ফাইনম্যান
“আসুন স্যার। দাঁড়ান, অন্ধকার। মোবাইলের টর্চটা জ্বালাই।”
অজিতেশ অবাক। এমন ঘুপচি সিঁড়ি দিয়ে মানুষ চলাফেরা করতে পারে? কিন্তু কী করবে! দেহোপজীবিনীর সস্তা ডেরায় আসতে গেলে তো অন্ধকার গলিগালা পেরোতেই হয় খরিদ্দারদের। সে না হয় এসেছে অন্য কাজে। সঙ্গে স্ত্রী। দুজনেই ডাক্তার। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের কথা আলোচনা করতে করতেই পায়েলের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
– হ্যাঁ গো, ওদের চলবে কীভাবে?
শহরের বিখ্যাত এন্ডোক্রিনোলজিস্ট অজিতেশ। রোগীর অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির হাল হকিকত বুঝে ফেলে মুহূর্তে। কিন্তু স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না। লোকে দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার হাত ধুচ্ছে, স্যানিটাইজার মাখছে ভাইরাসের ভয়ে। সংক্রমণের আতঙ্কে এখন যৌনকর্মীদের কাছে কেউ আসবে না। না-খেতে পেয়েই ক্রমশ মরে যাবে ওরা। নিশ্চুপে। খিদে না ভাইরাস, কোনটা বেশি খতরনাক গুলিয়ে গেল অজিতেশের। পায়েল একরোখা। একবার মাথায় ঢুকেছে মানে যাবেই।
– ছাড়ো তো! ওসব এনজিও মারফত টাকা দেওয়ার মানে হয় না। নিজেরাই যাই চলো। হাজার পাঁচেক টাকার চাল ডাল আর কিছু ওষুধ, মাস্ক।
এতকাল ‘ফেমিনিস্ট’ বলে বন্ধুবৃত্তে যারাই পায়েলকে গালি দিত, তারাই কী এক মন্ত্রবলে রাজি হয়ে গেল। ছ’জনের মেডিক্যাল টিমকে আগলে নিয়ে গেলেন লোকাল সাব ইন্সপেক্টর অভীক মুখার্জি। কে বলবে পুলিশের মানবিক মূল্যবোধ নেই! পুরনো ধ্যানধারণাগুলো দুমদাম ভেঙে দিচ্ছে করোনা। নাহ , সেলফি তোলেনি ওরা। যিশু বলেছিলেন, ডানহাতে এমনভাবে দান করবে যেন বাঁ-হাত না জানতে পারে। কাকে দেখাবে বদান্যতা? কী লাভ?
মোটামুটি জনা পঞ্চাশেক মহিলাকে মাস্ক পরা শিখিয়ে বেরিয়ে আসার সময় একটা দৃশ্যে চোখ আটকে গেল সবার। খোলা চৌকোনো চাতালে কড়া রোদ। হাত নেড়ে নেড়ে, জোর গলায়, বই পড়ে শোনাচ্ছে একটি মেয়ে। বছর বারো তেরো হবে। সামনে জনা দশেক ছেলেমেয়ে নিশ্চুপে বসে শুনছে আর মাঝেমধ্যে হেসে উঠছে। ইন্সপেক্টর অভীক মৃদু হাসলেন।
– এদের বাচ্চারা। লকডাউনে যাবে কোথায়? স্কুল বন্ধ। ঐ একটু গালগপ্পো..
অজিতেশ ইশারায় থামিয়ে দিল অভীককে। কয়েকটা শব্দ তার কানে এসেছে। ‘ফাইনম্যান’, ‘ম্যানহাটন।’ স্ট্রেঞ্জ! পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল অজিতেশ। নীল ফুলছাপ প্রিন্টের ফ্রক পরা মেয়েটি চুপ করে গেল তখনই।

– থামলে কেন?
মেয়েটি চুপ।
– গল্পের বই?
মিষ্টি হেসে ঘাড় নাড়ল মেয়েটা।
– আজ তো রিচার্ড ফাইনম্যানের জন্মদিন।
অজিতেশের মুখ দিয়ে মিনিট খানেক কথা সরল না।
– ফাইনম্যান?
দর্শকদের মধ্যে থেকে জবাব এল, “ম্যাজিকের লোক।”
– তোর মুণ্ডু, উনি বিজ্ঞানী।
– এ বাবা! তুইই তো বললি উনি শক্ত শক্ত তালা খুলে ফেলতেন যাদু দিয়ে।
– দূর গাধা! উনি এমন বুদ্ধিমান ছিলেন যে সব লকারের কোড ক্র্যাক করতে পারতেন।
– আলিবাবা চিচিং ফাঁক বললে যেমন দরজা খুলে যেত?
একপ্রস্ত কুলকুল হাসির মধ্যে অজিতেশের কানে এল মেয়েটার গলা।
– বিজ্ঞানীরা সব পারে, বুঝলি। উনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানের হাতে একটাই চাবি। সেটা দিয়ে যেমন স্বর্গের দরজা খোলে, নরকের দরজাও খোলে। তবে কোন দরজাটা যে স্বর্গের আর কোনটা নরকের সেটা মানুষ এখনও জানে না।
– তাহলে?
অজিতেশ বিমূঢ়।
– প্রশ্ন হল, আমরা কি এই চাবি ছুড়ে ফেলে দেব আর স্বর্গে যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেব একদম? নাকি আরও চেষ্টা করে যাব কীভাবে এই চাবির সবথেকে ভাল ব্যবহার করা যায়? এটাই ফাইনম্যান জিজ্ঞাসা করেছিলেন।।”
পায়েল বলে উঠল,
– বিজ্ঞানের চাবিটাকে খুঁজে বার করতেই হবে।
মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে।
– আমরা খুঁজতে বেরোব ঠিক করেছি। লকডাউনটা উঠুক। ইস্কুল বন্ধ। আমাদের একটা কম্পিউটার কিনে দেবে আন্টি? পুরনো হলেও ইটস্ ফাইন।
অন্নপূর্ণা ইয়াসমিন
লকডাউনের মধ্যেও সাবিনার কাজকর্মের বিরাম নেই। কিছুটা স্বভাব, কিছুটা নেশা। মায়ের থেকেই এই উত্তরাধিকার প্রাপ্তি। রকমারি রান্না। শুধু তাই নয়, সেগুলোকে শৈল্পিকভাবে পরিবেশন। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছেই সাবিনা ইয়াসমিনের বাড়ি। হাসপাতালে নাকি করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে- গুজবের জেরে রাস্তা সিল করেছে পুলিশ। হাঁটাহাঁটি বন্ধ। পার্ক সার্কাস ময়দানের খোলা হাওয়ায় ঘোরাঘুরি নিষিদ্ধ। সবাই হাঁপিয়ে উঠলেও সাবিনার মুক্তি তার ছাদে। এক টুকরো মরূদ্যান। লাউশাকের লকলকে ডগা, কচি কচি উচ্ছে, ছোট ছোট বেগুন, নধর কুমড়ো। কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা, পার্সলে, পুদিনা।
একপদে হলেও দু’বেলাই তরিবত করে রান্না করে সাবিনা। তারপর গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, খোঁপায় একটা গন্ধরাজ। বেল, জুঁই, চাঁপার ঘ্রাণে ম’ ম’ করা ছাদে টেবিল পাতে সাবিনা। গোটা পরিবার ডিনার করে। কলাপাতা গোল করে কেটে ডিশের মধ্যে পেতে সুন্দর করে সাজায়। ফুলদানিতে লিলি। খাওয়া একটা শিল্পকলা। লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মিলন। সবাই পারে না।

পার্ক সার্কাসের অলিগলি, তিলজলা বস্তির কিছু মানুষ ভিনরাজ্যের। এঁরা বাড়ি ফিরতে পারেননি লকডাউনের জেরে। সাবিনাদের পাড়ার উদ্যোগ- যে যা পারবে রান্না করে পাঠিয়ে দেওয়ার। সাবিনা খেয়াল করেছে, গত দুদিন ধরে কিছু মানুষ এসেছেন খাবার নিতে। চেহারায় কুন্ঠিতভাব। এঁরা তো ভিখিরি নন। ঘাম ঝরিয়ে ভাত উপার্জন করেন। এভাবে হাতপেতে নিতে কার ভাল লাগে? পাশের বাড়ির তহমিনা বিভিন্ন পদ রেঁধে নিয়ে গেছিল। লোকজন একবার নিয়েই চলে গেছেন। আত্মাভিমান বোধহয় করোনাভাইরাসের থেকেও সংক্রামক। সাবিনা ঠিক করল একটাই পদ রাঁধা শ্রেয়। খিচুড়ি। উৎসবে, বিপদে খিচুড়ি মান রক্ষা করে। পেট ভরে, মনও। রান্নার ঝামেলাও নেই। ঘরের সবজিতেই হবে। ফুলকপি, ডুমো ডুমো করে কাটা খোসাসমেত আলু, বরবটি, টমেটো।
কিন্তু আন্দাজটা কী হবে? ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আড়াই কেজি ভাতের চাল, দেড় কেজি মুগ ডাল আর এক কেজি মসুর ডাল নিয়ে নিল সাবিনা। মুগডাল শুকনো কড়াইতে ভেজে নিল। পাঁচকেজি বিরিয়ানির হাঁড়িতে রান্নাটা করেছে সাবিনা। ওরা হাঁড়িশুদ্ধ খিচুড়ি নিয়ে চলে গেছে। পরে হাঁড়ি ফেরৎ পেলে সেটা জীবাণুনাশ করে তুলে দেওয়ার কাজটা রান্নার করার মতো অত আনন্দের হবে না সেটা বোঝে। তবে সে কাজ করে দেওয়ার জন্য লোকের অভাব নেই সাবিনার। কেন থাকবে?
খিচুড়ির হাঁড়ি পাঠিয়েই স্বস্তিতে থাকেনি সাবিনা। সাবিনার ভাষায়:
– দ্যাখো, খাবার একটু শৈল্পিকভাবে পরিবেশনের ক্ষেত্রে দামি রান্না, সস্তার রান্না এসব কথা মাথায় আসে না। খেয়ে তৃপ্ত হওয়ার আগে মনও তৃপ্ত হওয়ার দাবি রাখে। দেখে আগে ভালো লাগতে হবে। ওই ভালোলাগার মূল্য তো আছেই! নইলে বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টগুলোতে দামি এবং সুদৃশ্য প্লেটে খাবার পরিবেশন করেই ক্ষান্ত থাকত। প্লেটের কোণায় অথবা মাঝখানে আড়াআড়িভাবে টমেটোর গোলাপ, লঙ্কাজবা ফুল শোভা পেত না। যে কোনও খাবারের পাশে একগুছি ধনেপাতা, বা নানারঙের শৈল্পিক আঁচড়, তারও তো যথেষ্ট মূল্য ধরে নেওয়া হয়। খাবার পরিবেশনের শিল্পসম্মত উপায়গুলো যথেষ্ট পরিমাণে টাকাপয়সা খরচ করেই প্রতিষ্ঠান থেকে শিখতে হয়। কিন্তু কেউ কেউ আবার জন্ম থেকেই একটুআধটু এইরকম গুণ নিয়ে জন্মায়। এই গুণের অধিকারীরা গরিব হলেও এবং মাটির বাড়িতে বাস করলেও এদের বারান্দা সর্বদাই লেপাপোঁছা থাকে। এঁদের ছোট উঠোনখানিও সযত্নে নিকানো থাকে। তাই আমি প্রতিটি শালপাতার থালার একপাশে সাজিয়ে দিয়েছি কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ, একটুকরো গন্ধলেবু, টমেটো আর পুদিনাপাতা।
খিচুড়ি পাতে পাতে বেড়ে দিয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা। সাবিনা ইয়াসমিন চর্মচক্ষে দেখতে পায়নি- সেদিনের খিচুড়ির প্রতিটি গ্রাসে তৃপ্তির সৌরভ মিশে ছিল পরিযায়ী অভুক্ত শ্রমিকদের। বারবার চেয়ে খেয়েছেন ওঁরা। সাবিনা ঈশ্বরী পাটনিদের দেখেনি, কিন্তু খাইয়েছিল সযত্নে।
*ছবি সৌজন্য: সুনীল দাসের ছবিটি Artnet থেকে
Pradip, Everyday Recipe
পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।
khub bhalo legeche