আশির দশকে কবি জয়দেব বসু তার ভ্রমণকাহিনী কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় মধুসূদনের প্রতিপক্ষে একটি পংক্তি রচনা করেছিলেন। বাকদেবীর সমীপে সে ছিল এক সমীচীন প্রশ্ন। প্রত্নকল্পের জিজ্ঞাসা ছিল এই যে – শুধু শব্দে শব্দে বিয়ে দিয়ে কবি হওয়া যায় নাকি যিনি শব্দে শব্দে ডিভোর্স দেন তিনিও কাব্য পৌরহিত্যই করেন! তিনিও কেন কবি নন?
বাংলা কবিতায় লিরিক চর্চার পাশে এ হেন প্রয়াসের একটি স্পষ্ট ধারাও কিন্তু আশাজনক ভাবে বর্তমান। এবং আমার বয়ানের সমর্থনে যে বইটিকে সার্থক প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যায়, সেটি হল সিগনেট আনন্দ প্রকাশিত কবি অগ্নি রায়ের ‘জর্দা বসন্ত’।
অগ্নির লেখার ইতিহাস দীর্ঘ আড়াই দশক সময় পেরিয়ে এসেছে। নানান পরীক্ষার চিহ্ন তার শরীরে। সেই সমস্ত পরীক্ষা-নিরিক্ষার সফল ও ব্যর্থ শিক্ষাগুলি নিয়ে যখন ‘জর্দা বসন্ত’ লেখা হল, এই দশকের উপান্তে, পাঠক হাতে পেল ভিন্ন স্বরের কাব্যচিন্তা-কলার এক নিপুণ ঋজু উদাহরণ। ধারাবাহিকভাবে যদি কবিকে পড়া যায়, তবে নিঃসন্দেহে বলা যাবে জর্দা বসন্ত অগ্নির কাব্যকৃতির শীর্ষপট ছুঁয়েছে।
অগ্নি শব্দের অর্থ প্রকাশের বাইরে তার বিমূর্ত যে পরিসর তার স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে ব্রতী। ফলে তার কবিতা কোনও গল্প, কিংবা চমকদার স্মরণিকা নয়। বরং এক সমান্তরাল বয়ান বা ন্যারেটিভ। এখানে ব্যবহৃত প্রতিমাগুলি একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। বারংবার পাঠে সেই সংঘর্ষ যাপনের উপাদানগুলি পাঠক সংগ্রহ করতে পারবেন। অর্থাত কবি চাইছেন তার পাঠক কতিপয় হলেও যেন দীক্ষিত হয়। বিনাশ্রমে কবিতার চাষজমির ফসল হাতে আসবে না।
বই-এর নামকরণেই এই ইঙ্গিত স্পষ্ট। আসলে জর্দা বসন্ত কোনও নির্দিষ্টতা কিংবা ডেফিনিটনেস নয়, একটি অ্যারোমা সংক্রান্ত ধারণার স্থানাঙ্ক। সেটি এই কাব্যগ্রন্থের ‘বীজ’ কবিতারও নাম বটে।
আলাদা করে পংক্তি তুলে তুলে, কাব্যধারণার আভাস দেওয়া অগ্নি রায়ের কবিতার ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। উদ্ধৃতি দিতে হলে গোটা কবিতাই ছেপে দিতে হবে। সেটা নতুন প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রে অনুচিত।
কিন্তু একটা কবিতার কথা ও তার বৈশিষ্ট্য- সূচক উল্লেখ করতেই হবে। প্রায় বার-ছয়েক পড়ার পর, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত করে কবিতার অন্তরটি যখন আমি অধিগ্রহণ করলাম, পাঠক হিসেবে আমার হাতে এল আমার দশকে বাংলা ভাষায় লেখা, (অবশ্যই আমার পাঠ-পরিধি অনুযায়ী) শ্রেষ্ঠ সাবঅলটার্ন কবিতাটি। ‘প্রলাপ নামচা’। সরলরৈখিক, আপাত সম্পর্কহীন, অগোছালো বয়ানে ব্যবহৃত উপাদানগুলি ওই ‘সংঘর্ষের’ মধ্যে দিয়ে এক অন্তেবাসী জীবনপট খুলে দিল যখন, বুঝলাম প্রান্তভাষণের উপান্তে কবিজীবন তার যাত্রাপথের ধুলো খুঁটে নিতে পেরেছেন।
স্মৃতি বলছে ‘জর্দা বসন্ত’ কবিতাটি আনন্দবাজার পূজোসংখ্যায় পড়েছি এর আগে। গোটা বইটি হাতে আসার পর কবিকে সাবাস জানাব তারই কথায় – “ঠোঁটার আড়ালে যে ভাষা / আমি তার বানান পড়লাম“। (ট্রিলজি এক)।
নিরাপদ প্রচ্ছদে অলংকৃত ‘জর্দা বসন্ত’ কিনুন, পাঠক আপনার জন্য এক অর্ন্তবর্তী বয়নশিল্প অপেক্ষা করছে। যে বয়নশিল্প অগ্নি তৈরি করেছেন শব্দ-অর্থের জায়মান সংঘর্ষে।
শুভাশীষ ভাদুড়ীর জন্ম কলকাতায়, পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। তাঁর কবিতার বই 'আশ্চর্য ভূগোলে'-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। 'ভিতর মনের দরবেশ' ও 'ঈশ্বর আমার' এই লেখকের অন্যান্য বই। লেখালেখি ছাড়া ভালোবাসেন ছবি আঁকতে।
একটি অবশ্যপাঠ্য কবিতার বই, আদত পাঠকদের জন্যে ।
অসামান্য বিশ্লেষণ
বাঃ খুব ভালো রিভিউ করেছে। বইটি উইশ লিস্টে আছে। এটি পড়ে আরও আগ্রহ বাড়ল। কলেজস্ট্রিট থেকে কিনব। অগ্নি’কে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।
অসামান্য পাঠ-প্রতিক্রিয়া, শুভাশীষ। ভাল লাগল।
খুব ভালো আলোচনা। খুব ভালো লাগল পড়ে।
অব্যর্থ পাঠ-প্রতিক্রিয়া শুভাশীষ দা। বইটির কাছে আরো পাঠক পৌঁছক।
খুব ভালো হয়েছে সমালোচ।
Chamatkar alochona. Valo laaglo.
দারুণ লেখা। একরাশ জর্দা। বসন্ত সমেত
অসামান্য পাঠ প্রতিক্রিয়া।