সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে যোগ্যতা লাগে। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি নিছক অভিনেতা নন। নানা পরিচয়ে তিনি আমাদের কাছে পরিচিত। চলচ্চিত্র অভিনেতা, মঞ্চ অভিনেতা, কবি, আবৃত্তিকার, চিত্রকর এবং সবার উপরে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ও কৃষ্ণনাগরিক।
কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা মানেই কিন্তু কৃষ্ণনাগরিক হওয়া যায় না।প্রমথ চৌধুরী ছিলেন কৃষ্ণনগরের মানুষ। তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন কৃষ্ণনাগরিক সংস্কৃতির কথা। তাঁর মতে কৃষ্ণনাগরিক তাঁরাই, যাঁদের মধ্যে সৃজনী শক্তির বৈচিত্র্য রয়েছে। যাঁরা স্থানিক হয়েও আন্তর্জাতিক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও প্রমথ চৌধুরী দু’জনেই ছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা। আবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু হয় মহারাজার আনুকূল্যে কৃষ্ণনগরে আসার পর। ফলে তিনি কৃষ্ণনাগরিক হয়ে ওঠেন। ভারতচন্দ্রের সময় থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, দিলীপ কুমার রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (বটুক) হয়ে হাল আমলের অধ্যাপক তথা লোকসংস্কৃতির গবেষক সুধীর চক্রবর্তী ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সকলেই কৃষ্ণনগর থেকে তাঁদের সৃজনযাত্রা শুরু করেছিলেন।

মনে রাখা দরকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবি দিয়ে। তারপর থেকে দীর্ঘ একষট্টি বছর তিনি মোট ৩৩০টি ছবিতে কাজ করেছেন (সূত্র ‘আইএমডিবি’ ওয়েবসাইট)। তবে এই হিসেব চূড়ান্ত এমন মনে করার কারণ নেই। এইসব ছবিগুলির মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের চোদ্দোটি ছবি যেমন আছে তেমনই তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অজয় কর, অসিত সেনের মতো পরিচালকদের ছবিও আছে। এছাড়া সেই তালিকায় এমন ছবিও আছে যা তিনি না করলেও পারতেন। করেছেন, তার কারণ পেশাগত বাধ্যবাধকতা। এই লেখায় আমি কেবল চলচ্চিত্র অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলব।
যেটা দেখার, অন্যধারার ছবি দিয়ে শুরু করলেও মূলধারার ছবির জগতে তাঁর সাফল্য বাংলার আর কোনও অভিনেতার কপালে জোটেনি। এর থেকে একটা ব্যাপার বোঝা যায়, তৎকালীন বাংলা ছবির সামগ্রিক মানের উচ্চশীলতা। সেসময় অন্যধারা ও মূলধারার মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। সবই সিনেমা ছিল এবং পরিচালকেরাও সৃজনশীলতার দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী ও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তাই সৌমিত্রদার পক্ষে মূলধারার ছবির পরিবেশে এসে কাজ করতে যেমন কোনও অসুবিধা হয়নি, তেমনই ছবির চরিত্রগুলিও তাঁর কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়নি। এর ফলে খুব সহজেই তিনি উত্তমকুমারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন নিজের অন্যধারার ছবির অভিনয় শৈলীকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র রুচির অঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে।
আমাদের প্রজন্ম যখন থেকে সৌমিত্রদার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে, তিনি তখন সত্তর ছুঁয়েছেন। তাঁর পরিচালকেরাও আর তেমন কেউ বেঁচে নেই। উত্তমকুমার গত হয়েছেন। সহযোগী বন্ধুবান্ধব ও অভিনেতা যাঁরা ছিলেন তাঁরাও এক এক করে চলে যাচ্ছেন। এমন এক অবস্থায় আমি লক্ষ করেছি সৌমিত্রদার মধ্যে এক ধরনের একাকীত্ব বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। যা ক্রমশ বেড়েছিল সময়ের সঙ্গে। টেলিভিশন আসার পর বাংলা সিনেমারও এমন এক চারিত্রিক বদল ঘটে গিয়েছিল যে তাঁর পক্ষে সেই বদলে যাওয়া চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। যেসব পরিচালক ও অভিনেতার সঙ্গে তাঁকে কাজ করতে হত তাঁদের সঙ্গে বৌদ্ধিক স্তরে তাঁর কোনওরকম আদানপ্রদান হত না। টেলিভিশনকে তিনি কোনওদিনই আত্মস্থ করতে পারেননি। শুধুমাত্র আর্থিক কারণে একটা সময়ে ছোট পরদায় ‘সিরিয়াল’-এর কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে কবুল করে গেছেন। যদিও তাঁর একমাত্র ছবি ‘স্ত্রীর পত্র’ করার সুযোগ এসেছিল টেলিভিশনের দৌলতেই।

সৌমিত্রদার বৌদ্ধিক স্তরের পরিচয় তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি নানাভাবে পেয়েছি। তবে তিনি কখনওই নিজেকে আমাদের থেকে আলাদা করতে চেষ্টা করতেন না। সকালে উঠে শুটিংয়ে যাওয়া তাঁর নিত্যদিনের কাজের অঙ্গ ছিল। শুটিং ফ্লোরে এসে টালিগঞ্জের পরিচিত সকালের প্রাতঃরাশ ডিম পাঁউরুটি সহযোগে এক কাপ চায়ে চুমুক দেওয়া যে অপার ভোজনবিলাসের আনন্দ দিত, তা তিনি আমাদের মতো করেই উপভোগ করতেন। শুটিংয়ের ফাঁকে আড্ডা দিতে বসে সরস (কখনও অশ্লীল) গল্প বলতে তাঁর জুড়ি মেলা শক্ত ছিল, যা শুনে আমাদের হাসির ফোয়ারা উঠত। আবার শটের জন্য ডাক পড়তেই তিনি প্রস্তুত।
আমার প্রথম যে ছবিটিতে ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল, সেটি ‘দ্রোণাচার্য’। ছবিটিতে এক জায়গায় চরিত্রের রুচির আভিজাত্য বোঝাতে আমার ইচ্ছে হয়েছিল চরিত্রটা একটি দৃশ্যে সংলাপের বদলে য়োহান সেবেস্তিয়ান বাখের একটি সুর গুনগুন করবে। সৌমিত্রদাকে আমার ইচ্ছের কথা জানাতে উনি বললেন, “ওরে বাবা! আমি অতশত জানি না।” আমি সেই সুরটি জোগাড় করে তাঁকে দিতে গেলে উনি আবার বলে উঠলেন, “না না আমি অত পারব না। আমি মুখভঙ্গি করব তুমি কাউকে দিয়ে ডাবিং করে নিও।”
কী আর করা! বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিলাম। শুটিংয়ের সময় আমি সৌমিত্রদাকে শটটি নেওয়ার আগে মন করিয়ে দিলাম যে, কথামতো উনি মুখভঙ্গি করবেন যেন গুনগুন করছেন। শট শুরু হল। সকলে চুপ। সময় যখন এল দেখি সৌমিত্রদা আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে গেয়ে চলছেন য়োহান সেবেস্তিয়ান বাখের একটি সুর, যা তাঁর জানা ছিল। সারা ফ্লোরে একটিও শব্দ নেই। আমিও আর ‘কাট’ বলতে পারছি না। একসময় সৌমিত্রদা থামলেন। বুঝলেন আমরা হতবাক। আমাদের দিকে তাকিয়ে তাঁর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল, যে হাসি আমরা যারা ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি, সকলেই দেখেছি। শিশুর মতো নির্মল সেই হাসি ভরা মুখ সৌমিত্রদা শিল্পীসত্ত্বার এক পরিচয় ছিল। সেই হাসি মুখ যেন জানতে চাইত – “কেমন লাগল বলো। ঠিক করেছি তো?” স্বভাবতই উত্তর দেওয়া সম্ভব হত না। যা অতুলনীয় তার পরিমাপ কেউ করতে পারে না। শিশির ভাদুড়ী ও সত্যজিতের মানস পুত্রকে আমরা যারা তাঁর কর্মক্ষেত্রে চাক্ষুষ করেছি তা আমাদের জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে আজীবন

তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে লক্ষ করেছিলাম, ধারাবাহিকভাবে তাঁর ছবিগুলিকে যদি দেখা যায়, তা হলে সহজেই ধরা পড়ে শিল্পী হিসেবে তিনি তাঁর সামাজিক বিশ্বাস ও দায়বদ্ধতার পরিচয় রেখে গেছেন তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যে অদ্ভুতভাবে রয়ে গেছে সময়ের স্বাক্ষর। ব্যাপারটা আশ্চর্য্যের মনে হলেও সত্যি। আমার সেই তথ্যচিত্র ‘অনায়কোচিত’ ছবিতে সেটা ধরা আছে। অনায়কোচিত, কারণ সৌমিত্রদার ইচ্ছে ছিল তিনি নায়কের চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই পরিচিত হতে চান। সাধারণভাবে নায়ক বলতে আমরা যা বুঝি তা তিনি কোনও দিনও হতে চাননি। স্টার হয়ে ওঠার ব্যাপারে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। অভিনেতা হিসেবে এখানেই তাঁর অনন্যতা ও উচ্চতা। কেবল সিনেমা আঙ্গিনায় নিজেকে আটকে না রেখে তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শিল্পের অন্যান্য কলায়। স্থানিক এক সাংস্কৃতিক কর্মী হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এইজন্যই কৃষ্ণনাগরিক। যাঁরা বাঙালির সমাজে বিশেষ প্রজাতির মানুষ। এঁরা সুলভ নন।
তাঁকে নিয়ে আমি তিনটি ছবি করেছি। সেইসব ছবিতে তাঁর সান্নিধ্য আমাকে ঋদ্ধ করেছে। অনেক কিছু শিখিয়েছে। অনেক স্মৃতি জমে আছে মনের মধ্যে। কখনও সম্ভব হলে তা লেখার ইচ্ছে রইল। তাঁর ৮৮ বছরের জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল আমার শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
ছবি সৌজন্য: লেখক
শৈবাল মিত্র এ কালের একজন গুরুত্বপূর্ণ চিত্রপরিচালক। পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। চলচ্চিত্রের একাধিক ধারায় কাজ করে আসা শৈবাল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি বানান ২০০৭ সালে, 'সংশয়' নামে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দাকাহিনি অবলম্বনে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় ও কঙ্কণা সেনশর্মাকে নিয়ে ২০১৫ সালে বানান 'সজারুর কাঁটা'। বিএফজেএ সেরা পরিচালকের সম্মান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ইন্ডিয়ান প্যানোরামাতেও দু'বার নির্বাচিত হয়েছে তাঁর ছবি। ঘুরেছে দেশবিদেশের ফিল্মোৎসবে।