প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০]

(৩৬)

‘দিস প্লেস রিমাইন্ডস্‌ মি অফ অ্যানাদার টাইম৷ ঠিক যেন স্বপ্নে দেখছি ছোটবেলার অন্য ক্যারেকটারগুলোকে, এরকম ফিলিং হচ্ছে’ অরুণাভ একদৃষ্টে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল৷

বাড়িটার চারপাশে এখন সময়ের থাবা, সীমন্তিনী তাকিয়ে দেখছিল৷ কার্নিশ বেয়ে দু’একটা অশ্বত্থের চারা৷ ভাঙা ফাটা পাইপ ঝুলে আছে৷ আগাছার জঙ্গল বাড়ির সামনে৷ জানলাগুলো ভেঙেচুরে গেছে৷ বাইরের দেওয়াল জুড়ে শ্যাওলার পলেস্তারা৷ বাড়ির কোনায় একটা চৌকো বোর্ড লাগানো৷ তাতে একজন বিল্ডারের নাম লেখা আছে৷ রবীন সামন্ত অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট্‌স্‌৷ বাড়িটাকে প্রোমোট করা হবে৷ পনেরো বছর আগে যারা কিনেছিলেন বাড়িটা, বোঝাই যাচ্ছে তাঁরা খুব একটা যত্ন করে মেনটেন করেননি৷ পনেরো বছরেই বাড়িটা তাই এমন জরাজীর্ণ নড়বড়ে চেহারায় এসে পৌঁছেছে! নাকি যখন অরুণাভদের পরিবার এ বাড়ি বিক্রি করে দেন, তখন থেকেই বাড়িটা এমন দুর্দশাগ্রস্ত ছিল? বাড়িটা যেন অথর্ব, স্থবির হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে— মনে হয়েছিল সীমন্তিনীর৷ ‘তুমি এই বাড়িটায় কতদিন ছিলে?’ সীমন্তিনী জানতে চেয়েছিল৷

‘মাই পেরেন্টস অ্যান্ড আই লেফট ফর ইংল্যান্ড হোয়েন আই ওয়াজ সিক্স অর সেভেন৷ তারপর আবার এসেছি যেবার মাই গ্র্যান্ডফাদার ডায়েড৷ দ্যাট ওয়াজ ফিফটিন ইয়ারস্‌ এগো৷ দ্য হাউজ সিম্‌ড্‌ টু বি ভেরি গ্লুমি ইভ্‌ন্‌ দেন৷ কিন্তু এখন যেরকম হয়েছে, আই কান্ট থিংক হাউ মাই পেরেন্টস্‌ উইল রিঅ্যাক্ট টু দিস৷’

‘দেন ডোন্ট শো দিস৷ এই বাড়িটার ছবি তুলে নিয়ে গেলে ওঁরা ডেফিনিটলি খুব দুঃখ পাবেন৷ তার চেয়ে না দেখানোই তো ভালো৷’ সীমন্তিনী সাজেস্ট করেছিল৷

বাড়িটার চারপাশে এখন সময়ের থাবা, সীমন্তিনী তাকিয়ে দেখছিল৷ কার্নিশ বেয়ে দু’একটা অশ্বত্থের চারা৷ ভাঙা ফাটা পাইপ ঝুলে আছে৷ আগাছার জঙ্গল বাড়ির সামনে৷ জানলাগুলো ভেঙেচুরে গেছে৷ বাইরের দেওয়াল জুড়ে শ্যাওলার পলেস্তারা৷ বাড়ির কোনায় একটা চৌকো বোর্ড লাগানো৷ তাতে একজন বিল্ডারের নাম লেখা আছে৷ রবীন সামন্ত অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট্‌স্‌৷ বাড়িটাকে প্রোমোট করা হবে৷ পনেরো বছর আগে যারা কিনেছিলেন বাড়িটা, বোঝাই যাচ্ছে তাঁরা খুব একটা যত্ন করে মেনটেন করেননি৷

‘কিন্তু ওরা বারবার করে বলে দিয়েছে এই বাড়ির ছবি তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য৷’ অসহায় লাগছিল অরুণাভকে৷ ওর দিকে তাকিয়ে সেই প্রথম এক ধরনের নতুন মায়া অনুভব করেছিল সীমন্তিনী অরুণাভর জন্য৷

‘আর ইউ স্যাড দ্যাট দ্য হাউজ ইজ ভার্চুয়ালি গন?’ ও জিজ্ঞেস করেছিল৷

‘আই অ্যাম কাইন্ড অফ স্যাড৷ কিন্তু মা অ্যান্ড বাবাই উইল বি রিয়েলি স্যাড৷ ওরা ভেবেছিল বাড়িটা ঠিকই আছে৷ তাই আমাকে একবার দেখে আসতে বলেছে৷’ অরুণাভ বলেছিল খুব বিষণ্ণভাবে৷

পাশের দিক থেকে শ্যাওলা, নোনাধরা অংশগুলো বাদ দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছিল ও সন্তর্পণে৷ ঠিক মৃতদেহকে পর্যবেক্ষণ করার মতো দেখে ছবি তুলছিল ও— সীমন্তিনী না ভেবে পারেনি৷

‘আমি হলে তুলতামই না ছবিগুলো৷ বলতাম ক্যামেরা কাজ করেনি৷’

‘আই কুড সে দ্যাট টু৷’ অরুণাভ একটু ভাবছিল… কিন্তু আই লুক অ্যাট ইউ দিস্‌ ওয়ে৷ ছবিগুলো তোলা থাক৷ এরপর তো প্রোমোটিং শুরু হয়ে যাবে৷ অনেক উঁচু একটা ফ্ল্যাটবাড়ি মাথা তুলবে এখানে৷ তখন যদি আসি, বা ধরো আমার মা বাবা যদি আসে, ওরা তো আর খুঁজে পাবে না বাড়িটাকে৷ তাই ছবিটা তুলে রাখি৷ এই ছবিগুলোই রয়ে যাবে৷ অ্যান্ড দিস্‌ ইজ অলসো আ ওয়ে টু টেল মাই পেরেন্ট্‌স্‌ দ্যাট আই কেয়ার ফর দেম৷ 

Broken House
বাড়িটা যেন অথর্ব, স্থবির হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে

অরুণাভর ভিতরের কেয়ারিং স্বভাবটা এরকম দু-একটা ছোট্ট ছোট্ট কথায় ধরা পড়ছিল সীমন্তিনীর কাছে৷ ওর লম্বা রোগা চেহারা, কাঁধ পর্যন্ত চুল, গালে স্টাবল৷ চোখদুটোয় একটু বিষণ্ণতার আভাস৷ হঠাৎ সীমন্তিনী বুঝতে পারছিল ওর অরুণাভকে খুব ভালো লাগছে৷ ভালো লাগছে জীবনকে আবারও৷ 

দমদমের সেই ছোট্ট পাড়ায় পথচলা লোকজন একটু কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছিল ওদের দুজনের দিকে৷ নিশ্চয়ই খুবই বেমানান লাগছে ওদের৷ এই মফস্বলি পাড়ার চৌহদ্দিতে কয়েকটি বালক স্কুল থেকে ফেরার পথে ভিড় জমিয়েছিল গাড়ির কাছে৷ পাশেই আর একটা সদ্যনির্মিত ফ্ল্যাট৷ এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা বারান্দা থেকে রেলিং-এ শাড়ি মেলতে এসে অবাক চোখে লক্ষ করছিলেন ওদের৷ বাড়িটার পাশে ওদের অনেকক্ষণ ধরে ঘুর ঘুর করতে দেখে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন— ‘কাউকে খুঁজছেন?’

সীমন্তিনী একটু অপ্রস্তুতভাবে মাথা নেড়েছিল৷ ‘না, এই বাড়িটায় ওরা থাকত আগে৷’ অরুণাভর দিকে দেখিয়েছিল ও৷

‘কে? বিষ্টুবাবুর কেউ?’

ভদ্রমহিলা একটু অনিশ্চিতভাবে প্লেস করার চেষ্টা করছিলেন, ‘নাম কী তোমার?’ প্রশ্নটা ছোড়া হয়েছিল অরুণাভর উদ্দেশ্যে৷

‘অরুণাভ৷’

‘অরুণাভ কী?’

‘অরুণাভ সেন৷ আমার বাবা জ্যোতির্ময় সেন৷’ অরুণাভ একটু বিরক্তভাবে বলেছিল৷

দমদমের সেই ছোট্ট পাড়ায় পথচলা লোকজন একটু কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছিল ওদের দুজনের দিকে৷ নিশ্চয়ই খুবই বেমানান লাগছে ওদের৷ এই মফস্বলি পাড়ার চৌহদ্দিতে কয়েকটি বালক স্কুল থেকে ফেরার পথে ভিড় জমিয়েছিল গাড়ির কাছে৷ পাশেই আর একটা সদ্যনির্মিত ফ্ল্যাট৷ এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা বারান্দা থেকে রেলিং-এ শাড়ি মেলতে এসে অবাক চোখে লক্ষ করছিলেন ওদের৷

ভদ্রমহিলার মুখের অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছিল৷ উনি দ্রুত ভিতরে ঢুকে গেছিলেন৷ সীমন্তিনীও একটু হকচকিয়ে গেছে, কেন উনি একটাও কথা না বাড়িয়ে ভিতরে চলে গেলেন ভেবে৷ হঠাৎ ফ্ল্যাটের তলার গেট দিয়ে উনি হাঁপাতে হাঁপাতে নেমে এসেছিলেন৷

‘আমি তোমার পিসি হই বাবা৷ জ্যোতি আমার চেয়ে একটু ছোট৷ তোমার মা শান্তিনিকেতনের মেয়ে না? অরুণলেখা৷ তোমাদের একবার আমার ফ্ল্যাটে আসতেই হবে৷ আমি কোনও আপত্তি শুনব না৷’

প্রায় জোর করে উনি টেনে নিয়ে গেছিলেন ওঁর ফ্ল্যাটে৷ কোনও ওজর আপত্তি শোনেননি৷

ভদ্রমহিলার নাম অর্পিতা সান্যাল৷

‘জ্যোতিকে বোলো পপাদি৷ তাহলে চিনতে পারবে৷ তোমার কাকা ছোট ছিল তো, আমার নামটা পুরো উচ্চারণ করতে পারত না৷ তাই পপাদি বলত৷ সেই থেকে ওদের সব ভাইবোনদেরই আমি পপাদি৷’ মিষ্টি আর লেবুর শরবত দিতে দিতে উনি বলছিলেন৷

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন জ্যোতির্ময়, অরুণলেখা সবাই এখন কেমন আছেন৷ একটু খেদের সঙ্গে বলছিলেন ‘পুরো পরিবারটা কেমন ভেঙে গেল৷ ছোট ভাইটা বেঘোরে মারা গেল৷ চোখের সামনে মাসীমা শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন৷ উনি তো হাসির কাছেই ছিলেন শুনেছি৷ এখন কেমন আছেন?’

‘ঠাকুমা আর নেই৷ বছর পাঁচেক হল৷’ অরুণাভ বলেছিল৷

‘ও হো! কী ভালোই না বাসতেন মাসীমা আমাকে৷ এটি কে? বোন নাকি?’ এতক্ষণে ওঁর সীমন্তিনীর দিকে নজর পড়েছিল৷

‘না, বোন ওখানে৷ এবার কলেজে যাবে৷ শি ইজ মাই ফ্রেন্ড৷ ওদের ওখানেই আছি৷’ 

‘আচ্ছা আচ্ছা৷ কোথায় থাকো তুমি?’

‘ভবানীপুরে’। সীমন্তিনী জবাব দিয়েছিল৷

‘বেশ বেশ৷ তোমার নাম?’

‘সীমন্তিনী রায়৷’ শুনে উনি বলেছিলেন বামুন, না বৈদ্য? রায় আবার ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ সব রকমের হয়, জানো তো? পদবী দেখে বোঝার উপায় নেই কে কী৷ আমি যেমন সান্যাল, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ৷ আমাদের শুধু রাঢ়ি আর বারেন্দ্র বিয়ে হয়৷’

এসব কথায় অরুণাভ এবার একটু অধৈর্য বোধ করছিল৷ সেটা লক্ষ করেই উনি একটু হেসে বললেন— ‘আমি এসব বলছি বলে বোর হচ্ছ না তো? আসলে পুরনো দিনের মানুষ তো আমরা৷ এরকম কথা বলে ফেলি৷ কিছু মনে কোরো না যেন।

সীমন্তিনীর বেশ লাগছিল ওঁর কথা শুনতে৷ ঠাকুমার কাছে ও এরকম অনেক গল্প শুনত৷ ঠাকুমা মারা যাবার পর থেকে এ ধরনের গল্পগুলো ও খুব মিস করে৷ বেশ সহজ সাদাসিধে ভদ্রমহিলা।

ওঁর বাবা পার্টিশনের পর চলে আসেন রংপুর থেকে৷ জ্যোতির্ময়দের প্রতিবেশী হিসেবে বহুকালের চেনাজানা দু পরিবারের৷ ‘আমাদের বাড়িটাই সবচেয়ে আগে প্রোমোটার নিল৷ দুভাই দুটো ফ্ল্যাট পেয়েছে৷ আমিও মাথা গোঁজার জন্য একটা জায়গা পেলাম৷ সাতশো স্কোয়ার ফুটের একচিলতে পায়রার খোপের মতো৷ তবু একা মানুষের জন্য এই বা মন্দ কী?’

OLd kolkata lanes

দুপুর বারোটা বাজে৷ ওরা সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়েছিল৷ দমদমের বাসস্থান দেখে বাড়ি ফিরে বিকেলে আরও কয়েকটা জায়গায় যাওয়ার প্ল্যান৷ এবার ওঠা দরকার৷ সেকথা জানাতে অর্পিতা মলিন মুখে হেসেছিলেন৷

‘এস বাবা৷ তোমাদের আর আটকাব না৷ এতদিন বাদে এদিকে এলে৷ আমার উচিত ছিল তোমাদের দুটি খাইয়ে দেওয়া৷ কিন্তু আজ আমার ঘরে তোমাদের খাওয়াবার মতো কিছুই নেই৷ ফ্ল্যাটটাতে আমিই প্রথম এসেছি৷ এতদিন তো ভাইদের সংসারে ছিলাম, প্রোমোটারের ভাড়া করা বাড়িতে৷ অন্য কোনও ফ্ল্যাটেই এখনও লোক আসেনি৷ তোমাদের তাই খেতে বলতে পারলাম না৷ কিছু মনে কোরো না৷’

লিফট চালু হয়নি এখনও৷ ওরা সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসেছিল দোতলা থেকে একতলায়৷ সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি৷ ওদের নেমে যাওয়ার সময় বললেন ‘জ্যোতি আর অরুণকে বোলো একবার এসে ঘুরে যেতে পুরনো জায়গায়৷ আমার কাছেই থাকবে নাহয়৷ ওরা না হয় আমেরিকায়, হাসি আর খুশিও তো আসতে পারে এক আধবার! খুশি তো শান্তিনিকেতনে থাকে৷ কতটুকু আর দূরে৷’ একটু থেমে উনি আবার বলেছিলেন— আসলে বুড়ো হচ্ছি তো! পুরনো লোকদের কথা মনে পড়ে খুব৷ তুমি জ্যোতি আর অরুণের ছেলে! এভাবে এত বছর পর যোগাযোগ হল, কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার৷’

বিকেলে বেরোবার আগে নতুন করে প্রসাধন পর্ব সেরেছিল সীমন্তিনী৷ সীমন্তিনীর একমাথা কালো চুল, সকালে চিকণের সাদা সালোয়ার কামিজের সঙ্গে চুলগুলো চুড়ো করে বেঁধেছিল ও অনেকটা টপ নটের মতো৷ বিকেলে রওনা হবার আগে একটা ঘন নীল রঙের ঢাকাই জামদানি শাড়ি পরেছিল সে৷ শাড়িটা তার একুশ বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিনে দিয়েছেন অম্বিকা৷ জন্মদিনের পর সে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এই শাড়িটা পরল৷ গলায় নীল লকেটের একটা চোকার আর কানে নীল পাথরের চৌকো টপ৷ একটু বিশেষ যত্ন নিয়ে সে সেজেছিল অনেকদিন বাদে৷ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখল সীমন্তিনী, বেশ ভালোই দেখাচ্ছে তাকে, সেই বোরোলীনের অ্যাডের সময়ের মতো৷

অনেকদিন বাদে খুব ফুরফুরে বোধ হচ্ছিল ওর৷ অরুণাভ কলকাতা দেখতে চায় ওর সঙ্গে৷ যেমনভাবে ও দেখাবে৷ ‘কী দেখতে চাও প্ল্যান রয়েছে কিছু?’ জিজ্ঞেস করেছিল সীমন্তিনী৷

না, কোনও প্ল্যান নেই ওর৷ সীমন্তিনী যা দেখাবে, যে অর্ডারে দেখাবে, সেইভাবেই শহরটাকে বুঝতে চায় ও৷ শুনে একটা ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেছিল বুকের মধ্যে দিয়ে৷ এই প্রথম ওর জীবনে কেউ নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে চাইছে, আত্মসমর্পণ করতে চাইছে— কোনও শর্ত ছাড়াই৷

সীমন্তিনীর একমাথা কালো চুল, সকালে চিকণের সাদা সালোয়ার কামিজের সঙ্গে চুলগুলো চুড়ো করে বেঁধেছিল ও অনেকটা টপ নটের মতো৷ বিকেলে রওনা হবার আগে একটা ঘন নীল রঙের ঢাকাই জামদানি শাড়ি পরেছিল সে৷ শাড়িটা তার একুশ বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিনে দিয়েছেন অম্বিকা৷ জন্মদিনের পর সে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এই শাড়িটা পরল৷ গলায় নীল লকেটের একটা চোকার আর কানে নীল পাথরের চৌকো টপ৷ একটু বিশেষ যত্ন নিয়ে সে সেজেছিল অনেকদিন বাদে৷

সীমন্তিনীকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল সেদিন৷ অরুণাভর চোখের মুগ্ধতা, ভালোলাগার আবেশটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল ও৷ ভিক্টোরিয়া আর ময়দান চত্বর ঘুরে ওরা আউট্রাম ঘাটে প্রিন্সেপ ঘাটের চত্বরে বসেছিল একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে৷ সপ্তাহান্তে এ তল্লাটে প্রেমিক প্রেমিকাদের খুব ভিড় থাকে৷ কিন্তু সেদিন শুক্রবার বিকেল৷ দুদিন টানা বৃষ্টির পর সারাদিন চড়া রোদ উঠেছিল৷ ওরা যখন রবীন্দ্রসদন, ভিক্টোরিয়া হয়ে ওখানে পৌঁছল তখন রোদ মরে এসেছে৷

একটা বাঁধানো অর্ধচন্দ্রাকার চাতালের মতো জায়গা৷ সেখানে একটা বেঞ্চে বসে সামনে গঙ্গার শোভা দেখছিল ওরা৷ গঙ্গার উপর দিয়ে কয়েকটা নৌকো ইতস্তত ভাসছে। চাতালটা নদীর মধ্যে এতখানি ঢুকে এসেছে যে হঠাৎ তাকালে মাঝনদীতে নৌকোয় ভাসছে বলে বিভ্রম হয়৷ ‘ঠিক মনে হচ্ছে না, আমরা নৌকোতে বসে আছি!’ প্রশ্নটা করে সীমন্তিনী অরুণাভর দিকে তাকিয়েছিল৷ অরুণাভ একদৃষ্টে ওর দিকেই চেয়ে আছে৷ সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে অরুণাভ ভাবছিল— সীমন্তিনীর কী আশ্চর্য মিল ওর মাসির সঙ্গে!

‘ইউ রিমাইন্ড মি অফ সামওয়ান৷’ অরুণাভ বলেছিল৷

‘কে? সামওয়ান ফ্রম ফিলাডেলফিয়া অর বস্টন?’

‘শি লিভস্‌ ইন দ্য ওয়েস্ট কোস্ট৷ আই অ্যাম টকিং অ্যাবাউট বৃন্দা৷ ইউ লুক একজ্যাক্টলি লাইক হার৷’

সীমন্তিনী চুপ করে আছে৷ ও ঠিক করেছে বৃন্দার সম্পর্কে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করবে না৷ কোনও মন্তব্যও নয়৷

ও শুধু বলেছিল— ‘হাউ ডু ইউ নো হার?’

‘সি ওয়াজ মাই পেরেন্টস্‌ ফ্রেন্ড ফর আ ভেরি লং টাইম৷’ 

সীমন্তিনী লক্ষ করেছিল অরুণাভ কষ্ট করে সহজ হচ্ছে বৃন্দার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে৷ অরুণাভকে কোনও অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি ও৷ কথা ঘুরিয়েছিল ওর মা-বাবা-বোনের প্রসঙ্গে৷ দমদমের বাড়ি থেকে কবে ইংল্যান্ডে গেল, জিনিয়ার জন্ম, আমেরিকায় চলে আসা, একটা সুখী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা— সব কিছুই যেন সীমন্তিনীর অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ ওর আশপাশে চেনা যাদের দেখেছে, তাদের থেকে যেন অনেকই আলাদা অরুণাভ, প্রতিদিন নতুন করে মনে হচ্ছিল সীমন্তিনীর৷ ওর ক্ষতটায় যেন অদ্ভুত একটা প্রলেপের কাজ করছিল অরুণাভ৷

Princep Ghat
ভিক্টোরিয়া আর ময়দান চত্বর ঘুরে ওরা আউট্রাম ঘাটে প্রিন্সেপ ঘাটের চত্বরে বসেছিল

ঠিক সেই সময় আউট্রাম ঘাটের সেই বেঞ্চে বসে অরুণাভ বলেছিল— আই নো অ্যাবাউট ইওর মম৷ বৃন্দাদি হ্যাজ টোল্ড মি এভরিথিং৷

চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল সীমন্তিনীর। ‘অরুণাভ হোয়াটেভার য়্যু নো, কিপ দ্যাট টু ইয়োরসেল্ফ৷ আমার মা সেই দু’বছর বয়স থেকেই আমার কাছে মৃত৷ ডেড অ্যাজ ডেড ক্যান বি৷ প্লিজ ডোন্ট মেনশন হার অর হার সিস্টার টু মি এভার৷’ অরুণাভ একত্রিশ বছর ধরে সেই কথার খেলাপ করেনি৷ মেনে নিয়েছে ওদের প্রাইভেসির সীমা কখনও লঙ্ঘিত হবে না৷

বাদামওয়ালা কাছ থেকে বাদাম কিনেছিল ওরা৷ ভাঁড়ে চা খেতে খেতে ওরা দেখছিল— পশ্চিমের আকাশ রাঙা হয়ে আসছে৷ সূর্যাস্তের রং ধরেছে ওপারে বিদ্যাসাগর সেতুর উপর দিয়ে তেরছাভাবে৷ হঠাৎ অরুণাভ বলেছিল—

‘চল নৌকো চড়ি৷ চড়বে?’

একটা গোটা নৌকো ভাড়া করেছিল ওরা৷

পাশাপাশি বসে যেতে যেতে অরুণাভ বলেছিল— ‘ইওর নেম ইজ সো বিগ৷ ক্যান আই কল ইউ সামথিং এলস্‌?’

‘আমার নতুন নাম দেবে?’ সীমন্তিনীর মুখে একটু হাসির আভাস লক্ষ করেছিল অরুণাভ৷

‘না না, নতুন নাম নয়, ইফ আই শর্টেন ইট? যদি সিমন বলি? আই ক্যান প্রোনাউন্স ইট ইজিলি৷’

‘আর তো বেশিদিন আমার নাম প্রোনাউন্স করার দরকার হবে না৷ তোমার ফ্লাইট তো আর তিন দিন বাদে৷ তারপর আবার কবে আসবে তো ঠিক নেই! শহরটা তো দেখেই গেলে মোটামুটি৷ সীমন্তিনীর গলা একটু কেঁপে গেছিল৷

সদ্যনির্মিত বিদ্যাসাগর সেতুর ওপাশ দিয়ে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে সূর্যাস্ত হচ্ছিল৷ পশ্চিমের সমস্ত আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে রয়েছে৷

‘আর দু-এক বছরের মধ্যেই এই ব্রিজটা চালু হয়ে যাবে৷ দু’বছর পরে যদি কলকাতায় আসি, তখন দেখব ব্রিজের উপর দিয়ে পারাপার করছে মানুষ৷’ অরুণাভ একটু উইস্টফুলি বলছিল৷

‘ব্রিজের কাজই তো তাই, পারাপার সহজ করে দেওয়া’৷

‘জানো আর্কিটেক্ট হিসেবে আমার বাবা শহরের স্কাইস্ক্র্যাপার বানিয়েছেন যা তার চেয়ে অনেক কম তৈরি করেছেন ব্রিজ৷ হি শুড হ্যাভ বিল্ট মোর ব্রিজেস৷ ইফ আই ওয়্যার অ্যান আর্কিটেক্ট আই উড হ্যাভ কনসেনট্রেটেড মোর অন বিল্ডিং ব্রিজেস৷’

‘তবে সব ব্রিজ পারাপারের জন্য হয় না৷ কিছু ব্রিজ হয় চির নির্বাসনের জন্য৷ ভেনিসে যেমন বিচার হবার পরে বন্দিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সেতুর উপর দিয়ে চলে যেত প্রিজনে৷ যাবার আগে ছোট্ট জানলার ফাঁক দিয়ে শেষবারের মতো দেখে নিতো বাইরে জেগে থাকা মোহময়ী ভেনিসকে৷’ সীমন্তিনী মনে করিয়ে দিয়েছিল৷

‘কিন্তু হোয়াট আ রোম্যান্টিক নেম! ব্রিজ অব সাইজ৷ দীর্ঘশ্বাসের সেতু৷ যেন অসংখ্য মানুষের হাহাকার আর কান্না মিশেই তৈরি হয়েছে ওই ব্রিজ৷ হারিয়ে যাওয়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে ওই সেতুর প্রতিটি অণু পরমাণুর গায়ে৷’ একটু থেমেছিল অরুণাভ৷ একটু সময় নিচ্ছিল কীভাবে বলবে কথাটা ভাবতে গিয়ে৷ সীমন্তিনীর জন্য একটা চোরা মায়ার টান ভিতরে ভিতরে টের পাচ্ছিল ও৷ অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছে এই মেয়ে৷ ওকে আর কখনও কষ্ট পেতে দেবে না অরুণাভ৷

bridge of sighs venice

‘আমি জানি না কীভাবে বলব কথাটা৷ আমি কলকাতা এসেছিলাম এমনিই৷ কিছু পাব বলে ভাবিনি৷ কিন্তু এই ক’দিনে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর একটা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি আমি৷ সেই স্বপ্নটা তুমি ছাড়া ইনকমপ্লিট রয়ে যাবে৷ সিমন, উইল য়্যু ম্যারি মি? প্লিজ ডোন্ট সে নো৷’ আর্তনাদের মতো শুনিয়েছিল অরুণাভর গলাটা৷ সীমন্তিনীর ডান হাতটা নিজের হাতে নিয়ে খুব সন্তর্পণে ধরেছিল অরুণাভ৷ যেন হাতটা পরম ভঙ্গুর একটা পদার্থ, যত্ন করে ধরে না রাখলে ভেঙেচুরে যাবে৷ সীমন্তিনী বাধা দেয়নি৷ হাতটা ধরে রাখতে দিয়েছিল৷ 

হ্যাঁ, আমরা সেতু গড়তে চেষ্টা করি একটা আমাদের মতো করে। দুজন ভাঙাচোরা মানুষ সেখানে এসে একটু বিশ্রাম করবে, একটু রসদ নিয়ে নেবে দৈনন্দিন লড়াইয়ের জন্য৷ না, এসব কিছু বলেনি সীমন্তিনী, শুধু মাথাটা হেলিয়ে দিয়েছিল অরুণাভর কাঁধে৷ অনেক পরে বলেছিল, ‘হানিমুনে কোথায় যাব আমরা?’

‘ভেনিস যাবে? তোমাকে আমি সারা পৃথিবী ঘোরাব সিমন৷ তুমি শুধু আমার সঙ্গে থেকো৷ আমাকে ছেড়ে যেও না৷’ ভিতর থেকে খুব আন্তরিকভাবে কথাগুলো বলেছিল অরুণাভ৷ সেই শুরু একসঙ্গে পথ চলার৷ বাকি অংশগুলো স্মুদলি হয়ে গেছিল৷ মার্কিন নাগরিকের স্ত্রীর আমেরিকায় যাওয়ার ছাড়পত্র পেতে অসুবিধা হয়নি৷ অম্বিকা যেন এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিলেন৷ ওদিকে অপেক্ষায় ছিলেন জ্যোতির্ময়, অরুণলেখাও৷ হঠাৎ ছেলে কলকাতায় গিয়ে অচেনা এক মেয়েকে বিয়ে করে আনছে, এই আশঙ্কা সমূলে দূর হয়েছিল সীমন্তিনীকে দেখার পর৷ বিরাট বড় রিসেপশনের আয়োজন করেছিলেন তাঁরা ফিলাডেলফিয়ার একটি মহার্ঘ্য হোটেলে৷

তখন কলকাতা থেকে সরাসরি আমেরিকার কোনও বিমান ছিল না৷ অরুণাভর টিকিট পিছিয়ে যেদিন করা হয়, সেই একই দিনে টিকিট কাটা হয়েছিল সীমন্তিনীর৷ ‘অরুণাভ, এত তাড়াতাড়ি তোমরা বিয়ের ডিসিশন নিলে, এ তো আমাদের একটা প্রোভার্ব আছে, ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ সেরকম হয়ে গেল৷ আমার পক্ষে তো সব জোগাড় করাই মুশকিল!’ একটু ঠাট্টার সুরে বললেও অম্বিকার কথার মধ্যে সত্যি ছিল৷ অরুণাভ অবশ্য কোনও আতিশয্য করতে দেয়নি৷ ম্যারেজ রেজিস্টার ডেকে সই করে বিয়ে হয়েছিল কলকাতায়৷ একটা ঢাউস স্যুটকেসে কিছু নতুন শাড়ি আর অত্যাবশ্যক সামগ্রী নিয়ে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছিল সীমন্তিনী নতুন বরের সঙ্গে৷ ‘আঙ্কল, য়্যু হ্যাভ টু বি উইথ ইয়োর ডটার ভেরি সুন৷’ অরুণাভ অনুরোধ করেছিল৷ প্রসন্ন হেসে সম্মতি দিয়েছিলেন অম্বিকা৷ বিদেশ যাত্রার সময় মেয়ের সঙ্গে দেশের শেষবিন্দুটি অবধি গিয়েছিলেন তিনি৷ সান্টাক্রুজ বিমানবন্দরে বাবাকে হাত নেড়ে অরুণাভর সঙ্গে বাঁক ঘোরার মুখে কাঁদতে কাঁদতে সীমন্তিনী দেখেছিল প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে আসা বহু মানুষের ভিড়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন অম্বিকা৷ মাঝে মাঝে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছেন চোখ৷ না, তখন সিকিউরিটি এনক্লোজারের ভিতরে চলে এসেছিল সীমন্তিনী৷ দৌড়ে আর বাবার কাছে গিয়ে ‘কেঁদো না বাবা’ বলারও উপায় ছিল না৷ বিশাল বিমানে উইন্ডো সিট নিয়েছিল অরুণাভ ওর জন্য৷ সিট বেল্ট বাঁধতে শিখিয়ে দিয়েছিল ওর তিন দিন আগের বিয়ে করা প্রায় অচেনা বর৷ আত্মরক্ষার সহজ করণ-কৌশল৷ সিট বেল্ট বেঁধে কাঠের পুতুলের মতো বসেছিল সীমন্তিনী সামান্য উদ্বেগ নিয়ে অচেনা দেশে অচেনা শ্বশুরশাশুড়ির জন্য, তিনদিনের পুরনো প্রায় অচেনা স্বামীর জন্য, একলা রেখে যাওয়া বাবার জন্য৷ আস্তে আস্তে মাটি দিয়ে চলতে শুরু করে গতি বাড়াল লুফৎহানসা৷ একসময় লাফিয়ে উঠল উঁচুতে৷ নীচের দিকে তাকিয়ে সীমন্তিনী অনুভব করছিল মাথার ভিতরটা একটু ফাঁকা ফোঁপরা মতো লাগছে। সীমন্তিনী বুঝতে শিখেছিল একে বলে ভারহীনতা৷ বিমান একটু হেলে ক্রমশ সোজা হচ্ছে, গতি বাড়ছে উড়ন্ত হাঁসের৷ উচ্চতাও বাড়ছে একটু একটু করে৷

বিদেশ যাত্রার সময় মেয়ের সঙ্গে দেশের শেষবিন্দুটি অবধি গিয়েছিলেন তিনি৷ সান্টাক্রুজ বিমানবন্দরে বাবাকে হাত নেড়ে অরুণাভর সঙ্গে বাঁক ঘোরার মুখে কাঁদতে কাঁদতে সীমন্তিনী দেখেছিল প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে আসা বহু মানুষের ভিড়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন অম্বিকা৷ মাঝে মাঝে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছেন চোখ৷ না, তখন সিকিউরিটি এনক্লোজারের ভিতরে চলে এসেছিল সীমন্তিনী৷ দৌড়ে আর বাবার কাছে গিয়ে ‘কেঁদো না বাবা’ বলারও উপায় ছিল না৷ বিশাল বিমানে উইন্ডো সিট নিয়েছিল অরুণাভ ওর জন্য৷ সিট বেল্ট বাঁধতে শিখিয়ে দিয়েছিল ওর তিন দিন আগের বিয়ে করা প্রায় অচেনা বর৷

সীমন্তিনী জানলা দিয়ে একটু ঝুঁকে দেখছিল বাড়িঘর, ঘাসজমি, বিশাল চাকার মতো টারবাইনগুলো ক্রমশ ছোট থেকে আরও ছোট হচ্ছে, সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আছে দিগন্ত ছাপিয়ে। আর অনেক নীচে আরব সাগরের জলরাশি৷ ভারতবর্ষের চেনা তটরেখা ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে৷

(৩৭)

রণো আর রোহিণী এখন উইকেন্ডগুলোয় একটু দূরে দূরে যেতে পছন্দ করে৷ সানিভেল ছোট জায়গা৷ সানিভেলের সব আর্ট মিউজিয়াম, কফিশপ, ফার্মর্স মর্কেট, রাস্তা, গলিঘুঁজি সব যেন মুখস্থ হয়ে গেছে রোহিণীর৷ রণো ট্রেনে অফিসে চলে গেলে সারাটা দিন ওর অফুরন্ত সময়৷ তখন ও নিজের কাজে ডুবে যায়৷ বিকেলে নিয়ম করে হাঁটতে বেরোয়৷ ঠিক ব্যায়াম করার মানসিকতা নিয়ে নয়৷ যে কোনও শহরে হেঁটে হেঁটে তার চার পাশে চৌহদ্দিগুলো চিনতে ভালো লাগে ওর৷ কিন্তু কাঁহাতক আর ফার্মাস মার্কেটে গিয়ে ফ্রেশ সব্জি কেনা, নতুন কফিশপে কফি আর কুকিজ খাওয়া, সব কিছুরই একটা নভেলটি ভ্যালু আছে৷ কিছুদিন বাদে সবই একটু একঘেয়ে লাগে৷ রোহিণী ঠিক করেছে শনি রবিবারগুলো চুটিয়ে ঘুরে বেড়াবে রণোর সঙ্গে৷ অনেকদিন বাদে একসঙ্গে এরকম ঘুরে বেড়াবার মধ্যে দিয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে রোহিণীর৷ নিউ ইয়র্কে ঠিক এভাবেই ঘুরে বেড়াত ওরা৷ পায়ে হেঁটে, কিংবা সাবওয়েতে৷ ও আসার পর রণো একটা নতুন গাড়ি কিনেছে৷ স্লেট রঙের টয়োটা করোলা, ওদের হাইব্রিড কার৷ ইলেকট্রিকে চলে গাড়িটা৷ শুধু ইগনিশনটা হয় গ্যাসে৷ রণোর কোম্পানিও এই ধরণের গাড়ি কেনার জন্য এনকারেজ করছে৷ ওর অনেক সহকর্মী বন্ধুবান্ধব হাইব্রিড কারের দিকে ঝুঁকেছে৷ গাড়িটা নিয়ে দুসপ্তাহ হল শনি-রবিবার দেখে ওদের শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে দূরে বেরিয়ে পড়ছে৷ সেইরকমভাবেই ওরা আজ এসেছে সানফ্রানসিস্কো৷ রোহিণীর  আবার গোল্ডেন গ্রেট ব্রিজ দেখতে ইচ্ছে ছিল অনেকদিন ধরে৷

sunset from flight
সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আছে দিগন্ত ছাপিয়ে

রণো একটু মনমরা হয়েছিল রোহিণী যতদিন আসেনি৷ এবার ও নিজে থেকেই এসেছে৷ শুধু তাই নয়, ওর ফেরারও সেরকম কোনও তাড়া নেই৷ অনেকদিন বাদে রোহিণী সত্যি সত্যিই পড়ানোর চাকরিটা ছাড়বে ছাড়বে করছে৷ রণো এতে ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজিত৷ সেই জন্যেই রোহিণীর সঙ্গে গিয়ে দেখেশুনে গাড়িটা কিনেছে ও৷ এমনিতে রণো ক্যালট্রেনেই অফিস যাতায়াত করে৷ স্যানহোসে থেকে সানফ্রানসিস্কো যাতায়াত করে ক্যালট্রেন৷ সানিভেল থেকে মাউন্টেন ভিউ একটা স্টেশন৷ ভ্যালি ট্রান্সপোর্ট অথরিটির বাসও যায় মাউন্টেন ভিউ৷ কিন্তু ছুটির দিনে রোহিণীর সঙ্গে একটু ঘুরবে, একটু শপিং করবে, তারপর রেস্টুরেন্টে খেয়ে ফিরবে— এসব ভেবেই গাড়িটা কেনা৷ রোহিণীও ইদানীং অপেক্ষা করে থাকে উইকেন্ডের ডে আউটের জন্য৷ আজ ওরা সোজা গাড়ি নিয়ে সানফ্রানসিস্কো এসেছে৷ বাড়ি থেকে খুব কাছে৷ মিনিট চল্লিশের ড্রাইভ৷ ফেব্রুয়ারি মাস পড়ে গেছে৷ এখানে ওয়েদার খুব সুন্দর৷ ইস্ট কোস্টের মতো তীব্র শীত নেই৷ সূর্যাস্তের সময় নাগাদ ওরা গোল্ডেন গেটের কাছে পৌঁছে গেল৷

‘উপর দিয়ে যাই ওপারে?’ রণো জিজ্ঞেস করল৷

‘তোর যা খুশি৷ দূর থেকেও দেখতে পারি৷’ 

‘আগে ব্রিজের উপর থেকে তলায় সমুদ্রটা কেমন দেখায় দেখে নে৷ ম্যারিনো কাউন্টি অবধি যাই চল৷ তারপর তো আবার এদিক দিয়েই ফিরব৷’

অন্য সময় হলে রোহিণীও ভাগ করে চালায়, কিন্তু কেন জানে না, নতুন জায়গায় এসে গাড়ি চালাতে ওর একদম ইচ্ছে করে না৷ বরং রণোর পাশে বসে চারিদিকটা তাকিয়ে দেখতে ওর অনেক বেশি ভালো লাগে৷ সূর্য পশ্চিমে চলে এসেছে৷ সাইড মিরর দিয়ে দেখা যাচ্ছে পিছনে অনেকটা আকাশ জুড়ে সিঁদুরে রং৷ ওদের ডান দিকে বে এরিয়া, বাঁদিকে প্যাসিফিক৷ অনেক দূরে দিগন্তের কাছে দু-একটা জাহাজের আভাস৷ এপাশেও দু-একটা প্রমোদ তরণী সুসজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধের প্রমোদভ্রমণের জন্য৷ ওপারে গিয়ে একটা ছোট্ট কফিশপে থেমেছে ওরা৷ রোহিণী একটা লাইম জুস কার্ডিয়াল নিয়েছে৷ রণো কাপুচিনো৷ অরেঞ্জ কেক আর কুকিজ নিয়েছে দুজনে৷ সারা সপ্তাহ নিয়ম মেনে খুব অল্প ক্যালোরি ইনটেক করে ওরা৷ ওট্‌স্‌ ফল এসবই খায় বেশি৷ রণোর অফিসের ক্যাফেটেরিয়াতে প্রচুর খাবার৷ কিন্তু ইদানীং খুব হিসেব করে খায় রণো৷ ফ্যাট একবার জমতে শুরু করলে কমানো খুব কঠিন৷ শুধু উইকেন্ডের এই বেড়ানোর সময় খাওয়ার কোনও বাছবিচার করে না ওরা৷ ইচ্ছেমত খায়৷ রোহিণী শুধু ক্যাফিন-বেস্‌ড কোনও ড্রিঙ্ক সাধারণত বিকেলের পরে খায় না, ঘুমের অসুবিধে হয় বলে৷

খেতে খেতে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে ওরা৷ পরে কোনও সময় একবার পিসিমণির ওখানে যেতে হবে৷ রোহিণীও সানিভেলে এসেছে শুনে জিনিয়া অনেকবার করে ওদের যেতে বলেছে৷ এপ্রিলের শেষের দিকে পিসিমণিরা আবার একটা ক্রুজে বেরিয়ে যাবে৷ কথা দেওয়া ছিল ওর ছেলে রুণকে৷ তার আগে যেতে হবে সান ডিয়েগোতে৷ এর মধ্যে সীমন্তিনীদেরও একবার আসার কথা আছে৷

‘আই ওয়াজ থিঙ্কিং অফ গোয়িং টুগেদার উইথ বাবাই অ্যান্ড মাম্মা৷ পিসিমণির সঙ্গে দেখা হলে একটা ফ্যামিলি রি-ইউনিয়ন হয়ে যাবে৷’

‘হ্যাঁ৷ তাহলে তো দারুণ হয়৷’ বলছে বলে, কিন্তু রোহিণীকে যেন একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে৷ ‘কী রে, কী ভাবছিস?’ রণো খুব আন্তরিকভাবে জানতে চায়৷

সূর্য পশ্চিমে চলে এসেছে৷ সাইড মিরর দিয়ে দেখা যাচ্ছে পিছনে অনেকটা আকাশ জুড়ে সিঁদুরে রং৷ ওদের ডান দিকে বে এরিয়া, বাঁদিকে প্যাসিফিক৷ অনেক দূরে দিগন্তের কাছে দু-একটা জাহাজের আভাস৷ এপাশেও দু-একটা প্রমোদ তরণী সুসজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধের প্রমোদভ্রমণের জন্য৷ ওপারে গিয়ে একটা ছোট্ট কফিশপে থেমেছে ওরা৷ রোহিণী একটা লাইম জুস কার্ডিয়াল নিয়েছে৷ রণো কাপুচিনো৷ অরেঞ্জ কেক আর কুকিজ নিয়েছে দুজনে৷

একটু চুপ করে আছে রোহিণী৷ বলবে কি বলবে না ভাবছে৷

‘রণো, আমি মার্চের শেষের দিকে দেশে যাব ভাবছি৷ তোকে বলেছিলাম না একটু ঘুরতে চাই কয়েকটা জায়গা৷’

‘তুই এখনও ওই ডায়েরিটা নিয়ে অবসেস্‌ড্‌ হয়ে আছিস, তাই না?’ রণো জানতে চায়৷

‘না রে৷ আসলে তা ঠিক নয়৷ বাবাইয়ের পিসির ব্লগটাও খুব টানে আমাকে৷ মনে আছে তোকে দেখিয়েছিলাম কয়েকটা৷ মনে হয় আমিও তো দেশেই ছিলাম আঠেরো বছর অবধি৷ কিন্তু আমার দেখার চোখটা ঠিক ডেভেলপ করেনি তখনও৷ তাই আবার ওই জায়গাগুলোয় যেতে ইচ্ছে করে৷ এখনকার জায়গাগুলো, মানুষগুলোকেও বুঝতে ইচ্ছে করে৷ আবার একটু টাইম-ট্রাভেল করে জানতে ইচ্ছে করে তখনকার মানে সিক্সটিজ, সেভেন্টিজ, এইট্টিজ কীরকম ছিল৷’

‘তোর আইটিনারি ঠিক করেছিস?’ রণো বলে৷

‘কিছুই ভাবিনি সেভাবে৷ বাংলাদেশেও যাওয়া দরকার৷ ডক্টর রহমানদের বললেই ওঁরা ওখানে ব্যবস্থা করে দেবেন৷ ঢাকা, খুলনা আরও কয়েকটা জায়গায় যাবার ইচ্ছে আছে৷ দাদাকে মেল করে টেন্টেটিভ প্ল্যানটা বলেছি৷ রণো, তুই যাবি আমার সঙ্গে?’

‘আমি? ইউ মিন তোর সঙ্গে? এত শর্ট নোটিশে?’ রণো একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলে৷ —‘তুই কতদিন থাকবি? আমি তো ছুটি পাব না অত৷’ এক অনিশ্চয়তা রণোর চোখে মুখে৷

‘ধর তুই যদি পরে জয়েন করিস আমার সঙ্গে৷ অন্তত বাংলাদেশের ফেজটায়? একবার কোনও চাকরিতে জয়েন করলে তো আমিও ছুটি পাব না সঙ্গে সঙ্গে৷ তাই ভাবছিলাম৷ এখনই ঘুরে আসি৷ এই চার মাসের মধ্যে৷’

‘দাঁড়া, দেখছি কী করা যায়?’ রণো বলে

আবার গোল্ডেন গেট ব্রিজ ধরে দক্ষিণের দিকে ফিরছে ওরা৷ টুপটুপ করে সন্ধের আলোগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে৷ রণো গাড়ি চালাতে চালাতে বলে ‘চল ডিনার খাওয়ার আগে তোকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাই৷’

‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করে রোহিণী৷ রণো জি.পি.এস-এর দিকে ইশারা করে৷ বেদান্ত সোসাইটি বলে একটা জায়গা, সাব ডেস্টিনেশন দিয়েছে ও৷ —‘এই জায়গাটা শুনেছি খুব ইন্টারেস্টিং৷ সাম অফ মাই কলিগস টোল্ড মি৷’

lime cordial juice
রোহিণী একটা লাইম জুস কার্ডিয়াল নিয়েছে

মোটামুটি সংক্ষিপ্ত একটা ইতিহাস বলে রণো৷ ইন্টারনেট লব্ধ-জ্ঞান৷ বিবেকানন্দের ফ্রিসকো সফর থেকেই শুরু হয় ওয়েস্ট কোস্টে বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তোলার ভাবনা৷ গায়ত্রী দেবী বলে এক বাঙালি মহিলাও পুরনো বেদান্ত সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় শিকাগো সেন্টারটা চালাতেন উনি৷ রণো ফিক করে দুষ্টুমিভরা হাসি হাসছে৷ 

‘দেখ, এখন আবার মর্ডান এরা-র কোনও বাঙালি মহিলাকে ওখানে ডিসকভার করিস নাকি?’ তোর প্রজেক্টের একটা বড় দিক হয়ত খুলে গেল, বলা যায় না৷’

‘ডোন্ট টক রাবিশ রণো৷ ফালতু কথা বলিস না৷ তুই জানিস আমি কতটা সিরিয়াস এই আগের সময়কে রি-ডিসকভার করার ব্যাপারটা নিয়ে৷’ রোহিণী রেগেমেগে বলছে৷

‘আরে তুই রাগছিস কেন? আমিও সিরিয়াসলি বলছি৷ প্রচুর ইন্ডিয়ানরা আসে ওখানে, টিমোথিই বলছিল৷ পুজোতে যেরকম হয় না?’ রণো কনভিন্স করতে চেষ্টা করছে রোহিণীকে৷

একটু খুনসুটির মেজাজেই ওরা পৌঁছে গেল মন্দিরটার চত্বরে৷ ব্রিজ থেকে নামার পর আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা৷ সন্ধে হয়ে এসেছে৷ মন্দিরটা অনেকটা চার্চের ধাঁচে বানানো৷ বাইরেটা স্প্যানিশ আর্কিটেকচার৷  ভিতরটায় লম্বা টানা হল৷ দুপাশে বড় বড় শার্সির জানলা৷ দুদিকে রো ধরে চেয়ার পাতা৷ মাঝখান দিয়ে সরু করিডর চলে গেছে মূল বেদীর দিকে৷ রামকৃষ্ণ, সারদা মা, স্বামী বিবেকানন্দের ছবির পাশে বুদ্ধেরও ছবি, রোহিণী লক্ষ করল৷ মন্দিরে সন্ধ্যারতির জোগাড় চলছে৷ অল্প পরেই আরতি শুরু হবে বলে বোঝা যাচ্ছে ৷ দুজন মহারাজ বসে আছেন ভক্তদের দিকে মুখ করে একটু কোনাচেভাবে৷ রণোর কথা মিথ্যে নয়৷ বেশ কিছু ভক্ত সমাগম হয়েছে৷ সত্যিই রণো যেমন বলেছিল অধিকাংশই মধ্যবয়সী ভারতীয় স্ত্রী-পুরুষ৷ কিছু বৃদ্ধ বৃদ্ধাও এসেছেন৷ যদিও এঁদের মধ্যে কতজন বাঙালি, দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ আরতি প্রায় শুরু হবে হবে৷ এমন সময় প্রধান দরজা দিয়ে দুই ভদ্রমহিলা ঢুকলেন৷ এঁরা ভিতরে আসতেই সমাবেত ভক্তদের মধ্যে একটা গুঞ্জন তৈরি হল৷ মহারাজদের একজন সহাস্যে বললেন— বড় মা আর দিদি এসেছেন৷ একজন সাহায্যকারীকে বললেন ধরে ধরে নিয়ে এসে ওঁদের সামনের সারিতে বসিয়ে দেবার জন্য, রোহিণী তাকিয়ে দেখতে পেল ৷

মহিলা দুজনের পরনে গাদোয়াল শাড়ি, ভীষণ সোফিস্টিকেটেড রুচিসম্পন্ন দুজনেই বোঝা যায়৷ আশপাশের ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলারা বেশিরভাগই ওঁদের চেনেন বলে মনে হল রোহিণীর৷ চেনাই স্বাভাবিক৷ এই মন্দিরে বা বেদান্ত সোসাইটির বিভিন্ন লেকচারে একই গোষ্ঠীর লোকজন আসে৷ হয় তারা বেদান্ত সোসাইটির মেম্বার, মিশন এবং স্বামী বিবেকানন্দের মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়তো এই অঞ্চলেই বসবাস৷ বোঝা যাচ্ছে ভদ্রমহিলা দুজনও এদের খুব পরিচিত৷ রোহিণীরা যেখানে বসেছে, তার উল্টোদিকের ডানহাতের দুটো চেয়ারে ওঁরা বসেছেন৷ প্রথমে একটু বেদগান৷ তারপর আরতি শুরু হল৷ ওঁরা সঙ্গে করে একটা বিরাট বড় ডালি সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন৷ কাঠের একটা গোল সুদৃশ্য থালার উপর অনেক জিনিস রাখা৷ যেহেতু উপরে একটা কুরুশের কাজ করা ঢাকা রয়েছে, তাই ভিতরের জিনিসগুলো কী বোঝা যাচ্ছে না৷ রোহিণীর এপাশে এক মধ্যবয়সী মহিলা৷ বোঝা যায় উনি ওই দুজন ভদ্রমহিলাকে চেনেন৷ ওপাশ থেকে ওঁরা ওর পাশের ভদ্রমহিলাকে নড করে হাসলেন৷ আরতির পর যখন প্রসাদ বিতরণ পর্ব চলছে তখন এক ফাঁকে রোহিণী পাশের ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল ওঁদের পরিচয়৷ ভদ্রমহিলা একগাল হেসে বলছেন— ‘ইউ ডোন্ট লিভ হিয়ার, ডু ইউ? থাকলে তুমি মিসেস গোল্ডস্টাইনকে নিশ্চয়ই চিনতে৷ অন্যজন ওঁর মেয়ে৷’

আরতি প্রায় শুরু হবে হবে৷ এমন সময় প্রধান দরজা দিয়ে দুই ভদ্রমহিলা ঢুকলেন৷ এঁরা ভিতরে আসতেই সমাবেত ভক্তদের মধ্যে একটা গুঞ্জন তৈরি হল৷ মহারাজদের একজন সহাস্যে বললেন— বড় মা আর দিদি এসেছেন৷ একজন সাহায্যকারীকে বললেন ধরে ধরে নিয়ে এসে ওঁদের সামনের সারিতে বসিয়ে দেবার জন্য, রোহিণী তাকিয়ে দেখতে পেল ৷

বোঝাই যাচ্ছে মিসেস গোল্ডস্টাইন এ অঞ্চলে বেশ বিখ্যাত ব্যক্তি৷ অন্য মহিলার বাবা তাহলে আমেরিকান কোনও ব্যক্তি৷ মহিলাকে দেখেও মনে হয় বিদেশি রক্তের একটা মিশেল আছে৷ রোহিণীর বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে এই মহিলাদের৷ ওর মধ্যে অন্যের ব্যক্তিগত জীবনগুলো বোঝার একটা উদগ্র চেষ্টা আছে৷ যেটা সবসময় সবার ভালো না লাগাই স্বাভাবিক৷ তবু রোহিণী উশখুশ করছে এঁদের সঙ্গে একটু আলাপ করার জন্য৷ সেটা লক্ষ করে রণো বলল—‘ডোন্ট ট্রাই টু ওভারপুশ৷ সিভিলিটি রেখে যেটুকু কথা বলা যায়, সেটুকুই বল্‌৷’

কিন্তু কথা বলবে কী করে ? গোটা হলঘরটায় রীতিমত ভিড়৷ কেউ কেউ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ঠাকুর আর স্বামীজীর ছবিতে প্রণাম করার জন্য৷ কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যস্ত৷ ওই দুই মহিলা এখন উঠে দাঁড়িয়েছেন৷ ওঁদের ঘিরে ধরেও একটা ছোটখাটো জটলা৷ এর মধ্যে হঠাৎ সম্পূর্ণ অচেনা একজন গিয়ে যদি আলাপ করতে চায়, তবে সেই আলাপ কতটুকু এগোতে পারে? রোহিণী একটু অনিশ্চিতভাবে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আছে৷ পাশে রণো দাঁড়িয়ে৷ একটু কিউরিয়াসভাবে বুঝতে চেষ্টা করছে রোহিণী— কীভাবে অ্যাপ্রোচ করবে৷ ওঁরা মহারাজদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে বাইরের দিকে আসার জন্য করিডর ধরে হাঁটছেন, রণো আর রোহিণী করিডরের শেষ মাথায় অপেক্ষা করছে৷ রোহিণী খুব ব্যগ্রভাবে ভাবছিল শেষ মুহূর্তে যদি ওঁদের কারুর সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়! তাহলে ওর একটা সুযোগ থাকে আলাপ করার৷ রণো ক্যাজুয়ালি দাঁড়িয়ে ওর স্টাবলে হাত বোলাচ্ছে। মিসেস গোল্ডস্টাইনের হাতে একটা লাঠি৷ লাঠির উপর ভর দিয়ে আসতে আসতে উনি থমকে গেলেন, ওঁর দৃষ্টি সোজা রণোর দিকে৷ সঙ্গের মাঝবয়সী মহিলা যিনি ওঁর মেয়ে, তিনিও মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে রণোর দিকেই তাকিয়ে৷ রোহিণী ধড়ফড় করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু তার আগেই উনি রোহিণীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রণোকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন— ‘ডু আই নো ইউ? হ্যাভ আই সিন ইউ সামওয়্যার?’

রণো একটু ভড়কে গেছে৷ এভাবে তাকে প্রশ্ন করবেন মহিলা, ও আশা করেনি একদম৷ হতভম্ব ভাবটা চটপট কাটিয়ে উঠে ও বলল— ‘আই ডোন্ট থিংক সো৷ আই অ্যাম রণজয় সেন অ্যান্ড দিস ইজ মাই ওয়াইফ রোহিণী৷’

এবার ওঁর মেয়ে এগিয়ে এসে ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল৷ ভদ্রতা করে বলছে— ‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ৷ আই অ্যাম সিমোন, বাই দ্য ওয়ে, ডু ইউ লিভ নিয়ারবাই?’

‘সানিভেল৷ হি ওয়ার্কস্‌ ইন গুগল৷ সো উই আর হিয়ার নাও৷ উই আর অরিজিনালি ফ্রম দ্য ইস্ট কোস্ট৷ মাই ইনল’জ আর ইন লেক্সিংটন, আ বস্টন সাবার্ব৷’ রোহিণী বলে৷

মিসেস গোল্ডস্টাইন ওর কথা কিছু শুনছেন না বোঝাই যাচ্ছে৷ উনি একদৃষ্টে রণোর দিকে তাকিয়ে আছেন৷ এবার উনি আবার বললেন— সেন? বাঙালি? কলকাতার?’

এবার রণো আর রোহিণী দুজনেই রীতিমত চমকে গেছে৷ ভদ্রমহিলা ইন্ডিয়ান বলে বুঝতে পারলেও বাঙালি বলে বুঝতে পারেনি একেবারেই৷

‘না, ঠিক কলকাতার নয়৷ মাই গ্র্যান্ডফাদার কেম ফ্রম কলকাতা টু ফিলি৷ মাই ড্যাড ইজ আ নিউরো-সার্জেন ইন ম্যাসজেন৷ মার বাড়ি ছিল কলকাতায়৷

জ্যোতির্ময় সেন? তোমার দাদু? অরুণাভ ইজ ইয়োর ড্যাড৷’ প্রশ্ন নয়, যেন অনেকটা প্রফেসি করছেন উনি৷

হঠাৎ মেঘবিহীন আকাশে বাজ পড়লেও ওরা এতটা অবাক হত না৷ কীভাবে? উনি ওদের ফ্যামিলিকে এতটা চেনেন কীভাবে? অন্য মহিলাও বেশ অবাক হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে৷

রণো অবাকভাবে বলছে ‘আপনি আমাদের ফ্যামিলিকে চেনেন?’ রোহিণী হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করছে— কখনও মাম্মা বা বাবাই কিছু বলেছিল কি, ফ্রিসকোতে চেনা কেউ থাকে বলে! নাঃ তেমন কিছুই মনে পড়ছে না৷

সন্ধের অন্ধকারে ওরা পার্কিং লটের দিকে এগোচ্ছে৷

সল্ট অ্যান্ড পেপার চুলের ভদ্রমহিলা একটু হাসছেন৷ বলছেন, ‘তোমরা আমাকে চিনবে না৷ বাট ওয়ানস্‌ আপন আ টাইম, আই ইউজড টু নো ইওর হোল ফ্যামিলি সো ওয়েল৷’ উনি একটু দম নিচ্ছেন৷ পাশের মহিলা বলছেন— ‘মানি, তুমি একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও৷’

উনি আবার বললেন— ‘না এটুকু আমাকে বলতেই হবে৷’ উনি রণোকে উদ্দেশ্য করে বলছেন— ‘তোমরা হয়ত কখনও পরিবারের কারোও মুখে আমার কথা শুনে থাকবে৷ আমার নাম বৃন্দা৷ বৃন্দা সিনহা৷ এখন সবাই গোল্ডস্টাইন বলে চেনে৷ তোমার মা সীমন্তিনীর আমি মাসি৷ একমাত্র মাসি৷ আর, এই যে একে দেখছ, সিমোন, ও তোমার একমাত্র মাসি৷ তুমি শুনেছ কিনা জানি না, সীমন্তিনী আর সিমোন একই মায়ের সন্তান৷ ওদের মা ছিল আমার দিদি রাধিকা৷’

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৮ জানুয়ারি ২০২৩

ছবি সৌজন্য: Pixahive, Pexels, Flickr, Peakpx, Pxhere,

Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *