আগের পর্ব- ঈশ্বর: পর্ব ১  ঈশ্বর: পর্ব ২ ঈশ্বর: পর্ব ৩ ঈশ্বর: পর্ব ৪ ঈশ্বর: পর্ব ৫

এফবিআই: অতুলানানন্দ মহারাজ – আপনাকে মিস্টার অতুলানন্দ বলে সম্বোধন করতে পারি? রাজা মহারাজার দেশ তো এটা নয়, তাই মহারাজ মহারাজ বলে ডাকতে একটু অসুবিধে হয়। 

অতুলানানন্দ: আপনার যা খুশি বলে ডাকতে পারেন। 

এফবিআই: তাহলে আপনাকে মিস্টার, না সরি, ডক্টর অমিত মুখার্জি বলে ডাকলে নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না।

অতুলানানন্দ: আবার? না প্লিজ আমাকে অমিত মুখার্জি বলে ডাকবেন না, কারণ আমি অমিত মুখার্জি নই! 

এফবিআই: তাহলে আপনি কে?

অতুলানানন্দ: এই প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজছি অফিসার। 

এফবিআই: ফিলজফি কপচাচ্ছেন? আমি পাতি অফিসার সোয়ামিজি। ওই সব ফিলজফি টফি আমি বুঝি না। সুতরাং ফিলজফি কপচে আপনার কোনও সুবিধে হবে না। আমি একটা জিনিসই বুঝি – অপরাধ আর অপরাধী। আমি খুব ভাল করে জানি,  আপনিই অমিত মুখারজি। (পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে দেখেন) বছর আঠের আগে আপনি এম-আঈ-টি থেকে পি-এইচ-ডি করেছিলেন। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন। আপনার উপর অনেক আশা ছিল। কিন্তু সেই আশায় ছাই দিয়ে, প্রায় শ-খানেক মানুষকে পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে ভয় দেখিয়ে তাদের সর্বস্ব নিয়ে আপনি পালিয়ে যান। 

অতুলানানন্দ: বাজে কথা। নিশ্চয়ই শাশ্বতী আপনাদের এই সব কথা বলেছে? মিথ্যে কথা বলেছে। 

এফবিআই: তারপর আঠের বছর বাদে আবার আপনি ফিরে এসেছেন – সম্পূর্ণ ভোল পাল্টে। প্রমুখ সোয়ামী অতুলানন্দ মহারাজ সেজে আপনি আবার মানুষদের ধোঁকা দিচ্ছেন। তাদের আবার পৃথিবী ধ্বংস হবার ভয় দেখাচ্ছেন!  

অতুলানানন্দ: না! আমি কাউকে ভয় দেখাচ্ছি না, ধোঁকা দিচ্ছি না। বরং সাহস যোগাচ্ছি। বলছি, পৃথিবী ধ্বংস হোক বা না হোক, ভয় পাবার কিছু নেই।  

এফবিআই: আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। আমাদের কাছে ডেথ বেড স্টেটমেন্ট দিয়ে গেছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি।

অতুলানানন্দ: বৃদ্ধ দম্পতি? কে তাঁরা? একটু আগেই এখানে এক বৃদ্ধ দম্পতি এসেছিলেন। মিথ্যে দাবি করছিলেন আমি তাদের সন্তান। তাঁরাই কি? 

এফবিআই: হ্যাঁ তারাই। বৃদ্ধের পকেটে আপনার আশ্রমের ঠিকানা পাওয়া গেছে। সুতরাং অনুমান করতে অসুবিধে নেই, তাঁরা এখানেই এসেছিলেন। কিন্তু এখান থেকে বেরিয়েই তাঁরা এক দুর্ঘটনায় পড়েন। একটা ট্রাক থেঁতলে দিয়ে গেছে তাদের। ট্রাক ড্রাইভার বলেছে, অত্যন্ত বিভ্রান্ত ছিলেন সেই দম্পতি। কী এমন হয়েছিল এখানে যে তাঁরা এমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন? যান বাহন না মেনে হাইওয়েতে নেমে পড়লেন? কতটা অশান্ত মন হলে মানুষ এমন করতে পারে? আপনি বুঝতে পারছেন, ওই দম্পতির মৃত্যুর জন্য আমি আপনাকে দায়ী করতে পারি? ওদের রক্ত এখন আপনার হাতে। 

অতুলানানন্দ: না! না ওদের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী নই। আমি তাদের এখানে আমন্ত্রণ জানাইনি। তাঁরা স্বেচ্ছায় এসেছিলেন। আমাকে যারপরনাই অপমান করে গেছেন। 

এফবিআই: আর সেই দম্পতি কি স্টেটমেন্ট দিয়ে গেছেন জানেন? মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে বলে গেছেন তাদের ছেলে ভণ্ড, ঠগ। মানুষ ঠকানোই তার ব্যবসা।  আর তাদের ছেলের নাম অমিত মুখার্জি, এখন যাকে সবাই চেনে প্রমুখ স্বামী অতুলানন্দ মহারাজ বলে। 

অতুলানন্দ: (চিৎকার করে ওঠে) আমি অমিত মুখার্জি নই। আমি – আমি – অতুলানন্দ – 

এফবিআই: না, আপনিই অমিত মুখার্জি। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। 

অতুলানন্দ: কী প্রমাণ আছে? 

এফবিআই: আমাদের কাছে অমিত মুখার্জির ডি-এন-এ স্যাম্পল আছে। এখন আপনার ডী-এনের সঙ্গে যদি তুলনামূলক পরীক্ষা করানো হয়, কি হবে মনে হয় আপনার? ম্যাচ করবে? সন্ন্যাস নেবার পর শুনেছি মানুষের নব জন্ম হয়। ডী-এনে পাল্টে যায় কি? 

অতুলানন্দ: আপনার কাছে অমিত মুখার্জির-ই ডি-এন-এ  স্যাম্পেল আছে সেটা আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে? অমিত মুখারজ্জির ডী এন এ আপনি কোথায় পেয়েছেন? শাশ্বতী আপনাকে দিয়েছে? আপনি জানেন ও একটু আগে এখানে এসেছিল। ও নিশ্চয়ই এখান থেকে আমার চুলের একটা টুকরো নিয়ে গিয়ে দিয়েছে আপনাদের। বলেছে অমিত মুখারজির ডি এন এ স্যাম্পল। 

এফ বি আই: আপনি নিজেকে খুব চালাক মনে করেন তাই না? আর আমাদের বোকা মনে করেন? 

অতুলানন্দ: আপনার কথাবার্তা শুনে সেরকম মনে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক কি? আপনার যদি আর কোনও প্রশ্ন না থাকে, তাহলে প্লিজ আসুন। আমি এখন ধ্যানে বসব। 

এফ বি আই: ধ্যানে বসার আপনি অনেক সময় পাবেন অতুলানন্দ মহারাজ। জেলের ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে নিশ্চিন্তে ধ্যান করতে পারবেন। কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দিন। আপনি কি জানেন অমিত মুখারজির একটি মেয়ে আছে?  মেয়েটির বয়স আঠের বছর। নাম ক্যামেলিয়া। 

(অতুলানন্দের মুখ হটাত ফ্যাকাসে হয়ে যায়) 

অতুলানন্দ: শুনেছি – শাশ্বতীর মুখে শুনেছি। 

এফ বি আই: আপনাকে নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না অমিত মুখারজির ডি-এন-এ স্যাম্পল কোথা থেকে পাব আমরা? তবে সত্যি কোথা বলতে কি আপনার আর আপনার মেয়ের মুখের যা মিল, ডি এন এ ম্যাচ না করালেও যে কেউ বলে দিতে পারবে ও কার মেয়ে। (অতুলকে লক্ষ করে) কী হল মহারাজ? মুখে যে আর কথা ফুটছে না? 

(অতুলানন্দ পাথরের মত বসে থাকেন) 

এফ বি আই: সরি মিস্টার অতুলানন্দ মহারাজ ওরফে ডক্টর অমিত মুখারজি, ইউ আর আন্ডার এরেস্ট। 

অতুল: (চিৎকার করে ওঠে) না আমি অমিত মুখার্জি নই। অমিত মুখার্জি মরে গেছে – মরে গেছে – মরে গেছে – 

(ইতিমধ্যে এফবিআই বেরিয়ে গেছে। মৃণাল অতুলের পাশে এসে দাড়িয়ে আছে। একটু দূরে দরজার কাছে দাড়িয়ে শাশ্বতী। ) 

অতুলানন্দ: (বিড়বিড় করছে) 

মরে গেছে – মরে গেছে – আমি অতুলানন্দ – অতুলানন্দ মহারাজ -না – না –  আমি – আমি – আমি কে – আমি – 

মৃণাল: (গলা খাঁকারি দিয়ে) মহারাজ। মহারাজ। 

অতুলানন্দ: (হঠাৎ ঘুম থেকে উঠেছেন যেন। অথবা গভীর ধ্যান থেকে) 

তুমি – তুমি কে? ও মৃণাল – তুমি? (দেখেন ভক্তরা কেউ নেই) ওরা? ওরা সব কোথায় গেল? 

মৃণাল: ওরা চলে গেছে মহারাজ। আপনি সমাধিস্ত হয়ে গেছেন দেখে ওরা সবাই চলে গেছে। আমিই চলে যেতে বলেছি। 

অতুলানন্দ: উহা সত্য, নাকি ইহা সত্য? 

মৃণাল: কিছু বলছেন মহারাজ? অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছিল দেখে আমি ভাবলাম আপনার সমাধি ভাঙানোর সময় হয়েছে। 

অতুলানন্দ: ভাল করেছ। খুব ভাল করেছ। 

মৃণাল: মহারাজ, টাইমস থেকে একজন ম্যাডাম এসেছেন আপনার সাক্ষাত্‍কার নিতে। আপনি কি একটু সময় দিতে পারবেন? 

অতুল: টাইমস থেকে? (দেখেন শাশ্বতী দাড়িয়ে আছে) শাশ্বতী? 

(শাশ্বতী এগিয়ে আসে) 

শাশ্বতী: নমস্কার। হ্যাঁ আমি শাশ্বতী।  কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আপনি আমাকে চেনেন?  

অতুল: না চিনি না। (হেসে) আপনার লেখা পড়েছি টাইমসে। 

শাশ্বতী: তবে আমার কিন্তু আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে… 

অতুল: চেনা লাগছে? আশ্চর্য! আমি কিন্তু আজও নিজেকে চিনতে পারলাম না। এখন বলুন আপনি কী জানতে চান? পৃথিবী ধ্বংস হবে কি হবে না, তাই তো?  

শাশ্বতী: গুজবটা তাহলে আপনিও শুনেছেন। বেশ, তাহলে ওই প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক। কী মনে করেন আপনি? পৃথিবী ধ্বংস হবে? 

অতুল: হ্যাঁ হবে। বড়জোর আর দশদিন। তারপরই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি লিখে রাখুন। 

শাশ্বতী: আপনি সত্যিই এই কথা বিশ্বাস করেন? মাফ করবেন, এসব ভবিষ্যৎবাণী তো ঠগ জোচ্চরেরা করে। 

অতুল: হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। জোর গলায় এরকম দাবি ঠগ জোচ্চরেরা করে, অথবা যে নিজেকে ঈশ্বর মনে করে, সে করে। আমি বলছি। সুতরাং হয় আমি ঠগ, নয় আমি ঈশ্বর। দশদিন অপেক্ষা করুন, সব প্রমাণ হয়ে যাবে। 

(শাশ্বতী অবাক হয়ে অতুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো নিভে যায়।) 

সমাপ্ত

সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *