আগের পর্ব পড়তে: [] []

কুলধারা

কুলধারা। সে আবার কোথায়? দেখ কাণ্ড! সেই কবে থেকে সোনার কেল্লা উপন্যাস/সিনেমায় মজে থাকার পরে এমন প্রশ্ন করলে দুঃখ হয়। ওই এক সোনার কেল্লার দৌলতে জয়সলমিরের লোকজন একটু-আধটু বাংলা শিখেছেন, দোকানে দোকানে টাঙানো রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ছবি। এমনকী স্থানীয় পুরসভাও নিজেদের পোশাকি নাম করে ফেলেছে স্বর্ণনগরী, আর এখন বলছেন কুলধারার নাম শোনেননি? সত্যিই বিচিত্র সমস্যা। জয়সলমির গিয়ে কেল্লা দেখে, কেনাকাটি সেরে বেলা গড়ালে নিশ্চয়ই চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাম-এর স্যান্ড ডিউন্স দেখতে ছুটেছেন। ওখানে উটের পিঠে চেপে ছবি না তুললে তো জয়সলমির ভ্রমণই সার্থক হল না। এরপরেও কুলধারা কোথায় জানতে চাইলে সত্যি সত্যিই বড্ড লজ্জা লাগে। আরে বাবা, সাম স্যান্ড ডিউন্স যাওয়ার পথে বাঁ দিকে কুলধারা লেখাটা খেয়াল করেননি? যেখানে অনেকগুলো মরু পান্থনিবাসের ফলক লাগিয়ে বাঁ দিকে তির চিহ্নের নিশানা লাগানো আছে, সেই পথেই এগিয়ে চলুন। পথের দু’পাশে গজিয়ে ওঠা চার-পাঁচ তারার ছাপ মারা আট-দশটা হোটেল পেরিয়ে যেখানে গিয়ে রাস্তা মরুতে হারিয়ে যাবে, সেখানেই পেয়ে যাবেন হাল আমলের পাঁচিল ঘেরা এক ধ্বংসাবশেষ যার একমাত্র ফটকের উপর লেখা রয়েছে— কুলধারা।

নিজের জন্যে তো বটেই, কাঁধে ঝোলানো বা মুঠোয় ধরা ক্যামেরাটির জন্যেও টিকিট কেটে ভেতরে চলে আসুন। দেখুন ধ্বংসাবশেষ সাজিয়ে গুজিয়ে রাজস্থান সরকারের পর্যটন উন্নয়ন নিগম কেমন রোজগার করছে। প্রধান রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলে একটু পরেই পেয়ে যাবেন বাজার ও বাসগৃহের ধ্বংসস্তূপ। পাথরের তৈরি বাড়িগুলির দেওয়ালের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আন্দাজ করতে পারবেন, বাড়িগুলি মোটামুটি একই নকশায় নির্মিত হয়েছিল। মাঝখানে উঠোন রেখে চারপাশে গড়ে উঠেছিল ঘর-রান্নাঘর-স্নানাগার। প্রতিটি বাড়ির পিছন দিকে নিকাশি নালার অস্তিত্ব ছিল। এক লপ্তে বেশ কয়েকটি বাড়ির পরেই রাস্তা থাকায় বোঝা যায় যে, বেশ চিন্তা-ভাবনা করেই রীতিমতো নীল নকশা সামনে রেখে গড়া হয়েছিল এই পরিকল্পিত জনপদ। এখন কোনও বাড়িরই ছাদ নেই। সম্ভবত প্রবল মরুঝড়ে উড়ে গেছে অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে না পেরে ভেঙে গেছে। কয়েকটি বাড়ি নিশ্চয়ই দোতলা ছিল। ভাঙাচোরা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারেন। কিন্তু দোতলার ওপরের ছাদ যথারীতি অনুপস্থিত। বাজারের ঘর হোক বা বসতবাড়ির ঘর প্রতিটি দেওয়ালেই কুলুঙ্গি খুঁজে পাবেন। 

Kuldhara village
কুলধারায় এখন কোনও বাড়িরই ছাদ নেই

পর্যটক টানতে রাজস্থান পর্যটন উন্নয়ন নিগমের উদ্যোগে একটি বাড়িকে মেরামত করে অতীতের এক টুকরো নিদর্শন উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। অন্তত একটি মন্দিরকে সারিয়ে তোলায় বোঝা যায় যে কুলধারার মন্দিরগুলি আকার-আয়তনে খুব একটা বড়ো ছিল না। তবে দেওয়ালে পাথর কেটে নানারকমের আলঙ্কারিক কারুকার্য করা হয়েছিল। এই পর্যন্ত রাস্তা নতুন করে গড়ে তোলায় চলতে কোনও অসুবিধা নেই। আরও এগনো যায়। কিন্তু পথ বড্ড বন্ধুর। দূর-দূরান্তে যত দূর চোখ যায় সেই একই দৃশ্য। তিরিশ-চল্লিশটা বিধ্বস্ত বাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। বয়ে যাচ্ছে দুরন্ত বাতাস। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাসই দুপুরের দিকে এখানে বয় মরুভূমির তপ্ত হাওয়া। শীতে তীব্রতা যেটুকু কমে গরমের দিনে তার দ্বিগুণ উত্তপ্ত হাওয়া ঘাটতি পুষিয়ে সমতা ফিরিয়ে আনে। আবার সন্ধ্যার পরে পৃথিবী ঠান্ডা হতে শুরু করলে গরমকালেও উষ্ণতা অনেক কমে আসে। আর তখনই নাকি শুরু হয় তেনাদের রাজত্ব। প্রবল বেগের হাওয়ার সঙ্গে নাকি ভেসে আসে মেয়েলি গলার ক্রন্দনধ্বনি। 

kuldhara
তিরিশ-চল্লিশটা বিধ্বস্ত বাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ

মনুষ্য অবয়বের ছায়া দেখা গেছে বলে শোনা যায় না। তবে কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। এমনকী ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের স্থানীয় মানুষেরাও এই তথ্যকে মর্যাদা দেয়। সত্যি বলতে কী, ধ্বংসাবশেষ ধরে এক-দেড় কিলোমিটার এগিয়ে যাওয়ার পরে একেবারে খটখটে রোদ্দুর ছড়ানো ভরদুপুরে শান্ত ভাবে একটু কান পাতলে আপনিও অমন কিছু একটা শুনতে পারেন। চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে তীব্র বেগে বয়ে যাওয়া মরুবাতাস যেন এক ধরনের ফিসফিসানি বা আলতো কান্নার মতোই শব্দ সৃষ্টি করে। কানে শোনা শব্দ অচিরেই হৃদয়ে অনুভব করবেন। অবশ্যই সেই অনুভূতির সঙ্গে, বুক ঠুকে বলা যায়, কিঞ্চিৎ শীতল শিহরণ মিশে থাকে। তাহলে এটা কি সেই এতদিন ধরে শুনে আসা তেনাদের কণ্ঠস্বর?

এখানে নাকি দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই একদল পালিওয়াল ব্রাহ্মণ বসবাস করত। জপতপ-অধ্যয়ন ছাড়াও তাদের বাণিজ্যে মতি ছিল। মূলত বাণিজ্যের কারণেই তাদের এত সমৃদ্ধি। জয়সলমিরের রাজারাও নাকি এদের সমীহ করতেন এবং একটু দূরত্ব রক্ষা করতেন। উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল এখানকার পরিস্থিতি। লোককথায় বলা হয় যে এককালে নাকি এখানে একটা নদীর অস্তিত্ব ছিল। এবং স্থানীয় বাসিন্দারা জলপথেই বাণিজ্য করতেন। এমনটা হতেই পারে। পর্যাপ্ত জলের জোগান থাকায় সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর অববাহিকায় সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। আবার জলের অভাবেই একসময় এখানকার সমাজ-সভ্যতা অবলুপ্ত হয়। সেই জন্যেই কি কুলধারার চুরাশিটি সমৃদ্ধ জনপদ হারিয়ে গেছে? 

জনশ্রুতি অবিশ্যি অন্য কথা বলে। জয়সলমিরের মহামন্ত্রী সালিম সিংহ নাকি কুলধারার কোনও এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এখানকার বাসিন্দারা সেই প্রস্তাবে সম্মতি না দিয়ে রাতারাতি নিজেদের যাবতীয় অস্থায়ী সম্পদ নিয়ে দেশান্তরী হয়ে যায়। ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় অবশ্যই ঘোষিত হয়েছিল সেই ভয়ঙ্কর অভিশাপ— এখানে বসবাসের অভিপ্রায়ে এলে মৃত্যু অবধারিত। ভাঙাচোরা অবস্থায় কুলধারা দীর্ঘকাল লোকের চোখের আড়ালেই পড়েছিল। নব্বইয়ের দশকে জনৈক সুমের রাম এবং তার বাবা কুলধারার একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে দু’জন বিদেশি তিনদিন এখানে খোঁড়াখুড়ি করে কিছু প্রাচীন সম্পদ উদ্ধার করেন। সুমের রাম এবং তার বাবা ঘটনাটির ওপর সতর্ক নজর রেখেছিলেন। বিদেশিরা উদ্ধার করা সম্পত্তি এখান থেকে সরানোর চেষ্টা করলে সুমের রাম এবং তার বাবার সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়। পুলিশের সহায়তায় সংঘর্ষের নিষ্পত্তি হয়। বিদেশিরা দীর্ঘকাল কারাগারে কাটিয়ে জামিনে মুক্তি পায়। সংগৃহীত সম্পদ অবিশ্যি জয়সলমির আদালতের তোষাখানায় গচ্ছিত আছে। 

Kuldhara (1)
ভাঙাচোরা অবস্থায় কুলধারা দীর্ঘকাল লোকের চোখের আড়ালেই পড়েছিল

কুলধারাকে কেন্দ্র করে তিরিশ কিলোমিটারের ব্যাসার্ধের এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা চুরাশিটি জনপদের মধ্যে মাত্র দুটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে এবং তাদের যথাযথ সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। কুলধারা ছাড়াও দশ কিলোমিটার দূরের খাবা-য় গেলে দেখতে পাবেন দুশো বছরেরও আগে হারিয়ে যাওয়া জনপদের ভগ্ন স্মারক। বাদবাকি বিরাশিটি বোধ হয় মরুঝড়ের তীব্রতায় পরাজয় স্বীকার করে কালের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। সালিম সিংহের গল্প অবিশ্যি জয়সলমিরের কেল্লায় অবস্থিত ‘সালিম সিং কি হাভেলি’ দেখার সুবাদে আগেই শুনে নিয়েছেন। তবে যেটা শোনেননি তা হল— কুলধারার ধ্বংসাবশেষ পাহারা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন সুমের রাম। কুলধারায় পৌঁছে সুমের রামকে খুঁজে নিলে একই সঙ্গে ইতিহাস ও তেনাদের গল্প তো শুনতে পাবেনই— বাড়তি পাওনা হিসেবে পেয়ে যাবেন এক বিচিত্র অনুভূতি। 

কুলধারা দর্শন সেরে বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে বাঁ পাশে তাকান। ক্যাকটাস পার্ক লেখা এই বাগিচায় প্রবেশের জন্য কোনও টাকা লাগে না। ভেতরে চলে আসুন। দেখুন ক্যাকটাসেরও কত রকমফের। এখানে কিন্তু চোখ ভরে কাঁটাবাহারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে গেলেও সবসময় সতর্ক থাকবেন। না, তেনাদের দাপট নয়— অসতর্ক হলেই কাঁটার খোঁচায় রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটতে পারে। ক্যাকটাস পার্কের পাশেই রয়েছে এক শীর্ণকায় জলধারা। এক ছুটে কুলধারার ফটকের ওপারে বসে থাকা সুমের রামকে প্রশ্ন করলে জেনে যাবেন যে, এককালে ওখানে ছিল কাক নদী। হঠাৎ করে মনে পড়ে যেতে পারে যে হরপ্পা সভ্যতায় হাক্রা নামের একটি নদী ছিল। সেই হাক্রা-ই কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাক-এ পরিণত হয়েছে? হবেও বা!

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ অগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Thrillophilia, Adobestock
Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *