বিশ্বভারতীর কলাভবনে গ্রাফিক আর্টের  বিভাগটি প্রকৃতপক্ষে গড়ে ওঠে সোমনাথ হোরের হাত ধরে। আগে অল্পবিস্তর কাজ এখানে হত ঠিকই, কিন্তু সে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। ১৯৬৭ সালে দিনকর কৌশিক কলাভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজে যোগদানের পর নতুন করে প্রতিষ্ঠানটি তিনি সাজিয়ে তুলতে চাইছিলেন। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগ দিচ্ছিলেন শিল্পী তথা শিক্ষকেরা। এই পর্বেই শান্তিনিকেতনে আসেন সোমনাথ হোর, শর্বরী রায়চৌধুরী, অজিত চক্রবর্তী, সনৎ কর, সুহাস রায়, লালু প্রসাদ সাউ প্রমুখের মতো শিল্পী ও শিক্ষক। ক্রমশ সেরা হয়ে ওঠে কলাভবনের সমস্ত বিভাগ। সত্তরের দশকের গোড়ার থেকে ছাপাই-ছবির বিভাগটি সমগ্র দেশের নজর কাড়তে শুরু করে। তারই ছাত্র হিসেবে পিনাকী বড়ুয়া কলাভবনে যোগদান করেন এই সময়েই। মৃদুভাষী শান্ত স্বভাবের ছাত্রটি প্রায় প্রথম দিন থেকে শিক্ষকদের নজর কেড়েছিল, তার হাতের কাজও ছিল চমৎকার।

lithograph by pinaki barua
লিথোগ্রাফ, ১৯৭৮

গ্রাফিক বিভাগে বিশেষ পাঠ নেওয়ার সময় সোমনাথ হোর ও সনৎ করের কাছাকাছি আসেন পিনাকী এবং ছবি রচনার পাশাপাশি ছাপাই-ছবির প্রকরণ কৌশলকে গভীরভাবে আত্তীকরণ করতে থাকেন। ছাত্রাবস্থাতেই একাধিক উল্লেখযোগ্য তিনি কাজ করেছেন– যা বিভিন্ন প্রদর্শনীতে উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। 

পিনাকীর শিল্পীজীবনের সম্মাননার গ্রাফ-লাইনটা শুরু থেকেই লক্ষ করার মতো। কলাভবনে স্নাতকোত্তর পাঠ চলাকালীনই শিল্পী সোমনাথ হোরের অধীনে ভারত সরকারের জাতীয় বৃত্তি ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে জুনিয়র এবং সিনিয়র ফেলোশিপ-এ সম্মানিত হন তিনি। শিল্পকলার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ললিতকলা অ্যাকাডেমি থেকে। এ ছাড়া বিড়লা অ্যাকাডেমি, কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন-আর্টস ও হায়দ্রাবাদের প্রদর্শনীতে সম্মানিত হয়েছে তাঁর কাজ। কলকাতা ও শান্তিনকেতন-সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন আর্ট-ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন– বরোদা, মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর, ভোপাল, বাংলাদেশ, মরিশাস ইত্যাদি দেশে।

landscape by Bengal artist Pinaki Barua
কাগজে তুলি ও কলমের ল্যান্ড্স্কেপ, ১৯৭৭।

তাঁর কর্মজীবনের ক্ষেত্রটিও কেবল নিজের প্রতিষ্ঠান কলাবভবনে সীমাবদ্ধ নয়। অধ্যাপক হিসেবে কলাভবনে যোগদানের আগে শিক্ষকতা করেছেন কলকাতার জুলিয়েন ডে স্কুল ও পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাজের সূত্রে কেবল নানা গবেষণামূলক প্রজেক্ট ও কর্মশালায় যুক্ত থাকাই নয়, পিনাকীর শিল্প প্রদর্শনী তালিকাও যথেষ্ট দীর্ঘ। দিল্লি, কর্ণাটক, চণ্ডিগড় ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, মুম্বই ভোপাল ইত্যাদি ছাড়া হাঙ্গেরি, নরওয়ে অন্যান্য দেশে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর কাজ।

কিন্তু আশ্চর্য লাগে, যখন দেখি কোনও কোনও শিল্পী জীবনের মধ্যপথ অতিক্রমের পর যেন তাঁর দুয়ার বন্ধ করে দিতে চান। অথচ সামনে পড়ে থাকে অনেক পথ, অফুরন্ত কাজের পরিসর, শিল্পভাবনার বহুবিস্তৃত ক্ষেত্র। শান্তিনিকেতনের শিল্পী পিনাকী বড়ুয়ার (জন্ম ১৯৫৪) সংক্ষিপ্ত শিল্পী জীবন তেমনই এক অসমাপ্ত আঁচড়ে আঁকা ছবির মতো।

aquatint by Pinaki Barua
আকোয়াটিন্ট, ১৯৮৩

গত ২৯ এপ্রিল দীর্ঘ অসুস্থতার পর তিনি চলে গেলেন। সাতের দশকের উজ্জ্বলতম ছাত্রটি প্রায় নিঃশব্দে বিদায় জানালেন তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতনকে। তাঁর চলে যাওয়া ভারতীয় শিল্পের পক্ষে এক বড় ক্ষতি। শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা বলেই তাঁকে কেবল কলাভবনের শিল্পী হিসেবে সীমাবদ্ধ করে দেখা চলে না। আধুনিক ছাপাই-ছবির বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে বোঝা যাবে পিনাকী এক আলোকিত অধ্যায়।

coloured lithograph by Pinaki Barua
রঙিন লিথোগ্রাফ, ১৯৭৯

লিথোগ্রাফ, আকোয়াটিন্ট, ড্রয়িং, কাঠ-খোদাই ইত্যাদি ছাপাই ছবির সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর কাজ সাড়া জাগিয়েছে। আমরা জানি, গ্রাফিক আর্টে ছবির প্রিন্ট নেওয়ার সূক্ষ্ম করণ-কৌশলটুকুও শিল্পীর কাজের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। চূড়ান্ত দক্ষতায় তা শিল্পীকে আয়ত্ত করতে হয়। নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, তাঁর মতো অনুভূতিশীল প্রিন্ট-মেকারের সন্ধান সহসা পাওয়া যাবে না! আগেই বলেছি, শিল্পশিক্ষার এই পাঠ তিনি অর্জন করেছিলেন গুরু সোমনাথ হোরের কাছে। গুরুও তাঁর এই শিষ্যটির প্রতি অপরিসীম স্নেহে আচ্ছন্ন ছিলেন৷ স্বল্পবাক, মিতভাষী, রিসেপটিভ পিনাকী তন্নিষ্ঠ মনোযোগ আর দক্ষতার সঙ্গে গুরুর কাছে শিখে নিয়েছিলেন শিল্প-আঙ্গিকের গভীর খুঁটিনাটি। আর আঙ্গিকের দক্ষতাই শুধু নয়, তাঁর মতো অনুভবী শিল্পী আজ তেমন নজরে পড়ে কোথায়?

Dreaming, Aquatint by Pinaki Barua
স্বপ্নদর্শন, আকোয়াটিন্ট, ১৯৮৪

হয়তো বিনোদবিহারীর মতো তিনিও চোখ-ভোলানো দৃষ্টিনন্দন রঙের বৈভবকে তেমন প্রাধান্য দিতে চাননি। খেয়াল করলে দেখি, পিনাকী র অধিকাংশ কাজ জুড়ে আছে সাদা-কালোর মায়াবী ভুবন। ছাত্র জীবনে তাঁর নিসর্গের ছবিতে বিনোদবিহারীর ছায়াও কোথাও যেন ফুটে ওঠে। তাঁর কাজের নিজস্ব ভুবন রচিত হয়েছে আশির দশকের গোড়ায়। সেখানে একদিকে রয়েছে বিন্যাসের ঋজু জ্যামিতি, অন্যদিকে অন্ধকারের আড়াল থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলোকের উজ্জ্বল উদ্ভাস। তাঁর চিত্রপটে তৈরি হয় আলো ও কালোর এক অলৌকিক ইন্দ্রজাল। 

woodcut Pinaki Barua
পিনাকী বড়ুয়ার কাঠখোদাই, ১৯৮৫

নিস্তব্ধ ঘন কালো আর রুপোলি সাদায় পিনাকীর ছবি দর্শককে এক আশ্চর্য কাব্যময়তার  দিকে নিয়ে যায়, সৃষ্টি করে নতুনতর দৃশ্যভাষা। শিল্পীকে কাছ থেকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, আজীবন এই মানুষটি কত সহজ ও আন্তরিক ছিলেন। দেশ বিদেশের অজস্র প্রদর্শনী, অসংখ্য ওয়ার্কশপ, প্রখ্যাত সব আর্ট-ক্যাম্পে আমন্ত্রণ এবং সম্মাননা কোনওদিন তাঁর পায়ের তলার মাটির স্পর্শকে  এক চুল আলগা করতে পারেনি। পিনাকীপ মৃত্যুতে নানান দেশে ছড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা তাদের অসামান্য এক শিক্ষককে কে হারাল, দেশ হারাল এক সংবেদনশীল নিভৃতচারী শিল্পীকে। 

ছবি সৌজন্য: সুমিতা মুখোপাধ্যায়
তথ্যঋণ: রতি বসু

sushobhan adhikary

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুশোভন অধিকারী একইসঙ্গে শিল্প-ঐতিহাসিক এবং সংরক্ষক। একদা কলাভবনের ছাত্র হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পরে সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘকাল। বর্তমানের রবীন্দ্র-গবেষকদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র চিত্রকলা নিয়ে রয়েছে বিশেষ অধ্যয়ন ও চর্চা। মাস্টারমশাই নন্দলাল নামে তাঁর লেখা বই পাঠকমহলে বহুল সমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *