জোর কদমে চলছে রবিবার ছবির শুটিং।মুখ্য ভূমিকায় প্রসেনজিত চ্যাটার্জী।সেই শুটিংয়ের মাঝেই অনেক অন্তরঙ্গ কথা শোনালেন পরিচালক অতনু ঘোষ। তার সঙ্গে কথা বললেন তন্ময় দত্তগুপ্ত।

আপনার ছবির নামকরণের মধ্যে একটা সাহিত্যের আস্বাদ রয়েছে।যেমন ‘একফালি রোদ’,’রূপকথা নয়’,’বিনিসূতোয়’, ‘রবিবার’। কোথাও কি সাহিত্যের সংযোগ কাজ করে?

অতনু ঘোষঃ সাহিত্যের সংযোগ কাজ করে কিনা বলতে পারব না। তবে সিনেমার নামটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি চেষ্টা করি অনেকগুলো স্তরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার। বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে একটা গল্প বলতে হয়। তাই নামের একটা ভূমিকা আছে। ছবি দেখার সময় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নামের ইন্টারপ্রিটেশন বদলাতে থাকে। ছবির নাম দেখে একটা ধারণা তৈরী হয়। এটা ঠিক যে নাম নিয়ে সত্যি আমি ভাবি।

আপানার সাম্প্রতিক ছবির নাম ‘বিনিসুতোয়’। এরকম নাম রাখার কারণ কী?

অতনু ঘোষঃ আমাদের সব কিছুতেই একটা বন্ধন থাকে। এবং এই বন্ধনের সঙ্গে সুতোর একটা সংযোগ আছে। এই বন্ধন থেকে মুক্তির প্রয়াস মানুষের থাকে। বিভিন্ন অপ্রাপ্তি অপূর্ণতা থেকেও মুক্তির চেষ্টা চলে। এই বন্ধন মুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের সুতোগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। এই সুতোগুলোকে ছিঁড়ে বা ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার গল্পই বিনিসুতোয় দেখানো হয়েছে। এছাড়াও আরও অনেকস্তর আছে।

আপনার পরিচালিত ছবি ‘ময়ূরাক্ষী’-তে বাবা এবং ছেলের সম্পর্কের একটা ভূমিকা ছিল। ছেলে আর্যনীলবাস্তব থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়ে নিল। একটা বন্ধন মুক্তির প্রসঙ্গ সেখানেও ছিল। তাই নয় কি?

অতনু ঘোষঃ এখানে দুটো বিষয় আছে। বাস্তব থেকে মুখ ফেরানোর বিষয় সেই অর্থে ‘ময়ূরাক্ষী’ এবং ‘বিনিসূতোয়’ নেই।কঠিন পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফেরানোর গল্পে আমি আগ্রহী নই।অনেক পরিস্থিতি মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মানুষ অতোটা শক্তিশালী নয়। অনেক সময়ই দেখা যায় কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ব্যাপারে মানুষের ক্ষমতা অনেকটাই কম। চরম সংকটের মুহূর্তে মানুষ অন্য একটা রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করে। সেই রাস্তার মধ্যেই সে বাঁচে। বা বাঁচার চেষ্টা করে।ময়ূরাক্ষীর আর্যনীল(প্রসেনজিত চ্যাটার্জী)-ও তাই। তার বাবার যে মানসিক সমস্যা; সেটা ডিমেনসিয়া। সেটাএকটা গ্লোবাল সমস্যা।

আপনি বলছেন সংকটের মুহূর্তে মানুষ একটা অন্য রাস্তা খোঁজে। আপনার ‘তখন তেইশ’ ছবির চমৎকার একটা সংলাপ —‘ফ্যান্টাসির সবকটা দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায় ,তখন সে পালাতে চায়’।এই পালানোটাই তো একটা রাস্তা খোঁজার মতো?

অতনু ঘোষঃ এই রাস্তা খোঁজাটা হয় নিজেকে চেনার মধ্যে দিয়ে। প্রসেস অফ সেলফ ডিসকভারির মাধ্যমে। সেই সেলফ ডিসকভারি আমার ছবিতে আছে। বাবা এবং ছেলের গল্প নিয়ে ময়ূরাক্ষী,দ্বিতীয় গল্প বিনি সূতোয় কাজল এবং শ্রাবণী দুজনেই অপরিচিত। রবিবারে অসীমাভ ও সায়নীর কোনও এক সময়ে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তিনটে ছবির মধ্যেই এই সেলফ ডিসকভারির সূত্র রয়েছে। তিনটে গল্পের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক বিষয় হোল,শহর। শহরের পালটে যাওয়া,সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক বদলের ইনটেনসিটি ছবিতে আছে। আমদের প্রজন্ম মানে সত্তর বা আশির দশকে যারা জন্মেছি,তার অসংখ্য বদল দেখেছি।হয়ত,এই বদল আমাদের মতো অন্য প্রজন্ম দেখেনি। সম্পর্কেরও অনেক বদল হয়েছে। আগে ছিল ওপেন রিলেনশিপ। এখন এলো ভারচুয়াল রিলেশনশিপ। মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে আস্থার জেরে।’ময়ূরাক্ষী’ করার পর আমার মনে হোল,আরো দুটো গল্প আমি বলতে চাই ।’বিনি সূতোয়’,’ রবিবারের’ প্রসঙ্গ এবং প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা।’ময়ূরাক্ষী’,’বিনি সূতোয়’, ‘এবং রবিবার’ আসলে ট্রিলজি।

‘অ্যাবি সেন’ এবং ‘ময়ূরাক্ষীর’ মধ্যে অতনু ঘোষের ব্যক্তি জীবনের প্রতিচ্ছবি রয়েছে।’বিনিসুতোয়’,’ রবিবারেও’ কি অতনু ঘোষের প্রত্যক্ষ ব্যক্তি জীবনের প্রতিফলন রয়েছে?

অতনু ঘোষঃ এই শহরে এতো বছর কাটানোর অনুভূতি আমার আগামী দুটো ছবিতেই আছে। এই দুটো গল্প তরুণ প্রজন্মের গল্প নয়। মধ্যবয়স্কের গল্প। এই মধ্যবয়সের মধ্যে দিয়ে আমিও যাচ্ছি।হয়ত চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমার মিল নেই। কিন্তু এটা ঠিক যে তাদের মনের ভেতরের টানাপোড়েন আমার খুব চেনা।

‘ রবিবারের’ বিষয় কি সমাজ থেকে নেওয়া নাকি ব্যক্তির ভাবনা সমাজে প্রতিফলিত?

অতনু ঘোষঃ আমার খোঁজার জায়গায় ব্যক্তিকে অনেক সময় সমাজ ছাপিয়ে গেছে।’এক ফালি রোদের’মধ্যে এই স্পেসটা অনেক বেশি ছিল। আমার ছবি ‘রূপকথা নয়’-তে সমাজ ও ব্যক্তির সংযোগের জায়গা তৈরী হয়েছে।’ময়ূরাক্ষী’,’বিনি সূতোয়’ ‘রবিবারের’ মধ্যেও ব্যক্তি এবং সমাজের টানাপোড়েন তীব্র। তুমুল সংকটের কারণে ব্যক্তি অনেক সময় সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়।’রবিবারের’ অসীমাভ আর ‘ময়ূরাক্ষীর’ আর্যনীলও ঠিক তেমনই।

আপনি ট্রিলজির কথা বললেন।ট্রিলজির কথা বললেই সত্যজিত রায়ের অপু ট্রিলজির কথা মনে পড়ে।সেখানে তিনটে ছবিতেই অপুর ধারাবাহিক জীবন দেখানো হয়েছে।’ময়ূরাক্ষী’,’বিনি সুতোয়’ ‘রবিবারে’-ও কি কোনও কেন্দ্রীয় চরিত্রের ধারাবাহিক জীবন দেখা যাবে?

অতনু ঘোষঃ একেবারেই নয়। এটা বিষয়ের ট্রিলজি। ট্রিলজি অনেক রকমের হয়। একই মানুষের হয়। একই ভাবনার হয়।

‘রবিবারে’ প্রসেনজিত চ্যাটার্জী অভিনয় করছেন। এবং আপনার সাথে ওনার এটা দ্বিতীয় ছবি। প্রসেনজিত চ্যাটার্জীর এখানে ভূমিকা কী?

অতনু ঘোষঃ এই তিনটে ছবির কিছু চরিত্রের মুখ এক। মানুষ এই তিনটে ছবি দেখার পরে বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারবেন; ময়ূরাক্ষীর আর্যনীল এবং অসীমাভর মধ্যে কোথাও একটা যোগসূত্র আছে।লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে আমি একজন অভিনেতাকে ইচ্ছা করেই দুটো ছবিতে রেখেছি। কারণ এটা হোল একই মুখের দুটো রূপ।

প্রসেনজিতের আত্মজীবনী ‘বুম্বা দা শট রেডি’-তে প্রসেনজিত ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবির বিশেষ একটা সংলাপের কথা উল্লেখ করেছেন —‘বিয়ের মধ্যে তুই সেনসিটিভিটি পেলি কোথায়?’। এর প্রসঙ্গে প্রসেনজিত আপনার সম্পর্কে লিখেছেন —‘অতনু আমাকে খুব বেশিদিন চেনে না। কিন্তু কি করে এই সংলাপ লিখল’। এখানেই প্রশ্ন — কোথাও কি সংলাপ লেখার সময় প্রসেনজিতের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতাকে আপনি চিত্রনাট্যে কাজে লাগিয়েছেন? বা ওই সংলাপ কোথাও কি প্রসেনজিত চ্যাটার্জীর বায়োপিক হয়ে উঠছে?

অতনু ঘোষঃ আমার মনে হয় না। অভিনেতা মাত্রই সংবেদনশীল। একজন বিখ্যাত অভিনেতার জীবনে নানা টানাপোড়েন থাকে। সেটা কিছুটা মিলতেই পারে। ‘রবিবারে’ আমি প্রসেনজিত চ্যাটার্জীকে ভেবেই চিত্রনাট্য লিখেছি। জয়া আহসানকে আমি প্রথমেই ‘রবিবারের’ কথা বলেছি। পরে ‘বিনিসূতোয়’-র কথা বলেছি। কারণ ‘বিনিসূতোয়’-র পরে রবিবারে জয়া অভিনয় করতে আগ্রহী না হলে একই মুখের দুটো রূপ বা দুই দিকের ভাবনা আসত না। একজন অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবনে কিছু ঘটতেই পারে। সেটা অভিনয়ের রসদও হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেটা একমুখী নয়।

আপনি পার্টিতে যান না।গরমাগরম কথা বলে পেইজ থ্রিতে জায়গা করেন না। সেক্ষেত্রে আপনার কি কোনও সমস্যা হয়?

অতনু ঘোষঃ আমি আমার মতো করে চিরকাল ভেবেছি। আমি ব্যক্তিগত জীবনে যা; তার থেকে আমার পরিচালক সত্তাকে আলাদা করিনি। সম্পূর্ণ অন্য জীবনযাত্রার সঙ্গে আমি নিজেকে কোনওদিনই অভ্যস্ত করিনি। মনের সাড়া না পেলে,এমন কোনও কাজই আমি জীবনে করিনি। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে — ‘আপনি দশ বছরে ছয়-টা ছবি করলেন। এটা কেন’?আমি জীবনে ছটা ছবি করার সুযোগ পেয়েছি। তাই ছয়-টা ছবি হয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। আমি একই প্রযোজকের সঙ্গে একাধিক ছবি করেছি। আমার মনের সায় বাদে আমি কোনও কিছু করতে নারাজ।

প্রথম টেলিভিশনে কাজ করতে যাওয়া অতনু ঘোষ এবং আজকের অতনু ঘোষের আত্মবিশ্বাাসের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে?

অতনু ঘোষঃ আত্মবিশ্বাস আমার বরাবরই ছিল। তারকারণ সিনেমার টেকনিক্যালিটিজ বা ক্রাফ্টটা আমি শিখে এসেছিলাম।আমি সিনেমা এডিটিংয়ের কাজ করতাম। সিনেমার কারিগুরি দিক না জানলে কাজ করা যায় না। ওটা আমার জানা ছিল। গোড়ার দিকে আমার খামতির জায়গা ছিল।সেটা ছিল অভিনয়ের জায়গায়। কারণ আমি নিজে অভিনেতা নই। অভিনয়টা পরিচালনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমার মনে হয়; অভিনয় বোঝা বা শেখার প্রক্রিয়া এখনও আমার চলছে। প্রত্যেক ছবি শুরুর আগে আমার মনে হয়; এই ছবিটাই আমার প্রথম ছবি। এই বোধ চলে গেলে;সেদিন থেকে আমার ছবি না করাই ভালো।

বিতর্কিত কিছু হলেই বাংলা ছবিতে ভিড় হয়। এতে বাংলা ছবির নান্দনিক দিকের আদৌ কি উন্নতি হয়?

অতনু ঘোষঃ এটা বলা খুব মুশকিল। সিনেমাটাকে একেকজন একেক ভাবে দেখেন। কারোর যদি মনে হয় বক্স অফিসের সাফল্যই সব,তার বিরুদ্ধে কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ পপুলিস্ট সিনেমা পৃথিবীর সমস্ত দেশে চিরকাল ছিল। আছেও।সিনেমাকে শিল্প মাধ্যম হিসেবে দেখার মানুষও থাকবে।আবার শুধু বিনোদন রূপেও দেখার মানুষ থাকবে। এটা নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ নেই।

আপনার কখনও মনে হয়েছে ইংরাজি ভাষায় ছবি করলে ন্যাশোনাল বা ইন্টারন্যাশোনাল ক্ষেত্র খুলে যাবে?

অতনু ঘোষঃ তেমন বিষয় মাথায় এলে মূল ভাষাটা বাংলা না হয়ে ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাষা হতেই পারে। কিন্তু শুধুমাত্র বৃহত্তর দর্শক পাওয়ার জন্যই আন্তর্জাতিক ভাষায় কাজ করার আমার কোনও আগ্রহ নেই।

আপনি সোসাইটির কাছ থেকে আপনার সিনেমার কেমন ফিডব্যাক পান?

অতনু ঘোষঃ সিনেমা সমাজ সংস্কারকের মাধ্যম নয়। অতো শক্তি সিনেমার আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কোনও মানুষের আমার ছবি ভালো লাগলে সেটুকুই আমার পাওয়া। ডিমেনশিয়ায় বহু মানুষ ভুগছেন। সেটা দেখে কারোর ‘ময়ূরাক্ষী’-র কথা মনে হলে;সেটাই আমার প্রাপ্তি। তার বেশি আশা না করাই ভালো। আর আমরা যে ধরনের ছবি করি,সেটা বিশ্ব সিনেমাশিল্পের কণামাত্র।

শেষ প্রশ্ন। সাহিত্য নিয়ে সিনেমা করার ইচ্ছে হয়?

অতনু ঘোষঃ বিনোদ ঘোষালের গল্প আমার খুব ভালো লাগে। স্বপ্নময় চক্রবর্তী, প্রচেত গুপ্ত — এরকম অনেক লেখকের অসাধারণ গল্প আছে। অনেক গল্প নিয়ে সিনেমা করতে ইচ্ছে হয়।সাহিত্যের গল্প সিনেমা মাধ্যমে কতোটা সার্থক রূপায়ণ হতে পারে; সেটা জরুরি বিষয়। লেখকের লেখাকে বিকৃত করার অধিকার আমার নেই। সাহিত্যের গল্পকে সিনেমা মাধ্যমে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের ব্যাপারে লেখক কতোটা আগ্রহী;সেটাও একটা ফ্যাক্টর। শেষ পর্যন্ত ভুল বোঝাবুঝি হয়ে তো কোনও লাভ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *