বিশেষ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় যাঁকে সর্বাধিক ব্যবহার করেছেন, তিনি হলেন সন্তোষ দত্ত (আটটি ছবি)! সত্যজিতের ছবিতে সন্তোষ দত্তের প্রথম আত্মপ্রকাশ ‘পরশ পাথর’(১৯৫৮) ছবির মাধ্যমে। সত্যজিৎ তাঁকে প্রথম দেখেন মঞ্চে, ‘রূপকার’-এর ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ নাটকে ভবদুলালের চরিত্রে। তখনই বোধহয় তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে এঁকে, এঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতাকে অনেক ছবিতেই ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির যে কোনও ভূমিকায় সন্তোষ দত্ত অনায়াসেই মানিয়ে যাবেন।

পরীক্ষামূলকভাবে সত্যজিৎ ‘পরশ পাথর’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন সন্তোষবাবুকে। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে ঘোষকের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। অনুষ্ঠানে মাইক বিভ্রাটের ফলে তাঁর বিরক্তিজনিত মুখবিকৃতি দর্শকদের খুব আনন্দ দিয়েছিল। এবং অবশ্যই সত্যজিতের মনে যথেষ্ট ভরসা জুগিয়েছিল। তার পুরস্কারস্বরূপ মিলেছিল সত্যজিতের পরবর্তী ছবিতে আর একটু বড় চরিত্র। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ রায় তিনটি রবীন্দ্রকাহিনি —‘পোস্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’ এবং ‘সমাপ্তি’-র চিত্ররূপ দেন এবং তিনটি ছবি একত্রে ‘তিন কন্যা’ নামে প্রদর্শিত হয়। ‘সমাপ্তি’ ছবিতে পাত্রের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) মেয়ে দেখতে আসার একটি দৃশ্যে পাত্রীর বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। একটি কাঠবিড়ালি হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ায় কনে দেখার বিষয়টি একটি কৌতুকদৃশ্যে পরিণত হয় এবং সেই ছোট্ট পরিসরেও সন্তোষ দত্ত অসামান্য অভিনয় করেছিলেন।

Jatayu
‘সমাপ্তি’ ছবিতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার চরিত্রে তুলনাহীন সন্তোষ দত্ত। ছবি সৌজন্য – iebangla,com

কিন্তু সন্তোষ দত্তের অভিনয় ক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করার মতো বা বলা ভাল তাঁর প্রতিভাকে কাজে লাগানোর মতো উপযুক্ত গল্প তখনও খুঁজে পাচ্ছিলেন না সত্যজিৎ রায়। অথচ সন্তোষ দত্তকে একেবারে বাদ রাখতেও তাঁর মন বোধহয় চাইছিল না। তাই ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবির ‘মহাপুরুষ’ অংশে (পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ ছোটগল্প অবলম্বনে) আর একটি ছোট কৌতুক চরিত্রে সন্তোষ দত্তকে ব্যবহার করলেন সত্যজিৎ। এক তোতলা আপনভোলা বিজ্ঞানের প্রফেসরের চরিত্রে। এই চরিত্রেও দারুণ সফল ছিলেন সন্তোষ দত্ত। এর পরের দুটি ছবি ‘নায়ক’(১৯৬৬) এবং ‘চিড়িয়াখানা’(১৯৬৭) – তে বহু চরিত্রের ভিড় থাকলেও সন্তোষ দত্তকে ব্যবহার করেননি সত্যজিৎ উপযুক্ত মানানসই চরিত্রের অভাবে।

Jatayu
‘মহাপুরুষ’ ছবিতে প্রফেসর ননীর চরিত্রে অনবদ্য সন্তোষ দত্ত। ছবি – facebook.com

জীবনের প্রথম দু’টি ছবি ছাড়া চলচ্চিত্র জীবনের প্রথম সাত-আট বছর ছবির প্রধান চরিত্রাভিনেতাদের প্রয়োজন মেটাতে সত্যজিৎ রায় বারবার দ্বারস্থ হয়েছেন ছবি বিশ্বাসের। একাধিকবার দ্বারস্থ হয়েছেন পাহাড়ি সান্যালেরও। প্রথম দু’টি ছবিতে অবশ্য কানু বন্দ্যোপাধ্যায় চরিত্রাভিনেতার চাইতেও বেশি কিছু ছিলেন। কিন্তু ১৯৬১ সালে তুলসী চক্রবর্তীর মৃত্যু, ১৯৬২ সালে পথদুর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাসের অকালমৃত্যু এবং ১৯৭৪ সালের গোড়াতেই পাহাড়ী সান্যালের মৃত্যু সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যে ডাকসাইটে জবরদস্ত চরিত্র (বনেদি জমিদার বা সাহেবি মেজাজের ধনী কর্তাব্যক্তি বা মধ্যবিত্তের চোখে পড়ার মতো বড়সড় চেহারা) ব্যবহার করার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমশঃ তাঁর ছবিতে চরিত্রাভিনেতার সংজ্ঞাটিই বদলে যেতে থাকে। তার কারণ, সত্যজিৎ তাঁর ছবির বিষয়বস্তু এবং প্রেক্ষাপটও প্রয়োজনের তাগিদে বদলে ফেলতে থাকেন। ক্রমশঃই তাঁর ছবির চরিত্ররা অভিজাত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ থেকে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত চরিত্রে বদলে যেতে থাকে। ‘জলসাঘর’ বা ‘দেবী’-র জমিদার, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র অভিজাত রায়বাহাদুরের মতো চরিত্রেরা তাঁর ছবি থেকে ক্রমশঃই হারিয়ে যায়। তার জায়গা নিতে থাকে ব্যাঙ্ক করণিকের উদ্বাস্তু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বাবা (মহানগর) বা সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া, চাকরির উমেদারিতে ঘোরা তরুণের বয়স্ক অসহায় বাবা (জনঅরণ্য) প্রমুখ। ছবির প্রয়োজনমাফিক সত্যজিৎ পার্শ্বচরিত্রাভিনেতাদের নির্বাচন করলেও তাঁর ছবিগুলি একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিন-চারজনকেই তিনি বারবার ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ, মুখ্য চরিত্রের ক্ষেত্রে তিনি যেমন নতুন মুখের (বরুণ চন্দ, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, জয়শ্রী রায়, কাবেরী বসু, পারমিতা চৌধুরী, অলকানন্দা রায়) সন্ধানে থেকেছেন বা ভরসা করেছেন, বিশেষ ধরণের চরিত্রাভিনেতাদের ক্ষেত্রে তেমনটি করেননি। তাঁর সেই অন্যতম ভরসা তৈরি হয়েছিল সন্তোষ দত্তকে ঘিরে, যাঁর প্রতিভার পূর্ণ ব্যবহার তিনি করতে চাইছিলেন।

Jatayu
হাল্লার রাজার চরিত্রে সন্তোষ দত্ত। ছবি সৌজন্য – iebangla.com

১৯৬৮ সালে এসে সত্যজিৎ সন্তোষবাবুকে অন্যতম মুখ্য চরিত্রে ব্যবহার করার সুযোগ না-পাবার কষ্ট লাঘব করতে পেরেছিলেন। সে বছর পুত্র সন্দীপ রায়ের অনুরোধে প্রথমবার ছোটদের জন্য ছবি বানাতে উদ্যোগী হন সত্যজিৎ। সেই ছবির জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজেরই ঠাকুর্দার লেখা গল্প ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’(মূল নাম ‘গুপী গাইন’)। গীতবহুল সেই ছবিতে ‘শুণ্ডির রাজা’ এবং ‘হাল্লার রাজা’র দ্বৈত-চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় ডেকে নেন সন্তোষ দত্তকে। শুণ্ডির ভাল রাজা এবং মন্ত্রীর চক্রান্তে ওষুধ খাইয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা হাল্লার মন্দ রাজা, যাঁরা আদতে দুই ভাই — এই দুই বিপরীতধর্মী ভূমিকায় ছবির দুই নায়ক তপেন চট্টোপাধ্যায় (গুপী) এবং রবি ঘোষের (বাঘা) সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসাধারণ অভিনয় করেন সন্তোষ দত্ত। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এই প্রথম কোনও অভিনেতা দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করলেন।

ভাল রাজার সহজ সরল অভিব্যক্তি এবং খারাপ রাজার হিংস্র কুটিল অভিব্যক্তি নিখুঁত অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সন্তোষবাবু। সহায়ক বা প্রপ হিসেবে খারাপ রাজার ভূমিকায় তাঁর ভরসা ছিল পোশাকের অঙ্গ হিসেবে স্টাফড-মাথা-সহ একটি চিতাবাঘের ছাল এবং এক প্রমাণ সাইজের তুলোর পুতুল। শুধু কথা বলার ভঙ্গি বদলে এবং চোখের ব্যবহারে হাল্লা রাজার হিংস্র চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সন্তোষ দত্ত।

Jatayu
সোনার কেল্লায় আবির্ভাব জটায়ু নামক আইকনের। ছবি সৌজন্য – facebook.com

এরপরেই সন্তোষ দত্তের টুপিতে যোগ হয়েছিল অবিস্মরণীয় অভিনয়ের দু’টি পালক। ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবি দু’টিতে একই চরিত্র— বাংলাসাহিত্যের অনন্যসাধারণ সৃষ্টি ‘জটায়ু’। বস্তুতঃ ‘জটায়ু’ নিয়ে আলোচনার আগে এর ইতিহাসটা বলে নেওয়া প্রয়োজন। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্দেশ পত্রিকায় ফেলুদা-তোপসের আবির্ভাব ঘটলেও জটায়ু এদের সঙ্গে যোগ দেন ১৯৭১ সালে ‘সোনার কেল্লা’ অভিযানে। ‘সোনার কেল্লা’ চিত্রায়িত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। ফেলুদা কাহিনির অলঙ্করণে সত্যজিৎ জটায়ুর যে মুখটি আঁকতেন, তা ক্রমশঃ বিবর্তিত হয়ে ১৯৭৩ সালের পুজো নাগাদ সন্তোষ দত্তের মুখের আদল গ্রহণ করে। অর্থাৎ ফেলুদা কাহিনি নিয়ে ছবি বানাবার আইডিয়া সত্যজিতের মাথায় আসামাত্র তিনি ‘জটায়ু’ চরিত্রের জন্য সন্তোষ দত্তকে মনে মনে একরকম নির্বাচন করেই ফেলেছিলেন এবং ফেলুদা কাহিনির পাঠকদের সঙ্গে তাঁর পরোক্ষ যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছিলেন। এটা একজন অভিনেতার পক্ষে এক বিরাট সম্মান এবং তাঁর প্রতি পরিচালকের আস্থারই পরিচায়ক। সন্তোষ দত্তও তাঁর অভিনয় ক্ষমতাবলে পরিচালকের সেই আস্থার সম্পূর্ণ মর্যাদা রেখেছিলেন। বাংলা ছবির বিপুল সংখ্যক দর্শক আজও তাঁকে ‘জটায়ু’ বলেই চেনেন।

Jatayu
জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে জটায়ু। ছবি সৌজন্য – pinterest.com

এর পরে ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতেও সন্তোষ দত্ত জটায়ুর ভূমিকাতেই ছিলেন এবং মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় ‘নাইফ থ্রোয়িং’-এর দৃশ্যে এক চিরস্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন। এরপরে সত্যজিতের আর একটিই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত- ‘হীরক রাজার দেশে’-তে বৈজ্ঞানিকের ভূমিকায়। এখানেও দ্বৈত চরিত্রে ছিলেন তিনি। প্রথমে পরিচিত শুণ্ডি রাজের ভূমিকায়, যেখানে হীরক রাজার প্রেরিত আমন্ত্রণপত্র তিনি দুই জামাই গুপী ও বাঘার সমীপে নিয়ে এসেছেন। অবশেষে লোভী ও উন্মাদ কিন্তু পণ্ডিত বৈজ্ঞানিকের ভূমিকা। পুরো ভোল পাল্টে সেই চরিত্রে সুঅভিনয় করে গিয়েছেন তিনি।

সন্তোষ দত্তের অকালমৃত্যুতে মর্মাহত সত্যজিৎ রায় অন্য কোনও অভিনেতাকে জটায়ুর ভূমিকায় মেনে নিতে না পেরে ফেলুদা কাহিনি নিয়ে আর একটিও ছবি বানাননি।

সত্যজিতের সিনেমা ছাড়াও আরও অনেকগুলো বাংলা চলচ্চিত্রে বিস্ময়কর অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন সন্তোষ দত্ত। এক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় চরিত্র হিসেবে উদাহরণযোগ্য ‘ ওগো বধূ সুন্দরী ‘ ফিল্মে অবলাকান্ত দত্ত চরিত্র। উত্তমকুমার অভিনীত গগন সেনের স্মার্ট উপস্থিতির বিপরীতে ভালমানুষ বন্ধু অবলকান্ত চরিত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং পরিপূর্ণ উপভোগ্য করে তোলা তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।

তাঁর অভিনয় ক্ষমতা বিশ্বের সেরা শিল্পীর তালিকাভুক্ত হতে পারে। তিনি বাঙালির চিরপ্রিয় সন্তোষ দত্ত।

সোমনাথ রায় 'এখন সত্যজিৎ' পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে পুরনো বাংলা ছবি নিয়ে গবেষণা করেন। বাংলা ছবির পাবলিসিটি মেটিরিয়ালস নিয়ে একটি আর্কাইভ তৈরি করেছেন। 'হাসি গল্পে সত্যজিৎ' 'A Monograph on Hiralal Sen', 'সিনেমা ধাঁধা' ইত্যাদি একাধিক সিনেমা সম্বন্ধীয় বইয়ের লেখক। এছাড়া তিনি পুরনো ছবির ফিল্ম বুকলেটের সংগ্রাহক।

2 Responses

  1. অননুকরণীয় সন্তোষ দত্ত র ওপর গবেষণাধর্মী অথচ সাধারণ পাঠকের সুপাঠ্য একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য শ্রীরায় কে অসংখ্য ধন্যবাদ!

  2. সন্তোষ দত্ত যে জটাযু -র স্কেচ কেও প্রভাবিত করেছিলেন তা জেনে সমৃদ্ধ হলাম। প্রফেসর শঙ্কু – র স্কেচেও মনে হয়েছে সন্তোষ দত্ত – র প্রভাব রয়েছে। সে বিষয়ে লেখকের মতামত জানতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *