সামনেই রথযাত্রা। জগন্নাথ ভক্তরা এখন তাঁর অর্চনায় মগ্ন। রথযাত্রা তো শুধু জগন্নাথ দেবের নয়, তাঁর ভক্তদেরও। দেবতার প্রতি ভক্তি ও টান প্রতিবার এগিয়ে নিয়ে যায় রথের চাকা। শুধু কি দেবতার প্রতি ভক্তি আর টান দিয়েই রথ চলে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি লেখার কথা মনে পড়ে যায়… শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোনও এক জন্মদিনে তাঁকে চিঠি লিখে জানান যে, জন্মদিনে “কালের যাত্রা” নামে একটি নাটক শরৎবাবুকে উৎসর্গ করেছেন। নাটকটির সারমর্ম উল্লেখ করতে গিয়ে একজায়গায় বলেন… “মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধবন্ধন দেশে দেশে যুগে যুগে প্রসারিত, সেই বন্ধনই এই রথ টানবার রশি। সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানবসম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গেছে…”

সেই গ্রন্থিগুলিই হল প্রধান বাধা, তাই রথযাত্রা হয় স্তব্ধ! অসাম্য আর বৈষম্য দূর করে সভ্যতার চাকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ঈশ্বরের ও চাহিদা। সেই রবিঠাকুর আবার রথের মেলা নিয়ে যে ছবি দুটি আঁকলেন যেখানে বললেন, বৃষ্টি শেষের সূর্যের আলোর মতো ছোট্ট মেয়েটির হাসি…
“সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি
এক পয়সায় কিনিছে ও
তালপাতার এক বাঁশি|”

আর ওদিকে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারার মতো ছেলেটির চোখে জল, সে কিনতে চেয়েছিল এক পয়সার রাঙা একটি লাঠি, কিন্তু পারেনি। রথের কবিতায় শৈশবের যে আলো আঁধারি, মেঘ বৃষ্টির ছবি এঁকে দিলেন তাতে কিন্তু পরোক্ষভাবে বৈষম্য বিভেদ দূর করে রথের চাকা এগিয়ে যাওয়ারই কথা গাথা! সেই ছবিই উঠে আসে রথযাত্রার আয়োজনেও…

56 Bhog
জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ বা ছাপ্পান্ন ভোগ

জগন্নাথদেব ভক্তদের কাছে বড়ো প্রিয় দেবতা, শ্রী কৃষ্ণেরই রূপ তিনি। আর রথযাত্রার সময় জগন্নাথের মন্দিরে তাঁর জন্যে রান্না করা হয় ছাপ্পান্ন ভোগ (ছপ্পনভোগ), যে ভোগের ভাগ পায় জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই। কখনও কম পড়ে না সেই মহাপ্রসাদ, কখনও উদ্বৃত্ত হয়ে ফেলাও যায় না। কথিত আছে, মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে আট প্রহরে খেতে দিতেন। একবার ইন্দ্রের রোষে পৃথিবী তখন মহাপ্রলয়ের মুখে, বালক কৃষ্ণ তখন সাতদিন না খেয়ে নিজের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে গোবর্ধন পর্বতকে তুলে নিয়ে মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা করেছিলেন। তারপর, ব্রজবাসী সাতদিন আটবেলা হিসেবে তাঁকে ছাপ্পান্ন রকমের খাবার খেতে দেন। সেই থেকে শুরু হয় কৃষ্ণের ছাপান্ন ভোগ।

সেই ছাপান্ন ভোগের একটি হল ‘রাসাবালি’। আজ দুটি মিষ্টির রেসিপিই জগন্নাথদেবের আপন দেশ থেকে:

১. রাসাবালি
২. ছেনা পোড়া

রাসাবালি

ওড়িশার কেন্দ্রপড়া রাসাবালির জন্যে বিখ্যাত। ছানাকে ছাঁকা তেলে ভেজে নিয়ে বানানো লালচে রঙের মিষ্টি, রাবড়িতে চোবানো, মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় এমন অমৃত! সে কি আর জগন্নাথদেব ভালো না বেসে পারেন?

Rasabali Sweets
ছাপ্পান্ন ভোগের রাসাবালি

বানাতে লাগবে:

এককাপ ছানা (বাড়িতে দুধ ফুটিয়ে লেবুর রস দিয়ে বানাতে পারলে আরো ভালো)
এক ছোট চামচ আটা
এক বড়ো চামচ সুজি
দুই বড়ো চামচ চিনি
ভাজার জন্য তেল
দুধ এক লিটার
চিনি আধ কাপ
এলাচগুঁড়ো এক চামচ

ছানা, আটা, সুজি আর চিনি, হাতের তালু দিয়ে খুব ভালো করে মেখে ঠেসে নিতে হবে, যাতে বেশ নরম হয়ে সবটা মিশে যায়। তারপর ছোট ছোট গোল্লা বল পাকিয়ে সেটা হাত দিয়ে চ্যাপটা করে নিতে হবে। সবগুলো হয়ে গেলে, ছাঁকা তেলে বা ঘিয়ে ভেজে রেখে দিতে হবে। অন্য পাত্রে দুধ ঢিমে আঁচে ফুটিয়ে ফুটিয়ে রাবড়ি বানাতে হবে, সঙ্গে চিনি আর এলাচগুঁড়ো দিয়ে। তারপর বড়াগুলো দিয়ে দু’মিনিট ফোটালেই রেডি, জগন্নাথ দেবের প্রিয় মিষ্টি!

Chhena Pora sweets
ওডিশার বিখ্যাত মিষ্টি ছেনা পোড়া

ছেনা পোড়া

জনশ্রুতি এই যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নয়াগড় জেলায় এই মিষ্টি বানানো শুরু হয়। ছানা, চিনি, কাজু, কিসমিস দিয়ে শাল পাতায় ভাপানো এই মিষ্টি স্বাদে অতুলনীয়।

বানাতে লাগবে:

২৫০ গ্রাম ছানা
১২৫ গ্রাম চিনি (মানে যতটা ছানা তার অর্ধেক চিনি)
এক ছোট চামচ এলাচগুঁড়ো
এক বড়ো চামচ চালগুঁড়ো বা সুজি
কাজু, কিসমিস কুচি দু’ চা চামচ
ঘি: শালপাতা বা বেকিং ট্রে-তে মাখানোর জন্যে

ছানা, চিনি, চালগুঁড়ো, এলাচগুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে হাতে করে মাখতে হবে বহুক্ষণ, যাতে কেকের মতো ফাঁপা ব্যাটার টাইপ হয়ে যায়। খুব শক্ত লাগলে অল্প দুধ দেওয়া যেতে পারে। এই মাখার কাজটাই আসল। যত ফাঁপা হবে, তত ভালো টেস্ট হবে এই মিষ্টির।

তারপর, শালপাতায় (না পেলে কলাপাতা, বা ডাইরেক্ট বেকিং ট্রে-তে ) ঘি লাগিয়ে মিক্সচারটা ঢেলে দিয়ে বেক করা। ১৮০ °সেন্টিগ্রেডে এ ৩০-৪৫ মিনিট, যতক্ষণ না ওপরটা লালচে বাদামি হচ্ছে ভালোমতো। টাইমটা বারবার দেখে নজরে রাখতে হবে আর টুথপিক দিয়ে কেকের মতো ভেতরটা চেক করতে হবে। ওভেন না হলে কুকারেও করা যায় কেকের মতন করেই। তাহলে এবারের রথে, জগন্নাথের জন্যে দুটি মিষ্টি বানিয়ে আসেপাশের ছোট বড়ো, ধনী দরিদ্র, সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যাক প্রসাদ আর খুশি…

 

ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
ছাপ্পান্ন ভোগের ছবি: Internet

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *