পুজো মানেই সেই নীল আকাশ, ঘরছাড়া হালকা মেঘ, মহালয়ার ভোরে রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী। পুজো মানেই ছুটির আয়োজন, স্মৃতিমেদুরতা। আর এই পুজোর সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে পুজোর গান, বলা ভালো, জড়িয়ে ছিল। কারণ, সত্যি কথা বলতে কি, এখন পুজোর গান কমই প্রকাশিত হয়। পুজোর গানের সেই অমোঘ আকর্ষণ এখন অন্তর্হিত।

১৯০১ সালে কলকাতায় অফিস খোলে দা গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার কোম্পানি। পরে নাম হয় দা গ্রামাফোন কোম্পানি লিমিটেড। ১৯০৭ থেকে রেকর্ড-প্রিন্ট শুরু। প্রতি মাসে নানা রেকর্ড প্রকাশিত হত। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখছি, ১৯১৪ থেকে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে প্রকাশিত গান আলাদাভাবে ‘পুজোর গান’ হিসেবে বিজ্ঞাপিত হয়েছে। ১৯১৪-তে সেপ্টেম্বর মাসের রেকর্ড ক্যাটালগে লেখা হল: ‘শারদীয়া পূজা উপলক্ষে। সেপ্টেম্বর, ১৯১৪। নতুন ১০ ইঞ্চি, ডবল সাইডেড ভায়োলেট (ধূমলবর্ণ) লেবেলযুক্ত বাংলা গ্রামোফোন রেকর্ড।’
সে সময় আগমনী-বিজয়ার গান খুবই প্রাধান্য পেত। সেবার বিখ্যাত কে. মল্লিক গাইলেন ‘গিরি, একি তব বিবেচনা’ (আগমনী – কাফি মিশ্র), ‘কী হবে, কী হবে উমা চলে যাবে’ (বিজয়া – ভৈরবী), নারায়ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘দেখ লো সজনী (আগমনী, বেহাগ- খাম্বাজ), ‘ও মা ত্রিনয়না যেও না’ (বিজয়া- ভৈরবী)। ভক্তিগীতিও বেরত। সেবার ব্ল্যাক লেবেলে নামী নর্তকী ও গায়িকা কৃষ্ণভামিনী গাইলেন ‘মাকে কে জানে’, ‘অলসে অবশে’। গানের শেষে তিনি নিজের নাম বলতেন — ‘মাই নেম ইজ কেষ্টভামিনী’। বেদানা দাসী দু’টি রেকর্ডের একটিতে শোনালেন জন্মাষ্টমীর গান, অন্যটিতে সুপরিচিত ‘গয়লা দিদি গো’ (নৃত্য-সম্বলিত, জংলা) ও ‘আমি এসেছি এসেছি’।

তখন ভদ্রঘরের মেয়েরা রেকর্ডে তেমন গাইতেন না। একমাত্র ব্যতিক্রম দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ। রেকর্ড জগতে মিস দাস (অ্যামেচার) নামে খ্যাত ছিলেন। ১৯১৪-র পুজোয় তিনি গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘হে মোর দেবতা’, ‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী’। বাংলা গানের এক বিশেষ ধারা — হাসির গান বা কমিক গান তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল। সেবার অভয়াপদ চট্টোপাধ্যায় গাইলেন ‘স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আদর’, আবার ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আদর’। ১৯১৪- র শিল্পীদের মধ্যে কে. মল্লিক সম্পর্কে বলা দরকার যে, তাঁর আসল নাম মহম্মদ কাশেম। কলকাতায় জনৈক গোরাচাঁদ মল্লিক তাঁকে রেকর্ড করতে খুব সাহায্য করেন। তখন কাশেমের কে আর গোরাচাঁদের মল্লিক নিয়ে নাম হল ‘কে মল্লিক’।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত সময়সীমায় আমরা পেলাম আরও কিছু স্মরণীয় শিল্পীকে। আশ্চর্যময়ী দাসী, এম এন ঘোষ (মন্তাবাবু), আঙুরবালা, ইন্দুবালা, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন্দ্রনাথ দাস প্রমুখ। কীর্তন আর আগমনী গানে প্রাণ মাতালেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁর বিভিন্ন পুজোর গান: ‘মা তোর মুখ দেখে’, ‘সখি লোকে বলে কালো’, ‘স্বপন দেখিছে’। ইন্দুবালার বিখ্যাত গান ‘ওরে মাঝি, তরী হেথা বাঁধব নাকো’ বেরোয় ১৯২৩-র পুজোয়। ‘বাঁধ না তরীখানি’ গাওয়া আঙুরবালা ১৯২২-এর পুজোয় গাইলেন ভক্তিগীতি: ‘কত আশা করে।’ কমলা ঝরিয়ার প্রথম রেকর্ড পুজোতেই, ১৯৩০-এ: ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না’ (গজল) ও ‘ নিঠুর নয়নবান’ (দাদরা)। হীরেন বসুর কথায় সুরে মা দুর্গা ও শারদোৎসব নিয়ে দু’টি গান আজও বিখ্যাত: ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও’ ও ‘আজ আগমনীর আবাহনে’ গেয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দাস, তবে বেরিয়েছিল ১৯৩১-এর ডিসেম্বরে।

দেশ তখন পরাধীন, স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে, লেখা হচ্ছে দেশাত্মবোধক গান। তার রেকর্ডও প্রকাশিত হল। ১৯২২ -এর পুজোয় একটি রেকর্ডে ক্ষেত্রমোহন মিত্র ও অন্যান্যরা শোনালেন ‘সেকালের বাংলা’ ও ‘চরকার গান’। হরেন্দ্রনাথ দত্ত গাইলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘দেশ দেশ নন্দিত করি’। এই হরেন্দ্রনাথই ১৯২৫-এর পুজোয় গাইলেন নজরুলের ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’ — সম্ভবতঃ রেকর্ডে এটাই প্রথম নজরুলগীতি। নজরুলের আরও গান পরে বিভিন্ন পুজোয় শুনিয়েছিলেন আঙুরবালা, ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্রনাথ দাস, মৃণালকান্তি দাস, হরিমতি, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ। ১৯২৫-এর পুজোর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য রেকর্ড — দ্বিজেন্দ্রলাল-পুত্র দিলীপকুমার রায়ের ‘মুঠো মুঠো রাঙাজবা কে দিল তোর পায়ে’। দিলীপকুমারের অননুকরণীয় ভঙ্গিতে গাওয়া আরও পুজোর গান: ‘ধনধান্য পুষ্পভরা ‘(১৯৩৮), ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ (১৯৪৭)।

রবীন্দ্রসান্নিধ্য ধন্য সাহানা দেবী অতুলপ্রসাদের গান গাইলেন ১৯২৫-এর পুজোয়: ‘কত গান তো হল গাওয়া’ ও ‘শুধু দুদিনেরই খেলা’। এই ‘কত গান তো হল গাওয়া’ প্রথম বাংলা গজল। রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলের এক শিল্পী কনক দাস বিভিন্ন বছর পুজোয় গেয়েছেন অতুলপ্রসাদী, রবীন্দ্রসংগীত: ‘তব চরণতলে সদা রাখিও’ (১৯৩২), ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ (১৯৩৮)। দিলীপকুমার-শিষ্যা উমা বসু এক মরমী শিল্পী, ১৯৩৯-এর পুজোয় শোনালেন দিলীপকুমারের বিখ্যাত রচনা: ‘জীবনে মরণে এস’। মঞ্চে জনপ্রিয় নাটকের গানও প্রকাশিত হত। ১৯১৫-এর পুজোয় ছটি রেকর্ডে বেরিয়েছিল পালাগান ‘অন্নদামঙ্গল’। ১৯১৬-র পুজোয় প্রকাশিত হয়েছিল গিরিশ ঘোষের গীতিনাট্য ‘আবু হোসেন’। আপাতত এই পর্যন্তই থাকল। দ্বিতীয় পর্বে আমরা পরবর্তী সময়ের পুজোর গানের কথায় আসব।
স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l
একটি সমৃদ্ধ নিবন্ধ। পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকছি।