অনেক কিছুই আগে থেকে ঠিক করা থাকে না। হঠাৎ, আচমকা সব ওলোটপালট করে দিয়ে এক একটা ঘটনা ঘটে যায়। আমার জীবনে তরুণদা, তরুণ মজুমদারের মৃত্যু সেরকমই একটা ঘটনা। পাঠক হয়তো ভাবছেন, মানুষটির বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। শরীরে একাধিক রোগের সংক্রমণ। তিনি যে চলে যাবেনই, এর মধ্যে আবার আকস্মিকতার কী আছে? কিন্তু বিশ্বাস করুন,  এমনটা সত্যিই কথা ছিল না। তরুণদার শরীরের বয়স হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মানসিকভাবে তিনি ছিলেন সার্থকনামা। চিরতরুণ। কথা ছিল, সুস্থ হয়ে আবার নতুন করে কাজ শুরু করবেন। ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ নামে যে বই পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল এবং এখনও বেস্টসেলার তালিকায়, তার তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড লিখবেন, বলেছিলেন। আরও অনেক পরিকল্পনা ছিল। ওঁর সংগ্রহে থাকা বইয়ের সম্ভার থেকে দুটি করে বই আমার হাতে তুলে দিতেন, কারণ আমার অগ্রজপ্রতিম গোপাল বিশ্বাস জীর্ণ বইকে নতুন কলেবরে সাজাতে পারেন। তরুণদা চাইতেন, আমি যেন বইগুলিকে সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করি।

কথার খেলাপ করার মানুষ তো ছিলেন না তরুণদা। যে কথা দিতেন, সেই কথাই রাখতেন। এবার এমন ব্যতিক্রম হল কেন! এখন আর দুঃখ হচ্ছে না। বরং রাগ আর অভিমান হচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যে এও মনে হচ্ছে, আমাদের জীবনপুরের পথিক হয়তো বর্তমানের কোথাও তাঁর মনের খবর না পেয়ে আমাদের প্রজন্মের উপর অভিমান করেই তাঁর দেওয়া সব কথা ফিরিয়ে নিলেন।  আমরা কি তবে তাঁর বাতিল চিত্রনাট্যের দলে পড়ে গেলাম? সংসার সীমান্ত পার করে কার নিমন্ত্রণে আজ তিনি পলাতক? নাঃ, এসব প্রশের কোনও উত্তর আর কোনওদিনই পাওয়া যাবে না। তরুণদার ভীষণ প্রিয় লালমাটির দেশে যখন বিশেষ একটি কাজে আমি ব্যস্ত, তখনই বন্ধু সৌরভ দূরভাষে জানাল, হাসপাতালের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে তরুণদার বন্দিদশা ঘুচে গিয়েছে। তরুণদা আজ পলাতক। 

A program in Gorky Sadan
গোর্কি সদনের এক অনুষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচালক

খবরটা শুনে মনে হল আমার জীবনের ভালোবাসার একটি দরজা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। বিভ্রান্ত  আমি তখন এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি গ্রামান্তরের নীল আকাশের গায়ে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে আসন্ন শরতের আভাস নিয়ে। যে কবির ‘গীতাঞ্জলি’ বুকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন কাচের স্বর্গে, তাঁরই লেখা বলাকার কটি লাইন মনে পড়ে গেল, ‘এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে কোন পার হতে কোন পারে। ‘ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে- “হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।”’ 

স্থবিরতা কাটিয়ে নিয়মরক্ষার্থে দু’মুঠো মুখে পুরে গাড়িতে চেপে বসলাম, গন্তব্য কলকাতা। দায়িত্ব সারতে চললাম কর্মক্ষেত্রে, সংবাদপত্রের দফতরে। তীব্র গতিতে দুপাশে পেরিয়ে যেতে লাগল বীরভূমের রাঙামাটির প্রান্তর। স্বচ্ছ আকাশে তখন মেঘ ও রৌদ্রের খেলা চললেও বিকেলটা বড় বেশি বিষণ্ণ। অজয়ের জল আর যে প্রবাহিত হচ্ছে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থির হয়ে। ডাঙালপাড়া, বাহিরি, কেঁদুলি, পলাশি, অজয়ের বাঁধ, রামপুরহাট আজ তাদের স্বজনকে হারিয়েছে। পথভোলা তরুণদা যে কত যুগ ধরে ক্যামেরা কাঁধে বীরভূম জেলার এইসব বিশেষ জায়গার ওপর দিয়ে তাঁর কলাকুশলী আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবির কাজ করেছেন, তার হিসাব কে রাখে? 

Book Launch Tarun Majumdar
এক ফ্রেমে বন্দি নায়ক-পরিচালক

অনেক কথা এসে মনে ভিড় করে আসছে আজ। সব হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কেন, কবে, কোথায়, কীভাবে যে বাংলা ছবির রূপকথার স্রষ্টা তরুণ মজুমদার আমার তরুণদা হয়ে গেলেন, তা কিছুতেই মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে। কখনও দুপুরে, কখনও বিকেলে আবার কখনও বেশ রাতে টেলিফোন বেজে উঠত। কত বিষয় নিয়ে কত যে কথোপকথন চলত, ঘড়ির কাঁটা হিসেব রাখতে পারত না। আনন্দও হত, অন্যদিকে লজ্জাও পেতাম। মনে হত, অত বড় মাপের মানুষটির কত মূল্যবান সময় অহেতুক নষ্ট করছি। পলকে চেতনা ফিরত, ভাবতাম ফোনটা তো উনিই আমাকে করেছেন। এক্ষেত্রে আমার কীই বা করার আছে। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী, শেষের কবিতা, চিঠিপত্রের সংকলন নিয়ে উনি একনাগাড়ে বলে যেতেন আর ফোনের এপারে আমার সমৃদ্ধ হবার পালা। সমাজসচেতন, সাহিত্যানুরাগী, গণনাট্য সংঘ আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রজন্মের স্বক্রিয় সদস্য তরুণদার কাছে শোনা প্রতিটা গল্পের স্মৃতি আমার কাছে চির-অমলিন। 

গণশক্তির লাইব্রেরির কোণে এক একদিন ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে আমাদের আড্ডা জমে উঠত। একদিন শোনালেন একটা মজার ঘটনা। সেবার পুজোয় প্রকাশিত হয়েছে ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটি। প্রকাশেই তুমুল চাঞ্চল্য। তরুণদা তখন কলকাতাতেই। কোথাও যাবার পথে গাড়ির মধ্যে বসে পুরো গানটাই তাঁর শোনা হয়ে গিয়েছিল, কারণ তখন প্রতিটি পাড়ার পুজো মণ্ডপেই হেমন্তকণ্ঠে লাউডস্পিকারে বেজে চলেছে, ‘জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা, শিশিরভেজা কাহিনি শোনাই শোনো।’ গানের প্রথম অংশ এক পাড়ায়, অন্য একটি অংশ এক রাস্তায় আর শেষ অংশটি শহরের অন্য প্রান্তে বাজায় পুরোটাই শোনা হয়ে গেল। সেই কথা বলতে গিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর শৈশবে। বলছিলেন, অবিভক্ত বাংলার একটা ছোট্ট জেলাশহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা করতোয়া নদীর ধারে দাঁড়িয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেখার স্মৃতি।

পরবর্তীকালে পরিচালক হিসেবে পশ্চিমভারতে কাজ করতে গিয়ে স্বাদ পেয়েছিলেন অন্য ধাঁচের পুজোর। স্থানীয়দের তৈরি মণ্ডপ আর তার ওপর ওড়া রং-বেরঙের নিশান, প্রতিমার মুখে গ্রাম্যবালিকার সারল্য আর সঙ্গে শালপাতায় পুরি-সবজির ভোগ। গীতার পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী বুকে নিয়ে প্রস্থান করা আপাদমস্তক বামপন্থী মানুষটি ধর্মের আনুগত্য স্বীকার না করলেও সমাজের মধ্যে থাকা দরদী মন কখনওই সমাজের উৎসব বা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করেনি। জগতের আনন্দযজ্ঞ থেকে সরে থাকেননি কখনও। কিন্তু হাল আমলের থিমের পুজোর অর্থের ঝনঝনানি থেকে দূরে সরে চারটি দিন কাটিয়েছেন বাড়ি বসে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অপ্রাসঙ্গিক ঘটনা গভীরতর অর্থ বহন করে তাঁর মনে রেখাপাত করেছে বিশ্বচলচ্চিত্রের হাত ধরে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই আমার গাড়ি এসে দাঁড়ায় মাঝপথে। সহযাত্রীদের চা খেতে দেখে আবার ফিরে গেলাম ফ্ল্যাশব্যাকে। 

Closed Discussion with Author
লেখকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপে

মাস কয়েক আগে এক চৈত্রের বিকেলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাড়িতে বসে কড়িকাঠ গুনছি, পাশে রাখা ফোন বেজে ওঠে। ওপারে তরুণদা।  ‘কী করছেন? চলে আসুন আমার বাড়িতে। ডাক্তারের নিষেধে বাড়িতে বন্দি থাকতে হচ্ছে। অল্প কয়েকজনকে বাড়িতে ডেকে কাজের কথা বলি বা আড্ডা দিই। সেই অল্প কয়েকজনের মধ্যে আপনিও আছেন।’ ফোনের এপারে বাকরুদ্ধ এবং ধন্য আমি। কোনও বই উপহার দেওয়ার সময় ‘স্নেহভাজন’ শব্দটি ব্যবহার করলেও কথা বলার সময় আট থেকে আশি, সবাইকে ‘আপনি’ সম্মোধন। এটা বোধহয় আর এক প্রবাদপ্রতিম চিত্রনির্মাতা দেবকীকুমার বসুর কাছ থেকে শিখেছিলেন। হাতে করে নিয়ে গেলাম ‘ছিন্নপত্রাবলী’ আর রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের ১৩ নম্বর খণ্ডটি। একদিন বলেছিলেন ওঁর সংগ্রহে থাকা ছিন্নপত্রাবলীটির দশা জীর্ণ তাই আবার কিনতে চান। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ নাকি অনেকদিন ধরেই এই বইটি নতুন করে ছাপছে না। সেই কারণে আমার সংগ্রহে থাকা বইটির দুটি কপির মধ্যে একটি রেখে অপরটি ওঁর জন্য নিয়ে গেলাম। 

বইদুটি ওঁর হাতে তুলে দেওয়ার পরে বার পাঁচেক জিজ্ঞেসা করলেন যে সত্যিই আমার নিজেরটাই ওঁকে দিচ্ছি কিনা? যখন ওঁকে আশ্বস্ত করলাম, তখন বললেন, বইতে ওঁর নাম লিখে সই করে দিতে। আমার তখন আবারও অবাক এবং অপ্রস্তুত হবার পালা। হাজারো তরুণ মজুমদার অনুরাগীরা যেটা ওঁকে করতে বলেন, সেটা উনি আমাকে করতে বলছেন! স্নেহের নির্দেশ, কী করি। লজ্জায় মাথা নিচু করে নীরবে নির্দেশ পালন করলাম। এরপর মুখোমুখি বসে দু’জনে একান্তে অনেক কথা হয়েছিল। হঠাৎ বললেন, ‘আমার হাতে তৈরি চা খেতে আপত্তি আছে?’ ধরণী দ্বিধা হও! বললাম, ‘তা তো খাবো কিন্তু আমিও আপনাকে সাহায্য করব।’ শুনে সোফা ছেড়ে সটান উঠে বেঠকখানা সংলগ্ন রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই চা বানালেন। চা হয়ে গেলে পাশের ঘর থেকে পরিষ্কার একটা রুমাল এনে দিয়ে বললেন, ‘কাপটা একটু বেশিই গরম হয়ে গেছে, ধরতে অসুবিধে হবে।’ ওঁর চা পরিবেশনের পরিপাট্য দেখে বুঝেছিলাম, সিনেমা তৈরি হোক, কি চা খাওয়া, একইরকম সৌন্দর্যে লালিত করে রাখেন সবটুকু। 

Ganashakti Office Tarun Majumdar
গণশক্তির দফতরে লেখকের সঙ্গে

যতই দেখি, ততই অবাক হই! ওই মাপের একজন মানুষের কী সহজ-সরল জীবনযাত্রা! ‘সেলিব্রেটি’ শব্দটি সচেতনভাবেই বাদ দিলাম কারণ ওই বিশেষ শব্দটি ব্যবহারে তরুণদার আপত্তির কথা জানতাম। আপসহীন, আদর্শবাদী মানুষটি হয়তো কোনও প্রয়োজনে গণশক্তির লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা জেরক্স করাবেন, তার আগেই জানতে চাইতেন, কত দাম দিতে হবে? অনেক অনুরোধও কাজ হত না। গ্রন্থাগারিককে টাকা নিতেই হত। কোথাও যাওয়ার সময় নিজের ব্যাগ নিজেই ধরতেন। শত অনুরোধ করা সত্ত্বেও কারোকে ধরতে দিতেন না। কোনও অবস্থাতেই কারো কাছ থেকে কোনওরকম সুবিধে নেওয়া ছিল ওঁর স্বভাববিরুদ্ধ। 

ইতিমধ্যে বীরভূমের সীমানা পেরিয়ে আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে কলকাতার উদ্দেশে। কিছুটা এগোবার পরেই শুরু হল টাপুরটুপুর। ক্রমে মুষলধার। মন আবার পিছিয়ে যায় অতীতে। গত বছর বর্ষা আর শরতের মাঝামাঝি এক সন্ধায় গণশক্তির অফিসে বসেছি আমরা। কিছুটা সময় পরে যোগ দিলেন সাংবাদিক-লেখক শিলাদিত্য সেন আর তরুণ রাজনীতিবিদ শতরূপ ঘোষ। সেদিনও বাইরে অঝোর বৃষ্টি। থামার কোনও লক্ষণ নেই। বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল আর তিনি শঙ্কিত হচ্ছিলেন। বারে বারে বলছিলেন বাড়ি যেতে পারব তো? সেদিন কথাপ্রসঙ্গে গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কথা, সুভাষচন্দ্র বসুর কথা আলোচিত হচ্ছিল। বললেন, একসময় ঠিক করেছিলেন সুভাষ বসুকে নিয়ে ছবি তৈরি করবেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেই সময় পড়া নেতাজি বিষয়ক বিভিন্ন বই থেকে আশ্চর্য রোমাঞ্চকর সব ঘটনার কথা ভাগ করে নিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। এরপরও বারবার অনেক দেখা, অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু সব কি লেখা যায় না লেখা উচিত? 

Tarun Majumdar Filmmaker
কখনও নিজের জন্য কোনও সুবিধা নিতে চাইতেন না

মাঝেমধ্যে ওঁর এবং আমার মধ্যে ওঁর ছবির বেশ কিছু বুকলেটের আদানপ্রদান হত। যেগুলো আমার কাছে নেই সেগুলো উনি আমায় দিতেন আবার যেগুলো ওঁর কাছে নেই সেগুলো আমি ওঁকে দিতাম। শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিনের কথা আজও কানে বাজে। বলেছিলেন রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পর থেকেই ছবি তৈরির বিষয়ে বিভিন্ন প্রযোজকদের সঙ্গে কথা চূড়ান্ত হওয়ার পরেও শেষ পর্যন্ত সবাই পিছিয়ে যেতেন। বলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একাকিত্ব, অসুস্থতা আর বিশেষ কিছু মনোকষ্টের কথা। তরুণদার ব্যক্তিগত জীবনের কোনও বিষয় সম্পর্কে আমার কোনওদিনই কোনও আগ্রহ ছিল না। আজও নেই। তবু সেদিনের আলোচনায় ‘জীবনকাহিনী’ ছবির প্রসঙ্গ উঠতে আমি সচেতনভাবেই বিকাশ রায় এবং অনুপকুমারের অভিনয়ের কথা বলি। উনি হঠাৎই হাসিমুখে বলে ওঠেন, ‘কেন, সন্ধ্যার কী অসাধারণ অভিনয়’। আজ বলতে বাধা নেই, সেই মুহূর্তে খানিক অপ্রস্তুত বোধ করেছিলাম। কিন্তু ওঁর মুখের দিকে চেয়ে সে ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বুঝেছিলাম, শিল্পীর কদর করতে কোনও বাধা নেই ওঁর মননে, চেতনায়।

আজকের রাজ্য তথা দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা উঠতে বলেছিলেন, ‘ভালগার আর ক্রুকেড’। শুধুমাত্র দুটো শব্দ। আর একটা কথাও বলেননি। পাঠকরা যা বোঝার বুঝে নেবেন। কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন গণশক্তির অফিসে বসেই। অবশ্যই সেই সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এতসব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে কলকাতায় ফিরে অফিসে ঢুকে ওঁর চলে যাওয়ার সংবাদ পরিবেশনের কাজটুকু সেরে বাড়ির পথে পা বাড়িয়ে ভাবছিলাম, সিনেমাপাড়ার মানুষ বইপাড়ায় গিয়েও সাফল্য পেলেন। ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ প্রকাশ হওয়ার বছর খানেকের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্করণ শেষ। প্রকাশকমশাই তরুণদার হাতে তুলে দিয়েছিলেন বেশ মোটা অঙ্কের একটি চেক। অঙ্কটা বলেছিলেন সেই শেষ সাক্ষাতে, কিন্তু প্রকাশ করতে বারণ করেছিলেন। তাই এ বিষয়ে আমি নীরবই রইলাম। 

মাসে একবার কি দুবার শরৎ বোস রোড এবং বেলতলা রোডের সংযোগস্থলের যে কফি শপে আমরা বসতাম, এগিয়ে গেলাম তার দিকে। আমাদের বিশেষ টেবিল-চেয়ার দুটি এক জায়গাতেই আছে। শুধু আজ সেখানে অন্য লোক, অন্য আলোচনা। আসলে আজ তো তরুণদা সব শারীরিক কষ্টের ঊর্দ্ধে উঠে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন এসএসকেএম-এর অ্যানাটমি বিভাগের রেফ্রিজেটারে আর ক্লান্ত বিষণ্ণ আমি চলেছি নিজ নিকেতনে। খেয়াল করিনি কখন চিরকালের কংগ্রেস সমর্থক আমার মুখ দিয়ে আনমনেই বেরিয়ে এসেছিল গুটিকয়েক শব্দ– কমরেড তরুণ মজুমদার, লাল সেলাম।             

 

মতামত লেখকের নিজস্ব
ছবি সৌজন্য: লেখক, The economic Times

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

4 Responses

  1. অরিজিৎ মৈত্রর লেখা প্রয়াত ‌তরুন‌ মজুমদারের স্মৃতি রোমন্থন হৃদয়কে স্পর্শ করে গেল। এ যাবৎ শ্রী মৈত্রর এ ধরনের একাধিক রচনা পড়েছি। কিন্তু তরুন মজুমদারের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসার নিদর্শন যে প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি তুলে ধরেছেন‌ তা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ।‌ কেন যেন মনে হয় এ রচনা লেখককেও যাক্ লাগাবে নিশ্চয়। প্রয়াত তরুন মজুমদারকে নিয়ে এ যাবৎ বিভিন্ন পত্র ত্রিকায় অনেক লেখাই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে যে কটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে তাতে মনে হয়েছে অরিজিৎ মৈত্রর এ রচনা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী।
    লেখাটি পড়ার পর আমরা যারা এক আধটু গল্প চর্চা করি তারা সবাই সহমত করবে যে অরিজিৎ কেবল প্রতিবেদক নন কজন সার্থক কথাশিল্পীও।‌ আমার বোধবুদ্ধি থেকে মনে হয়েছে তাঁর হাতে গল্প আছে। তিনি পাশাপাশি গল্পচর্চা করলে সমান পারদর্শীতা দেখাতে পারবেন। তাই আশা করব অরিজিৎ আগামীতে প্রাঞ্জল প্রতিবেদনের সাথে গল্পলেখাও শুরু করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *