২০১২ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার মিসৌরি রাজ্যের শহর কেপ জিরারডুতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। আমেরিকার সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন (যারা সংখ্যালঘুদের, বিশেষত কৃষ্ণবর্ণ মানুষদের জন্য আদালতে লড়াই করে) বর্ণবৈষম্যকারী দল কে.কে.কে. ( কু ক্লুক্স ক্ল্যান) এর হয়ে আদালতে কেস করল। কেকেকের সদস্যরা মেম্বার বাড়াবার জন্য গাড়িতে গাড়িতে লিফলেট বিলি করছিল। স্থানীয় পুলিশ তাতে বাধা দেয় এবং তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস (ACLU) আদালতে পেশ করল – সরকার কারওর স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে সেন্সর করতে পারে না, সে চিন্তাভাবনা যতই জঘন্য অথবা অ-জনপ্রিয় হোক”।

আমরা যখন স্কুলে, তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরী অবস্থা জারি করলেন। আমার বাবা যিনি ‘৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে ভোট দিয়েছিলেন, তখন দাঁতে দাঁত চেপে ইন্দিরা ও সঞ্জয় গান্ধীকে গালি দিতেন। যদিও, সঞ্জয় গান্ধীর পরিবার পরিকল্পনায় বা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থায় আমার বাবার তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি কিন্তু আমার বাবা ছিলেন ভারতের কোটি কোটি মানুষের একজন যাঁরা ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে সমস্ত প্রাক নির্বাচন পরিসংখ্যানকে ভুল প্রমানিত করে, তাদের একমাত্র ক্ষমতা ভোটের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেস পার্টির ভরাডুবি করালেন। বিশ্বের ইতিহাসে যুগে যুগে এরকম উদাহরণ আছে। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হাত পড়লে মানুষ ছেড়ে কথা বলে না। মানুষের জীবনের নূন্যতম স্বাধীনতা হচ্ছে বেঁচে থাকার বা জীবনধারণের স্বাধীনতা, বাক্ স্বাধীনতা, প্রার্থনা করার ও ভয় পাবার স্বাধীনতা।

সাহিত্যিক সলমান রুশদির মাথার ওপর ইরানি সরকার ইসলামিক মৃত্যুদন্ডের ফতোয়া জারি  রেখেছে তাঁর ‘সাটানিক ভার্সেস’ গ্রন্থের জন্য। কবি লোরকাকে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট সৈনরা হত্যা করে। অথচ লোরকা সারাজীবন ধরে প্রেমের কবিতা লিখেছেন।

বাক্ স্বাধীনতা কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিন্তু দেশ কাল অনুযায়ী ক্রমপরিবর্তিত। মনে পড়ে গার্গী যখন তাঁর বাকস্বাধীনতা প্রকাশ করে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে মহাকাশ, ব্রহ্মার উৎস খোঁজার চেষ্টায় ছিলেন তখন  তাঁকে আর প্রশ্ন করতে মানা করা হয়। এক অর্থে এই বিদূষী বাগ্মী মহিলার বাক বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। সেটা সেকাল। একালে? সাধারণ মানুষের চাই জীবন, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। এই প্রয়োজন যখন মিটে যায়, তখন মানুষ মত প্রকাশের স্বাধীনতা চায়। ব্যক্তি স্বাধীনতা আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই শিশু। এদের কারওরই বেঁচে থাকার বা জীবন জীবন ধারণের স্বাধীনতাটুকু ছিল না।

আমি চিনদেশ ও কিউবায় বেড়াতে গিয়েছি। দুটো দেশই কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা শাসিত। দুটো দেশেই কোনও বাক স্বাধীনতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। জনগণ যদি সরকারের পলিসি অনুযায়ী কথা বলে তবেই বাক স্বাধীনতা আছে। যদিও কিউবাতে জনসাধারণ জাতির জনক ফিদেল কাস্ত্রোকে ভালোবাসে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি কে ঘেন্না করে। চিনদেশেও প্রায় তাই। মানুষ মাও কে শ্রদ্ধা করে। কিউবায় মানুষের দুর্দশা দেখলে চোখে জল আসে! এই দুই দেশেই সন্ধের পর থেকে দেহপসারিণীদের পসরা বসে। এই দুই দেশের সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। সাংহাই শহরে সন্ধের পর রাস্তায় হাঁটলে মেয়েরা হাত ধরে টানাটানি করে খদ্দেরের জন্য। এত সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশ আমি পৃথিবীর কোনও দেশে দেখিনি। তাহলে সরকার নিশ্চয় সব জানে ও দেহ বিক্রির ব্যক্তিস্বাধীনতার অনুমতি দেয়! অথচ ফেসবুক, গুগল বন্ধ হয়ে যায়, যা আজ বিশ্বময় আমজনতার বাক স্বাধীনতার আর এক নাম।

curbing freedom of speech

ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে মাত্র ৭৩বছর। জনসংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্রের ভিত্তিই হচ্ছে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা। ১৯৮৯-‘৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশই গণতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবহার করছে। ১৬৭টি দেশ কম বেশী গণতান্ত্রিক, ২১ দেশ একনায়ততান্ত্রিক, ৪৬টি দেশ মাঝামাঝি। বেশীর ভাগ ইসলামিক দেশ ও কমিউনিস্ট দেশগুলো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে  244 বছর। আমেরিকার প্রথম সংবিধান সংশোধনে বলে, সরকার কোনও ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। এছাড়া মানুষের থাকবে বাক স্বাধীনতা, মিডিয়া কিংবা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানুষের জমায়েত হবার স্বাধীনতা ও সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাবার স্বাধীনতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই তিনটে স্বাধীনতাকে এক কথায় বলা যায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলি যা হয়ত অনেকের জানা নেই। আমেরিকার দ্বিতীয় সংবিধান সংশোধন বলে, ‘গণতন্ত্র টিকে থাকার বা রক্ষার জন্য চাই নাগরিক সৈন্যবাহিনী (মিলিশিয়া), মানুষের বন্দুক রাখা ও চালাবার অধিকার থাকবে।’ অর্থাৎ সরকার যদি জনগণের কাজ না করে, জনগণের স্বাধীনতা আছে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার! এত বড় কথা! যা হোক আগে যেটা বলেছি জীবন, অন্ন, বস্ত্র র সমস্যা দূর না হলে প্রকৃত মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যায়। যেমন ভারতের সংবিধান গণতান্ত্রিক কিন্তু সমাজ সামন্ততান্ত্রিক বা ফিউডালিস্ট। মানুষের প্রধান স্বাধীনতা ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা। সেটাই প্রধান মত প্রকাশের স্বাধীনতা। শহর থেকে গ্রাম, লোকালয় থেকে পঞ্চায়েত, রাজনীতি-সাহিত্য থেকে মিডিয়া সর্বত্র দাদাদিদির কর্তৃত্ব! দাদা/দিদিদের মদত না পেলে কিছু হবে না।

ব্যক্তি স্বাধীনতা আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই শিশু। এদের কারওরই বেঁচে থাকার বা জীবন জীবন ধারণের স্বাধীনতাটুকু ছিল না।

পাড়ায় পাড়ায় একজন করে অমুকদা থাকবেন যাকে না ধরে কোনও কাজ হবে না। রাজনীতিতে দাদা/দিদিরা থাকবেন যাদের আশীর্বাদ না পেলে মতামত প্রকাশ করা যাবে না, এমন কি শিল্প সংস্কৃতিতেও দাদা/দিদি আছেন যারা রেগে গেলে সমাজ ব্রাত্য করে দেবে। এর জ্বলন্ত প্রমান কিংবদন্তী বাঙালি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই কষ্ট নিয়ে আমার একটা কবিতা ‘একটু পা চালিয়ে’ -এর লাইনে বলি -‘সুভাষদার বন্ধ হয়েছিল নাপিত, মুদির দোকান কি ভুলেই তিনি লেনিনকে বলেছিলেন – একটু পা চালিয়ে ভাই-লেনিন নিজে কিছু করেন নি সাঙ্গপাঙ্গরা সুভাষদাকে করেছিল একঘরে….’।নবীন গণতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও সহজ নয়। তবে এই ফেসবুক, ইন্টারনেটের যুগে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় মানুষ এগিয়ে এসে প্রকাশ করে দিচ্ছে দুর্নীতি, দেখাচ্ছে কলুষিত সমাজের দগদগে ঘা।

অনেক সময় শাসকের আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে মানুষ, স্বাধীন মানুষ। আর তারাই হচ্ছে ভারতের মতো পৃথিবীর সব নবীন গণতন্ত্রের আশার আলো। ট্যুইটারের মাধ্যমে সারা মধ্যপ্রাচ্যে জনমানসের ‘বসন্ত বিপ্লব’ হয়ে গেল। আবার এই ট্যুইটারের মাধ্যমেই আমেরিকায় রেসিস্ট প্রেসিড্ন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জিতল! অধুনা বিশ্বে ইন্টারনেট মিডিয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন সহজ করে দিচ্ছে আবার জটিলও করে তুলছে।

১৬৩২ সালে গ্যালিলিও তাঁর বৈজ্ঞানিক মতে বলেছিলেন পৃথিবী এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় “The dialogues concerning two chief world systems”। ফলে তখনকার পোপ ‘আরবান এইট’ এর নির্দেশে বিচার সভায় গ্যালিলিওকে সারা জীবন গৃহবন্দী থাকার শাস্তি দেওয়া হয়। এই তো সেদিন ১৯৫২ সালে ব্রিটিশ কোর্ট বিশ্বখ্যাত গণিত বিজ্ঞানী আল্যান টুরিং-কে সমকামীতার অভিযোগে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশ্যান শাস্তি দিল ও মাত্র ৪১বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হল! বিজ্ঞানী, কবি, নাটককার, শিল্পী সাহিত্যিকরা যুগে যুগে শাসকের হাতে শাস্তি পেয়ে এসেছেন।

ভ্যাকলাভ হাভেল, নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা এই তালিকা অনেক লম্বা। সাহিত্যিক সলমান রুশদির মাথার ওপর ইরানি সরকার ইসলামিক মৃত্যুদন্ডের ফতোয়া জারি  রেখেছে তাঁর ‘সাটানিক ভার্সেস’ গ্রন্থের জন্য। কবি লোরকাকে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট সৈনরা হত্যা করে। অথচ লোরকা সারাজীবন ধরে প্রেমের কবিতা লিখেছেন। কবি সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের কবিতা ‘কবির মৃত্যু : লোরকা স্মরণে’-র শেষ লাইন তিনটি বাক স্বাধীনতার শেষ কথা -“আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,বলেছিলাম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না।”

জন্ম ১৯৫৯ | ইংরাজি ও বাংলা দুই ভাষায় লেখেন।প্রকাশিত পাঁচটি কবিতার বই | 'বরফে হলুদ ফুল'-এর জন্য ২০০৫ সালে পেয়েছেন জসীমউদ্দিন পুরস্কার | ২০০৮ সালে সুধীন্দ্রনাথ পুরস্কার "গৃহযুদ্ধের দলিল" কাব্যগ্রন্থের জন্য। ভাষানগর পুরস্কার ২০১৭ সাল। তাঁরই প্রচেষ্টার ফসল 'উড়ালপুল' |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *