সামান্য মনে হলেও আসলে অসামান্য… একটা রুপোর চাকতি, আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পরাধীন ভারতের এক বর্ণময় সময়কাল। অনেকেই জানেন না, এই বাংলার বুকেই একদা স্থাপিত হয়েছিল এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা। তবে কলকাতায় নয়, ইংরেজ আমলের প্রথম চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠে ব্যারাকপুরে, গঙ্গার ধারে। ভারতের গভর্নর জেনারেল তখন লর্ড ওয়েলেসলি। তাঁরই ইচ্ছে আর পরিকল্পনায় ১৮০০-১৮০৪ সালের ভিতরে গড়ে উঠেছিল সেই পশুশালা।
অবস্থা বদলাতে শুরু করে ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই। কলকাতা ততদিনে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর। এই অবস্থায় ১৮৭৩ সালে লেফটানেন্ট-গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল খাস কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব অনুসারেই আলিপুরের এশিয়াটিক সোসাইটি সংলগ্ন ৪৫ একর জমিতে গড়ে ওঠে সুবিশাল আলিপুর চিড়িয়াখানা। উদ্বোধন করেছিলেন প্রিন্স অফ ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড স্বয়ং। আলিপুর চিড়িয়াখানার তরফে সেইসময় এক বিশেষ ধরণের গোলাকার রুপোর চাকতি টোকেন হিসাবে তুলে দেওয়া হয়েছিল কিছু অভিজাত পরিবারের মানুষজনের হাতে। এই চাকতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতার এই পশুশালার বহু পুরনো ইতিহাস। ঔপনিবেশিক কলকাতার এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষ্য দেয় এই টোকেন…
কলকাতার ইতিহাসের সেই অজানা কথাই তুলে ধরলেন চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়…
গড়ে উঠছে আলিপুর চিড়িয়াখানা। সাল ১৮৭৬। খুলে গেল চিড়িয়াখানার দরজা। সে সময় এই আলিপুর চিড়িয়াখানা গড়ে তুলতে দেশের রাজন্যবর্গ প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। বিশেষ করে ময়মনসিংহের জমিদার বা মহীশূরের রাজার অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়াও সে সময়ের সম্ভ্রান্ত কলকাতার বাসিন্দারাও নানারকমভাবে সাহায্য প্রদান করেছিলেন। আমার ঠাকুরদা ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেই সেযুগের নামী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর নিজস্ব পশুশালায় ছিল বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও প্রচুর গরু। জেব্রা, কুমির, ভাল্লুক, বাঘের ছানা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়ও ছিল। এই পশুশালা ছিল এখনকার ভবানীপুরে হরিশ মুখার্জি রোডে, ৫২ নং বাড়িতে। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী এসেছিলেন আমার ঠাকুরদার সেই পশুশালা দেখতে। পরবর্তীতে আমার ঠাকুরদা আলিপুর চিড়িয়াখানায় তাঁর সংগ্রহের কয়েকটি পশু দান করেন। তার মধ্যে একটি জেব্রাও ছিল। আমার দাদামশায় উত্তরপাড়ার বিখ্যাত জমিদার যোগেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় চিড়িয়াখানায় দান করেছিলেন অর্থ। সেসময় যাঁরা চিড়িয়াখানায় কোনওকিছু দান করতেন, চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের একটি করে রুপোর টোকেন দিতেন সম্মান প্রদানের জন্য। এই টোকেনটি দেখিয়ে তিনি অথবা তাঁর বংশধরেরা যে কোনও দিন চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করতে পারবেন। উত্তরাধিকার-সূত্রে আমিও সেই টোকেনটি পেয়েছি যা এখনও আমার কাছে আছে।

মনে আছে বহু বছর আগে আমার মা তখন জীবিত। মাকে নিয়ে এবং কিছু আত্মীয় মিলে গিয়েছিলাম চিড়িয়াখানায়, এই টোকেনটি সত্যি কাজ করে কিনা দেখার জন্য। মনে আছে সেদিন ছিল ছাব্বিশে জানুয়ারির ছুটি। খুবই ভিড়। চিড়িয়াখানায় সেই সময় যিনি ইনচার্জ ছিলেন তাঁকে এই টোকেনটি দেখাতে তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, যে এটার কথা তিনি শুনেছেন কিন্তু এই প্রথম এটি চোখে দেখলেন। তিনি অনুরোধ করলেন এটার জন্য সেই সাবেক খাতা নামিয়ে তাতে এন্ট্রি করতে হবে। সেটা সময়সাপেক্ষ। আসলে সেদিন অত ভিড়। তিনি একটা রেজিস্টারে আমাদের সই করিয়ে চা খাইয়ে ভেতরে প্রবেশ করালেন। তারপর এটা নিয়ে আর কোনওদিন যাইনি। ইচ্ছে আছে এখনকার চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ এটার বিষয়ে কিছু জানেন কিনা সেটা একবার পরখ করার।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, লেখক,
১৯৬১ সালে কলকাতায় জন্ম। সাংবাদিকতা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করার পর লেখালিখি শুরু 'মহানগর' পত্রিকায়। পরে পিয়ারলেস সংস্থায় জনসংযোগ আধিকারিক হিসেবে যোগদান এবং দীর্ঘ দু'দশক পরে স্বেচ্ছাবসর। ১৯৭৮ সাল থেকে 'কিঞ্জল' পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। পুরনো কলকাতা নিয়ে গবেষণাই ধ্যান জ্ঞান। 'কলকাতার কথকতা' দল তৈরি করেছেন পুরনো কলকাতার নানা হারিয়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে চর্চার জন্য। কবিতা যখন কবিতা, হ্যাপি হোম ক্লিনিক, গণসংযোগ, বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথ, কার্টুন ক্যালকাটা-সহ একাধিক বই লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন।