রাধারমণ মিত্রের প্রধান পরিচয় বিশিষ্ট সাহিত্যিক তথা পুরনো কলকাতার ইতিহাস গবেষণা সংক্রান্ত হলেও তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম জীবনে গান্ধীর একনিষ্ঠ সমর্থক পরবর্তীকালে সেই মতাদর্শ থেকে সরে এসে জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনে।  পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছেন নিরলস গবেষণা ও লেখালিখির কাজ।  ১৮৯৭ সালে আজকের দিনটিতেই কলকাতার শ্যামবাজার এলাকার এক অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন রাধারমণ মিত্র। পড়াশোনা হিন্দু স্কুলে। ১৯১৫-তে স্বর্ণপদক নিয়ে আইএ পাশ করেন।  উচ্চশিক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

স্কুলে রাধারমণের সহপাঠী ছিলেন বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়।  আইএ পাশ করার পর বঙ্কিম ভর্তি হন প্রেসিডেন্সিতে। রাধারমণ চলে যান সেন্ট পলস কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে পড়তে বঙ্কিম আচমকাই ঠিক করেন,  উত্তরপ্রদেশে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে চলে যাবেন।  রাধারমণও বন্ধুর সঙ্গ নেন। এবং দু’জনেই ১৯২১-এ একসঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। উত্তরপ্রদেশের এটাওয়াতে সংগঠকের কাজ শুরু করেন রাধারমণ মিত্র। গ্রেফতার হন। মুক্ত হয়ে সাবরমতী আশ্রমে গিয়ে টানা বেশ কয়েকবছর সরাসরি গান্ধীজির আদর্শে তাঁরই সঙ্গে কাজ করেন। কিন্তু ক্রমশই মহাত্মার সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দিতে শুরু করে। কাজে উৎসাহ হারাতে থাকেন রাধারমণ।

এরপরই কলকাতায় ফিরে শিক্ষকতার কাজ নেন। ক্রমশ মার্কসবাদী দর্শনে আগ্রহী হয়ে পড়েন রাধারমণ। ততদিনে বন্ধু বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ও কলকাতায় এসে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন। পিছিয়ে থাকতে পারলেন না রাধারমণও। যদিও আমৃত্যু তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। নিজের সাম্যবাদী চেতনায়, বিশ্বাসে অটল থেকে দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকেই কাজ করে গিয়েছেন।

শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপকতায় শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকার দুটি বিল পাশ করে – শিল্পবিরোধ বিল, যাতে সবরকম ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এবং জননিরাপত্তা বিল, যাতে শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের উপরে কড়া দমননীতি প্রয়োগ করা যায়। এই দুই বিলকে হাতিয়ার করে শ্রমিক আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাকে ফাঁসানো হয় মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯২৯)। এস এ ডাঙ্গে, কে এন যোগলেকর, জি আর কামলে, মুজফফর আহমেদ, কিশোরীলাল ঘোষ, পি সি যোশি প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় রাধারমণ মিত্রকেও।  এই মামলা চলেছিল অনেকদিন। আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।

চল্লিশের দশকে মুক্তি পাওয়ার পরে সক্রিয় রাজনীতিতে সেভাবে আর জড়িয়ে পড়েননি রাধারমণ। বরং মনোনিবেশ করেন তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়, কলকাতার ইতিহাসে। ষাটের দশক থেকে নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় পুরনো কলকাতা নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন রাধারমণ বাবু। ১৯৭৫ সাল থেকে নিয়মিতভাবে এই পত্রিকায় ‘কলকাতার টুকিটাকি’ নামে একটি কলাম লিখতে শুরু করেন তিনি। তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে সেই ধারাবাহিক রচনা। পরে তাঁর এই সম্পর্কিত সমস্ত রচনা একত্রিত করে ১৯৮১ সালে ‘কলিকাতা দর্পণ’ দুই খণ্ডে পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়। এই গ্রন্থের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারও পান রাধারমণ মিত্র।

Kolikata Dorpon by Radharaman Mitra
দুই খণ্ডে কলিকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র রচিত কলকাতার ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থ


‘কলিকাতা’ নাম প্রসঙ্গে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতামত খণ্ডন করে নিজস্ব মত পেশ করেছিলেন রাধারমণবাবু যা পরে প্রামাণ্য বলে বিবেচিত হয়। এমনকী, ১৬৯০ সালে জোব চার্নক এসে কলকাতা নগরের পত্তন করেন, এই বহুল প্রচলিত ধারণাটিকেও নস্যাৎ করে দেন রাধারমণ মিত্র। তাঁর ‘কলকাতা বিচিত্রা’ গ্রন্থে তিনি তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখান যে জোব চার্ণক ১৬৯০-এর আগেও কলকাতায় এসেছিলেন এবং তিনি মোটেই কলকাতার আবিষ্কর্তা নন। কারণ তার ঢের আগে, ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে ‘কলিকাতা’-র উল্লেখ মেলে।  এমনকী মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যেও কলিকাতার নামোল্লেখ পাওয়া যায়।

কলকাতার ইতিহাস এবং উৎপত্তি নিয়ে রাধারমণের এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে মামলা মকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে তাঁর তত্ত্বকেই মান্যতা দেয় কলকাতা হাইকোর্ট।  তবে আদালতের রায়ের কারণে নয়, রাধারমণ মিত্রকে তাঁর মেধা, মননচর্চা, ইতিহাসচেতনা এবং পাণ্ডিত্যের জন্যই মনে রেখেছে আপামর বাঙালি। আজও তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী।

*ছবি সৌজন্য: Facebook 

তথ্যসূত্র: 

কলিকাতা দর্পণ প্রথম খণ্ড – রাধারমণ মিত্র
রাধারমণ মিত্রের প্রবন্ধ
পরিচয় পত্রিকা
আনন্দবাজার পত্রিকা

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

3 Responses

  1. এটোয়া পুরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন রাধারমণ মিত্র। এটোয়া টাউন হল-এর দেওয়ালে একটি পাথরের প্লেকে হিন্দিতে লেখা আছে। হাওড়া দিল্লি লাইনে এটোয়ার অবস্থান। তবে কোনো মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন থামে না। টুন্ডলা জংশনে নেমে প্রায় একশো কিলোমিটার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চড়ে যেতে হয়। এটোয়া চম্বল উপত্যকার অন্যতম প্রবেশ দ্বার। রাধারমণ মিত্র ১৯৮০তে রবীন্দ্র পুরস্কার এবং ১৯৮১তে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।

  2. শ্রদ্ধেয় রাধারমণ মিত্রর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে। পায়ে হেঁটে কলকাতার রাস্তাঘাট, অলিগলি, ঐতিহাসিক বাড়ি, দিঘি ইত্যাদি দেখা ও তার ইতিহাস জানা ও জানানোর আন্তরিক প্রচেষ্টার কিছু পরিচয় পেয়েছি।
    আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নির্লোভ মানুষ। বেহালার কাছে চার তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন। সরকারের পক্ষ থেকে একতল বা সুবিধাজনক ফ্ল্যাটের অনুরোধ গ্রহণ করেন নি।
    জন্মদিনে আপনার স্মরণ ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *