পৃথিবী (নাটক): [পর্ব ১] [পর্ব ২]

সুজয়: আপনি বুঝতে পারছেন না মেসোমশাই। পৃথিবীর সব মানুষকে যদি সেই পাথর পরানো যেত, তাহলে তাদের সবার এই মৃত্যুযোগ কেটে যেতে পারত, ফলে পৃথিবীও ধ্বংস হত না। কিন্তু সারা পৃথিবীতে প্রায় সাত বিলিয়ান মানুষ, মানে সাতশ কোটি। অতজন মানুষকে আংটি পরাবেন কীকরে? 

মৃত্যুঞ্জয়: সেটা একটা সমস্যা বটে। মাত্র দশ দিনের মধ্যে – 

শ্যামলী: আর পশু পাখি? তাদের আংটি পরাতে হবে না? 

সুজয়: শুনলেন? শুনলেন মাসিমা? কোথায় আমি এসেছিলাম আপনাদের কাছে ওর  – যাক গে। আমি চলি মাসিমা। 

মানসী: দাঁড়াও সুজয়।  তুমি কী বলছিলে? তুমি এসেছিলে – 

শ্যামলী: তুমি সুজয়দাকে যেতে দাও মা। ওর তাড়া আছে – 

সুজয়: আমার তাড়া নেই মাসিমা। ও আমাকে তাড়াতে চায়! 

শ্যামলী: হ্যাঁ তাই চাই। তুমি এখন তোমার ওই “পৃথিবী ধ্বংস” হবার বার্তা বাড়ি বাড়ি দিয়ে বেড়াও। ইচ্ছে করলে, গলায় একটা বোর্ড ঝুলিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাক। মাইক নিয়ে রিক্সায় করে ঘুরে ঘুরে ঘোষণা করে বেড়াও। কিন্তু এখন আমার সময় নেই। আমাকে গান প্র্যাকটিস করতে হবে। 

সুজয়: শ্যামলী, আমি জানি ভেতরে ভেতরে তুই ঠিক জানিস যে আমি সত্যি কথাটাই বলছি। ভেতরে ভেতরে তুই ভয় পাচ্ছিস। ভয় পাচ্ছিস যে এতদিনের এত স্বপ্ন –  সব কেমন ধুলিসাত্‍ হয়ে যেতে চলেছে। কিন্তু তুই ওপরে একটা কঠিন ভাব দেখাচ্ছিস – ভাব দেখাচ্ছিস যেন সব কিছু স্বাভাবিক রয়েছে – কেবল আমিই পাগল হয়ে গেছি। 

শ্যামলী: এবার কিন্তু আমি পাগল হয়ে যাব। 

সুজয়: আমি কিন্তু তোর পাশে থাকতে চেয়েছিলাম শ্যামলী। আপনাদের সবার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন মাসিমা। বিশ্বাস করুন মেসোমশাই। 

মৃত্যুঞ্জয়: তুমি বস সুজয়। একটু স্থির হয়ে বস। (মানসী কে) তুমি ওর জন্য এক কাপ চা করে আনো না। চা খেলে ওর ভাল লাগবে। 

সুজয়: না মেসোমশাই। আমার চা লাগবে না। এক গেলাস জল – 

শ্যামলী: (মানসী কে) তোমাকে যেতে হবে না, আমি আনছি। যত সব ঢং – 

(শ্যামলী বেরিয়ে যায়) 

সুজয়: একটা কথা জিজ্ঞাসা করব মেসোমশাই? কিছু মনে করবেন না তো? 

মৃত্যুঞ্জয়: না না কিছু মনে করব না। তুমি বল যা বলতে চাও। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। 

সুজয়: ঠিক! ঠিক বলেছেন মেসোমশাই। আর মাত্র কয়েকটা দিন। এখন কোনও কথা চেপে রাখার মানে হয় না। 

মানসী: তুমি বল না, কী বলবে? নির্দ্বিধায় বল। 

সুজয়: মেসোমশাই, আপনি তখন বললেন, মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে না, খরচ বেঁচে যাবে। কথাটা সিরিয়াসলি বললেন? 

মৃত্যুঞ্জয়: ঠিকই তো বলেছি। দশদিন বাদেই যখন সব শেষ, তখন আর – 

সুজয়: কিন্তু দশ দিনের মধ্যেই যদি বিয়ে হয়? 

মৃত্যুঞ্জয়:দশ দিনের মধ্যে? কেউ কি আর তাতে রাজি হবে? (মানসী কে) কি গো, তোমার কি মনে হয়? 

মানসী: এই রকম একটা দুর্যোগ মাথায় নিয়ে কেউ বিয়ে করতে রাজি হবে? যদি ভালয় ভালয় ফাঁড়াটা কেটে যায় – 

সুজয়: না না, ধরুন দশ দিনের মধ্যেই বিয়ে করতে রাজি হল? 

মৃত্যুঞ্জয়: তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ একটু খোলাখুলি বলবে? 

সুজয়: ইয়ে মানে – মেসোমশাই, শ্যামলীর বিয়ের জন্য কি আপনার কোন সঞ্চয়ই নেই? সত্যি? 

মৃত্যুঞ্জয়: কী করে থাকবে বল? মাইনের টাকার বাইরে তো আর কোনও আয় ছিল না। টিউশনি করিনি কোনওদিন। কাজের বাইরে কেবল অকাজ করেছি, আর ঘুরে বেরিয়েছি। ভ্রমণের নেশাটা সেই ছোটবেলাতেই ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বাবা। ফলে যদিও বা কিছু জমেছে, বেড়াতে বেরিয়েই সব শেষ হয়ে গেছে। 

সুজয়: তাহলে তো মুশকিল। 

(শ্যামলী জল আর মিষ্টি নিয়ে প্রবেশ করে। সুজয়কে দেয়।) 

শ্যামলী: এই নাও ধর। দশ দিন বাদে আর এই মিষ্টি পাবে না। খেয়ে নাও। 

মানসী: হ্যাঁ হ্যাঁ খেয়ে নাও। তোমার মুখ চোখ কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। এখন আর কথা না বলে, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও। আর যদি কোনও প্রতিকার খুঁজে পাও, আমাকে জানিও। কোন সিদ্ধপুরুষের সন্ধান পেলে, তিনি হয়ত কোনও বিধান দিতে পারবেন। 

সুজয়: না মাসিমা। কথাটা আমাকে আজই বলতে হবে, এখনই বলতে হবে। পরে আর সময় পাওয়া যাবে না। 

মৃত্যুঞ্জয়: তা বল না কী বলবে? আমাকে এই পাণ্ডুলিপি শেষ করে চানে ঢুকতে হবে। 

সুজয়: না মানে আমি ভাবছিলাম, যদি বিয়েটা – 

মৃত্যুঞ্জয়: হ্যাঁ বল –  

সুজয়: মানে – আঃ শ্যামলী, তুই বল না। 

শ্যামলী: আমি বলব? কেন আমি বলব কেন? তোমার বলার কথা তুমি বলবে। 

মানসী: এসব তোমরা কী বলছ? শ্যামলী, কী বলছে সুজয়। 

শ্যামলী: (সুজয়কে) কী হল? চুপ করে আছ কেন? বল। 

সুজয়: হ্যাঁ বলছি। (ঢক ঢক করে জলটা খেয়ে নেয়) মাসিমা, মেসোমশাই, আপনারা জানেন শ্যামলী কে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই চিনি। মানে, শ্যামলীর সঙ্গে আমার জীবন একেবারে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ঠিক যেমন আপনারা ওঁকে ছাড়া আপনাদের জীবন ভাবতে পারেন না, আমিও শ্যামলীকে ছাড়া আমার জীবন ভাবতেই পারি না। আমি ব্যাপারটা আপনাদের বোঝাতে পারছি? 

মানসী: বুঝব না কেন?  কিন্তু কী করব বল। মেয়েকে তো একদিন বিদায় দিতেই হবে। 

সুজয়: না না বিদায় দিতে হবে না।  হ্যাঁ, মানে বিদায় দিতে হবে, কিন্তু ঠিক বিদায় নয়। কিছুদিনের মধ্যেই যখন আমরা সবাই সবাইকে বিদায় জানাব, তখন আগেই  বিদায় জানিয়ে কি লাভ বলুন? ও আপনাদের কাছেই থাকবে, আমিও থাকব – যদি – 

মানসী: তুমি কী বলছ আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। 

মৃত্যুঞ্জয় (হেসে): বুঝতে পারছ না, শ্যামলীকে বিয়ে করতে চায় সুজয়। কি ঠিক বলছি তো? 

সুজয়: হ্যাঁ -মানে – কিন্তু – 

মানসী: বিয়ে করবে? শ্যামলী কে? কিরে শ্যামলী, সুজয় তোকে বিয়ে করবে? তুই তো কিছুই বলিস নি আমায়। 

ছবি সোজন্য়: extremetech.com

চলবে

সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *