প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০]

রোমানিদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতবর্ষ৷ মোটামুটি হাজার দেড়েক বছর আগেই তারা মাইগ্রেট করতে শুরু করে৷ প্রথমে ইউরোপে, তারপর আমেরিকায়৷ পশ্চিমমুখী এই মাইগ্রেশনের ফলে রোমানিরা ছড়িয়ে আছে বহু দেশে৷ প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদানের ফলে তাদের ধর্ম, ভাষা এসব বদলে গেছে৷ যেখানে তারা বসতি করেছে, সেই জায়গার ধর্ম তারা গ্রহণ করেছে, রোমানি ভাষায় ঢুকে গেছে বহু আঞ্চলিক শব্দ৷ কিন্তু যেহেতু এদের আদিভূমি ভারত, সেজন্য হিন্দি আর পাঞ্জাবি ভাষার সঙ্গে এদের ভাষার মিল রয়েছে, ভাষার ব্যাকরণও বাংলা ব্যাকরণের অনুসারী৷ সংস্কৃত ভাষার আদি ছাঁচ এখনো এ ভাষায় স্পষ্ট৷ নীলের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হবার আগে বিস্তর হোমওয়ার্ক করেছে জিনি রোমানিদের সম্পর্কে৷ সান-ডিয়েগো ম্যারিয়টে উঠেছে নীল৷ হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে কনভেনশন সেন্টার৷ সেন্টারটা বিশাল লম্বা, টানা এক ব্লক ধরে এমুড়ো থেকে ওমুড়ো অবধি চলে গেছে৷ নীল একবার যেখান থেকে ওর বই বেরোচ্ছে তাদের অফিসেও দেখা করবে৷ কিন্তু সেটা ওর গৌণ উদ্দেশ্য৷ ও এবার মূলত এসেছে কনভেনশন সেন্টারে তিনদিনের একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে৷ জিনিকে আসার আগে ও ফোন করেছিল একবার৷
– আমাকে একটা কাজে এবার ওয়েস্ট কোস্টে যেতে হচ্ছে৷ আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং ইফ আই কুড মিট ইউ ফর এ ব্রিফ চ্যাট ওভার এ বিয়ার অর টু, সাম টাইম?
জিনি এককথায় সানন্দে সম্মতি দিয়েছিল৷ অনেকদিন ধরেই ও ভাবছিল নীলকে মিট করলে হত একবার৷ শুক্র-শনি-রবি নীল সকাল থেকে রাত অবধি খুব ব্যস্ত থাকবে৷ সারাদিন কনফারেন্সের পরও কনফারেন্স ডিনার, মিট দ্য প্রেস এসব থাকবে৷ সেজন্য ওরা ঠিক করেছে বৃহস্পতিবার আর্লি বিকেলে নীল পৌঁছনোর পরই কোথাও একসঙ্গে বসবে৷

রুণকে বিয়াট্রিসই সামলাবে, যেমন অনেক বছর ধরেই ও করে আসছে৷ বিয়াট্রিস কখনও জিনির কাজের ব্যাপারে নাক গলায় না৷ শুধু প্রশ্ন করে ফিরতে কত দেরি হবে৷ আজ নীলের সঙ্গে ডিনার করে ফেরার সম্ভাবনা৷ জিনির ফিরতে দেরি হবে শুনে বিয়াট্রিস কাঁধ ঝাঁকাল৷
– হোপ, ইউ এনজয় ইয়োর ইভনিং!
বলার দরকার ছিলো না, তবু জিনি কিছুটা কৈফিয়তের সুরেই বলল,
– ইট্‌স সেমি-অফিসিয়াল৷
নীলের বই যে ওদের পাবলিশিং হাউস থেকে অদূর ভবিষ্যতেই বেরোতে চলেছে সেসব গল্প বিয়াট্রিসকে বলল কিছুটা, ও জানতে না চাইলেও৷ বিয়াট্রিসের জিনির উপর একটা প্রচ্ছন্ন অধিকারবোধ আছে৷ সেই ব্যাপারটা এমনিতে জিনির ভালোই লাগে, তবু কোনও কোনও সময় মনে হয় একটু শ্বাসরুদ্ধ লাগছে৷ ওর মনের গড়নের জন্য বা অন্য যে কোনও কারণে, নিজের স্বাধীনতা সম্পর্কে ও খুব সচেতন৷

Neil and Jinia
তিনজনে বার কাউন্টারে গিয়ে পছন্দমতো মাছ ভাজা নিয়ে এসেছে।

হোটেলে পৌঁছেই ফোন করেছে নীল৷ কোথায় কীভাবে দেখা হতে পারে? জিনিয়া ওকে বলল, সাড়ে চারটে নাগাদ হোটেলের পাশের দিকটায় টিন ফিশ কাফেতে চলে আসতে৷ ট্রাম নিয়ে ঠিক চারটে কুড়ির সময় কাফের সামনের স্টপেজে নামল ও৷ গাড়ি আনেনি আজ৷ অফিসে বা নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেরনো একটা বদারেশন৷ টুকটাক পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠে পড়া, আবার নেমে যাওয়া অনেক বেশি সুবিধার৷ তাছাড়া নীল আগে এ শহরে এসেছে কিনা, জিনিয়া জানে না৷ যদি শহর ঘুরতে চায়, তাহলে পায়ে হাঁটার কোনও বিকল্প নেই৷ এই কাফেটা খুব মজাদার৷ ভিতরে কিছু বসার বন্দোবস্ত আছে৷ কিন্তু কাফের পাশে একটা চৌকো উঠোনের মতো জায়গা ঘিরে নিয়ে বসানো হয়েছে আরও অনেকগুলো গোল উঁচু টেবিল৷ পাশে দুটো বা তিনটে করে চেয়ার৷ আইডিয়াটা এরকম যে রাস্তার লোকজনও যেতে যেতে তাকিয়ে দেখবে খোলা চত্বরে সবাই গল্পগুজব করছে, টুকটাক খাবারও খাচ্ছে৷ অন্যদিকে কাফেতে বসে খাবার খেতে খেতে কাফের খরিদ্দাররাও দেখবে চারপাশে বয়ে যাওয়া চলমান জীবনকে৷ 

আজ টিন ফিশ কাফেতে বেশ ভিড়৷ এখন অফিশিয়ালি স্প্রিং৷ কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার একটা সুবিধা– শীত-গ্রীষ্ম কোনওটাই এখানে তীব্র আকার ধারণ করে না৷ এখন অনেকক্ষণ বিকেল থাকে৷ সামারে এই বেলাটা আরও প্রলম্বিত হবে৷ সূর্য অস্ত যাবে অনেক দেরিতে৷ লম্বা লম্বা পা ফেলে জিনিয়া গিয়ে ট্রামলাইনটা চোখে পড়ে, এমন একটা জায়গা দেখে বসে পড়ল৷ নীল টেক্সট করেছে ‘ইজ ইট ওকে ইফ আই ব্রিং অ্যালং অ্যানাদার গাই?’ জিনিয়ার ভুরুটা একটু কুঁচকে গেলেও সেটা ও তৎক্ষণাৎ ঢেকে নিল৷ ‘অ্যাবসল্যুটলি ফাইন’ ফিরতি ম্যাসেজ-এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জিনিয়া দেখল দু’জন একটু অনিশ্চিতভাবে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে কাফেতে ঢুকছে৷ বহু করেস্পন্ডেন্সের সূত্রে নীলের