স্ট্রায়ান ইংরিজির অনেককিছুই এতদিনে দিব্যি শিখে নিয়েছি আমি। ভাষাশিক্ষার এই এক মজা, মূল চলনটুকু বুঝে গেলেই হল। তারপরের ব্যাপারটা দেখেছি বেশ সহজই মনে হয়। এরই মধ্যে একদিন রায়ানের কফিশপে যেতে সে বলল,“সিস্টাহ্, আর্বান স্ট্রায়ান ইংরিজি নিয়ে তোমার আর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আঁটঘাটগুলো এতদিনে বেশ বুঝে গিয়েছ তুমি। এবার একটা নতুন জিনিস শেখাব তোমায়।” আমি তাকালাম ওর দিকে। এখনও শেষ হয়নি! আবার কিসের নতুন জিনিস?
“মনে কর শর্ট ফর্মে কথা বলা বা অ্যাকসেন্টের অদলবদল, সেসব তুমি বেশ ভালই শিখেছ। এবার শুধু নতুন ওয়র্ডজ় শিখে নিলেই হল। এই যেমন…” ওকে থামালুম।
“নতুন ওয়ার্ডজ় মানে? ইংরিজির ভোক্যাবুলারি বাড়াতে বলছ, তাই তো? ও নিয়ে ভাবতে হবে না।’’ চেয়ারটা টেনে নিয়ে, চেয়ারের পিঠের দিকে মুখ করে বসল রায়ান। মুখে মিচকে হাসি। আমি দেখে বললুম,“হাসলে যে বড়! বিশ্বাস হল না বুঝি। নো প্রবলেম। জিজ্ঞাসা করে দেখ। দেখবে কেমন টপাটপ উত্তর দিই।”
“তাই? বেশ তো। বল দেখি, ডিনকাম (Dinkum) মানে কী?”বুঝলুম প্রথম বলে গোল্লা হাঁকিয়েছি আমি। আমি ভেবেছিলুম বার্বি, লিপি, সিগি ওসবের মানে জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু রায়ান সেসবের ধারেকাছেও গেল না। হাতিমির মতো মুখ করে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। ভাবখানা এমন যে শব্দটার অর্থ মনে আছে, কিন্তু মুখে আসছে না। কিছুক্ষণ ভেবে ভেবে কূলকিনারা না পেয়ে গুটি গুটি হাত বাড়ালুম টেবিলে রাখা মোবাইলটার দিকে। রায়ান খপ করে আমার মোবাইলটা সরিয়ে বলল,“নো, নো, নো চিটিং! গুগল্ করা নট অ্যালাউড!” তখন ব্যাজার মুখে বললুম, “ঠিক আছে, ওটার মানে আমি জানি না।” গুরুমশাই খিক্ করে হাসলেন। “তবে যে বললে ইংরিজির সব ওয়র্ড তুমি জানো?”রেস্তোরাঁর জমায়েতে গড়গড় করে বলে যাওয়া অজ়ি ইংরিজি বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। ছবি – লেখকের সংগ্রহ থেকে।আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলুম, বা রে, অমন কথা আমি কখন বললুম! একটা ভাষার সব শব্দ কি কখনও জানা সম্ভব? তার ওপরে ইংরিজি তো আমার মাতৃভাষাও নয়, থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ! কিন্তু কিছু বলার আগেই ও বলল,“আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে আর কাঁদুনি গাইতে হবে না। এমনিতেও ঠেঁট অজ়ি না হলে এমন শব্দগুলো না জানারই কথা।” আমি বড় বড় চোখে তাকালাম, “আর দিজ় ইভেন রিয়্যাল ইংলিশ ওয়র্ডজ়? নাকি আমাকে সাদাসিধে ভালমানুষ পেয়ে টুপি পরাচ্ছ?” ওপক্ষ থেকে তৎক্ষণাৎ স্মার্ট উত্তর এল,“গুগল্ তো রইলই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে মোবাইলে দেখে নিও।” এরপরে আর কিছুই বলা চলে না। অতএব বললুম, “অলরাইট! টেল মি দেন। ডিনকাম মানে কী?”“জেনুইন বা অনেস্ট, অথবা এক্সেলেন্ট। আমরা বলি ‘ফেয়ার ডিনকাম্’, অর্থাৎ খুব ভাল। যেমন মনে কর, ‘উনি এত বয়সেও ফেয়ার ডিনকাম্! অর্থাৎ বেশি বয়সেও উনি জেনুইনলি নিজেকে মেইনটেন করে রেখেছেন। আবার ফেয়ার ডিনকাম ক্রোক হান্টার বললে বুঝবে সত্যিকারের (প্রফেশনাল) কুমির শিকারি। এই রকম বুঝলে?” আমি ওপর নীচে মাথা নাড়িয়ে বলি, “বুঝলুম, এগুলো তাহলে অজ়ি স্ল্যাং?”
“হ্যাঁ, তা বলতে পার। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া এসব শব্দের ব্যবহার অন্য কোনও দেশ করে বলে জানা নেই।”এখানে বলে রাখি, যে যে কোনও ভূখণ্ডের জনজাতির সঙ্গে একাত্ম হতে গেলে সে দেশীয় স্ল্যাং শব্দগুলি অতি অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন। স্ল্যাং মানে কিন্তু গালিগালাজ নয়। বাংলায় স্ল্যাং-এর অর্থ ‘অপশব্দ‘ হলেও এহেন লিটারেল অর্থে আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি আছে। স্ল্যাং-কে স্ল্যাং বলাই ভাল, সোজা ইংরিজিতে ইনফর্ম্যাল ওয়র্ডজ় বলা যেতে পারে। এই ধরনের শব্দসমূহ শুধুমাত্র কথ্য ভাষায় প্রচলিত, এবং এদের ব্যবহার শুধুমাত্র ব্যবহারকারীর পরিচিত বৃত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণত লেখার সময় স্ল্যাং শব্দের ব্যবহার হয় না, তবে আজকাল হোয়াটস্অ্যাপ বা মেসেঞ্জারের ক্ষেত্রে আবার সেই নিয়ম খাটে না।প্রত্যেকটি দেশেরই এমনি নিজস্ব কিছু স্ল্যাং রয়েছে, যা বাইরে থেকে শেখা অসম্ভব। বিশেষত অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ, যেখানে প্রচলিত ইংরিজি ভাষার অর্ধেকটাই এমন শব্দ দিয়ে তৈরি, সেখানে প্রাদেশিক স্ল্যাংগুলির হাল হকিকত সম্পর্কে না জানা থাকলে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশতে রীতিমতো অসুবিধে হবে। তা ছাড়া সবসময় বিশুদ্ধ, নির্ভুল ইংরিজিতে কথা বললে এদেশীয় লোকজন আপনাকে নাকউঁচু ভাববে। রায়ানকে বললুম,“হোয়াট এলস্? এমন শব্দ বা শব্দ বন্ধ আরও আছে নিশ্চয়?”ঘরোয়া আড্ডার ভাষায় মিশে থাকে একাধিক স্ল্যাং। ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে।রায়ান বলল,“হ্যাঁ, অবভিয়াসলি! যেমন মনে কর ‘ড্রঙ্গো’ (Drongo)। এ দেশে ইডিয়ট বা স্টুপিড বোঝাতে ড্রঙ্গো বলা হয়। তবে এটা কোনো সিরিয়াস গালিগালাজ নয়। বন্ধুরা একে অপরকে প্রায়ই ড্রঙ্গো বলে।” অর্থাৎ ড্রঙ্গো হল আমাদের নিরীহ “বোকা” অথবা ‘হাঁদারাম।’ আরও বেশ কতকগুলো আজব শব্দের অর্থ শিখলুম, যেগুলো ইংরিজি হলেও কখনও শুনেছি বলে মনে হয় না। যেমন ধরুন,ব্লটো (Blotto) –– মাতাল বা মদখোর, এদেশে ড্রাঙ্ক বা ড্রাঙ্কার্ডের পরিবর্তে বলা হয় ব্লোটো। “We got blotto”, অর্থাৎ আমরা মাতাল হয়ে গিয়েছিলুম। অথবা ব্লোটোর মতো বিহেভ করছ কেন, অর্থাৎ মাতলামো করছ কেন?বোগান (Bogan) – গাঁইয়া বা গেঁয়ো স্বভাবের মানুষ। বস্তুত, এর সঙ্গে গ্রামে থাকার সম্পর্ক তেমন নেই। আনকালচার্ড, অপরিষ্কার পোশাক পরে, চেঁচিয়ে বা গালিগালাজ ছাড়া কথা বলে না, লোকজনের সঙ্গে মিশতে জানে না এমন লোকজনকে এদেশে বোগান বলা হয়। শীলা (Sheila) – নারী বা মেয়ে। আরও নিখুঁতভাবে বললে, ‘দজ্জাল মহিলা!’ যে নিজের মতে চলে, স্বেচ্ছাচারী, যাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, যাকে অন্য দশজন লোক রীতিমতো ভয়ভক্তি করে, যার সঙ্গে ঝামেলা করলে বিপদের সম্ভবনা ষোলো আনা, তিনিই হলেন শীলা। পং (Pong)– খুব বাজে গন্ধ। বাক্যে ব্যবহার করার সময় বলব, “ইউ পং”, অর্থাৎ “আপনার গায়ে বড় দুর্গন্ধ!”সিক্ (Sick)– শব্দখানা নতুন না হলেও এদেশে এর ব্যবহার একদম আনকোরা। নর্ম্যালি ইংরিজি ‘সিক্’ শব্দটির অর্থ হল অসুস্থ বা অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু এদেশে সিক্ বলতে বোঝায় দারুণ মজাদার বা অত্যন্ত গুণী কোনও ব্যক্তি। মনে করুন আপনি দশ ফুট উঁচু ঢেউয়ের মাথায় রকমারি কায়দা দেখিয়ে সার্ফ করছেন। আপনার বন্ধুবান্ধব চোখ ছানাবড়া করে আপনাকে দেখছে। আপনি সার্ফিং-এর শেষে জল থেকে উঠে এলে তারা দৌড়ে গিয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরে বলবে,“সিস্টাহ্, ইউ ওয়ার সিক্!” অর্থাৎ বাবাহ্, কী দিলে গুরু! দারুণ!রিপার (Ripper) – স্ট্রায়ান সিক্-এর সমার্থক। অসাধারণ, অ্যামেজিং বোঝাতে ‘লিটল রিপার’ বা ‘ব্লাডি রিপার’ বলা হয়।ডানি (Dunny) – অর্থ শৌচাগার বা টয়লেট। যদিও শহরের দিকে এই শব্দটি তেমন কেউ ব্যবহার করে না।অস্ট্রেলীয় স্ল্যাংয়ের নমুনা। ছবি – লেখকের সংগ্রহউপ্ উপ্ (Woop woop) – অজ গাঁ অথবা ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর! যেখানে কেউ যেতে চায় না। বাক্যে ব্যবহার করলে বলব, ‘হি লিভস্ ইন উপ্ উপ্’ অর্থাৎ লোকটার বাড়ি গ্রামে।আউটব্যাক (Outback) – উপ্ উপ্-এর সমার্থক। সেন্ট্রাল অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি এবং তার কাছাকাছি গ্রামগুলি বোঝাতে আউটব্যাক বলা হয়।টাকার(Tucker) – অর্থ খাদ্য। যা কিছু পেটের ভেতর গুঁজে ফেলা অর্থাৎ টাক করে রাখা যায়, তাই হল টাকার। “দ্যাট ওয়াজ আ গুড টাকার” বললে বোঝানো হয় যে আহা, কী ভাল খেয়েছিলুম!ডেডসেট্ (Deadset) – অতি অবশ্যই বা ডেফিনিটলি বোঝাতে এদেশে ডেডসেট শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন ধরুন, “আই উইল ডেডসেট পে ইউ ব্যাক্।“ অর্থাৎ আমি তোমাকে অতি অবশ্যই টাকাটা ফিরিয়ে দেব। ব্রলি (Brolly)– অর্থ ছাতা। আমব্রেলার শর্ট ফর্ম।চুক (Chook) – অর্থাৎ চিকেন।স্যাঞ্জার (Sanger) – স্যান্ডউইচ শব্দটি বলতে আমাদের ভারী কষ্ট হয়। তাই এদেশে আমরা ছোট করে স্যাঞ্জার বলি।এমন আরও অনেক শব্দ রয়েছে, সব নিয়ে আলোচনা করতে বসলে অনায়াসে আর একখানা মহাভারত লেখা যাবে। ইনফ্যাক্ট স্ল্যাং বিষয়টাও ভীষণ ইন্টারেস্টিং। আপাতভাবে দেখলে মনে হয় স্ল্যাং শব্দগুলির প্রয়োজন আদৌ নেই। বিশেষত ভাষা-বিশুদ্ধতাবাদী অনেকেই প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু যে কোনও ভাষার বিবর্তনে এই সমস্ত ক্যাজুয়াল সাধারণ শব্দগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত ভাষাকে যদি নদী হিসেবে দেখেন, তবে বহতা সেই নদীর বুকে ছোট ছোট তরঙ্গ হল এই অদ্ভুত, স্ল্যাং শব্দগুচ্ছ। যতদিন তরঙ্গ রয়েছে ততদিনই নদী স্বতঃসলিলা। নইলে স্রোত হারানো নদীর বুকে শ্যাওলা জমতে বেশি সময় লাগবে না। স্ল্যাং শব্দগুলি মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতির ফল। ভাষাগত লেনদেন বা আদানপ্রদান যত হবে, তত সেই ভাষার উপযোগিতা এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। কাজেই স্ল্যাং শব্দের যথাযথ ব্যবহারে লজ্জার কিছু নেই। অস্ট্রেলিয়ানরা এই সত্যটি বেশ ভালভাবে বোঝেন এবং এটিকে মানসিকভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা ও অভিযোজনযোগ্যতার ছাপ এই দেশ এবং এখানকার সমাজের সর্বস্তরে দেখতে পাওয়া যায়। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নিতে জানাটাই ট্রু ব্লু অজ়িদের সবচাইতে বড় গুণ।পিকোলো ইংরিজি পর্ব ২পিকোলো ইংরিজি পর্ব ১
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।
বাহ চমৎকার লাগলো