প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২]

(৩৯)

গোল্ডস্টাইন ম্যানসন থেকে ফিরে আসা ইস্তক রণোর মধ্যে একটা টালমাটাল চলছে৷ ও নিজেকে এতদিন একজন চৌখস, যুক্তিবাদী মানুষ বলেই জানত যে কোনও জটিল সমস্যার সহজ সমাধান করতে পারে৷ পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠলেও ও যুক্তিপূর্ণ সঠিক সমাধান করতে পারে, এই রকম একটা আত্মপ্রত্যয়ের বুদ্বুদের মধ্যে এতকাল বাস করত ও৷ কিন্তু সীমন্তিনীর জীবনের পুরো গল্পটা শোনার পর ওর আত্মপ্রত্যয়ের জায়গাটা ভীষণভাবে নড়ে গেছে৷ ওর মধ্যে এই পরিবর্তন, এই দোলাচলের ব্যাপারটা রোহিণীর চোখ এড়ায়নি৷ যে রণোকে ও দশ বছরেরও বেশি ঘনিষ্টভাবে জানে, যে সুপারকনফিডেন্ট, সহজ এবং ইজি গোয়িং, তার মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা, বিপন্নতা আর অসহায়তা লক্ষ করে খুব মায়া হচ্ছিল রোহিণীর৷ কয়েকটা দিন ও রণোকে একটু নিজের মতো করে যুঝতে দিচ্ছে৷ পরিস্থিতিকে বোঝার শক্তি রণোর মারাত্মক৷ রেজিলিয়েন্স ব্যাপারটা ওর সহজাত৷ যে সত্য ওর সামনে এসেছে, তাকে গ্রহণ করা, স্বীকার করার শক্তি রণো নিজের ভিতর থেকেই পাবে, এ ব্যাপারে রোহিণীর কোনও সংশয় নেই৷

কাজকর্ম, অফিসের ফাঁকে ফাঁকে বৃন্দার বলা অতীতটা হানা দিয়ে যাচ্ছে রণোর মধ্যে৷ নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে ওর শৈশব, কৈশোর, মাম্মার মা বাবাই-এর সম্পর্ক, মাম্মার ভালনারেবিলিটি, সব কিছু আবার নতুন পাওয়া সত্যের ভিত্তিতে রিভিজিট করার চেষ্টা করছে রণো এই কয়েকটা দিন৷ ইনফ্যাক্ট ও কখনও এসব তলিয়ে দেখেনি৷ রণোর কাছে ওর মা বাবা এবং ছোট্ট পারিবারিক বৃত্ত ছিল স্বতঃসিদ্ধের মতো৷ নিজে বরাবরই মেধাবী ছাত্র ছিল৷ ম্যাগনেট স্কুলে যাওয়া, ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া, পিয়ানো বাজানো, জাগলিং, ম্যাজিক— সব কিছুই যেমন সহজাত প্রতিভার কারণে ওর কাছে ভীষণ সহজ ঘটনা ছিল, পারিবারিক সম্পর্কগুলো তেমনই খুব স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিল রণো৷ ওর দাদু জ্যোতির্ময় নামকরা আর্কিটেক্ট, দিদান অরুণলেখা বড় হয়েছেন শান্তিনিকেতনে, বাবাই প্রফেশনালি খুব সাকসেসফুল নিউরো-সার্জেন, মাম্মা কলকাতায় বড় হলেও বাইশ বছর বয়েসে বাবাই-এর সঙ্গে দেখা হবার পর বিয়ে করে চলে এসেছিল আমেরিকা৷ পুরোটাই খুব নিটোল স্মুদ সেলিং একটা গল্প, এরকম ধরে নিয়েই বড় হয়েছে রণো৷ মাম্মা ওকে সমস্ত বিপন্নতা থেকে ঢেকে রেখেছে চিরকাল৷ কখনও আভাস দেয়নি নিজের জীবনে যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছিল সে সম্পর্কে৷ রণোও নিজের অভ্যস্ত চৌহদ্দিতে বুঁদ হয়ে ছিল। কখনও ভাবেনি আশপাশের আরও অনেক নারী পুরুষের মতো সীমন্তিনী আর অরুণাভও জীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা, ভালো-মন্দে ভরা দুজন রক্তমাংসের মানব-মানবী৷

রণোর কাছে ওর মা বাবা এবং ছোট্ট পারিবারিক বৃত্ত ছিল স্বতঃসিদ্ধের মতো৷ নিজে বরাবরই মেধাবী ছাত্র ছিল৷ ম্যাগনেট স্কুলে যাওয়া, ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া, পিয়ানো বাজানো, জাগলিং, ম্যাজিক- সব কিছুই যেমন সহজাত প্রতিভার কারণে ওর কাছে ভীষণ সহজ ঘটনা ছিল, পারিবারিক সম্পর্কগুলো তেমনই খুব স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিল রণো৷ ওর দাদু জ্যোতির্ময় নামকরা আর্কিটেক্ট, দিদান অরুণলেখা বড় হয়েছেন শান্তিনিকেতনে, বাবাই প্রফেশনালি খুব সাকসেসফুল নিউরো-সার্জেন, মাম্মা কলকাতায় বড় হলেও বাইশ বছর বয়েসে বাবাই-এর সঙ্গে দেখা হবার পর বিয়ে করে চলে এসেছিল আমেরিকা৷ পুরোটাই খুব নিটোল স্মুদ সেলিং একটা গল্প, এরকম ধরে নিয়েই বড় হয়েছে রণো৷

রণো হঠাৎ খুব অপরাধবোধে ভুগছে যে ও নিজের জীবনে এত সাকসেসফুল হয়েও কোনও দিন ওর মায়ের মনটাকে তলিয়ে বোঝার চেষ্টাই করেনি৷ সম্পর্কের মধ্যেও যে অনেক জটিলতা থাকে, মানুষের সামনের চকচকে গল্পটার আড়ালেও যে একটা নিভৃত গল্প থাকে, সে সম্পর্কে প্রথম রোহিণীই ওকে সচেতন করে৷ রোহিণী যে ওর পরিবারের গল্পটা খুঁজে বার করছে, সেজন্য রোহিণীর কাছে অদ্ভুত একটা কৃতজ্ঞতা বোধ করল রণো৷ বৃন্দার গল্পটা শোনার পর থেকে রণোর নিজের মধ্যে নতুন করে একটা কৌতূহল জাগছে ওর পরিবারের হারানো মানুষগুলোর বিষয়ে৷ নিজের মধ্যে একটা দায় বোধ করছে রণো, অর্ধশতাব্দী কি আরও বেশি আগে ঘটে যাওয়া কতগুলো জীবনের গল্পকে আবার নতুনভাবে বুঝতে৷

দুদিন আগে হঠাৎ সবকিছু পাল্টে গেছিল৷ জীবনের নগ্ন বাস্তবরূপ ধরা পড়ল ওর চোখে৷ একটা আশ্চর্য রাত ছিল সেদিন৷ জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছিল চারপাশটা৷ দূরে গোল্ডেন গেট ব্রিজের দিকে তাকিয়ে বৃন্দা বলছিলেন একটা অদ্ভুত গল্প, যা মাম্মার জীবনেরও একটা টুকরো৷ মাম্মার মায়ের একটা ছবি দেখিয়েছিলেন উনি৷ অল্পবয়েসের ছবি৷ ভদ্রমহিলা যে কি অপূর্ব সুন্দরী, তা পুরনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবিটা থেকেও মালুম হচ্ছিল৷

thoughtful Man
কাজকর্ম, অফিসের ফাঁকে ফাঁকে বৃন্দার বলা অতীতটা হানা দিয়ে যাচ্ছে রণোর মধ্যে

বড় হবার সময় রণোর জীবনে মাম্মার মা-বাবার কোনও গুরুত্ব ছিল না৷ ওর জন্মের আগে মাম্মার বাবা মারা গেছেন৷ আর মাম্মার মা আরও অনেক আগে মাম্মার শিশু বয়েসে৷ অন্ততঃ রণোকে সেরকমই বোঝানো হয়েছিল৷ বৃন্দার মুখে পুরো ঘটনা শুনে রণোর একটা অদ্ভুত কৌতূহল তৈরি হল মাম্মার বাবা লোকটা কেমন ছিল জানতে, যার সুন্দরী বউ অন্য আরেকজনের আকর্ষণে স্বামী আর দুবছরের মেয়েকে ফেলে অন্য সংসারে গেল সুখ খুঁজতে৷ লোকটা স্ত্রীর স্বাধীন ইচ্ছেয় বাধা দিল না৷ পঞ্চাশ বছর আগের পক্ষে যথেষ্টরও বেশি আধুনিক ছিল লোকটা৷ তবে একটা শর্ত দিল৷ দু’বছরের শিশু মেয়েকে নিয়ে যেতে দিল না স্ত্রীর সঙ্গে৷ ওটাই শাস্তি! গতকাল সন্ধেবেলা এটাই ভাবছিল ও বাড়িতে ফিরে৷ রোহিণী কী সব কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে৷ ও জানে রণোর ভিতরে অনেকরকম উথালপাতাল চলছে৷ রণো একটা ঘোরের মধ্যে আছে৷ ওর স্মুথ সেলিং জীবনে একটা আকস্মিক সত্যের উদ্ভাসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে ওর মনে৷ রণোর ভাবনায় কোনও বাধা দিতে চায়নি রোহিণী৷ হঠাৎ রণোই মুখ তুলে প্রশ্ন করল— ‘ডু ইউ থিংক, ইট ওয়াজ আ পানিশমেন্ট মেটেড আউট ফর হিস ওয়াইফ ওয়েন হি কেপট দ্য ডটার ট্যু হিমসেলফ?’ হি বলতে যে মাম্মার বাবা অম্বিকাচরণ রায়ের কথাই বলছে ও, বুঝতে দেরি হয়নি রোহিণীর৷ ও ঘাড় নাড়ছে— না, আমি ওভাবে দেখি না ব্যাপারটা৷ বরং মাম্মার বাবা নিজেই বোধহয় ভিকটিম৷ উনি এবং মাম্মা৷ ওদের তো দোষ ছিল না— এই পুরো ঘটনাটার জন্য৷ কিন্তু গোটা ব্যাপারটা, মানে মাম্মার মার অন্য আরেকজনের সঙ্গে প্রেম, এক্সট্রাম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের জেরে প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়া— এই পুরো ব্যাপারটাই তো ফেট অ্যাকমপ্লি হিসেবে এসেছিল মাম্মার বাবার কাছে৷ উনি তো আপত্তি করতে পারতেন? অ্যাবর্ট করতে বলতে পারতেন৷ উনি কিন্তু স্ত্রীকে জোর করেননি৷ শুধু মেয়েকে ছেড়ে দেননি৷ মাম্মাও যদি মা’র সঙ্গে চলে যেত, তাহলে কী নিয়ে থাকতেন মাম্মার বাবা? ওঁর তো আর আঁকড়ে ধরার কিছু ছিল না৷’ রোহিণী বলতে থাকে— ‘মাম্মার মার চলে যাওয়াটা কিন্তু অদ্ভুত হার্টলেস৷’ শুধু স্বামী নয়, বাচ্চা মেয়েটার প্রতিও অদ্ভুত ইনসেনসিটিভ একটা স্টেপ৷

রণোরও মনে হয় এটা এমন একটা ঘটনা যা সারা জীবনের জন্য দাগ রেখে গেল ফেলে যাওয়া দুটো মানুষের মনে৷ যখন মাম্মা সত্যিটা জানতে পারল, তখন কী অদ্ভুত অসহায় লেগেছিল মাম্মার! সারা জীবন মাম্মা একটা রিজেকশনকে, একটা ফাঁপা শূন্যতাকে বয়ে বেড়ায় তার মার একটা নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের জন্য৷ হঠাৎ রণোর খুব রাগ হয় ওর না দেখা দিদিমার উপর৷ ভদ্রমহিলার অনুপস্থিতি একটা প্রলম্বিত ছায়া ফেলে গেছে মাম্মার মনের উপর৷ অথচ আয়রনি এই যে— যে অলীক সুখের জন্য নিশ্চিন্ত মায়াভরা একটা সংসার ছেড়ে গেল সে, সেই সুখও তার ভাগ্যে ছিল না৷ 

মদ্যপ অত্যাচারী স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ নিয়ে সে একা সিঙ্গল পেরেন্ট হিসেবে মানুষ করল আরেক মেয়েকে৷ সেই মেয়ের মধ্যেও অন্য মহাদেশে ফেলে আসা মেয়ের ছায়া খুঁজত সে৷ তাই হয়ত দুই মেয়ের নামেও এত মিল!

রণোর মনে হল বাবাই মাম্মাকে সীমোন বলে ডাকে৷ মাম্মা জানে না এদেশটার পশ্চিম দিকে অন্য আরেকজন সিমোন আছে, যে ভারতবর্ষ নয়, কিন্তু অন্য একটা মহাদেশ থেকে ভাসতে ভাসতে ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছে৷ সিমোন মাম্মার নিজের বোন৷ একই মায়ের রক্ত বইছে ওদের ধমনিতে৷ অথচ ওরা পরস্পরকে চেনে না৷ সিমোন তাও জানে ওর একজন স্টেপসিস্টার আছে৷ কিন্তু মাম্মা জানেই না যে তার একজন বোন আছে৷

হঠাৎ রণোর খুব রাগ হয় ওর না দেখা দিদিমার উপর৷ ভদ্রমহিলার অনুপস্থিতি একটা প্রলম্বিত ছায়া ফেলে গেছে মাম্মার মনের উপর৷ অথচ আয়রনি এই যে— যে অলীক সুখের জন্য নিশ্চিন্ত মায়াভরা একটা সংসার ছেড়ে গেল সে, সেই সুখও তার ভাগ্যে ছিল না৷ 

রণোর মনে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে। মাম্মা কি ছোট থেকেই জানত যে তার মা ওদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে, নাকি বড় হওয়ার পর কেউ বলেছিল মাম্মাকে এই নির্মম সত্যিটা? মাম্মার বাবা, নাকি বাবাই? বৃন্দা বললেন— উনি অনেকদিন ধরে চিনতেন বাবাইদের সবাইকে৷ রোহিণীও দাদাই-এর খাতায় বৃন্দার কথা পড়েছে, আগেই বলেছিল ও৷ বৃন্দা সেদিন বললেন উনিই বাবাইকে ইন্ডিয়াতে যেতে বলেন৷ মাম্মাদের কলকাতার বাড়ির ঠিকানাও উনিই দিয়েছিলেন বাবাইকে৷ আর মাম্মার মা’র জীবনের আসল গল্পটা উনিই বলেছিলেন বাবাইকে৷ বাবাই আর মাম্মার বিয়ের পর বৃন্দা ভেবেছিলেন এবার হয়ত সীমন্তিনী সব অভিমান ভেঙে আবার যোগাযোগ করবে ওঁর সঙ্গে৷ ‘ওর মা, যে ওকে ফেলে চলে গেছে, তারই তো বোন আমি৷ তাই হয়তো আমার প্রতিও ওর কোনও অস্বস্তি বা অভিমান তৈরি হয়েছিল,’ বৃন্দা বলছিলেন— ‘ওর বাবা, আমার জামাইবাবু অম্বিকাদা দিদি চলে যাবার পর আমার সঙ্গেও আর যোগাযোগ রাখেননি৷ হয়তো ভয় পেয়েছিলেন মেয়েকে প্রোটেক্ট করার জন্য যে নিটোল গল্প সাজিয়েছিলেন দিদি মারা গেছে বলে, তাতে আমি চিড় ধরাব ভেবে৷ সীমন্তিনী তাই আমাকে চিনত না। ওর মা’র মতো মাসিরও কোনও অস্তিত্ব ছিল না ওর কাছে৷’ রণোর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে৷ বিয়ের পরও মাম্মা বৃন্দার সঙ্গে সম্পর্ক রিভাইভ করার চেষ্টা করেনি, কারণ তাহলে মাম্মার শ্বশুরবাড়িতে সবাইকে জানাতে হত বৃন্দা ওর মাসি৷ তাহলে মাম্মার মা’র গল্পটাও সামনে চলে আসত৷ সারফেস করত৷ মাম্মা সেটা হতে দিতে চায়নি৷ নিজের গোপন দুঃখটুকু বুকের মধ্যে সাবধানে রেখে দিয়েছে যত্ন করে। সারা পৃথিবীর কাছে, বাইরের লোকের কাছে হাট করে মেলে দিতে চায়নি৷ সবাই হয়তো বাঁকা কথা বলত, হাসি-ঠাট্টা করত এই নিয়ে৷ মাম্মা সমস্ত দুনিয়ার বিদ্রুপ থেকে ঢেকে রেখেছে তার মা’র এই সিক্রেটটুকু, হয়ত নিজেও আর খুঁড়ে খুঁড়ে বের করতে চায়নি পরে তার মায়ের কী হয়েছিল৷ রণোর মনে পড়ল ওর ছোটবেলায় মাম্মার চোখ দিয়ে মাঝে মাঝে জল পড়ত৷ ‘মাম্মা, আর ইউ ক্রাইং?’ রণো প্রশ্ন করত অবোধ চোখ মেলে৷ মাম্মার নিজের তখন উনত্রিশ কি ত্রিশ, এখন রণো যে বয়সে দাঁড়িয়েছে৷ মাম্মা কিছুতেই স্বীকার করত না যে কোনও কারণে মাম্মার কষ্ট হয়েছে৷ কান্নাগুলোকে গিলে নিতো৷ ভিতরে কান্না জমতে জমতে একসময় শান্ত পাথরের মূর্তির মত হয়ে গেল মাম্মা৷

Drunk man
মদ্যপ অত্যাচারী স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ নিয়ে সে একা সিঙ্গল পেরেন্ট হিসেবে মানুষ করল অন্য মেয়েকে

রণো ততদিনে হাইস্কুলে৷ কখনও খেয়াল করে দেখেনি, এখন হঠাৎ রণো বুঝতে পারল সেই সময় থেকেই কান্নাগুলো ভিতরে সংহত করতে করতে সীমন্তিনী একটা বিপজ্জনক খাদের কিনারায় চলে গেল৷ গভীর বিষণ্ণতা, ডিপ্রেশন বাড়তে লাগল বল্গাহীন৷ তখন থেকেই মাঝে মাঝে অভিযোগ ছিল সীমন্তিনীর— রণো দূরে সরে যাচ্ছে৷ রণোর আর সেরকম সময় নেই মাম্মার জন্য৷ প্রথম প্রথম বলত মাঝে মাঝে, তারপর আর বলতও না৷ মাম্মা বুঝতে পারত ছেলে বড় হয়ে গেছে৷ তার জীবনটা আলাদা খাতে বইছে৷ সেই জীবন আর সীমন্তিনীর জীবন একসঙ্গে মিলবে না৷ রণোর হঠাৎ মনে পড়ল একটা দিনের কথা৷ ওর দিদান অরুণলেখা কী যেন একটা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘বাপের বাড়ি’ কথাটা বলেছিলেন৷ আমার বাপের বাড়িতে পুজোর পাট ছিল না, এইরকম কিছু৷ রণো তখন দশ এগারো বছরের৷ ও দিদানের কথার মাঝখানে জিজ্ঞেস করেছিল ‘বাপের বাড়ি’ কী? শুনেছিল মেয়েদের বিয়ের আগে বাবা-মার সঙ্গে যে থাকাটা সেটাই ‘বাপের বাড়ি’, আর বিয়ের পরে ‘শ্বশুর বাড়ি৷’ 

অবাক রণো জিজ্ঞেস করেছিল সীমন্তিনীকে— ‘মাম্মা, ডু ইউ হ্যাভ বাপের বাড়ি?’

সীমন্তিনীর ম্লান হাসিটা খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে রণোর, প্রায় কুড়ি বছর পরে৷ বিষণ্ণ হেসে সীমন্তিনী বলেছিল, ‘বিয়ের পরেই যার বাবা মরে যায়, তার আর বাপের বাড়ি কী করে থাকবে? আমার তো মা ছিল না। বাবাও থাকল না। আমার তাই বাপের বাড়ি নেই৷ আমার শুধু নিজের এই বাড়িটা আছে৷

মাম্মা বুঝতে পারত ছেলে বড় হয়ে গেছে৷ তার জীবনটা আলাদা খাতে বইছে৷ সেই জীবন আর সীমন্তিনীর জীবন একসঙ্গে মিলবে না৷ রণোর হঠাৎ মনে পড়ল একটা দিনের কথা৷ ওর দিদান অরুণলেখা কী যেন একটা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘বাপের বাড়ি’ কথাটা বলেছিলেন৷ আমার বাপের বাড়িতে পুজোর পাট ছিল না, এইরকম কিছু৷ রণো তখন দশ এগারো বছরের৷ ও দিদানের কথার মাঝখানে জিজ্ঞেস করেছিল ‘বাপের বাড়ি’ কী?

‘নিজের বাড়িতে কারা থাকে মাম্মা?’ রণো তাও হাল ছাড়েনি৷

‘নিজের বাড়িতে নিজের লোকেরা থাকে৷ তুমি, বাবাই তোমরাই তো আমার নিজের লোক৷’

‘আর দাদাই, দিদান?’

‘তাঁরাও আমার নিজের। তবে বাবাই আর তুমি আমার সবচেয়ে বেশি নিজের লোক৷’

‘আমি যখন বড় হব, উইল আই হ্যাভ আ নিজের বাড়ি?’ রণো জানতে চেয়েছিল৷

‘দ্যাট ডিপেন্ডস্‌৷’ সীমন্তিনী একটু ভাবছিল কীভাবে উত্তরটা দেবে, ‘তুমি যদি একটা অন্য নিজের বাড়ি চাও, তবে সেটাও হতে পারে৷ কিন্তু এখানে এটাও তোমার আরেকটা নিজের বাড়ি থাকবে৷ কারণ আমরা তো তোমার নিজের লোক৷ তাই এটাও তোমার নিজের বাড়ি৷’ 

‘তোমরা যদি মরে যাও? তোমার মাম্মা আর বাবা যেমন গেছিল?’ বালক রণোর মুখে একটা আতঙ্ক খেলা করছিল৷

সেটা লক্ষ করেছিল কি সীমন্তিনী? কেমন একটা অন্যমনস্ক গলায় সীমন্তিনী বলেছিল— ‘না, আমরা কখনও মরে যাব না৷ চলে যাব না৷ উই উইল অলওয়েজ বি দেয়ার ফর ইউ৷ মি অ্যান্ড ইয়োর বাবাই৷’

‘প্রমিস?’ রণো কাঁদো কাঁদো ভাবে বলেছিল৷

‘ইটস্‌ আ প্রমিস্‌৷’ মাম্মার গলাটাও কেমন ভেজা ভেজা। কুড়ি বছর আগের দিনটা বিস্মৃতির অতল থেকে ছবির মতো উঠে এল রণোর সামনে৷ সেই দিনটা ভেবে, তাদের মা ছেলের কথোপকথন ভেবে যুবক রণোর চোখের কোণটা ভিজে উঠল একটু৷ মাম্মা ইজ ট্রু টু হার ওয়ার্ডস৷ রণোর জীবনে দুটো সলিড পিলারের মতো মাম্মা আর বাবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷

Mother and son walking
মাম্মা বুঝতে পারত ছেলে বড় হয়ে গেছে

বৃন্দা বলে ভদ্রমহিলার কাছে কৃতজ্ঞ লাগল রণোর৷ উনি ওঁর গল্পের ডালি উজাড় করে না দিলে এসব কথা কোনওদিন মনেই পড়ত না ওর ৷ বৃন্দা শুধু মাম্মার মাসি নয়, বাবাই-এর কাকা, যাকে ছোটকু বলত বাবাই, বৃন্দা তার প্রেমিকা৷ রোহিণী বলেছে দাদাই-এর অটোবায়োগ্রাফিতে স্বাধীন সেন বা ছোটকুর কথা আছে৷ ছোটকুর কথা লিখেছে বাবাই-এর পিসি, যার নাম আলোলিকা৷ কলকাতায় ভালো ছাত্র, নকশাল মুভমেন্টের নেতা স্বাধীন আর তার প্রেমিকা বৃন্দার একটা গল্প শুরু হতে হতে শেষ হয়ে গেছে৷ এখন আর কারুর তাকে মনে নেই৷ রোহিণী সেই হারিয়ে যাওয়া গল্প খোঁজার চেষ্টা করছে৷ রণোর ইচ্ছে করছে রোহিণীর পাশে থেকে হারিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া গল্পগুলো খুঁজে বার করতে৷ কিন্তু তার আগে একটা বড়  কাজ আছে৷

মাম্মাদের আসতে এখনও প্রায় এক মাস দেরি আছে৷ অতদিন অপেক্ষা করতে পারবে না রণো৷ মেক মাই ট্রিপ থেকে টিকিট বুক করে ফেলল ও৷ রোহিণীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল ওর আপত্তি আছে কি না৷ নাঃ, একেবারেই আপত্তি নেই রোহিণীর৷ সেই ভালো৷ সামনেই জন্মদিন মাম্মার৷ খুব চমকে যাবে ওরা৷ অরুণাভর জন্য কিছু বিশেষ নির্দেশ পাঠাল রণো৷ ও শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত বাবাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে যা বলেছে৷ বিশেষ কিছুই না, মাম্মার জন্মদিন পড়লে এবার ঠিক রাত বারোটায় ফোন করা হবে না, কারণ তখন প্লেনে থাকবে ওরা৷ মাম্মা খুব সিরিয়াসলি নেয় এসব ফোন করার রিচুয়াল৷ বাবাইকে বলতে হবে, ও কিছু না, রণো কাজের চাপে ভুলে গেছে৷ পরে করবে নিশ্চয়ই৷ আরও কয়েকটা টুকিটাকি কাজ সেরে ফেলল রণো৷ অফিসে ছুটির দরখাস্ত করল৷ তারপর বেরিয়ে এল৷ সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পর অনেকটা হালকা লাগছে৷ এটাই হচ্ছে মাম্মাকে জন্মদিনে দেওয়া ওর শ্রেষ্ঠ উপহার৷ এবার গিয়ে মাম্মাকে সব বলবে ও৷ যে সব কথা মাম্মার আগেই জানা উচিত ছিল, যদি না মাম্মা স্বেচ্ছায় অতীতটার উপর শাটার টেনে দিত৷ এবার ‘নিজের বাড়ি’ ফিরবে ও অনেকদিন বাদে, যেখানে মাম্মা আর বাবাই সবসময় ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে৷ বাড়ি ফিরে অনেকদিন পর মাম্মাকে জড়িয়ে ধরবে ও, সেই ছোটবেলার মতো৷ বলবে ‘মাম্মা, আই হ্যাভ ফাউন্ড দ্য ওয়ে টু আ রিয়েল ব্রিজ৷ একটা ইনকমপ্লিট ব্রিজকে সম্পূর্ণ করার রাস্তা খুঁজে পেয়েছি আমি ৷’

(৪০)

স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেই সীমন্তিনীর মনে পড়ল আজ ওর জন্মদিন৷ সীমন্তিনীর আজকাল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে৷ একটা অজানা আতঙ্ক জড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ওকে৷ পাশে শুয়ে অরুণাভ গভীরভাবে ঘুমোয়৷ আর বিদঘুটে সব স্বপ্ন দেখতে দেখতে আতঙ্কে জেগে ওঠে সীমন্তিনী৷ আজকেও তেমনই হল৷ রণোকে নিয়ে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখছিল ও৷ পনেরো-ষোলো বছরের রণো যেন একজন ব্ল্যাক ছেলে৷ আত্মরক্ষার জন্য কী একটা ঘোরতর অন্যায় করেছে সে৷ পুলিশ এসে জেরা করছে রণোকে৷ রণো অসহায়ভাবে খুঁজছে ওর বাবাইকে৷ পুলিশ কোনও কথা না শুনে পিস্তল বার করে গুলি করছে রণোর কানের কাছে৷ সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল৷ কোনও আওয়াজ হচ্ছে না৷ শুধু নির্বাক ছবির মতো রণো পড়ে যাচ্ছে৷ সীমন্তিনী ঘুমের মধ্যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে— ‘রণো! রণো! যাস্‌ না! তুই থাক্‌৷ তুই আমার কাছে থাক৷’ চারদিক অন্ধকার৷ স্বপ্নটা দেখে আতঙ্কে ধড়ফড় করে জেগে উঠেছে ও৷ চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে৷ ঘামে সপসপ করছে সারা গা৷ ভীষণ গরম লাগছে সীমন্তিনীর৷ হিটিংটা বড্ড বাড়ানো রয়েছে৷ ইদানীং এসব উপসর্গ চলছে বছরখানেক ধরে৷ হট ফ্লাশেস৷ হঠাৎ হঠাৎ গরমে ছটফটানি৷ রণোকে নিয়ে আতঙ্কের কোনও কারণ নেই৷ তাও এমন আজগুবি স্বপ্ন দেখে ও৷

Mother's Birthday
সামনেই জন্মদিন মাম্মার

প্রত্যেক দিন অদ্ভুত একটা অজানা ভয় তাড়া করে বেড়ায় ওকে৷ লেক্সিংটনের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেও সর্বক্ষণ একটা ভয়৷ ইদানীং মৃত্যুভয় বাসা বাঁধছে মনের খোপে৷ অনেক বছর আগে যখন ও বুঝেছিল রবি, ওর প্রথম প্রেমিক, ওকে ঠকিয়েছে, চোরের মত ওকে ফেলে পালিয়ে গেছে সীমন্তিনীর চৌহদ্দি থেকে, তখন প্রথম ঘন কুয়াশার চাদর ঘিরে ধরেছিল ওকে৷ এই কুয়াশার আস্তরণকে বড় ভয় সীমন্তিনীর৷ অম্বিকা ওর একুশ বছরের জন্মদিনের রাতে যখন প্রথম বলেছিলেন ওর মা যে ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল সেই সত্য, তখন আবার ঘন কুয়াশার আস্তরণ ঢেকে ফেলেছিল সীমন্তিনীকে৷ মনের মধ্যে সেই ঘন কুয়াশায় ও বারবার মৃত্যুকে ছুঁয়ে দেখেছে৷ কুয়াশাকে বড় ভয় সীমন্তিনীর৷

ইদানীং শরীরটা খারাপ যায় সীমন্তিনীর৷ বুকে চিনচিন করে ব্যথা করে৷ হাতে পায়ে ক্র্যাম্প ধরে৷ নার্ভজনিত সমস্যাও আছে৷ অরুণাভ ওর চিকিৎসা নিজে করে না৷ কিন্তু ম্যাসজেনে ওর সহকর্মী ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার৷ সবাই ওর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে বলেছে৷ শামুকের মতো নিজের ভিতর গুটিয়ে রয়েছে সীমন্তিনী৷ ওকে খোলস ছেড়ে বার হয়ে আসতে হবে৷ নিজের ভিতরের গুটিপোকাটাকে ফুরফুরে প্রজাপতিতে পরিণত না করতে পারলে আস্তে আস্তে আরও ঘন কুয়াশার অন্ধকারে ডুবে যাবে ও৷

সীমন্তিনী উঠে বাথরুমে গেল৷ চোখে মুখে জল দিল৷ তারপর এসে রকিং চেয়ারে বসল৷ বাইরে আবার বরফ পড়া শুরু হয়েছে৷ ওদের বেশ কয়েকটা বাড়ি গোল করে একটা ছোট্ট লেককে ঘিরে আছে বৃত্তাকারভাবে৷ সীমন্তিনীদের বাড়িটার দক্ষিণদিকে মেন এন্ট্রান্স৷ লেকের দিকটা ঠিক তার উল্টোদিক৷ লেকের পাশের জমিটা বরফে সাদা হয়ে আছে৷ লেকের জলেও বরফের একটা আস্তরণ৷ রাজহাঁসগুলো এই সময় থাকে না৷ শীতকালটা ওদের কমিউনিটি সেন্টারের বাড়ির মধ্যে একটা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ শীতের শেষে আবার ওদের জন্য চিহ্নিত মিনি লেকে এনে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ ধূ ধূ সাদা যতদূর চোখ যায় চারিদিক৷ উল্টোদিকে দূরে একটা বাড়ির অ্যাটিকে মৃদু আলোর আভাস৷ হয়তো সীমন্তিনীর মতো ওখানেও কেউ জেগে আছে৷ সীমন্তিনী অবশ্য আলো জ্বালায়নি৷ ও শুধু ভারি পর্দা সরিয়ে দিয়েছে একপাশে৷ বরফের সাদা রং বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারদিকে৷ সাদা রঙে চারদিক কেমন যেন অপার্থিব ঠেকছে৷ আকাশটা কী অদ্ভুত ধূসর৷ কোনও তারা দেখা যাচ্ছে না কোথাও৷

ইদানীং শরীরটা খারাপ যায় সীমন্তিনীর৷ বুকে চিনচিন করে ব্যথা করে৷ হাতে পায়ে ক্র্যাম্প ধরে৷ নার্ভজনিত সমস্যাও আছে৷ অরুণাভ ওর চিকিৎসা নিজে করে না৷ কিন্তু ম্যাসজেনে ওর সহকর্মী ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার৷ সবাই ওর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে বলেছে৷ শামুকের মতো নিজের ভিতর গুটিয়ে রয়েছে সীমন্তিনী৷

ঘড়িতে রাত তিনটে৷ সীমন্তিনীর হঠাৎ খুব আকুল লাগল৷ কেন ও অমন বিশ্রী স্বপ্নটা দেখল? ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন মধ্যরাত৷ রণোরা এখন কি শুয়ে পড়েছে? রণোর কথা ভাবতেই বুকের মধ্যে কোথায় একটা দলা পাকিয়ে ওঠে৷ রণোর ত্রিশ বছর বয়স হতে চলেছে ভাবতে পারে না সীমন্তিনী৷ এখনও ওকে অবোধ শিশুর মতোই মনে হয় ওর৷ রণোর যে এখন একটা নতুন জীবন হয়েছে, রোহিণীকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় ওর একটা নিজস্ব সংসার, সেটাতে যেন ঠিক ধাতস্থ হয়নি সীমন্তিনী৷ তার চেয়ে রণো যখন ছোট ছিল, প্রতিটি পদে মার উপর নির্ভরশীল ছিল, সেই সময়েই যেন এখনও ফিরে যেতে চায় ও৷ সম্পর্কেরও বিবর্তন হয়, সম্পর্ক এক জায়গায় আটকে থাকে না। সময়ের  সঙ্গে সঙ্গে ওর আর অরুণাভর সম্পর্কেরও পরিবর্তন হয়েছে৷ সেইরকমই রণোর সঙ্গেও সম্পর্কের অনেক ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে এখনকার অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে সীমন্তিনী৷ রণো এখন অনেক বদলে গেছে৷ আগে ও খুব মা-আঁকড়া ছিল৷ সীমন্তিনীকে না হলে এক মুহূর্তও চলত না ওর৷ ‘মাম্মা, লুক ওয়াট আই হ্যাভ গট হিয়ার৷’ স্কুল থেকে ফিরে রণো এক একদিন এক একটা জিনিস নিয়ে সীমন্তিনীকে চমতে দিত৷ কখনও মায়ের জন্য তৈরি করা কোনও হ্যান্ডিক্র্যাফ্‌ট্‌, কখনও ক্যান্ডি বা কুকিস, স্পেশালি মাম্মার জন্য নিয়ে আসত ও৷ কখনও সীমন্তিনীকে চমকে দিতে গুটি গুটি পায়ে খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে ড্রয়িংরুমের এক পাশে রাখা পিয়ানোটা বাজাতে শুরু করে দিত৷ তখন প্রতিটা দিনই আবর্তিত হত রণোর কোনও না কোনও অ্যাক্টিভিটি নিয়ে৷ এমনকি হাইস্কুলের পর যখন রণো আন্ডারগ্র্যাড হিসেবে প্রিন্সটনে ভর্তি হল, তখনও প্রতিদিন বাড়িতে ফোন করে কথা বলত মাম্মা আর বাবাই-এর সঙ্গে৷ কী খাচ্ছে, কী নতুন শো দেখল, এমনকি ক্লাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব কিছু অনুপুঙ্খ বিবরণ না দিলে রণোর মন ভরত না৷

সোফোমোর ইয়ার থেকেই একটু একটু করে দূরে সরে গেল রণো৷ নিজেকে মায়ের আঁচলের তলা থেকে বার করে নিতে শিখল৷ তারপর একটা সময় রণো নিজস্ব নতুন জীবনে মশগুল হয়ে গেল৷ সীমন্তিনীও আস্তে আস্তে রণোর সঙ্গে দূরত্বে অভ্যস্ত হয়ে গেল৷ মানিয়ে নিতে শিখল৷ প্রথম প্রথম ফাঁকা ফাঁকা লাগত৷ এখনও একটা শূন্যতার বোধ রয়ে গেছে ভিতরে৷ সীমন্তিনী ডিপ্রেশনের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে৷ অরুণাভ যথাসাধ্য চেষ্টা করে ওকে খুশি রাখার৷ এই একত্রিশ বছর ধরে অরুণাভ নিঃশর্তে ওর সমস্ত মনখারাপ, বিষাদ, দুঃখকে বহন করে চলেছে— সেজন্য খুব কৃতজ্ঞ লাগে সীমন্তিনীর৷ ওর মনে হয় অরুণাভ ওকে যেভাবে আশ্রয় দিয়ে আগলে রেখেছে, তার সঠিক দাম ও দিতে পারেনি৷ কিন্তু রণো আর সেই আগের মতো মাম্মাকে চোখে হারায় না৷ বরং সীমন্তিনীর এই ক্রমাগত ডিপ্রেশনে ইদানীং একটু যেন বিরক্ত হয় রণো৷ অনেকবার সীমন্তিনীকে ও বোঝাতে চেষ্টা করেছে পজিটিভলি ভাবার কথা৷ কিন্তু সীমন্তিনীর সবসময়ই মনে হয় রণো যেন ঠিক আগের মতো নেই৷ সীমন্তিনীর ভালো মন্দ, সুখ দুঃখ নিয়ে ওর কিছু যায় আসে না৷

Boy with piano

ডাক্তার ওকে বলেছে এসবই ওর মধ্যবয়সের সংকট৷ মেনোপজ জনিত শারীরবৃত্তের নানারকম রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল৷ সত্যিই শরীর-মনে অনেক রকম বদল ঘটছে টের পায় সীমন্তিনী৷ এই এবার তিপ্পান্ন বছরে পা দিল ও৷ সাধারণত রণো আর রোহিণী ওর জন্মদিনের তারিখে ঠিক রাত বারোটায় ফোন করে৷ ‘মাম্মা, হ্যাপি বার্থডে’— রণোর গলাটা শুনলে ভিতরটা আনন্দে ভরে যায় ওর৷ এবারই প্রথম ফোন করল না রণো৷ রাত বারোটায় জেগে ছিল সীমন্তিনী৷ অপেক্ষা করছিল রণোর ফোনের জন্য৷ রণোর কি একবারও মনে হল না মাম্মা অপেক্ষা করবে ফোনের জন্য? মনে করে একটা ফোন করা খুব কি কঠিন কাজ? অভিমানে বুকের ভিতরটা জ্বালা করছে সীমন্তিনীর৷ কেনই বা জন্মদিনের রাতে রণোকে নিয়ে ওই বিশ্রী স্বপ্নটা দেখল ও? মাঝরাতে চেয়ারে বসে বরফ পড়া অদ্ভুত নিস্তব্ধ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নিজের পুরো জীবনটা ছবির মতো দেখতে পাচ্ছে সীমন্তিনী৷ একুশ বছরের জন্মদিনের রাত, যে রাতে কুয়াশা ঘিরে ধরেছিল সীমন্তিনীকে৷ সেবারই শেষ জন্মদিন, যেবার ও বাবাকে পেয়েছিল৷ পরের বছর ফিলাডেলফিয়ার শ্বশুরবাড়িতে ওর জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রচুর বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন জ্যোতির্ময় ও অরুণলেখা৷ তখন ও সন্তানসম্ভবা৷ আর দু মাসের মধ্যেই রণোর জন্ম হওয়ার কথা৷ আগের দিনই বস্টন থেকে ওরা চলে এসেছিল ফিলাডেলফিয়া৷ জন্মদিনের ভোরে ঘুম থেকে উঠে সীমন্তিনী প্রণাম করেছিল শ্বশুর শাশুড়িকে৷ জ্যোতির্ময় বলেছিলেন— ‘আমি তোমাকে আমার সেই পেট আশীর্বাদটাই করছি মামণি,

সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রু ভব
ননান্দরী সম্রাজ্ঞী ভব, সম্রাজ্ঞী অভিদেবিষু’

সীমন্তিনী হেসে ফেলেছিল৷ ওর শ্বশুর ওকে এই আশীর্বাদটা প্রথম দেখা হওয়ার দিনও করেছিলেন, এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নামার পরেই৷ জিনির জন্য বুঝিয়েও দিয়েছিলেন ইংরেজি করে৷ শুনে জিনি বলেছিল— ‘ওয়াও, বৌদি হ্যাজ টু বি দ্য কুইন ইভন টু মি বাট নট টু  দাদা৷’ খুব হাসাহাসি হয়েছিল সেই নিয়ে৷ তার ন’মাস পরে জন্মদিনের সকালেও সেই প্রিয় শ্লোকটাই আবৃত্তি করেছিলেন জ্যোতির্ময়৷ অরুণলেখা আলমারির লকার থেকে বার করেছিলেন একটা পুরনো আমলের সীতাহার৷ সীমন্তিনীর গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘মামণি, এবার এটা তোমার পাওনা হয়েছে৷’

সীমন্তিনী জিজ্ঞাসুভাবে তাকিয়েছিল— ‘কেন, মামণি?’

‘যখন বাবাই হবে, তখন সাধভক্ষণের দিন আমার শাশুড়িমা আমার গলায় এটা পরিয়ে দিয়েছিলেন৷ তিনি আবার পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়িমার কাছ থেকে তোমার শ্বশুর হওয়ার সময়৷ সন্তানসম্ভাবনা হলে উত্তরাধিকার-সূত্রে এ জিনিস পুত্রবধূদের কাছে যায়৷ দেশভাগের আগে খুলনা ছেড়ে আসার সময় শাশুড়ি বুকের মধ্যে লুকিয়ে ট্রেনে এটি নিয়ে এসেছিলেন৷’ 

রাত বারোটায় জেগে ছিল সীমন্তিনী৷ অপেক্ষা করছিল রণোর ফোনের জন্য৷ রণোর কি একবারও মনে হল না মাম্মা অপেক্ষা করবে ফোনের জন্য? মনে করে একটা ফোন করা খুব কি কঠিন কাজ? অভিমানে বুকের ভিতরটা জ্বালা করছে সীমন্তিনীর৷ কেনই বা জন্মদিনের রাতে রণোকে নিয়ে ওই বিশ্রী স্বপ্নটা দেখল ও?

সেই হারটা সীমন্তিনীদের ভল্টে তোলা আছে এখনও৷ অমন সোনা এখন আর পাওয়া যায় না৷ সীমন্তিনী বেঁচে থাকতে থাকতে ওই হার কি রোহিণীকে দেবার সুযোগ হবে? একটু অন্যমনস্কভাবে সীমন্তিনী ভাবছে৷

সেই সকালে অরুণাভ নিজে উদ্যোগ করে ফোন করেছিল অম্বিকাকে৷ ‘আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন’ বলে ফোনটা ও ধরিয়ে দিয়েছিল সীমন্তিনীকে৷

সীমন্তিনীর গলা কেঁপে যাচ্ছিল৷ বাবা একহাতে এই সেদিন পর্যন্ত মা বাবা দুজনের কর্তব্যই করেছে৷ এই প্রথম জন্মদিন যখন বাবা তার কাছে নেই৷ প্রতি সপ্তাহে রবিবার ফোনে কথা হত৷ তবু জন্মদিনের ব্যাপারটা একদম আলাদা৷

‘তুমি কেমন আছ বাবা?’ সীমন্তিনী কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল৷

‘আমি খুব ভালো আছি মা। এই প্রথম তোমার জন্মদিনে তুমি কাছে নেই৷ আমার মনটা একটু খারাপ৷ কিন্তু অ্যাট দ্য সেম টাইম, আমার মধ্যে একটা পরম প্রশান্তি রয়েছে, কারণ জানি আমার মেয়েটা বিদেশে একটা আনন্দময় গৃহ খুঁজে পেয়েছে৷

সীমন্তিনীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছিল৷

‘বাবা তুমি কবে আসবে এখানে? পাসপোর্ট রিনিউ হয়ে আসেনি এখনও?’

‘আমার আসার জন্য ব্যস্ত কী মাগো? এখন তোমার নতুন সংসার, নতুন জীবন৷ এই জীবনে তোমার জন্মদিন এন্‌জয় কর৷ তোমার সন্তান আসবে পৃথিবীতে৷ তাকে তোমার স্নেহের সবটুকু দিও৷ সে যেন কখনও বঞ্চিতবোধ না করে৷ তোমার আগামী দিনগুলো কানায় কানায় ভরে উঠুক৷’

তখন মনে হয়নি, কিন্তু তারপর বহু বছর ধরে সীমন্তিনীর মনে হয়েছে অম্বিকা যেন তাঁর আমেরিকায় আসার কথা এড়িয়ে গিয়েছিলেন৷ যেন তিনি জানতেন কখনোই আর মেয়ের কাছে যাওয়া হবে না তার নতুন সংসার দেখতে৷ অম্বিকার কি কোনও প্রিমনিশন হয়েছিল? নয়তো তিনি কেন বলবেন সীমন্তিনীর অনাগত সন্তানের বিষয়ে— ‘ওকে ভালোভাবে মানুষ কোরো৷ তোমার দুঃখের দিনে যেন পাশে থাকতে পারে৷ সুখ দিতে পারে তোমায়৷ আর আমাদের গল্প কোরো তার কাছে৷ সে যেন জানতে পারে অন্য কোনও দেশে তার পূর্বজাতকেরা ছিল৷’

‘আমাদের গল্প’ কেন বলেছিলেন অম্বিকা? রণোকে কাদের কথা বলতে বলেছিলেন? তাঁর আর তাঁর অনেকদিন আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্ত্রীর কথা? তখন সেরকম মনে হয়নি সীমন্তিনীর৷

আকুল হয়ে ও বলছিল, ‘তুমি আসবে না বাবা? আমার বাচ্চাকে তুমি কবে দেখবে?’

ওপ্রান্তে অম্বিকা একটু হেসেছিলেন— ‘দেখ, না দেখা কি সবসময় মানুষের হাতে থাকে মা? তবে জেনো সব সময় তোমার পাশে আমি আছি৷ এত দূরের পথ পেরিয়ে যদি নাও যেতে পারি, তবু জানবে মনে মনে তোমার খুব কাছেই রয়েছি আমি৷’

তখন ল্যান্ডলাইনের যুগ৷ বেশ কিছুক্ষণ কথার পরে অম্বিকা  বলেছিলেন— ‘রাখি তাহলে৷ ভাল থেকো মা৷’ 

‘তুমিও বাবা’… ফোন ছেড়ে দিয়েছিল সীমন্তিনী৷

Philadelphia
আগের দিনই বস্টন থেকে ওরা চলে এসেছিল ফিলাডেলফিয়া

আজ ত্রিশ বছর বাদে বাইরের তুষারপাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সীমন্তিনীর মনে হল সেদিন অম্বিকা বোধহয় ‘আমাদের গল্প’ বলতে তাঁর স্ত্রীর গল্পের কথাও বলতে চেয়েছিলেন৷ আর জানার উপায় নেই এত বছর বাদে৷

সেদিন কথার পরই দোতলায় নিজের ঘরে শুতে চলে গিয়েছিলেন অম্বিকা৷ সীমন্তিনীর জন্মদিন আর বেবি শাওয়ার একসঙ্গে সেলিব্রেট করেছিলেন অরুণলেখারা৷ সন্ধেয় অতিথি অভ্যাগতরা জড়ো হয়েছিলেন৷ নতুন দেশে নতুন পাওয়া আদরের জোয়ারে সারা সন্ধে ভেসে গেছিল সীমন্তিনী৷ অতিথিরা বিদায় নেবার পর রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ফোন বেজে উঠেছিল আরেকবার৷ ওরা তখন ক্লান্ত হয়ে শোয়ার যোগাড় করছে৷ ভরা গর্ভ আর সারাদিনের হৈ চৈ-এর জেরে দু চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছিল সীমন্তিনীর৷ অরুণাভই ধরেছিল ফোনটা৷ —‘হ্যালো আংকল! সীমন্তিনী বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে৷ আমি দেখছি৷’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ও প্রান্ত থেকে লাল্টু, অম্বিকার ড্রাইভারের গলা শোনা গেছিল৷ সকাল থেকে ডাক্তারবাবু উঠছেন না দেখে রান্নার লোক মালতীদি ডাকতে গেছিল ডাক্তারবাবুকে৷ ঘুম ভাঙেনি৷ দরজা বন্ধ ছিল ভিতর থেকে৷ দরজা ভেঙে ওরা দেখেছিল ডাক্তারবাবু ঘুমিয়ে আছেন তখনও৷ সেই ঘুম আর ভাঙেনি অম্বিকার৷

তখন ইন্টারনেটের যুগ ছিল না৷ বহু কষ্টে চটজলদি টিকিট সংগ্রহ করে অরুণাভ পরদিনই রওনা হয়েছিল কলকাতা৷ অম্বিকার শেষকাজ থেকে পরবর্তী ব্যবস্থা, কলকাতার বাড়ির বন্দোবস্ত তখনকার মতো— সবই করতে হয়েছিল ওকে৷ সীমন্তিনীকে পরদিন ভোরবেলা জানানো হয়েছিল খবরটা৷ তার কিছুক্ষণ বাদেই অরুণাভর ফ্লাইট৷ বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিল সীমন্তিনী৷ ওর গাইনি ওকে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন৷ বেশ কয়েকদিন একটা গহন ঘুমঘোরের মধ্যে চলেছিল সীমন্তিনী৷ কোনওক্রমে সামলেছিল, যাতে গর্ভজ সন্তানের কোনও ক্ষতি না হয়৷

রণো পৃথিবীতে এসেছিল এর এক মাস কুড়ি দিন পর৷ একটু প্রি-ম্যাচিওর অবস্থাতেই সিজারিয়ান করে ওকে পৃথিবীর আলো দেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন ডাক্তার৷ এপ্রিলের এক সকালে রণোর আগমনে আবার জীবন পাল্টে গেছিল সীমন্তিনীর৷

পার্শিয়াল অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে অপারেশনের পর শিশু রণোর আমবিলিকাল কর্ড কেটে ধুইয়ে মুছিয়ে দেওয়া হয়েছিল সীমন্তিনীর কাছে৷ ক্ষণিকের জন্য সীমন্তিনীর মনে পড়ে গেছিল কলকাতার সেই অ্যাবরশন ক্লিনিকের দুঃসহ দিনের কথা৷ অপরিণত একটা রক্তমাংসের ডেলা তার দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে নিষ্কাশন করার যন্ত্রণাদায়ক প্রসেস৷ ব্যস ওটুকুই৷ পাশে শোওয়া ছোট্ট তুলতুলে শিশুকে দেখে সীমন্তিনীর চোখে জল আসছিল বারবার৷ মনে হচ্ছিল এই শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে সে পৃথিবীর তাকে দেওয়া সব দুঃখ কষ্ট, সব ব্যাথা, সব যন্ত্রণা ভুলতে পারবে৷ ভুলেও গেছিল সে৷ রণোর জন্ম তাকে সব শূন্যতা, সব মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দিয়েছিল৷ কতদিন সব ভুলে ছিল সীমন্তিনী? যতদিন রণো বড় হয়নি, ওর নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়নি, ততদিন রণোর কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত ওর জগৎসংসার৷

তারপর কেন যে রণো বড় হয়ে গেল! সীমন্তিনী এখন যে কী আঁকড়ে বাঁচে ? হঠাৎ ও টের পায় মধ্যবয়সের নিঃসঙ্গতা সমস্ত দাঁড়া উঁচিয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ করেছে ওকে৷ তুষারাস্তীর্ণ চরাচরের মধ্যে অপার্থিব এক রুপোলি আলোর আভাস৷ সীমন্তিনীর ঘোর লাগে৷ ঘুম আসতে থাকে ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে৷ বাইরে থেকে আসা ক্ষীণ রেখার মতো আলো বিছানো থাকে ঘরের মেঝেতে, লুটোপুটি খায়, বিভ্রম জাগায়। ঘুম ঘোরে বুঝতে পারে সীমন্তিনী আর বেশি সময় নেই, সামনের রাস্তা ঢালু হয়ে আসছে, ফুরিয়ে আসার আগে৷ তুই কেন চলে গেলি রণো? স্বপ্নে জাগরণে মেশা ভুবনে আবার ফিরে আসে মৃত কিশোরের মুখ, তার সঙ্গে মিশতে থাকে রক্ত মাংসের সেই দলা, যাকে ভ্রুণাবস্থাতেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সীমন্তিনী৷ অনেক কিছু জানা বাকি রয়ে গেল৷ জানা হল না বাবার জীবনের শেষ বিন্দুতে এসে মৃত্যু মুহূর্তে কী মনে হয়েছিল! জানা হল না কৈশোরকে ফেলে রেখে তরুণ যুবক রণোর নবজন্মের সময় কী মনে হয়েছিল! যে কথা আর কখনও ও সীমন্তিনীকে বলবে না… অজানা রয়ে গেল মায়ের জীবনের পরবর্তী পর্বের বাকি ইতিহাস৷

পার্শিয়াল অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে অপারেশনের পর শিশু রণোর আমবিলিকাল কর্ড কেটে ধুইয়ে মুছিয়ে দেওয়া হয়েছিল সীমন্তিনীর কাছে৷ ক্ষণিকের জন্য সীমন্তিনীর মনে পড়ে গেছিল কলকাতার সেই অ্যাবরশন ক্লিনিকের দুঃসহ দিনের কথা৷ অপরিণত একটা রক্তমাংসের ডেলা তার দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে নিষ্কাশন করার যন্ত্রণাদায়ক প্রসেস৷ ব্যস ওটুকুই৷ পাশে শোওয়া ছোট্ট তুলতুলে শিশুকে দেখে সীমন্তিনীর চোখে জল আসছিল বারবার

মা সুখ খুঁজতে চলে গেছিল নতুন প্রেমিকের হাত ধরে। নতুন সংসার পেতেছিল অন্য এক মহাদেশে। আচ্ছা মার কি ছেলে হয়েছিল, না মেয়ে? মা কি তার সেই সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ডেই কোথাও রয়ে গেছে? জীবনের বাঁকে নতুন প্রেমের তাড়নায় যে যুবতী তার স্বামী আর শিশুকন্যাকে রেখে পাড়ি দিয়েছিল অ্যালবিয়নস ডিসট্যান্ট শোরের অন্বেষণে, এতদিনে সে মধ্যবয়স পেরিয়ে অস্ত যাবার অপেক্ষায়৷ সময়ের বালি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভরিয়ে দিয়েছে তার শরীর। তার মুখে সময়ের বলিরেখা, সমুদ্র থেকে উড়ে আসা নুন তার ঝুরোঝুরো চুলে আটকে। একসময়ের সুন্দরী যুবতী এখন ন্যুব্জদেহ, শনের মতো সাদা চুল এক বুড়ি মৎসকন্যা, যে তটরেখা ধরে ঠিক মধ্যবিন্দুতে দাঁড়িয়ে, যে জলেও ভাসেনি, ডাঙাতেও আসেনি৷ 

কখন যেন চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে সীমন্তিনী৷ বরফ পড়া থেমে গেছে কখন৷ শেষ রাতের মরা চাঁদের আলো সন্তর্পণে ঢুকে এসে খেলা করছে সীমন্তিনীর ঘুমন্ত শরীরে৷

*পরবর্তী শেষ পর্ব প্রকাশিত হবে ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ছবি সৌজন্য: Istock, Wallpaper flare, PicrylPxHere, Needpix, Wikimedia commons,

Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *