এই বিভাগে প্রকাশিত প্রবন্ধের মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণ ও আলোচনা লেখকের ব্যক্তিগত। প্রবন্ধের কোনও বক্তব্যের জন্য বাংলালাইভ ডট কম পত্রিকা দায়বদ্ধ নয়।
এই সাপ্তাহিক নিবন্ধমালায় ভারতীয় জনগণ যে ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, যত অর্থনৈতিক সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং তার মূল্যায়ন সুদীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় অর্থনীতি এবং ভারতবাসীর জীনবযাপনকে একটি আকার দেয়, সেই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবার ইচ্ছে রইল। আমি চেষ্টা করব, ভারতীয় অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন সংক্রান্ত পন্থা বিশ্লেষণ করতে এবং নানাবিধ আর্থিক নীতির মূল্যায়ন করতে।
বিভিন্ন বাণিজ্যিক পরিকল্পনা, নীতি এবং রূপায়ণ সম্পর্কে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আবার সামগ্রিক দৃষ্টিকোণে উত্পাদন ও গ্রাহকের সম্পর্ক, বিনিয়োগ, বাণিজ্যিক ভারসাম্য, সাধারণ মানুষকে প্রদেয় ঋণনীতি, উন্নয়নের আবর্তনিক প্রেক্ষাপট, শেয়ার ও ইকুইটি সম্পর্কিত আলোচনা এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়ন নির্দেশক সম্পর্কে ধারণা।
কোভিড অতিমারীর সঙ্কট গোটা বিশ্বে প্রভাব ফেলেছে। ওলটপালট করে দিয়েছে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি। ভারত সহ একাধিক দেশে চলেছে লকডাউন এবং গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে নাগরিকদের। ভারতের অর্থনীতি প্রায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল দু মাস যার ফলে অর্থনীতিতে এক অভূতপূর্ব সঙ্কোচন ঘটতে দেখা গেছে। তার পর আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার সেই মর্মান্তিক এবং ঐতিহাসিক দৃশ্য যা আমাদের স্তম্ভিত করেছে। লকডাউনের প্রকৃত প্রভাব দেখা যায় ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষের প্রথম কোয়ার্টারের জিডিপি-তে। দেখা যায় বার্ষিক ২৩.৯% হারে জিডিপির পতন ঘটেছে। এর আগেও ১৯৯৬ সালে অথনীতিতে অভূতপূর্ব মন্দা দেখা গেছে। তার ফলে অর্থনৈতিক পূর্বাভাস অনেকাংশে পরিমার্জনা করতে বাধ্য হয় ব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলি। তার আগে পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতিতে দ্রুততম হারে বৃদ্ধি ঘটতে দেখা গেছে। ২০২০-২১ আর্থিক বছরে সেই বৃদ্ধির হারে বার্ষিক ১০% হারে ঘাটতি দেখা যাবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশের অধিক দেশে মাথাপিছু আয়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং ঘাটতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু করোনা অতিমারীর প্রতিষেধকের ব্যাপারেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না, বিশ্ব অর্থনীতি এই মন্দা কতদিনে কাটিয়ে উঠবে তা বলা কঠিন। যদি ওঠেও, তার প্রভাব এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম হবে। এ কথা বলা যায়, ২০২১ সালে আর্থিক বৃদ্ধির গতি হবে শ্লথ।

২০২০-র জুন মাস নাগাদ কলকারখানা এবং বিভিন্ন সংস্থা খুলতে শুরু করার পর আয় ঘাটতির বৃদ্ধিহারে খানিকটা সঙ্কোচন লক্ষ করা গেছে।
বৃদ্ধির হারে আগের গতি ফিরে পেতে আমাদের আর্থিক নীতিগত বিষয়ে ছ’টি দিকে নজর দিতে হবে।
- কৃষি ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে সামগ্রিক গ্রামীণ উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ পর্যটনের উন্নতির দিকে নজর দিলে, গ্রামীণ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব কমতে পারে। গোটা পৃথিবীতে পর্যটন গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। পর্যটনের হাত ধরে স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। ভারতের পর্যটনশিল্পের অন্তর্ভুক্ত বহু সহযোগী শিল্পের সম্ভাবনা এবং ক্ষেত্র রয়েছে যেমন, নৌবিহার, রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা, চিকিত্সা, পরিবেশবান্ধব পর্যটন, স্বাস্থ্যোদ্ধার, খেলা, চলচ্চিত্র, গ্রামাঞ্চল পর্যটন, ধর্মীয় পর্যটন, এমআইসিই অর্থাত্ বাণিজ্যকেন্দ্রিক সম্মেলন, ইত্যাদি। বর্তমান সময়ের দাবি অনুযায়ী পর্যটনশিল্প একটি প্রধান এবং পরিবর্ধনশীল শিল্প হিসেবে গুরুত্ব পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বহু উদ্ভাবনী প্রকরণ এবং আর্থিক বিনিয়োগ পর্যটনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আরো বেশি আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। সেইসঙ্গে বাড়িয়ে তুলতে পারে কর্মসংস্থানের সুযোগ, সৃষ্টি করতে পারে আর্থসামাজিক বিভিন্ন সুবিধা, বিশেষত ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে যেখানে আরো অনেক বড় আকারে উন্নয়ন এবং সুযোগসুবিধার মধ্যে সার্বিক সাম্য আনা প্রয়োজন। ভারতের অর্থনীতিতে এমন ধরনের পন্থা এই মুহূর্তে অবলম্বন করা প্রয়োজন, যা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিভিন্ন বণিজ্যিক ক্ষেত্রের গুরুত্ব এবং প্রাধান্য সম্পর্কে একটি সংযোগসূত্র সৃষ্টি করতে পারবে।
- নিয়ন্ত্রক নীতিসমূহের পুনর্বিবেচনা – আর্থিক নীতি, সেইসঙ্গে আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্ধন: সার্বিক প্রয়োগ (গ্রহীতা এবং বিনিয়োগ) এবং মূল্যায়ন।
- পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে আরো বেশি আর্থিক বিনিয়োগ এবং পরোক্ষ আর্থিক উত্সের (জিএসটি) দ্রুত বিভাজন, আঞ্চলিক এবং রাজ্যওয়াড়ি ক্ষেত্রে আর্থিক পুনর্বিকাশ। করোনাভাইরাস অতিমারীর আক্রমণে সারা ভারতবর্ষব্যাপী সরকারি আয়, অর্থাগম এবং বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চলতি বছরের অর্ধাংশ জুড়ে অবনমন দেখা গিয়েছে। এই ধরনের অবনমন বিনিয়োগকারীর মানসিকতায় প্রভাব বিস্তার করে, যার কুফল বর্তায় বেসরকারিকরণ পরিকল্পনায়, সরকারি ক্ষেত্রে এবং শিল্পে।
- আর্থিক বৈষম্য এমনই একটি বিষয়, যেখানে দেখা যায় আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষ সম্ভাব্য বৃহত্তর গ্রহিতা। এই পিছিয়ে পড়া শ্রেণীকে যদি কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) প্রকল্পের মাধ্যমে সঙ্গতিসম্পন্ন করে তোলা যায়, তাহলে তা উত্পাদনের মাত্রা প্রভূত পরিমাণে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে।
- বৃহত্ এবং ছোট বাণিজ্যিক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি করতে হবে। পরিচালনা, উত্পাদন, সরবরাহ, ঠিকা চুক্তিতে আংশিক উত্পাদন ইত্যাদি উপায়ে এই নির্ভরশীলতা তৈরি করা যায়। কোভিড-১৯ এর জন্য় পৃথিবীব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয়েছে এবং তার ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে স্পিলওভার এফেক্ট* দেখা গিয়েছে। এর ফলে আর্থিক ক্ষেত্র সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে সমস্ত দেশগুলি অনেক বেশি রপ্তানি করে, স্থানীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে তাদের সরবরাহ শৃঙ্খল বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং যে দেশগুলি আমদানি করে, তারা কাঁচামালের অভাবে উত্পাদন ক্ষমতা হারাবে এবং বটলনেক এফেক্ট দেখা দেবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) চলতি বছরে বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে ৩২% অবনতির আশঙ্কা করছে।
- বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নের উদ্দেশ্যে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলির উত্পাদন বৃদ্ধি, পদ্ধতিগত সুবিধা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সংযোগ স্থাপন করা দরকার। ভারতের মোট বৈদ্যুতিন আমদানির ৪৫% হয় চিন থেকে। প্রায় তিনভাগের একভাগ যন্ত্রাংশ এবং দুই-পঞ্চমাংশ জৈব রাসায়নিক বস্তু ভারত চিন থেকে খরিদ করে। সার এবং মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ, ৭০ শতাংশেরও বেশি ভারত আমদানি করে চিন থেকে। ওষুধ তৈরির উপাদান ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ আসে চিন থেকে এবং ৯০ শতাংশ সেলফোন ভারত চিন থেকেই আমদানি করে।
ভারতীয় মুদ্রার মূল্য হ্রাস পাওয়ায় ভারতের বাণিজ্য ও আর্থিক ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অধোগতি প্রবণতার আনুপূর্বিক বিশ্লেষণ দরকার– কীভাবে তা সম্ভাবনাময় বাজারকে প্রভাবিত করে, জ্বালানির দামের ক্রমাগত ওঠাপড়া কীভাবে প্রধান আর্থিক ক্ষেত্রগুলিকে প্রভাবিত করে।
*এমন একটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, যেখানে দুটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা, পরস্পর সম্পর্কহীন হওয়া সত্ত্বেও, একটি আর একটির আর্থিক পরিণতিকে প্রভাবিত করে।
ড. সুমনকুমার মুখোপাধ্যায় একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। সুদীর্ঘ ৪৬ ধরে তিনি অধ্যাপক এবং গবেষক হিসেবে বিভিন্ন দেশী বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যার মধ্যে এক্সএলআরআই, আইআইএসডব্লুবিএম, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কলকাতা, আইআইটি দিল্লি, উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সুমন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের একাধিক উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলকাতা, সেন্ট স্টিফেনস দিল্লি ও দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসের প্রাক্তনী। বর্তমানে অ্যাডভাইসরি বোর্ড অন অডুকেশন, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের সদস্য, চেয়ারম্যান ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং অ্যান্ড বিজনেস কমিউনিটির সদস্য, ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়ম ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইকনমিকস সাব কমিটি, বিসিসিঅ্যান্ডআই, এমসিসিঅ্যান্ডআই, অ্যাসোচ্যাম ইত্যাদি বোর্ডের সদস্য। তিনি সেনার্স-কে নামক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ের গবেষকদের সংগঠনের আজীবন সদস্য। বর্তমানে ভবানীপুর গুজরাটি এডুকেশন সোসাইটি কলেজের ডিরেক্টর জেনেরাল।