আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২]  [২৩] [২৪]

ক্ষমতাবান  অভিজাত  পরিবার   ছিল চন্দ্ররা।  তার  পক্ষে  অনেক  কিছু করাই  সম্ভব  ছিল। জেলার পুলিশ সুপার থেকে জেলা শাসক মহকুমা শাসক  সেই শহরে এলে তাঁদের বাড়ির আতিথ্য নিতেন। মিথ্যে অভিযোগে হাজতবাস করিয়ে শোধ নিয়েছিলেন চন্দ্র বাড়ির  মেধাবী যুবক। চাকরি  খেয়ে  নেবেন  সেই  ভয় দেখিয়েছিলেন। মঞ্জরীকে বলেছিলেন, শুভাননকে শেষ  করে  দিতে পারেন  তিনি।   কেরানির  সাধ  মিটিয়ে দেবেন।      

তখন জরুরি অবস্থা ছিল। আমলা পুলিশের হাতে সব ক্ষমতা। কেউ কিছু করতে পারেনি। বরং রটে গিয়েছিল, মঞ্জরী প্রত্যাখ্যান করেছিল শুভাননকে  তার  হাজতবাসের পর।  শহরে  মঞ্জরী  এবং চন্দ্র বাড়ির মেধাবী যুবকের প্রেম নিয় কথা রটে   গিয়েছিল। রটিয়ে দিয়েছিলেন চঞ্চলই।  সাধারণ মানুষ  এটা  পছন্দ  করেনি।   মঞ্জরী  বহুগামিনী এই  কুৎসায় কান পাতা যাচ্ছিল না। মঞ্জরীকে বিবাহর প্রস্তাব দিয়েছিল সেই সময় চঞ্চল। মঞ্জরী আবার প্রত্যাখ্যান করে। এবং তার বাবা শহর ত্যাগ করেন বাধ্য হয়ে। তারপর কী হয়েছিল জানা ছিল না চঞ্চলের। সে তখন মুসৌরির ট্রেনিং সেন্টারে। 

জেরুজালেমে  কি আপনি মঞ্জরীকে  খুঁজে  পেয়েছিলেন ?  জিজ্ঞেস করেছিলেন সুমিতাভ। 

সুমিতাভর প্রশ্নে আমি  অবাক। তা হয় নাকি ? জেরুজালেমে খুঁজে পাবে কী করে?  সে তো পুরোন দিনের কাহিনি হয়ে যায়। একশো বছর আগের গল্প। ঘটনাপুঞ্জ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে না। জীবন স্বাভাবিক। জীবন নদীর মতো, বাঁক নেয়, পাড় ভাঙে, আবার  ধীরে বহে যায়। 

চঞ্চলচন্দ্র  মৃদু গলায়  বলছিলেন, “আল-ফারিবা হোটেলে সারাদিন  বন্দি হয়ে  পাগলের মতো মঞ্জরীকে খুঁজেছিলাম ল্যাপটপে, সেই ৭৬-৭৭ সালের পর আমাদের আর দেখা হয়নি, তাকে আমি ভাঙতে পারিনি।  কিছুতেই না।   কতদিন আগের কথা এসব। একটি  কুড়ি একুশের মেয়ের যে এত তেজ হতে পারে ভাবিনি।  তারপর আমি আর দেখিনি তাকে, আর দেখিনি, আর দেখিনি।”  

চল্লিশ বছর কেন পঞ্চাশ বছরের বেশি  আমিও দেখিনি শ্যামাশ্রীকে। মাস পড়লেই চঞ্চলচন্দ্র  চলে যাবেন নতুন ফ্ল্যাটে। নীলমাধব  বসন্ত মল্লিকের মেয়েকে নিয়ে দেহরাদুন গেছে। ফুর্তির শেষ নেই। তার যৌবন নাকি নতুন করে জেগেছে। শুধু পয়সা খরচ করতে হয়। 

চঞ্চলচন্দ্রর ভাষ্যে  আবদাল্লা  তাঁর ভগবান, আশ্রয়হীন সহায়হীন ভগবান, ভগবানের কিছুই নেই,  মেডিক্লেইম, সরকারী স্বাস্থ্য বীমা,  জমানো টাকা, পেনশন, সুদ……কিছুই না। তাঁকে এক সময় ভগবান বাঁচিয়েছেন। বেঁচে থাকার কথা ছিল না। সামনের বাস গ্রেনেডে উড়ে গেছে, তাঁদেরটা বেঁচে গেছে। নিউ ইয়র্কে ছিলেন এগারই সেপ্টেমবর, দু’হাজার এক তারিখে, কত মানুষ নিহত হয়েছিল, তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন, বেরবার কথা ছিল, কিন্তু  আচমকা শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কারণ ছাড়াই, তাঁর তো ঐ টাওয়ারেই যাওয়ার কথা ছিল, সব মনে পড়ে…, “পৃথিবীতে কত মানুষ প্রত্যেকদিন মারা যাচ্ছে অকালে, বোমায়, গুলিতে, বিস্ফোরণে, আমি বেঁচে আছি কারণ ওই ভিখিরি হয়ে যাওয়া আবদাল্লা, মায় গড, মঞ্জরী এই কথা বলে।”  

সুমিতাভর প্রশ্নে আমি  অবাক। তা হয় নাকি ? জেরুজালেমে খুঁজে পাবে কী করে?  সে তো পুরোন দিনের কাহিনি হয়ে যায়। একশো বছর আগের গল্প। ঘটনাপুঞ্জ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে না। জীবন স্বাভাবিক। জীবন নদীর মতো, বাঁক নেয়, পাড় ভাঙে, আবার  ধীরে বহে যায়। 

তাঁর সঙ্গে কথা হয় ? সুমিতাভ জিজ্ঞেস করেছিলেন। 

কথাটা এড়িয়ে গিয়ে চঞ্চলচন্দ্র বলেছিলেন,  ঈশ্বর করুণাময়, তিনি  সব সময়ই ক্রুশ বিদ্ধ, তাঁর কিছুই নেই, সহায় সম্বল কিছুই নেই মশায়। বলতে বলতে তিনি  চশমা খুলে চোখ মুছলেন, বিষণ্ণ মুখে  হাসলেন।  

চঞ্চলচন্দ্রের কথা শুনে  তাঁর ফ্ল্যাট থেকে সেদিন বেরিয়ে এসে সুমিতাভ বলেছিলেন, বাড়ি ফিরবেন তিনি।

এখনই, চলুন পার্কের দিকে যাই, কী সুন্দর সন্ধ্যা, আজ মনে হয় পূর্ণিমা। আমি সুমিতাভকে বলেছিলাম।   

সুমিতাভ মাথা নেড়েছিলেন, বলেছিলেন, না,  তাঁর ভিতরে লেখা  এসে গেছে, ফিরতেই হবে।

সুমিতাভ চলে গিয়েছিলেন। লেখা  কি এই ভাবে আসে? একেই বলে শূন্য থেকে আসা ?  জানি না। তখন আমার নিজেকে খুব শূন্য মনে হচ্ছিল। শ্যামাশ্রী কি নীলমাধবের সঙ্গে দেহরাদুনে? বুক ভেঙে যাচ্ছিল।  আমি তো শ্যামাশ্রীর ঐ বয়সটাই জানি। আমি শূন্য মনে বাড়ি ফিরেছিলাম। জুড়ানকে ফোন  করলাম, ও জুড়ান, কেমন আছে তোমার বউ ?

জুড়ান বলল,  বিষ বিষ ঢুকেছে অনুতোষ, আমার কথায় নাকি…অনুতোষ  আমি মসলন্দপুর গিয়েছিলাম। অন্যকথা  শুনে  এলাম, কী  আশ্চর্য   অনুতোষ,   বসন্ত  মল্লিক সত্যিই যেন বসন্ত, লেখার পরও  আমার   বিশ্বাস  হয়নি   অনুতোষ, আমি  বানিয়ে  লিখেছিলাম, কিন্তু তা  সত্য   হলেও  হতে  পারে  অনুতোষ।

জুড়ানের  কথায়  জানলাম, যেতে যেতেও যায়নি  মল্লিকরা। বিরাম ঠাকুরের উৎসব থেকে ফিরে  মেয়েটার ভিতরে পরিবর্তন এসেছে। কেন তা সে নিজেই জানে। শুনতে  শুনতে   অনুতোষ   মানে  আমার   মনে হলো   আমাকে চিনতে পেরেছিল শ্যামাশ্রী। তার মনে পড়ে গেছে পঞ্চাশ বছরেরও  আগের কথা। এমন কি হতে পারে ?  ক্ষুধিত পাষাণ গল্পের সেই ধ্বংসস্তূপের  মতো বেঁচে আছি আমি। আমার গায়ে লেগে আছে কত সুখস্মৃতি।  আমার জীবন নদীর ওপারে, এসে দাঁড়ায়ও দাঁড়ায়ও  বধূ হে…।  আমার গায়ে সেই  ৫০ বছর আগের গন্ধ পেয়েছিল শ্যামাশ্রী।  আমাকে দেখে তার মনে পড়ে গিয়েছিল, আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ চিনি না। সেই রেডিও পার্ক থেকে ফিরতে ফিরতে ভ্রমর নয়, শ্যামাশ্রী বলেছিল, সে চলে যাচ্ছে স্যানেটোরিয়ামে, ফিরবে না। ফিরে তো এল।  মনে পড়ে যেতে সে পালোধীকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে মসলন্দপুর। চঞ্চলচন্দ্রর মঞ্জরী যেমন।  চলে গিয়েছিল সেই শহর পরিত্যাগ করে।   

 জুড়ান  বলছিল, “পালোধী খুব চেষ্টা করছে মেয়েটাকে তাঁবে আনতে, বসন্ত অভাবী মানুষ, লোভীও আছে, মাধব তাকে  লোভ দেখাচ্ছে, কিন্তু  মেয়েটা গান ভালোবাসে, গানের জন্য সে মেশে পালোধীর সঙ্গে,  গানের ইস্কুলের নাম কী হবে অনুতোষ, গানের ইস্কুলের জন্য টাকা দেবে বলেছিল পালোধী,  কিন্তু পরে বলেছে কলকাতায় ফারনিশড ফ্ল্যাট, গাড়ি দিচ্ছে,  মাস গেলে বেতন দেবে,  কিন্তু  মসলন্দপুরে গানের ইস্কুল হোক তা সে চায় না, পালোধী ওকে কেপ্ট  করে রাখতে চায়, সে  না বলেছে।” 

আবার মনে হলো চঞ্চলচন্দ্রর মঞ্জরী।  শ্যামাশ্রী মঞ্জরী একাকার হয়ে গেল। 

জুড়ান  বলছে, “আমি বলেছি আমার বন্ধু দেবে, তুমি দাও অনুতোষ, একটা ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙো, যা মন চাইবে দাও অনুতোষ, তোমার অনেক আছে, দেবে তো অনুতোষ ?”

আমি চুপ করে থাকলাম। শিহরিত হলাম,  বললাম, “পালোধী হেরে গেল ?” 

ইয়েস অনুতোষ, হেরে গেল, কাকে ভাড়া করে নিয়ে গেছে সে ও জানে, যাকগে, বসন্ত মল্লিককে আমি বলেছি আমার বন্ধু আসবে, সে ইস্কুলে সাহায্য করবে, কিন্তু সে পালোধী নয়,  সে এমনি করবে, এমনি। 

আমি যাব? জিজ্ঞেস করলাম কাঁপতে কাঁপতে। 

“হ্যাঁ অনুতোষ, একটা সুযোগ এসেছে পালোধীর মুখোস খুলে দেওয়ার, দেখ এবার পালোধীর সব জানা  যাবে, বসন্ত মল্লিকই বলবে।”  জুড়ান বলল, “বসির বসন্ত হতেই  পালোধীর সংস্পর্শ  ত্যাগ করল। পালোধীর সঙ্গে থাকলে সে রাজাকার বসির মল্লিক হয়েই থাকত বসন্ত, কিন্তু পালোধীরা তাই রয়ে গেল, আমি বিপিন রায়ের ছেলে, রাখির দাদা, আমি  শত জন্মেও ভুলব না অনুতোষ, শাস্তি ওদের পেতেই হবে,  মুজিব হত্যাকারী ধরা তো পড়ল, হাবড়ার ডাক্তার না মরে গেলে ধরা পড়তই।” 

“তাহলে আমাকে খবর দিও, আমি আর সুজাতা যাব শ্যামাশ্রীর গান শুনতে।”  আমি মৃদু স্বরে বললাম।

“হ্যাঁ, ওর অনেক নাম, শ্যামলীর চেয়ে শ্যামাশ্রী নাম ভালো।”  জুড়ান বলল। 

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কবে নিয়ে যায় জুড়ান। জুড়ান  একদিন ভোরে ফোন করে বলল, “অনুতোষ, সে নেই।”

“কে নেই ?”  আমার বুক কেঁপে উঠল। 

জুড়ান বলল, “লিপিকা, সময় দিল না, আমার বিষে ও চলে গেল অনুতোষ, তোমার টাকা আমি ফিরিয়ে দেব।” 

“কী বলছ জুড়ান, এসব বলার সময় এখন?” 

“কখন কী বলতে হয় তা কি আমি জানি অনুতোষ, তাহলে তো জীবনই বদলে যেত, নীলাম্বর মোল্লা আমাকে কর্পোরেশনে  ঢুকিয়ে দেবে বলেছিল, আমি থু করেছিলাম, আমার চেন পিয়নের চাকরি খেয়ে নেবে ভয় দেখিয়েছিল, পারেনি, আমি পালোধীদের ছাড়ব না।” 

আমি বললাম, “ জুড়ান ক্ষমা করে দাও, ভুলে যাও।”

জুড়ান বলল,” ক্ষমা, কিসের ক্ষমা, আমার বাবা কত কষ্ট পেয়েছিল রাখি দুহাতে মুখ ঢেকে  প্রায় সারারাত  বসে থাকায়, মেয়েটা কাঁদছিল, চোখের জলের শেষ নেই অনুতোষ, আমার ভিতরে সেই যে আগুন জ্বলেছিল, নিভছে না, নিভবে না।”

“থাক জুড়ান, তোমার বউ চলে গেল, তুমি শান্ত হও”।

“লিপি যদি আমার বিষে  চলে গিয়ে থাকে, সেই বিষ শেষ হয়ে  গেছে অনুতোষ, বসন্ত মল্লিককে আমি তো ভালোবেসেছিরে, ফেসবুকে  মেয়েটা আমার বন্ধু হয়েছে, তাকে আমি বলে দিয়েছি  নীলমাধব আসলে কে,  সে বলেছে  পালোধী  রাজাকার, লুটেরা তাকে বেড শেয়ার করতে বলেছিল, তাহলে সে টাকা দেবে গানের ইস্কুলে, টিভিতে নিয়ে যাবে, টিভির বড় কর্তা তার চেনা, একা যেতে বলেছিল দেহরাদুন, অনুতোষ, এই বিষ যাবে না, আগের বিষ নেই, এই বিষে হয়ত আমি মরব, তার আগে পালোধীর স্বরূপ প্রকাশ করে দিয়ে যাব।” 

কথা বলতে বলতে ফোন কেটে দিল অনুতোষ। আমি লিখব বলে কাগজ  কিনে আনলাম। ভাল বলপেন।  কত দিন চেক বইয়ে  স্বাক্ষর  করা ব্যতীত  লিখিইনি কিছু।  আমি মঞ্জরী শ্যামাশ্রীকে এক জায়গায় মেলাতে চেষ্টা  করছিলাম। আমার তো অভ্যাস নেই। আমার কি হবে?  হবে অনুতোষ হবে। আমার গান  কানের ভিতরে বাজিয়ে রেখ অনুতোষ। আমি তরীটি বাহিয়া আসব, তুমি চরণখানি বাড়ায়ো হে…।  কয়েকদিন বাদেই আবার ফোন, অনুতোষ তুমি কি যাবে মসলন্দপুর ?

সুজাতা যাবে বলল প্রথমে, তারপর বলল, ওই পাগল যাবে, সে যাবে না।

জুড়ান যে ক’দিন এসেছে বাড়িতে  সুজাতা সব লক্ষ্য করেছে। তার মনে হয়েছে  ওর ভিতরে উন্মাদের ভাব আছে, মুখের আগল নেই।  ওর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া যায় না। সুজাতা জানে না, ঐ ভাব তার স্বামী অনুতোষের  ভিতর এসেছে। সে শ্যামাশ্রীর খোঁজে  যাবে মসলন্দপুর। 

আমরা চললাম মসলন্দপুর। বনগাঁ লোকাল ধরে।  মনে পড়ে শ্যামাশ্রী, মনে পড়ে। তোমার গানের ইস্কুল নিয়ে ফিরে এলে তুমি শেষ পর্যন্ত। 

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *