উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছেন যেই পড়ুয়া, তাঁর ধর্ম জেনে কী লাভ? পড়ুয়ার তো একটাই ধর্ম! তিনি শিক্ষার্থী। কিন্তু ধর্ম কি সত্যি অপ্রাসঙ্গিক? “২০২১ সালে দাঁড়িয়ে লিবারাল মানুষজন অন্তত সামনাসামনি ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক বলতে পারেন। সেটাই কাম্য। কিন্তু সত্যি কি তাই?” 

শেষ যে বাক্যটা লিখলাম, সেটা আমার কথা নয়। রণক্ষেত্রে প্রাণ হারানো সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকির প্রিয় বন্ধুর কথা। যে বন্ধু দানিশের অপেক্ষা করেন। ইদে বাড়ি ফিরলে আবারও একসঙ্গে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার, মাঝরাতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ার, মানুষের এক মুঠো জীবন ফ্রেমে বন্দি করার অপেক্ষা। 

“আমায় সব বলত, কিছু লুকায়নি কখনও, শুধু প্রথমবার আফগানিস্তান পৌঁছে তারপর টেক্সট করল আমায়। যদি আমি যেতে চাই, তাই। খুব অভিমান হয়েছিল। আমি তো সবসময় পাশে থাকতাম। আচ্ছা আমার প্রাণের মূল্য আছে, দানিশের নেই? আমায় আগলে রাখত আর নিজে এমন ঝাঁপিয়ে পড়ল? এটা কি রাজনৈতিক মৃত্যু না?” বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল গড়ায় মেহরবানের, কেঁদে ফেলেন দিল্লির তরুণ।

দিল্লি হিংসার ঘটনায় যে দানিশ, দানিশ সিদ্দিকি ছুটে যাচ্ছেন ছবি তুলতে, করোনা আবহে যে দানিশ ছুটে যাচ্ছেন একের পর এক হাসপাতালে, যাচ্ছেন শ্মশানে, ছুটে যাচ্ছেন নাগরিকত্ব বিল নিয়ে প্রতিবাদ মঞ্চের সামনে, রাত জাগছেন শাহিনবাগে। না, সেই দানিশ একা নন, দানিশের ছায়া সঙ্গী মেহরবানও সাক্ষী থাকছেন সেই ঘটনার।
– ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য একটা ভয় কাজ করত হয়তো।

rohingyas
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে তোলা দানিশের বিখ্যাত ছবি

কে হন মেহরবান দানিশের? রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু সেটা দিয়েই কি সম্পর্কের বিচার হয়? দানিশ নিজের মতো গড়ে তুলছিলেন মেহরবানকে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে তোলা সেই ছবিটা অন্তর থেকে তোলা। 
– দানিশের দেখার চোখটাই আলাদা। এক মহিলা প্রিয়জন হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন হাসপাতালে, ছবিটা মনে আছে? ওই ছবি তুলেও দানিশ নির্বিকার, বলল, কী বা এমন ছবি তুলি। আমি ভাবছি পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া দানিশ এমন বলছেন!

মুগ্ধতা বেড়েই চলে মেহরবান, বিলালদের। এই দানিশ অনায়াসে বলতে পারেন, কয়েক বছর ভালভাবে কাজ করে নিয়ে তারপর পেশা থেকে বিরতি নেবেন। 
– কী করবে তুমি?
– বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াব, লোককে বেড়াতে নিয়ে যাব।
– সেকি?
– হ্যাঁ, ঘুরে না দেখলে মানুষ চেনা যায় না।

Migrant Labourers
কোভিডকালে পরিযায়ী শ্রমিকের অবস্থা – দানিশের লেন্সে

তাই অনায়াসে টেলিভিশন সাংবাদিক দানিশ চাকরি ছেড়ে দেন। নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চান। মাত্র ৫/৬ হাজার টাকা পেতেন ছবি তোলার ইন্টার্নশিপের সময়। মুম্বইয়ের এক চিলতে ঠেকে মাথা গুঁজে বড়া পাও খেয়ে থাকতেন অধ্যাপক-সন্তান। কাজের খিদে ছিল। তাই অসুবিধা হয়নি। অথচ জামিয়া মিলিয়াতে পড়াশোনার সময়ও দানিশ কিন্তু এমন জীবনের কথা ভাবেননি। গতি ভালবাসতেন, তাই বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর শখ ছিল আর ছিল বেলফুলের মতো নরম একটা মন। নিজে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও সহকর্মী, বন্ধুদের শেষদিন পর্যন্ত বলে গিয়েছেন, সাবধানে কাজ কর। সময়টা ভাল না। তবু সন্তান হারিয়ে দানিশের অধ্যাপক বাবা আখতার সিদ্দিকি শুধু বলেন, “ঈশ্বর সবার মঙ্গল করুন। দেশ ওকে হারিয়ে ফেলল। ” 

প্রাণ বিপন্ন করে ছবি তুলতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন দানিশ ফিরে এলেন নিজের দেশে, যে দানিশ বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন দেশের নাম। কিন্তু দেশের সরকার কি একবারও দানিশের মৃত্যুতে কোনও শোকবিবৃতি দিয়েছে? প্রশ্ন তুলছেন মেহরবান, বিলালের দানিশের বন্ধুরাই, প্রশ্ন তুলছেন জামিয়া মিলিয়ার প্রাক্তনীরা, শিক্ষকরা, প্রতিবেশীরা। দানিশের সহচরদের থেকেই উঠে আসছে, তাঁর জীবনের টুকরো ছবি। 

Covid deaths
কোভিডে মৃত্যুর চিতা। দানিশের ক্যামেরায়

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অস্থায়ী তাঁবুর মধ্যে কোনওমতে সামান্য খাবার আর জল খেয়ে কাটানো। কিন্তু কেন? দানিশ বলতেন, মানুষের অসহায়তার কথা, যন্ত্রণার কথা পৌঁছে দিতে চান। এটুকুই চাওয়া মানুষ হিসেবে। বর্ষার মরসুমের মাঝামাঝি পৌঁছে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। কক্সবাজারে সপ্তাহ তিনেক ছিলেন। একদিন সমুদ্রের ধারে অপেক্ষা করছিলেন প্রায় ঘণ্টাতিনেক। প্রথম শরণার্থী নৌকাগুলো এসে পৌঁছনোর পর শাহ পরীর দ্বীপে সেই ছবিটা তোলেন দানিশ। সেই সময় এত কিছু ঘটেছিল, সবটা এক ফ্রেমে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন। অন্তত বন্ধুদের তেমনটাই বলেছিল বিনয়ী, একটু খ্যাপাটে ছেলেটা। 

Shahinbag Delhi Protest
শাহিনবাগে রাত জাগছে কোলের শিশুও। দানিশ ক্যামেরায় ধরেছিলেন।

হংকংয়ে মানবাধিকার আন্দোলনের ছবি (২০১৯, ৮ ডিসেম্বর), তিন বছরের সরোয়ারের হ্যামকে শুয়ে থাকা (৭ মার্চ, ২০১২), চিড়িয়াখানায় এক সেনা জওয়ানের হাতে আইসক্রিমের ছবি (১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) এক একটা আলাদা জীবনের ছবি। আর সেই ছবি খুঁজতেই ছুটে বেরিয়েছেন দানিশ। করোনায় গণচিতার যে ছবি দানিশ তুলে ধরেন, সে ছবি দানিশের, আমার, আপনার, সহ-নাগরিকের, সে ছবি যন্ত্রণার। সময় যত এগিয়েছে, দানিশ যেন আরও মরিয়া হয়ে উঠেছেন, মানুষের ছবি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। মানুষের ভালবাসা, মানুষের কাছে পড়ে আছে, এমনটাই হয়তো ভেবেছিলেন তিনি। তাই যেন সন্ত্রস্ত, অসহায়, প্রতিবাদী মুখগুলো বার বার ধরা দিয়েছে তাঁর লেন্সে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার আস্ফালনের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারাগুলো যে আসলে সবচেয়ে বড় সত্যি, সাংবাদিকের মন ছাপিয়েও সংবেদনশীল সেই মন রক্তাক্ত লেন্সে ধরে রাখে সেই ছবি।

পরিযায়ী শ্রমিক দয়ারাম খুশবহা যখন তাঁর পাঁচ বছরের সন্তানকে কাঁধে তুলে হাঁটতে থাকেন অনিশ্চিত পথের দিকে, যখন দিল্লির চাঁদবাগে মহম্মদ জুবায়েরকে ঘিরে ফেলে লাঠিধারীরা, রক্তাক্ত হয় আমার দেশের নাগরিক। অকুতোভয় আলোকচিত্রী সাংবাদিকের লেন্সবন্দি সে ছবি আর শুধুই ছবি থাকে না তখন। সে ছবি অসহায়তার– যে অসহায়তা হাসপাতালের বিছানায় মাস্ক পরে শুয়ে থাকা দুটি মানুষের শেষ বিন্দু শ্বাসবায়ুটুকু নেওয়ার আর্তিতেও মিশেছিল। সেই দানিশ ছুটলেন কান্দাহারে। অসহায় মানুষের আর্তি কবেই বা ভৌগোলিক অবস্থান মেনে চলেছে? তাই আফগান মুলুকের যন্ত্রণার খবর তুলে ধরা সঙ্গত মনে করেছিলেন তিনি। হাতে গোনা কয়েকজনই জানতেন দানিশ কোথায় যাচ্ছেন। প্রিয় বন্ধুরাও জানতেন না।

Delhi Violence 2021
দিল্লিতে কৃষক বিদ্রোহে যখন রক্ত ঝরল, তাকে লেন্সবন্দি করেছিলেন দানিশ

আফগান সেনার দাবি, তালিবানদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে দানিশের দেহ। যদিও তালিবানদের দাবি, এমনটা ঘটেনি। তালিবানরা দানিশের দেহ বিকৃত করে দিয়েছেন, এমন দাবিও করেছেন কেউ। সত্যিটা কী? সহ-নাগরিকের মৃত্যুর কারণটা আসলে কী, সত্যিটা কতজন জানতে চেয়েছেন? 

এরপরও কি নীরব থাকা যায়? দেশের সরকার কি নীরব থাকতে পারে? আর দেশের অন্য নাগরিকরা? উত্তর মেলে না। মৃত্যুর ছবি, যন্ত্রণার ছবিগুলো রয়ে যায়। সত্যের জন্য, মানুষের কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটে বেড়ানো দানিশ একেবারেই বোঝেননি এখন
“নগরীর সিঁড়ি প্রায় নীলিমার গায়ে লেগে আছে;
অথচ নগরী মৃত।”

দু’হাজার একুশ সালে শোকের আয়ু অ্যালগোরিদমে মাপা থাকে।

*ছবি সৌজন্য: Reuters and Facebook

দিধিতির প্রতিভা বহুমুখী। শিল্পের একাধিক ধারায় তাঁর বিচরণ। পেশা সাংবাদিকতা হলেও নেশা গান, ছবি আঁকা, সাঁতার কাটা এবং বহু কিছু। মৌলিক লেখালিখি করতে ভালবাসেন বিজ্ঞানের ছাত্রী দিধিতি। অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেছেন একসময়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাঁর অন্যতম প্রিয় চর্চার বিষয়। এছাড়া ভালবাসেন নিজস্ব গবেষণার কাজ এবং সিনেমা।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *