অর্জুন: বর-বউতে বোধহয় বিশাল ক্যাচাল বেঁধেছে। জাফর, তুই ইচ্ছে করে টিকলির সঙ্গে বেশি ঢলাঢলি করছিলি, যাতে প্রণবের হাড় জ্বলে যায়।

(জাফর হেসে চোখ মারে)

তুই শালা একটা পাক্কা ঢ্যামনা। তোর মতো গেছোহারামি ইন্ডাস্ট্রিতে আর দুটো হবে না। ওই জন্য শালা আমি বিয়ে করিনি। বিয়ে করলেই মানুষ ঝগড়া করে। তার আগে দেখে মনে হবে, বিয়ে না করলে যেন দুঃখে কেতরে উল্টে যাচ্ছে।

কোকনদ: দিল্লির লাড্ডুর সেই গল্প। ওইজন্য তো আমিও বিয়ে করিনি।

অর্জুন: কিন্তু ডিরেকটারদের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে হাসি-তামাশা করা তো বন্ধ করিসনি।

কোকনদ: বাঃ অর্জুনভাই বাঃ! তুমি জাফরভাইয়ের সঙ্গেও শুচ্ছ, সাকিবভাইয়ের সঙ্গেও ফ্লার্ট করছ, তারপর নিজের ওই সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনকে কায়দা করে বাজারে সেল করছ, আর আমরা বেচারারা তা নিয়ে একটু হাসিতামাশা করলেই দোষ হয়ে গেল (হাসে)। নির্দোষ রসিকতা দাদা। নো ম্যালিস।

অর্জুন: কর না হাসিতামাশা। কে বারণ করেছে? তোরা যত হাসিতামাশা করবি, আমার বাজার তত চড়বে। আমার সিনেমার বাজেটও পাল্লা দিয়ে চড়বে। আমি তো ভাবছি আমার এই ওরিয়েন্টেশন নিয়ে বড় একটা ইন্টারভিউ দেব। একটা অটোবায়োগ্রাফিও লিখে ফেলতে পারি। নাম দেব, ‘বিফিটিং চ্যাপ।

জাফর: দারুণ হবে। লিখে ফেল অর্জুন।

অর্জুন: শোন পাপ্পু। বাজার বুঝিস, বাজার? জীবনে তো কোনও দিন ব্যাগ হাতে বাজার করিসনি। বাপের লালু ছেলে।




কোকনদ: সে তো তুমিও তাই দাদা। হিরালাল মেহরোত্রার দত্তক ছেলে। সোনার চামচ তোমার মুখেও জন্মাবধি ছিল।

অর্জুন: তুই কিছু জানিস না আমার সম্পর্কে। আমাকে যখন দার্জিলিং স্কুল তাড়িয়ে দিয়েছিল, আমার বাবা বলেছিল নিজের হাতখরচ নিজেকে যোগাড় করতে হবে, আর বাড়ির সব কাজ নিজের হাতে করতে হবে। তখন আমি রেগুলার বাজার করতাম। তুই সায়ান-এর মাছের বাজারে গেছিস কখনও?

কোকনদ: নাকেন বল তো?

অর্জুন: ওখানে গেলে দেখবি বম্বিলের একরকম দাম, তো সুরমাইয়ের আর একরকম। ভেটকির একরকম দাম তো পাঙাশের আর একরকম।। আমি দামি মাছের কথা বলছি। আর কোনও কোনও মাছওয়ালা ইচ্ছে করে তার স্টলে দাম চড়িয়ে রাখে, যাতে সংখ্যায় কম বিক্রি হলেও দিনের শেষে লাভে বাকিদের টেক্কা দিতে পারে। আমরা জানবি সেই মাছওয়ালা। তুই যত গসিপ করবি, যত কিসসা বানাবি, আমার স্টলের দাম তত চড়বে। লোকে আমার স্টলে এসে দু’দণ্ড দাঁড়াবে। বলবে, বাবা! এত ভিড়, এত লাইন! না জানি কী জাতের মাছ বেচছে রে বাবা! আমি যে আর পাঁচটা বম্বে ডাকের মতোই পচা শুঁটকি বেচি, সেটা তখন পাবলিক ভুলে যাবে। আর তোরা আমার সেই দাম চড়াতে সাহায্য করিস। সো দিস ইজ় দ্য মর‍্যাল অফ দিস স্টোরি। অ্যান্ড এন্ড অফ দ্য ডে, আই অ্যাম কোয়াইট হ্যাপি ফর দ্যাট।

কোকনদ: অ্যান্ড অ্যাজ় এ প্যাস্টি বম্বে ডাক, তাই তো? (হাসে) দাদা, আমি তোমাকে রেসপেক্ট করি, তুমি জানো।

অর্জুন: জানি তো।

কোকনদ: আমি শুধু উমাভাবির টেনাসিটির কথা ভাবিএকদিকে ইলিনা ইকবালকে নিয়ে গসিপ, অন্যদিকে তোমাকে নিয়ে চাপা গুঞ্জন। জাফরভাই বাড়িতে ঢুকে উমাভাবিকে কী বলে ম্যানেজ করে কে জানে?

জাফর: আবার আমার বউকে নিয়ে টানাটানি কেন?

অর্জুন: (কোকনদকে) হ্যাঁ, সে সব তুই ভাব। ভাবতে থাক। আর পারলে একবার বাড়ি ফিরে শ্রদ্ধেয় ধৃতিজি মানে তোর পূজনীয় মাতাজিকে জিজ্ঞেস করিস, উনি কী করে ইন্দীবর স্যারের টপ টাইমে স্বামীকে নিয়ে একইসঙ্গে দুই হিরোইন ভানুমতী আর রেহানা খাতুনের গসিপ হ্যান্ডল করতেন? সেই স্ট্রেস উনি কীভাবে নিতেন? বুঝেছিস? চলি।

কোকনদ: এখনই চলে যাবে?

অর্জুন:হ্যাঁ রে বাবা। আমার এফ.এম শো আছে। জাফর কী করবি?

জাফর: চলে যাব তো ভাবছিলাম, কিন্তু শুনলাম সি.এম আসবেন। তাই ভাবছি।

অর্জুন: তাহলে তুই থাক। এই নতুন সি.এম প্রচণ্ড অর্থোডক্স। এলজিবিটি-কে একদম সহ্য করতে পারেন না। ঘোর গন্ধর্ব তান্ত্রিক। আমাকে দেখলেই চটে যাবে।

জাফর: সে তো ও মুসলিম দেখলেও ভেতরে ভেতরে চটে। 

অর্জুন: আহা, তা তো চটেই। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করে না। অন্তত সুপারস্টার জাফর আলি খানের সামনে প্রকাশ করবে না। কিন্তু আমাকে দেখলেই ক্ষেপে যেতে পারে। চলি। ভিকি আর ওর ওই ডবকা সৎমাটার সঙ্গে একবার দেখা করে বেরিয়ে যাই।




(অর্জুন বেরিয়ে আসে। আবহ আসে। মাঝখানের ঘরে আলো কমে। ওপরের সিঁড়ি দিয়ে অর্জুন ওঠে। ভিকি
, দিব্যা, নবনীতঅরুণাদের সঙ্গে কথা বলে সে বিদায় নেয়। ওদের কথা শোনা যায় না। একটু পরে অর্জুন নামে। আপ স্টেজে আসে। রাস্তায় ওকে পুনম আর মহেশ ধরে। অর্জুন হাত তুলে না, নাকরতে করতে বেরোয়। পুনম, মহেশরা অর্জুনের পেছন পেছন যায়। বাইরে হইচই। আবহ কমে আসে। মাঝখানের ঘরে আলো জ্বলে। জাফর আর কোকনদ। জাফর দাঁড়িয়ে। কোকনদ বসে)

জাফর: আমি কিন্তু অর্জুনের ওই মাছের স্টলের থিওরি মানি না, বুঝলি পাপ্পু। কেন বল তো?

কোকনদ: কেন?

জাফর: কারণ ওদের জন্য ফিক্সড মাছের স্টলটা ওদের ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছিল। ওই অর্জুন, ওই সাকিব, ওই ওয়াসিম, ওই রোহন, ওই ভিকি, ওই…… 

কোকনদ: (হাসে) ওই কোকনদ খুরানা, মানে তোমর সামনে বসে থাকা পাপ্পু। সবার।

জাফর: তোর কথা আমি বলছি না। ইউ আর লাইক মাই ওন ব্রাদার। কিন্তু ওদের সবার জন্য সোনার চামচ তৈরি ছিল। সবার নিজস্ব স্টল ছিল। চামচে করে খাইয়ে দেওয়ার জন্য লোকলস্কর ছিল। কিন্তু তোর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, এই সুপারস্টার জাফর আলি খান, যার পেছনে এখন বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা লগ্নি করা হয়, সেই আমার, এই শহরে মাথায় ছাতটুকু পর্যন্ত ছিল না। কোনও বড় বাবা-কাকা-দাদা বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিল না, যে আমাকে সকালে ফোন করে বলবে জাফর আয়, আজ দুপুরে আমার বাড়িতে লাঞ্চটা খেয়ে যা। দুটো রুটি খেয়ে যা।আলিগড় থেকে যখন অভিনেতা হব বলে দু’চোখে স্বপ্ন নিয়ে এ শহরে, ঢুকলাম, কমবয়সে , ওই স্বপ্নগুলো চুরচুর করে নিজের হাতে ভাঙতে মাত্র একবছর সময় লেগেছিল আমার!

কোকনদ: তারপর?

জাফর: তারপর আমার ওই স্বপ্নের পুনর্নিমাণ ঘটালাম। আমি আমার ক্ষমতা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম। আমার স্ট্যামিনা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম। আমার জেদ নিয়েও। আমি জানতাম, ওগুলো ঠিকঠিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে কপাল একদিন ঠিক সাথ দেবে। আর আমি বরাবর বিশ্বাস করেছি যে, ভাগ্য (হাতের তালু দেখায়) এখানে থাকে না (হাত মুঠো করে) থাকে এখানে। আমি ওইজন্য ইন্দীবর স্যারকে এত পছন্দ করি। উনিও আমার মতোই ওই ফুটপাথ থেকে এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন।

কোকনদ: বাজে কথা বোল না জাফরভাই। বাবাকে তুমি একদম পছন্দ কর না।

জাফর: কে বলেছে? হ্যাঁ, উনিও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। ওঁকে সন্দেহ করি, কিন্তু শ্রদ্ধাও করি। রাগ করি, আবার প্রণামও করি। আমি মনে করি, উনি হচ্ছেন আমার সেই সৎ পিতা, যিনি আমার অদৃশ্য মা, ওঁকে না আমাকে বেশি ভালবাসেন, তাই নিয়ে বেশি চিন্তিত।

কোকনদ: কে তোমার সেই মা এখানে?

জাফর: আমার সেই অদৃশ্য মায়ের নাম খ্যাতি। ফেম। ওই নারী যদি আমার আর ইন্দীবর স্যারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে না থাকত, তোর বাবা হয়তো তোর থেকেও আমাকে বেশি ভালবাসত।

কোকনদ: (হাসে) উনি এখনও তোমাকে ভালবাসেন জাফরভাই।




জাফর: হুম। আর আমি যে তোর বাবার মতোই এই শহরের হাওয়ায় ঘুঁষি মেরে
, বাতাস ফাটিয়ে শীর্ষে উঠলাম, ওঠার সেই সময়ে আমার জ্যাকেটের পেছনে, দড়ি, হুক আর স্যাক হয়ে কে ছিল জানিস?

কোকনদ: কে?

 জাফর: তোর ওই উমাভাবি। যার কথা তুই বলছিলি। ও যদি আমার ভর হয়ে না থাকত, ঝড়ঝাপটায় যদি বাড়িতে কম্পাস ধরে না বসে থাকত, আমি উত্তাল সমুদ্রের একদম মাঝখানে গিয়ে ডুবে যেতাম। ও-ই আমার মাস্তুল, ও-ই আমার মাউন্টেনিয়ারিং রোপ। একদম ইন্দীবর স্যারের জীবনে ধৃতিম্যাডামের মতোই। আমরা তাই বাইরে যা করেছি, করেছি। কিন্তু দিনের শেষে জাহাজের ওই ক্যাপ্টেনের কাছে ফিরতেই হয়েছে।

কোকনদ: (হাসে) আমার মায়ের ব্যাপারটা আলাদা রাখ জাফরভাই। শি ওয়জ আ ফুলফ্লেজেড অ্যাকট্রেস। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া অ্যাকট্রেস। আমি জন্মানোর পর মা শুধু আমার জন্য অভিনয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

জাফর: হ্যাঁ সে উমাও আমার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করেছে।

কোকনদ: ওসব আমাদের পুরুষদের কথা জাফরভাই। সুবিধের কথা। ‘স্যাক্রিফাইস’ শব্দটা যখন বলি আমরা, তখন খেয়ালও করি না শব্দটার ওজন আসলে ঠিক কত। উমাভাবির কথাই ভাব। তোমার মতো এই বিরাট পাহাড়ের ছায়া! তা কি জীবনে খালি নিরাপত্তা আনে, নাকি তার সঙ্গে বাড়তি অনেক অপমান, অনেক তাচ্ছিল্য, অনেক অহেতুক বাড়তি টেনশন বা স্ট্রেস বয়ে নিয়ে আসে? আসে না? এদের সবাইকে তা হলে ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে হয় কেন? জীবনে এত কিছু পেয়ে যাওয়ার পরেও?

(নীরবতা। জাফর কোকনদের দিকে তাকিয়ে। তারপর জাফর নিস্তব্ধতা ভাঙে)

 জাফর: হ্যাঁ, এটা আমি অস্বীকার করছি না।

(থামে)

অভিনেতাদের ব্যক্তিগত জীবন হয়তো সত্যিই অভিশপ্ত। বাইরের এই ঠাটবাট, রঙচঙ আসলে একটা রকেটের মতো। একবার ফেটে পড়ে গেলে আর জ্বলবে না। তাই ওই হাউইটাকে আমরা আকাশেই কল্পনা দিয়ে জ্বলতে দেখতে পছন্দ করি। আর রুক্ষ বাস্তব দেখতে চাই না বলেই হয়তো, দিনে রাতে আমি কুড়ি ঘণ্টা পাগলের মতো কাজ করি। ইন্দীবর স্যারকে এখনও এই বয়সে রোজ, প্রতিদিন কানের কাছে সেই অপূর্ব অমৃতবাণী শুনতে হয়- রোল-অ্যাকশন-কাট্

*ছবি সৌজন্য Pinterest
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আগের পর্বের লিংক –

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আগের পর্বের লিংক -[ ] [] [] [] []

জন্ম ১৯৬৯, ২৫ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর। পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। পরবর্তীতে সিটি কলেজে অধ্যাপনা। নাটককার, পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্রাভিনেতা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গীতিকার সম্পাদক। 'কালিন্দী ব্রাত্যজন' নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার ও 'ব্রাত্যজন নাট্যপত্রের' প্রধান সম্পাদক। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মন্ত্রী। পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি। উল্লেখ্য সত্যেন মিত্র পুরস্কার, শ্যামল সেন স্মৃতি পুরস্কার, দিশারী পুরস্কার, রমাপ্রসাদ বণিক স্মৃতি পুরস্কার, খালেদ চৌধুরী স্মারক সম্মান, অন্য থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ নাট্য নির্মাণ সম্মান। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন গজেন্দ্র কুমার মিত্র-সুমথনাথ ঘোষ স্মৃতি সম্মান। তাঁর সম্পাদনায় 'গিরিশ কথা' ও 'শিশির কথা' দু'টি বই তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, প: ব: সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছেন এবিপি আনন্দ 'সেরা বাঙালি ২০১৯' সম্মান। পেয়েছেন বাংলার নাট্যশিল্প জগতের সর্বোচ্চ সম্মান 'দীনবন্ধু মিত্র পুরস্কার'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *