সত্যজিৎ রায়। বাঙালির চিরকেলে আইকন। ঘরের লোক। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। শতবর্ষে সত্যজিতের অজস্র মণিমানিক্য থেকে গুটিকয়েক তুলে নিয়ে বাংলালাইভ সাজিয়েছে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্যের ছোট্ট নিবেদন। এক পক্ষকাল ধরে বাংলালাইভে চলছে সত্যজিত উদযাপন। কখনও তাঁর সুরের মায়া, কখনও তাঁর ক্যামেরার আঙ্গিক, কখনও তাঁর তুলিকলমের দুনিয়া – আমরা ধরতে চেয়েছি বিভিন্ন বিশিষ্টজনের লেখায়-ছবিতে-চলচ্ছবিতে-সাক্ষাৎকারে। আজ সত্যজিতের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ ‘ ছবিতে ব্য়বহৃত কিছু ভুলে যাওয়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে লিখলেন প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত।
বেনারস মানেই শিল্প, কলা, সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সঙ্গীতের পীঠস্থান। সেখানে অলিতে গলিতে কান পাতলে শোনা যায় টপ্পা, ঠুমরি, দাদরা, কালোয়াতি খেয়াল। বাঙালিরা এমনিতেই সংস্কৃতি-সঙ্গীতমনস্ক। বেনারসের বাঙালি হলে তো কথাই নেই। বেনারসের ঘোষাল বাড়ির পরতে পরতে তাই জড়িয়ে ছিল এই গান। তা যেমন তেমন গান নয়, রীতিমত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। পরিবারের ‘মাথা’ অম্বিকা ঘোষালের বাবা ছিলেন ‘ক্লাসিকালে’র বড় সমঝদার। অন্তত “জয় বাবা ফেলুনাথ” সিনেমায় তেমনটিই দেখিয়ে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ দেখিয়ে ছিলেন বটে, আমরা কিন্তু আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি।
গল্প বলছে, বেনারসের বর্ধিষ্ণু ও বনেদি বাঙালি পরিবারের অন্যতম এই ঘোষালেরা। বহুযুগ ধরে প্রবাসী। বাড়িতে নাটমন্দির আছে, দুর্গাপূজা হয়। বাড়ির বৃদ্ধ কর্তা গোয়েন্দা কাহিনির দাপুটে ভক্ত অম্বিকা ঘোষাল। একমাত্র ছেলে উমানাথ, তাঁর স্ত্রী ও ছোট ছেলে রুকু ওরফে ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’-কে নিয়ে কলকাতায় থাকেন। অবশ্য এই বেনারসেই পড়াশোনা উমানাথের। গল্পের ‘ভিলেন’ মগনলাল মেঘরাজ আবার তাঁরই এক সময়কার সহপাঠী। পুজোর সময়ে সপরিবার তাঁরা বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এই ঘোষাল বাড়িতেই ছিল একটি মহামূল্যবান সম্পদ। বহু প্রাচীন সোনার গণেশ মূর্তি। নেপালের জিনিস। হিরে, চুনি, পান্নাখচিত। এই গণেশ মূর্তির রহস্যময় চুরির ঘটনা নিয়েই গোটা গল্পের জাফরি কাটা, পরে যার উদ্ধারে নামে প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা। এর পরবর্তী ঘটনা অবশ্য সকলেরই জানা।
তবে যে জিনিসটি সত্যজিৎ দেখালেও আমাদের কাছে উহ্য রয়ে গেছে তা হল ঘোষাল পরিবারে শুধু গণেশই ছিলেন না, ছিলেন সরস্বতীও। সারস্বত সাধনার ভিন্ন মার্গের নিদর্শন সেখানে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ। ঘোষাল পরিবারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মার্গসঙ্গীত। ছবির একটি দৃশ্যে ফেলুদা, তোপসে, জটায়ুকে অম্বিকাবাবুর সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে যাচ্ছেন উমানাথ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভেসে আসে ঠুমরি। কেসরবাঈ-এর কণ্ঠে ‘কাহে কো দারি’। উমানাথ জানান, তাঁর ঠাকুরদা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড় ভক্ত। একসময় গানবাজনা নিয়ে প্রচুর মেতে থেকেছেন। এখন একজন চাকর রয়েছে শুধু গ্রামাফোনের রেকর্ড পাল্টাবার জন্য!
কেসরবাঈ। কেসরবাঈ কেরকর (১৮৯২-১৯৭৭)। জয়পুর-আতারৌলি ঘরানার প্রবাদপ্রতিম গায়িকা। গোয়ায় জন্ম হলেও যার সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় মহারাষ্ট্রে, কোলহাপুরে। তালিম নিয়েছেন ভাস্কর বুয়া বাখলে, আল্লাদিয়া খান, আব্দুল করিম এবং রামকৃষ্ণ বুয়া ভাজের মত কিংবদন্তিদের কাছে। কলকাতাতেও গান গেয়েছেন তিনি। এই শহরই তাকে দিয়েছিল ‘সুরশ্রী’ উপাধি। শোনা যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার গুণমুগ্ধ। ভৈরবীতে কেসরবাঈ কেরকরের ওই বিখ্যাত ঠুমরিটি সত্যজিৎ অসামান্য দক্ষতায় এই দৃশ্যে ব্যবহার করেন। ছবির শেষ দৃশ্যেও কেসরবাঈকে দ্বিতীয়বার শোনা যায়।
ঘোষাল বাড়িতে শোনা যায় উনবিংশ শতকের আরও এক অসামান্য কৃতি গায়িকা জোহরাবাঈ আগ্রাওয়ালিকেও। ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায় রাতের ঘোষাল বাড়ি। সেখানে থমথমে এক পরিবেশ। অদ্ভুত শ্বাসরোধী সেই দৃশ্য। দেখা যায় গ্রামাফোনের পাশে ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে আছেন উমানাথের পিতামহ। অশীতিপর, মুণ্ডিতকেশ, ধ্যানমগ্ন এক বৃদ্ধ। টেবিলে পড়ে আছে জোনোফন রেকর্ডস। বাতাসে ভাসছে জোহরাবাঈ-এর বিখ্যাত গজল ‘পি কো হামতুম চলো’।
সেই জোহরাবাঈ (১৮৬৮-১৯১৩) যাঁর অধিকাংশ রেকর্ডে দেখা যায় ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে এক হাতে তানপুরা ছাড়ার সেই বিস্ময়কর ছবি। আগ্রা শহরে জন্ম ও মর্দানা কণ্ঠের জন্য বিখ্যাত জোহরা তালিম নিয়েছিলেন আগ্রা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম কল্লন খাঁ, মেহবুব খানের (দরস পিয়া) কাছে। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফৈয়াজ খান এবং বড়ে গোলামের মত কিংবদন্তিরা। জোহরাবাঈ-এর সেই গজল (পরবর্তীকালে যা গেয়েছেন মেহদি হাসান-ও) ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ওই দৃশ্যটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। আর এখানেই পরিচয় পাওয়া যায় সত্যজিতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অসামান্য মুনশিয়ানার। আজও তা অজর, অক্ষয়, চিরকালীন।
বলে রাখা ভাল, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর সংগীতের বিষয়ে আলোচনায় রেবা মুহুরির নাম না করলে তা অসম্পূর্ণ। ঘোষাল বাড়ির দৃশ্যে যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন কেসরবাঈ, জোহরাবাঈরা, ঠিক তেমনই মছলিবাবার দৃশ্যে ‘মোহে লাগি লগন গুরু’ বা ‘হে গোবিন্দ রাখো শরণ’ ও ‘পগঘুংরু বাধ মীরা নাচিরে’-র মত ভজনগুলিকে বোধকরি বাঙালি দর্শকেরা কোনওদিন ভুলবেন না। রেবা মুহুরি সেখানে ‘অমরত্ব’ পেয়েছেন।
সব মিলিয়ে ফেলুদার রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের এই দ্বিতীয় ভাগটি যতটা না গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে তা সার্থক, ঠিক ততটাই লঘুশাস্ত্রীয়, গজল ও ভজনের উৎকর্ষ নিদর্শনের দিকেও সমতুল্য। রেবা মুহুরি তাও এই ছবিতে তাঁর অসামান্য গায়ন প্রতিভার পরিচয় নতুন করে তুলে ধরতে সক্ষম হলেও উক্ত দুই বিশ্রুত, অসামান্যা গায়িকা কিন্তু শেষমেশ বিস্মৃতির অতলেই তলিয়ে গিয়েছেন। সত্যজিৎ নিজস্ব ভঙ্গিতে তাঁদের তুলে ধরেছিলেন রহস্য কাহিনির আবহসংগীতে নেপথ্য মোড়ক হিসেবে। দুর্ভাগ্য, আমরাই চিনতে পারিনি!
পুনশ্চ: এই অসামান্য কালেকশনটি শেয়ার করার জন্য শ্রী অর্চিস্মান মজুমদারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। প্রায় দু’বছর আগে তিনি লিঙ্কটি আপলোড করেন। আমি তাকে চিনি না। ‘ইউটিউবে’ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য, অগ্রন্থিত মণিমুক্তোর মাঝে এটি খুঁজে পাওয়া গুপ্তধন আবিষ্কারের চেয়ে কম কিছু নয়। ‘খোদার উপর খোদগারি’র মতো এই সামান্য রচনাটুকুর মাধ্যমে তাঁর প্রতি মুক্তকণ্ঠে সাধুবাদ জানাই।
পেশায় সাংবাদিক প্রসেনজিতের জন্ম ১৯৮১-তে। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলো, প্রসেনজিতের গবেষণার বিষয় রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্ব। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। অবসরে ভালোবাসেন সরোদ বাজাতে, পুরনো চিঠি ও বই পড়তে।
thanks for sharing