চেহারাটা এখন জিনির কাছে ছবিতে পরিচিত৷ কিন্তু ছবিতে যেমন মনে হয়, তার থেকে আরও অন্যরকম নীল৷ ওর মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুল এখন মাথার পিছনে একটা ব্যান্ডানা দিয়ে বাঁধা৷ বাদামি রঙের চোখের মণিতে বালকের মতো একরাশ বিস্ময়৷ গড়নটা মোটের উপর মাঝারি৷ উচ্চতাও খুব বেশি নয়৷ পরে আছে একটা ফুল ছাপ ছাপ সুতির হাফপ্যান্ট আর সেরকমই একটা বিচ শার্ট৷ মাথায় একটা পানামা হ্যাট৷ হঠাৎ করে দেখলে ওকে ল্যাটিন আমেরিকান বলে ভুল হতে পারে৷ পঁয়তিরিশ বছর বয়স বোঝা যায় না৷ হয়তো মুখচোখে অসম্ভব সারল্যের জন্য৷ অন্য যে ছেলেটি নীলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে জিনিয়ার সঙ্গে করমর্দন করছে, তার নাম ইউজিন৷ নীল পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,
– মিট মাই সোলমেট৷ হি থট হি শ্যুড নট ইন্ট্রুড ইনটু আওয়ার ফার্স্ট ফেস টু ফেস মিটিং৷ বাট আই প্রডেড হিম টু ডু সো৷
– ডিড দ্য রাইট থিং৷
জিনি ভদ্রতা রক্ষার জন্য বলছে৷ তিনজনে বার কাউন্টারে গিয়ে পছন্দমতো মাছ ভাজা নিয়ে এসেছে৷ নীল আর ইউজিন বিয়ার খাচ্ছে৷ ইউজিন বিয়ারটাতে স্প্রাইট মিশিয়ে শ্যান্ডি করে খাচ্ছে৷ জিনিয়া একটা লাইম জুস্‌ কর্ডিয়াল খাচ্ছে৷ বিয়ারের তিতকুটে স্বাদ ওর পছন্দ নয়৷ আস্তে আস্তে জমে উঠছে কথোপকথন৷ শেষ কবে যে জিনিয়া এতটা উপভোগ করেছে একটা বিকেল, এমন প্রাণময় বাক্যালাপে, ও মনে করতে পারে না নিজেই৷ ইউজিন নীলের পার্টনার, এটা ও আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল৷ ওরা এসেছে একটা এলজিবিটিকিউ কনফারেন্সে৷ এতদিন বিয়াট্রিসের সঙ্গে এক ছাদের তলায় বসবাস করলেও জিনিয়া এমন কোনও সম্মেলনে যায়নি৷ কখনও পাবলিক কোনও ফোরামে ভাগ করে নেয়নি ওদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে৷ ওর জীবনের গল্পটাও ভাগ করে নিচ্ছে জিনিয়া ওদের সঙ্গে৷ শুনতে শুনতে ইউজিন প্রস্তাব দিচ্ছে,
– ইউ ক্যান কাম অ্যালং৷ ইট’জ অ্যান ওপেন কনফারেন্স৷ নোবডি ইজ বারড ফ্রম এনটারিং দ্যা সেশনস্‌৷ 

নীলের বই যে ওদের পাবলিশিং হাউস থেকে অদূর ভবিষ্যতেই বেরোতে চলেছে সেসব গল্প বিয়াট্রিসকে বলল কিছুটা, ও জানতে না চাইলেও৷ বিয়াট্রিসের জিনির উপর একটা প্রচ্ছন্ন অধিকারবোধ আছে৷ সেই ব্যাপারটা এমনিতে জিনির ভালোই লাগে, তবু কোনও কোনও সময় মনে হয় একটু শ্বাসরুদ্ধ লাগছে৷ ওর মনের গড়নের জন্য বা অন্য যে কোনও কারণে, নিজের স্বাধীনতা সম্পর্কে ও খুব সচেতন৷

জিনিয়ার মধ্যেও এইরকম একটা সম্মেলনে যাবার ইচ্ছে জাগছে ভিতর থেকে৷ ইউজিনের তামাটে চেহারা, মাথা পরিপাটি করে কামানো, কালো চোখের মণিতে কীসের যেন বিষণ্ণতা। সুঠাম চেহারা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চুমরানো গোঁফ৷ পরনে পাতলা পাজামা আর সাইড বাটনড্‌ কুর্তা৷ জিনিয়া লক্ষ না করে পারে না যে ইউজিন মাঝে মাঝেই অপলক চেয়ে থাকে নীলের দিকে৷ ও বেশি কথা বলে না৷ শুধু নীলের দিকে গভীর বিষণ্ণভাবে তাকিয়ে থেকে যেন বুঝিয়ে দেয় ওর মনের কথা৷ ওদের ব্যক্তিগত কথা যতদূর ওরা বলে, তার চেয়ে বেশি জিজ্ঞেস করাটা অভব্যতা, তাই জিনিয়া কথা তোলে রোমানি হিসেবে নীলের অভিজ্ঞতা জানতে চেয়ে৷ জিনিয়ার কথায় নীল হাসে হা হা করে৷ বলে,
– ‘তুমি নিশ্চয়ই আমার উপন্যাসটা পড়ে ভেবে নিয়েছ আমি রোমানি? অ্যাকচুয়ালি লেট মি টেল ইউ, ইউজিন আমার সহ-লেখক৷
– মানে?
জিনিয়া একটু অবাক ৷ 
– মানে আর কিছুই না৷ আমার বইতে যে অভিজ্ঞতাগুলো, যে গল্প রয়েছে, তা যেমন আমারও অভিজ্ঞতা, তেমনই ইউজিনেরও৷
– হি ইজ মাই স্টোরি টেলার৷
ইউজিন একটু বিষণ্ণ হাসে৷ নীল আবারও বোঝাচ্ছে জিনিয়াকে৷ রোমানি পিপল আসলে একটা ক্যাচঅল শব্দ৷ অঞ্চলভেদে, দেশভেদে, সমাজভেদে রোমানিরা বদলায়৷ যে দেশে যায় সেই দেশের সংস্কৃতি, ধর্ম, জল-হাওয়াকে পুরোপুরি তো প্রতিরোধ করতে পারে না৷ মানিয়ে নিতে হয়। নীল ভারতবর্ষের সেই যাযাবর সম্প্রদায়ের লোক৷ বানজারা৷ সেজন্য ওর বাবার পদবীতে না লিখে ও নীল বানজারা নামে লেখে৷ সত্যিই তো! জিনিয়া তো জানে নীলের পুরো নাম নীল বানজারা৷ কিন্তু বানজারা শব্দটার মানে কী, তা নিয়ে জিনিয়া কোনওদিন মাথা ঘামায়নি৷ বানজারা মানে যারা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, ওয়ান্ডারারস ইন দ্য জাঙ্গল৷ বনচারী এই মানুষরা বনের সম্পদ আহরণ করে বেঁচে থাকত৷ আদিম কৌম অবস্থা থেকে সরে গিয়ে বন কেটে বসত করার কথা ভাবত না৷ তারা কোথা থেকে এসেছিল কেউ জানে না৷ কেউ বলে আফগানিস্থান থেকে ভারতে এসেছিল৷ আবার র‌্যালফ লিলি টার্নার নামে একজন ভাষাতত্ত্ববিদ বলেছিলেন মধ্য ভারতের মধ্যেই এদের উদ্ভব, ক্রমে যারা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে৷
– কিন্তু রোমানিরা চলে গেল কেন?
জিনিয়া জিজ্ঞেস করে৷ নীল এখন প্রবল উৎসাহে জিনিয়াকে বোঝাচ্ছে এই যাযাবর সম্প্রদায়ের চলনের ইতিহাস৷

Romani Gypsy
বনচারী এই মানুষরা বনের সম্পদ আহরণ করে বেঁচে থাকত৷

রোমানিরা অষ্টম শতক থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে পাড়ি জমাতে থাকে ইউরোপে৷ কেন যে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছিল কে জানে? ইতিহাসে অনেকরকম ব্যাখ্যা মেলে৷ কেউ কেউ বলে গজনীর মামুদের আক্রমণ এড়াতেই এই দেশত্যাগের শুরু৷ আবার এমনও হওয়া সম্ভব যে ভারতবর্ষের বর্ণ ব্যবস্থার শৃঙ্খলিত অবস্থান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল তারা৷ বানজারাদের স্থান ছিল বর্ণ ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচু কাঠায়৷ সবাই তাদের বাঁধতে চাইত৷ বর্ণহিন্দুরা তো বটেই, পরে ব্রিটিশ আমলে ১৮৭১-এ চালু হল ক্রিমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট ৷ ঔপনিবেশিক শাসক আইনের সাহায্যে জোর খাটাল তাদের উপর৷ বনচারী জীবন থেকে সরিয়ে এনে কৃষকের বৃত্তিতে জোর করে পুনর্বাসন দেওয়া হল মানুষগুলোকে৷

নীল হাসছে৷ কিন্তু যাযাবর বৃত্তি যাদের রক্তে, তারা কি করে এক জায়গায় স্থির থাকবে? আদিবাসী কৌম এই প্রান্তিক মানুষরা কখনও সভ্য সমাজ বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে, যুক্তি শৃঙ্খলার বেড়িতে বাঁধা পড়ত না৷ ভারতেও নয়, ইউরোপেও নয়৷ ষোড়শ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রোমানি বিরোধী আইন চালু করেছিল৷ একঘরে করার চেষ্টা হয়েছিল ‘জিপসি’ তকমা দিয়ে৷ ডেনমার্কের মতো দেশে এই সম্প্রদায়ের কোনও মানুষ ধরা পড়লেই মৃত্যুদণ্ড হত৷ ইউরোপের কালেক্টিভ মিথোলজিতে রোমানিদের দেগে দেওয়া হয়েছিল বহিরাগত, তন্ত্রমন্ত্র বশীকরণে পারদর্শী, ফোঁপরা নৈতিক চরিত্রের এক প্রহেলিকাময় জাতি হিসেবে, যাদের কাছ থেকে শত হস্ত দূরে থাকাই ভাল৷ ইউজিন এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল৷ এবার পাশ থেকে যোগ করে,
– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোয় নাৎসিরা রোমানিদের উপর কম অত্যাচার করেনি৷ ১৯৩৬ থেকে ৪৫ এর মধ্যে ১৫ লক্ষ লোক মারা গেছিল নাৎসিদের অত্যাচারে, যাকে বলা হয় প্রগ্রমস বা রোমানি হলোকস্ট৷
নীল বলে ইদানীং বিভিন্ন দেশের টনক নড়েছে৷ আগের অনেক ভুল ধারণা খারিজ হতে শুরু করেছে৷ কয়েক বছর আগে ২০১১ সালে বেলগ্রেডে একটা রোমানি অ্যাকাডেমি চালু হয়েছে রোমাণিদের বিভিন্ন দিক নিয়ে সিরিয়াস গবেষণার জন্য৷ অ্যাকাডেমির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের ২১ জন সদস্যের মধ্যে ১১টা ইউরোপীয় দেশের তো বটেই, ভারত, যা রোমানিদের আদি জায়গা এবং আমেরিকার প্রতিনিধিও রয়েছেন৷
– হ্যাঁ, ভালো কথা৷ তুমি তো বললে ওরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছিল৷ আমেরিকায় এল কবে? 
অনেকক্ষণ উত্তেজিত বক্তৃতার পর নীল একটু হাসে।
– যা শুনেছি ১৪৯৮-তে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের তৃতীয় সমুদ্রযাত্রার সময় চারজন রোমানি তাঁর সঙ্গী হয়৷ প্রচুর সংখ্যক লোক আসতে শুরু করে ১৯০০ সাল নাগাদ৷ ভার্জিনিয়া আর ফ্রেঞ্চ লুইসিয়ানা অঞ্চলে প্রথমে আসে ওরা৷
– ধর্ম কী ছিল রোমানিদের?
– ধর্মের ব্যাপারটা চিরকালই খুব গোলমেলে৷ জানো তো? ওই যে বললাম বর্ণহিন্দুদের অত্যাচার তো ভারতের দলিত বানজারারা চিরকালই সাফার করেছে৷ অথচ আমার বাবার মতো লোক, যে অত্যাচার এড়ানোর জন্য খালাসি হয়ে এদেশে পালিয়ে এল৷ তারপর সারাজীবন কাজ করছে ট্রাম্প ক্যাসিনোতে, সে তো নিজেকে হিন্দু বলেই খাতায় কলমে বলে৷ আমি অবশ্য কোনও ধর্মেই নেই৷ অ্যাগনস্টিক৷ আবার ইউজিনের পূর্বপুরুষরা, যারা উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষ থেকে পশ্চিমমুখো গিয়েছিল ইউরোপে, হাজার বছর আগে, আর সেখান থেকে দুশো বছর আগে পাড়ি জমিয়েছিল আমেরিকায়, তারা খ্রিস্টান হয়ে গেছে আগেই৷ আবার মুসলমানও আছে কিছু৷ তবে ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক বল, জন্মের পরে আতুঁড়ঘর বল, মৃত্যুর পরে অশৌচ বল, এসব রিচুয়ালে বিশ্বাসে কোথাও রোমানিরা ভিতরে ভিতরে হিন্দুই রয়ে গেছে৷

Ugene and Jinia
ইউজিন এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল

অবাক হয়ে শোনে জিনিয়া৷ তার বাবার জন্ম হয়েছিল খুলনায় দেশের বাড়িতে একটা আতুঁড়ঘরে৷ পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকানুনের কিছু কিছু আভাস জিনি বড় হয়ে ওঠার মধ্যেও পেয়েছে৷ অন্য দেশে অন্য সমাজেও ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাই যে গেঁড়ে বসে থাকে, মনে করা হয় বিয়ের পর মেয়েটির দায়িত্ব হল তার স্বামীর পরিবারের দেখভাল, এসব জিনিয়ার কাছে একটা রেভেলেশনের মতো৷ গল্পে গল্পে অনেক সময় কাটছে৷ ওরা সবাই মিলে একটা মধ্য-প্রাচ্যের রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে এসেছে৷ খেতে খেতে হঠাৎ যেন গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু মনে পড়ে গেছে এভাবে ইউজিন বলল,
– জানো তো, এমনকী আমাদের দেবীও এক৷
আবার অবাক হবার পালা জিনিয়ার৷

আজ টিন ফিশ কাফেতে বেশ ভিড়৷ এখন অফিশিয়ালি স্প্রিং৷ কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার একটা সুবিধা– শীত-গ্রীষ্ম কোনওটাই এখানে তীব্র আকার ধারণ করে না৷ এখন অনেকক্ষণ বিকেল থাকে৷ সামারে এই বেলাটা আরও প্রলম্বিত হবে৷ সূর্য অস্ত যাবে অনেক দেরিতে৷ লম্বা লম্বা পা ফেলে জিনিয়া গিয়ে ট্রামলাইনটা চোখে পড়ে, এমন একটা জায়গা দেখে বসে পড়ল৷

– কোন দেবী? 
– কেন? সেন্ট সারা যাঁর আরেক নাম সারা-এ-কালী তিনি তো তোমাদের দেবী কালী৷ এখন জানা গেছে আদতে ভারত থেকে আগত রোমানিরাই দেবী কালীকে এনেছিল ফ্রান্সে৷ এখন তাঁকে সেন্ট সারা নামে আমরাও পুজো করি৷
– এখন সারা পৃথিবীতে রোমানিদের জিপসি বলে সন্দেহের চোখে দেখা, একঘরে করে রাখার প্রবণতা একটু কমের দিকে৷ ইন্ডিয়ার বিদেশমন্ত্রক রোমানিদের ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ তারপর থেকে ইন্ডিয়ান ডায়াসপোরার অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে রোমানিদের৷ তারপরেই তো ভাবলাম, এই যে ডায়াসপোরা, আমিও যার অংশ, তাদের লড়াই, তাদের জীবন নিয়ে লিখি৷  
– প্রান্তিক মানুষদের এই জার্নির সঙ্গে তো আরও একটা জিনিসও আছে তোমার গল্পে৷ একজন মানুষের সমপ্রেমের গল্প? সেই জার্নিটাও তো ভীষণই কঠিন৷
– তা বলতে পারো৷
নীল একটু ভাবছে বলবে কি বলবে না৷
– আসলে তোমাকে বলছিলাম না এটা যেমন আমার গল্প, তেমনি ইউজিনেরও গল্প৷ আমি ছোট থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশান৷ ইউজিনের বুঝতে কিছুটা দেরি হয়েছিল৷ তোমরা ফেমিনিস্টরা ভারতীয় নিম্নবিত্ত মেয়েদের ডাবলি মার্জিনালাইজড বল, আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পেরেছি ইউজিন একজন পুরুষ হয়েও কীভাবে ডাবলি মার্জিনালাইজড ৷ আমার কিন্তু অন্য অনেক সম্পর্ক হয়েছে৷ মেয়েদের সঙ্গে, পুরুষদের সঙ্গে৷ কিন্তু ইউজিনের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা একদম আনকোরা, নতুন, টাটকা। ওর মা-বাবা ওকে ত্যাগ করেছে আমার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জেনে৷ এখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক না টিঁকলে, আমি তো স্বাধীন হয়ে যাব৷ ইউজিন যে কী করবে, ওই জানে৷ ইউজিন ওইজন্য ওর মিউজিক আর ক্রাফ্ট-কে বেছে নিয়েছে৷ হাঃ হাঃ হাঃ৷ ও দারুণ একজন সংগ্রাহক৷ রাজস্থানে ঘুরে ঘুরে যা ফোক মিউজিক কালেক্ট করেছে না, মাথা ঘুরে যাবে তোমার…
হুইস্কির ঘোরে নীল যা বলার নয়, তাও বলে যাচ্ছে৷ এগুলো ওদের প্রাইভেট ডোমেন৷ এত কথা না বললেও পারত নীল৷ পাশে বসে ইউজিন একটু অসহায়ভাবে হাসে। বলে,
– তোমাকে কখনও আমার মিউজিকের সংগ্রহের কিছু স্যাম্পেল শোনাতে পারলে খুশি হব৷

Woman with Laptop
রাতে বাড়ি ফিরে নীলের বলা কথাগুলোই মাথায় তোলপাড় করছে।

রাতে বাড়ি ফিরে নীলের বলা কথাগুলোই মাথায় তোলপাড় করছে জিনিয়ার৷ ভারতবর্ষে শিকড় ছিল যাযাবর মানুষগুলোর৷ বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে, বহুরকম দুর্যোগ পার হয়ে থিতু হতে পেরেছে ওরা অবশেষে৷ মিলেছে সরকারি বদান্যতা, সাহায্যের আশ্বাস, পৃথিবীর বহু দেশে৷ তবু সঞ্চরমান মানুষ ওরা৷ চলমানতা ওদের রক্তে৷ ওদের গায়ে তাই স্থবিরতার শ্যাওলা লাগে না৷ ডিনারের শেষে নীলের যখন আবেশে চোখ বুজে এসেছে, তখন ইউজিনের সঙ্গেই কথা হচ্ছিল ওর৷ বারবার ইউজিন ধন্যবাদ দিল চমৎকার একটা সন্ধ্যে আর স্বাদু খাবারের জন্য৷ জিনিয়াও পাল্টা ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিল,
– তোমার সঙ্গে আরও আগেই দেখা হওয়া উচিত ছিল আমার৷ যদিও তোমার সঙ্গে আমার ইতিহাসের আপাতভাবে কোনও মিল নেই৷ তবুও আগে দেখা হলে আমরা পারস্পরিক মত আরও বিনিময় করতে পারতাম৷ 
উত্তরে স্বল্পবাক ইউজিন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল৷ রেস্টোরেন্টের স্তিমিত আলো তেরচাভাবে পড়েছিল ওর মুখে৷ তারই আভায় খুব রহস্যময় লাগছিল ওকে৷ রহস্যময় হাসছিল ইউজিন ঠিক যাদুকরের মতোই৷
– সবসময় মনে রেখো জিনিয়া, আমাদের সকলের মধ্যেই একটা বোহেমিয়ান লুকিয়ে থাকে৷ কেউ সেই যাযাবর বোহেমিয়ান সত্ত্বাটা বের করে আনে, কেউ সেটা তুলোয় মুড়ে বুকের গোপন কোনও কুঠুরিতে রেখে দেয়৷ সারাজীবন অপেক্ষা করে করে সেই অন্য আমিটা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে, আর জাগে না, জাগতে পারে না৷ আই নেভার লেট দ্যাট হ্যাপেন টু মি৷ সারা জীবন আমি কোনও চাকরি করতে পারিনি৷ খুব একঘেয়ে লাগবে এই ভয়ে৷ ভারতবর্ষে অনেকবার ছুটে গিয়েছি লুকনো মণিমুক্তোর আশায়, হিডেন জেমস্‌, খুব বড়ো কিছু হয়তো পাইনি৷ কিন্তু যা পেয়েছি, তা আমার কাছে যথেষ্টর চেয়েও বেশি৷ এক একদিন উল্টোপাল্টা হাওয়া দেয়৷ তখন তোমার যত্ন করে তুলে রাখা অন্য ‘আমি’টাকে জাগিয়ে দিতে হয়৷ ৷ নতুন কিছু করার জন্য, কিছু সৃষ্টি করার জন্য৷ ঘরের চেনা চৌহদ্দি থেকে বার হয়ে এসে তখন নিজের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারি আমি প্রবলভাবে বেঁচে আছি৷ চেনা সীমানা পেরিয়ে তখন পায়ে পায়ে পেরিয়ে যায় অনেকটা পথ, দিগন্তের সীমার শেষে অন্য কোনও পথের সম্ভাবনা খুলে যায় পথের থেকে৷ 

কথাগুলো যেন ফিস্‌ফিস্‌ করে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলছিল ইউজিন৷ অল্প আলোয় ভেসে ছিল ওর জাদুভরা মায়াবী বিষণ্ণ চোখদুটো৷    (চলবে)

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৮ নভেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Shutterstock
Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *