, গান ইত্যাদির সঙ্গে হৈচৈ-এর মঞ্চ মাতিয়ে গেলেন ইন্ডিয়ান আইডল​-খ্যাত অমিত সানা। আর​, সেই বছরেই হৈচৈ-এর জন্যে থিম সং রচনা করলেন কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড – কায়া। আপনারা হৈচৈ-এর ফেসবুক পেজে বা ইউটিউব চ্যানেলে গেলেই সেই গান শুনতে পাবেন​। তার সঙ্গে যথারীতি শুদ্ধ শুচি থেকে ফুলকো লুচি ইত্যাদি তো থাকলই!

Netherlands
হৈচৈ-এর মঞ্চে অমিত সানা। ছবি – লেখকের সৌজন্যে

২০১৯-এর পুজোতেও আনন্দ-উৎসবের বিরাম ছিল না। ২০২০-তেও সমস্ত সরকারি নিয়ম মেনে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই চেষ্টা করেছিলাম যথাসম্ভব সুষ্ঠভাবে আমরা যেন সবাই মিলে মা-কে বরণ করতে পারি নেদারল্যান্ডসের বুকে। কিন্তু বিধি বাম। বাধ সাধল হল্যান্ডে করোনার থাবা। আশা রাখি, খুব শিগগিরই মায়ের আশীর্বাদে পৃথিবী আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। ২০২১-এর পুজোয় হল্যান্ডের বুকে আমরা আবার খুব হৈচৈ করতে পারব​।

পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলেও নেশায় সৃজন। অগ্নিভ লেখালিখি, শর্ট ফিল্মের গল্প থেকে শুরু করে অভিনয় ও নির্দেশনা সবেতেই রেখেছেন তাঁর নিজের সৃষ্টির ছোঁয়া। মূলত প্রবন্ধ লেখেন হল্যান্ডের জীবনযাপন ও অন্যান্য সমকালীন বিষয়ে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *